গত কয়েকদির ধরে সমাজ ছেয়ে গেছে ‘‘ছেলেধরা’’ আতঙ্কে। বিষয়টা আমার নলেজে এসেছে গতকাল (৮ জুলাই)। চতুর্থ শ্রেণির নিপা নামক এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ফোন করে কুশল বিনিময়ের পর বললেন, ‘স্যার, সবাই বলে, ছেলেধরা (পোলাচোর) নাকি বের হয়েছে?’’ আমি বললাম, ‘‘পোলাচোর’’ বের হলে আপনার তো মাথাব্যথা নেই, কারণ আপনার হচ্ছে মেয়ে!’ তিনি আমার কথায় না হেসে পারলেন না। আমি বললাম, ‘আপনি কোত্থেকে জানলেন পোলাচোর বের হবার কথা?’ তিনি বললেন, ‘লক্ষ্মীপুরের দালালবাজারে নাকি গতকাল একজন পোলাচোর ধরা খেয়েছে।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো ঘটনা কতটুকু সত্য।’ পরে অনলাইনে খোঁজ করে দেখলাম, লক্ষ্মীপুরের দালালবাজারে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন যুবককে মানুষ পোলাচোর সন্দেহ করে পিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে- এমন একটা সংবাদ দৈনিক মানবজমিনের অনলাইনে পাওয়া গেছে। আমি বুঝতে পারলাম, এই তিলকেই মানুষ তাল বানিয়ে যে যেভাবে পারছে একজন আরেক জনের নিকট প্রচার করছে।
বাংলাদেশ গুজবের দেশ। আমি শৈশব থেকে এ পর্যন্ত অনেকবার এমন ‘‘ছেলেধরা বের হওয়া’’র কথা শুনেছি। ছোট ছিলাম বলে আগে বিশ্বাস করতাম, ভয়ে ভয়ে থাকতাম। কিন্তু বড় হবার পর যখন দেখেছি, আমাদের সমাজে কয়েক বছর পরপরই এরকম গুজব ছড়ায়,পাশাপাশি আমরা গুজবে বিশ্বাসী একটা বিশেষ জাতি, তখন থেকে এমন গুজবগুলো আমাকে ভয় লাগাতে পারে না।
মোবাইল ফোন বিস্ফোরিত হয়ে মারা যাওয়া, বাঁশের পানি খাওয়া, পিতলের ১ টাকার কয়েন চড়া দামে বিক্রি হওয়া, রাক্ষস বের হয়ে মানুষকে জীবিত খেয়ে ফেলা, মাছ মাংস রাখা ফ্রিজ পুলিশ ভাংচুর করা- এমন নিত্যনতুন গুজব আমাদের সমাজে কয়েক বছর পরপরই ছড়িয়ে পড়েছে, মানুষকে আতঙ্কিত করেছে।
তবে ছেলেধরা বের হওয়ার গুজবটি একেবারে ভিন্ন। কারণ অন্য গুজবগুলো শুধু একবার ছড়িয়েছে, শুধু এ গুজবটি বার বার ছড়াচ্ছে।
আজ পঞ্চম শ্রেণিতে ক্লাস চলাকালীন সময় শাহেদুল নামক এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ফোন করে বললেন, ‘স্যার, শাহেদুল কি স্কুলে গেছে?’ আমি বললাম, ‘এসেছে। কিন্তু কেন এ প্রশ্ন করলেন?’ তিনি বললেন, ‘সবাই বলছে, ‘‘কল্লাকাটা’’ নাকি বের হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘‘আপনাদের বাড়ির কারো কল্লা (মাথা) কেটে নিয়েছে নাকি?’ তিনি বললেন, ‘‘পোদ্দার বাজার বোর্ড অফিসে নাকি কল্লাকাটা একজনকে ধরে বেঁধে রাখা হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘আমি আসল খবর জেনে আপনাকে জানাচ্ছি।’ তাঁর ফোন কেটে আমি পোদ্দারবাজার ‘বাজার কমিটি’র সেক্রেটারী হারুন ভাইকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বোর্ড অফিসে নাকি একজন কল্লাকাটা চোরকে ধরে ধোলাই দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে?’ তিনি বললেন, ‘কই, নাতো! এসবই গুজব।’ আমি এরপর বোর্ঢ অফিসের নিকটস্থ ‘মাল্টিমিডিয়া কম্পিউটার্স’ দোকানের সাইফুল ভাইকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বোর্ড অফিসে নাকি কল্লাকাটা একজনকে ধরে আটকে রাখা হয়েছে?’ তিনি বললেন, ‘কে বলেছে আপনাকে?’ আমি বললাম, ‘আমাদের স্কুলের একজন অভিভাবক বলেছে।’ তিনি বললেন, ‘সব ভুয়া খবর!’
আমি পরে গুগলে ‘‘ছেলেধরা গুজব’’ লিখে সার্চ করে দেখলাম, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত এরকম অসংখ্য সংবাদের লিঙ্ক চলে এলো। অধিকাংশই এরকম- ‘‘ছেলেধরা গুজবে গণধোলাই’’।
কিছুক্ষণ আগে আমাদের চতুর্থ শ্রেণির রায়হান নামক এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক খবর নিয়ে এলেন, সুবহানপুর বাজারে (চাটখিল, সদর, নোয়াখালী) নাকি একজন ‘পোলাচোর’কে ধরে গনধোলাই দেয়া হয়েছে। আমি ঐ বাজারের নিকটস্থ আমাদের এক আত্মীয়কে ফোন করে জানলাম, একজন অপরিচিত লোক নাকি ঘোরাঘুরি করছিল। মানুষ তাকে ছেলেধরা ভেবে ধরে গনধোলাই দিয়েছে। শেষে স্থানীয় চেয়ারম্যান নাকি তাকে ৩০০ টাকা দিয়ে বিদায় করেছে!
প্রকৃতপক্ষে ছেলেধরার বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। এই ঘটনাগুলো হচ্ছে পুরো ‘‘কান নিয়েছি চিলে’’র মতো বিষয়। এক লোকের মাথার উপর দিয়ে একটা চিল উড়ে গেল। একটু দূর থেকে অন্য একজন লোক ঐ লোককে বললো, ‘তোমার কান তো চিলে নিয়ে গেছে।’ লোকটির কথা শুনে ঐ লোক চিলের পিছে পিছে দৌড়তে শুরু করলো চিলের কাছ থেকে তার কান উদ্ধারের জন্য। পাশাপাশি এই বলে চিৎকার করতে লাগলো, ‘চিল আমার কান নিয়ে গেছে। কে কোথায় আছেন, বেরিয়ে আসুন। চিল থেকে আমার কান নিয়ে দিন!’
মানুষ তার চিৎকার শুনে তার সাথে চিলের পিছে পিছে দৌড়তে শুরু করলো। একসময় একজন লোক ঐ লোকটিকে বললো, ‘তুমি যে বলছো, চিল তোমার কান নিয়ে গেছে, তুমি কি তোমার কান ধরে দেখেছো, তোমার কান সত্যিই চিল নিয়ে গেছে কিনা!’ লোকটি বললো, ‘নাতো!’ এই বলে সে তার কানে হাত দিয়ে দেখলো, তার কান জায়গামতোই আছে, চিল নেয়নি। সে এতোক্ষণ অহেতুক চিলের পিছে দৌড়েছে।
আমরা যারা এখন ছেলেধরা বের হয়েছে বলে, শুনে ও ভেবে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি, তাদের নিকট অনুরোধ, যার কাছ থেকে এমন সংবাদ শুনবেন, তাকে তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করুন, ‘আপনার কোনো সন্তানকে কি ছেলেধরা নিয়ে গেছে?’ দেখবেন, কেউ আপনার প্রশ্নটির উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলবে না। শুধু বলবে, ‘অমুক বলেছে’, ‘ঐখানে ঘটেছে’ এমন সব কথা। যদি আপনার নিকটস্থ কারো বা আপনার সন্তানকে ছেলেধরা নিয়ে যায়, শুধু তখনিই ছেলেধরা বের হবার কথা বিশ্বাস করতে পারেন, না হয় মনে রাখবেন, এটা অপপ্রচার, একধরনের আতঙ্ক এবং সর্বোপরি গুজব।
নূর আহমদ, লক্ষ্মীপুর।
https://web.facebook.com/nurahmad.teacher
বাংলাদেশ গুজবের দেশ। আমি শৈশব থেকে এ পর্যন্ত অনেকবার এমন ‘‘ছেলেধরা বের হওয়া’’র কথা শুনেছি। ছোট ছিলাম বলে আগে বিশ্বাস করতাম, ভয়ে ভয়ে থাকতাম। কিন্তু বড় হবার পর যখন দেখেছি, আমাদের সমাজে কয়েক বছর পরপরই এরকম গুজব ছড়ায়,পাশাপাশি আমরা গুজবে বিশ্বাসী একটা বিশেষ জাতি, তখন থেকে এমন গুজবগুলো আমাকে ভয় লাগাতে পারে না।
মোবাইল ফোন বিস্ফোরিত হয়ে মারা যাওয়া, বাঁশের পানি খাওয়া, পিতলের ১ টাকার কয়েন চড়া দামে বিক্রি হওয়া, রাক্ষস বের হয়ে মানুষকে জীবিত খেয়ে ফেলা, মাছ মাংস রাখা ফ্রিজ পুলিশ ভাংচুর করা- এমন নিত্যনতুন গুজব আমাদের সমাজে কয়েক বছর পরপরই ছড়িয়ে পড়েছে, মানুষকে আতঙ্কিত করেছে।
তবে ছেলেধরা বের হওয়ার গুজবটি একেবারে ভিন্ন। কারণ অন্য গুজবগুলো শুধু একবার ছড়িয়েছে, শুধু এ গুজবটি বার বার ছড়াচ্ছে।
আজ পঞ্চম শ্রেণিতে ক্লাস চলাকালীন সময় শাহেদুল নামক এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ফোন করে বললেন, ‘স্যার, শাহেদুল কি স্কুলে গেছে?’ আমি বললাম, ‘এসেছে। কিন্তু কেন এ প্রশ্ন করলেন?’ তিনি বললেন, ‘সবাই বলছে, ‘‘কল্লাকাটা’’ নাকি বের হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘‘আপনাদের বাড়ির কারো কল্লা (মাথা) কেটে নিয়েছে নাকি?’ তিনি বললেন, ‘‘পোদ্দার বাজার বোর্ড অফিসে নাকি কল্লাকাটা একজনকে ধরে বেঁধে রাখা হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘আমি আসল খবর জেনে আপনাকে জানাচ্ছি।’ তাঁর ফোন কেটে আমি পোদ্দারবাজার ‘বাজার কমিটি’র সেক্রেটারী হারুন ভাইকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বোর্ড অফিসে নাকি একজন কল্লাকাটা চোরকে ধরে ধোলাই দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে?’ তিনি বললেন, ‘কই, নাতো! এসবই গুজব।’ আমি এরপর বোর্ঢ অফিসের নিকটস্থ ‘মাল্টিমিডিয়া কম্পিউটার্স’ দোকানের সাইফুল ভাইকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বোর্ড অফিসে নাকি কল্লাকাটা একজনকে ধরে আটকে রাখা হয়েছে?’ তিনি বললেন, ‘কে বলেছে আপনাকে?’ আমি বললাম, ‘আমাদের স্কুলের একজন অভিভাবক বলেছে।’ তিনি বললেন, ‘সব ভুয়া খবর!’
আমি পরে গুগলে ‘‘ছেলেধরা গুজব’’ লিখে সার্চ করে দেখলাম, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত এরকম অসংখ্য সংবাদের লিঙ্ক চলে এলো। অধিকাংশই এরকম- ‘‘ছেলেধরা গুজবে গণধোলাই’’।
কিছুক্ষণ আগে আমাদের চতুর্থ শ্রেণির রায়হান নামক এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক খবর নিয়ে এলেন, সুবহানপুর বাজারে (চাটখিল, সদর, নোয়াখালী) নাকি একজন ‘পোলাচোর’কে ধরে গনধোলাই দেয়া হয়েছে। আমি ঐ বাজারের নিকটস্থ আমাদের এক আত্মীয়কে ফোন করে জানলাম, একজন অপরিচিত লোক নাকি ঘোরাঘুরি করছিল। মানুষ তাকে ছেলেধরা ভেবে ধরে গনধোলাই দিয়েছে। শেষে স্থানীয় চেয়ারম্যান নাকি তাকে ৩০০ টাকা দিয়ে বিদায় করেছে!
প্রকৃতপক্ষে ছেলেধরার বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। এই ঘটনাগুলো হচ্ছে পুরো ‘‘কান নিয়েছি চিলে’’র মতো বিষয়। এক লোকের মাথার উপর দিয়ে একটা চিল উড়ে গেল। একটু দূর থেকে অন্য একজন লোক ঐ লোককে বললো, ‘তোমার কান তো চিলে নিয়ে গেছে।’ লোকটির কথা শুনে ঐ লোক চিলের পিছে পিছে দৌড়তে শুরু করলো চিলের কাছ থেকে তার কান উদ্ধারের জন্য। পাশাপাশি এই বলে চিৎকার করতে লাগলো, ‘চিল আমার কান নিয়ে গেছে। কে কোথায় আছেন, বেরিয়ে আসুন। চিল থেকে আমার কান নিয়ে দিন!’
মানুষ তার চিৎকার শুনে তার সাথে চিলের পিছে পিছে দৌড়তে শুরু করলো। একসময় একজন লোক ঐ লোকটিকে বললো, ‘তুমি যে বলছো, চিল তোমার কান নিয়ে গেছে, তুমি কি তোমার কান ধরে দেখেছো, তোমার কান সত্যিই চিল নিয়ে গেছে কিনা!’ লোকটি বললো, ‘নাতো!’ এই বলে সে তার কানে হাত দিয়ে দেখলো, তার কান জায়গামতোই আছে, চিল নেয়নি। সে এতোক্ষণ অহেতুক চিলের পিছে দৌড়েছে।
আমরা যারা এখন ছেলেধরা বের হয়েছে বলে, শুনে ও ভেবে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি, তাদের নিকট অনুরোধ, যার কাছ থেকে এমন সংবাদ শুনবেন, তাকে তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করুন, ‘আপনার কোনো সন্তানকে কি ছেলেধরা নিয়ে গেছে?’ দেখবেন, কেউ আপনার প্রশ্নটির উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলবে না। শুধু বলবে, ‘অমুক বলেছে’, ‘ঐখানে ঘটেছে’ এমন সব কথা। যদি আপনার নিকটস্থ কারো বা আপনার সন্তানকে ছেলেধরা নিয়ে যায়, শুধু তখনিই ছেলেধরা বের হবার কথা বিশ্বাস করতে পারেন, না হয় মনে রাখবেন, এটা অপপ্রচার, একধরনের আতঙ্ক এবং সর্বোপরি গুজব।
নূর আহমদ, লক্ষ্মীপুর।
https://web.facebook.com/nurahmad.teacher