বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে সম্প্রতি নির্মমভাবে হত্যা করে ছাত্রলীগের পদবিধারী কিছু সদস্য। আবরারকে খুন করার পর সারাদেশের মানুষ বেদনায় মর্মাহত হয়। মর্মাহত হবার কিছু কারণ হচ্ছে- ১. আবরার কোনো সাধারণ শিক্ষার্থী ছিল না, বরং বেশ মেধাবী একজন শিক্ষার্থী ছিল, যে শুধু বুয়েটেই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং মেডিকেল কলেজেও ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল; ২. আবরারকে বলতে গেলে বিনা অপরাধেই হত্যা করা হয়েছে; ৩. আবরার কোনো সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়নি, কোনো পেশাদার খুনি বা ছিনতাইকারীর হাতেও নিহত হয়নি, বরং নিহত হয়েছে বুয়েটেরই বেশ কয়েকজন ছাত্রের হাতে এবং ৪. আবরারকে হত্যা করা হয়েছে প্রায় পাঁচ ঘন্টা সময় ধরে নৃশংসভাবে পিটিয়ে পিটিয়ে।
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বুয়েটের যে ছাত্ররা আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, তারা কোনো সাধারণ ছাত্র নয়, তারা ছিল একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের সদস্য। সাধারণ ছাত্র হলে আবরার হত্যার কারণে মানুষ হয়তো এতো কষ্ট পেতো না। তাই আবরার হত্যার পর ছ্ত্রারাজনীতি নিষিদ্ধ করা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয় সর্বত্র। অবশ্য শুধু আবরার হত্যার পর থেকেই নয়, যখন থেকে ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের দ্বারা খুন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসী কার্যক্রমের নানান ঘটনা ঘটতে শুরু করলো, তখন থেকেই দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে ঐসব মানুষ, যাদের সাথে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সরাসরি সম্পর্ক নেই, তারা ছ্ত্রারাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছিল বিভিন্নভাবে। অপরদিকে ছ্ত্রারাজনীতি নিষিদ্ধ না করা বা বহাল রাখার পক্ষে সব সময় একটা বিশেষ শ্রেণিকে সরব থাকতে দেখা যায়। এরা কারা? এরা হচ্ছে তারা, যারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে জড়িত। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি বড় দলের একজন উর্ধ্বতন নেতাকে ‘‘ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা আত্মহত্যার সামিল’’ এমন কথা বলতে শোনা যায়। [কালের কণ্ঠ অনলাইন ১৫ অক্টোবর, ২০১৯]
‘‘আবরার হত্যা: বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি কি বন্ধ হওয়া উচিত?’’ শিরোনামে বিবিসি বাংলায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ৮ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘বুয়েটের ইলেক্ট্রনিক এন্ড ইলেট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের একজন সাধারণ শিক্ষার্থী যিনি নিজেকে রাহাত নামে পরিচয় দিতে চান, তিনি বলেন, শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হওয়া উচিত।
‘‘আমাদের ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির নামে যা চলছে তা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত। এসব অত্যাচারগুলা বন্ধ হতে হলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হওয়া উচিত’’ বলেন রাহাত।
তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এমন দাবি মানতে চাইছেন না ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা। তারা বলছেন, ছাত্র রাজনীতি নয় বরং ছাত্র রাজনীতির নামে যে সন্ত্রাস ও দখলদারিত্বের রাজনীতি শুরু হয়েছে তা বন্ধ হওয়া উচিত।’
‘‘আমাদের ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির নামে যা চলছে তা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত। এসব অত্যাচারগুলা বন্ধ হতে হলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হওয়া উচিত’’ বলেন রাহাত।
তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এমন দাবি মানতে চাইছেন না ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা। তারা বলছেন, ছাত্র রাজনীতি নয় বরং ছাত্র রাজনীতির নামে যে সন্ত্রাস ও দখলদারিত্বের রাজনীতি শুরু হয়েছে তা বন্ধ হওয়া উচিত।’
এভাবে দেখা যায় যারাই ছাত্ররাজনীতি বহাল রাখার কথা বলছেন, তারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে জড়িত। তারা মুখে অন্য উদ্দেশ্যের কথা বললেও তাদের মনে লুকিয়ে থাকে যে উদ্দেশ্য, তা হলো, ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজেদের দলের আধিপত্য বিস্তার করা বা ধরে রাখা।
শুধু এই বিষয়টা সবার সামনে পরিষ্কার হলে সবাই সহজেই বুঝতে পারবে, ছাত্ররাজনীতি বহাল রাখার কথা যারা বলছেন, তাদের উদ্দেশ্য দেশের কল্যাণ সাধন নয়, বরং শুধু নিজ দলের কল্যাণ সাধন করা।
ছ্ত্রারাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক, যারা চান না, তারা বলে থাকেন, ভাষা আন্দোলন, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনসহ অনেক আন্দোলনে ইতিপূর্বে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাই ছ্ত্রারাজনীতি নিষিদ্ধ করা ঠিক হবে না।
শুধু এই বিষয়টা সবার সামনে পরিষ্কার হলে সবাই সহজেই বুঝতে পারবে, ছাত্ররাজনীতি বহাল রাখার কথা যারা বলছেন, তাদের উদ্দেশ্য দেশের কল্যাণ সাধন নয়, বরং শুধু নিজ দলের কল্যাণ সাধন করা।
ছ্ত্রারাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক, যারা চান না, তারা বলে থাকেন, ভাষা আন্দোলন, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনসহ অনেক আন্দোলনে ইতিপূর্বে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাই ছ্ত্রারাজনীতি নিষিদ্ধ করা ঠিক হবে না।
যারা এমন কথা বলছেন, তারা সচেতনভাবে অথবা অসচেতনভাবে একটা কথা ভুলে থাকেন, ছ্ত্রারাজনীতি এবং ছাত্রআন্দোলন এক নয়। ছ্ত্রারাজনীতির অবদান হিসেবে যেসব উদাহরণ তারা দিচ্ছেন, সবই মূলতঃ ছাত্রআন্দোলনেরই ফসল, ছ্ত্রারাজনীতির নয়। এ প্রসঙ্গে অতীতের যেসব ইস্যুর কথা তারা সচরাচর উল্লেখ করে থাকেন, দেখা যায় সেখানে ‘ছাত্র’দের ভূমিকার কথাই তারা বলছেন, তাদের মুখ দিয়ে ভুলেও ‘ছ্ত্রারাজনীতি’ কথাটি আসে না!
তাই ছাত্ররাজনীতি দেশের কোনো উপকারে কখনো এসেছে, বলা ঠিক হবে না, বরং ছাত্রআন্দোলনই বিভিন্ন ইস্যুতে জাতির উপকারে এসেছে, এখনো ছাত্রআন্দোলনই দেশ এবং জাতির স্বার্থে কাজ করছে, ছাত্ররাজনীতি নয়। বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত যে প্রতিবেদনের কথা একটু আগে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে আরো বলা হয়, ‘‘ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় ছাত্র রাজনীতির অনেক অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাই ছাত্ররাজনীতি দেশের কোনো উপকারে কখনো এসেছে, বলা ঠিক হবে না, বরং ছাত্রআন্দোলনই বিভিন্ন ইস্যুতে জাতির উপকারে এসেছে, এখনো ছাত্রআন্দোলনই দেশ এবং জাতির স্বার্থে কাজ করছে, ছাত্ররাজনীতি নয়। বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত যে প্রতিবেদনের কথা একটু আগে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে আরো বলা হয়, ‘‘ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় ছাত্র রাজনীতির অনেক অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে গত ১০ বছরে বাংলাদেশে যতগুলো বড় আন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোটা বিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, ২০০৬ সালে শিক্ষাঙ্গনে নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান বিরোধী আন্দোলন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন।
এসব আন্দোলনের কোনটাই রাজনৈতিক দলের সহযোগি ছাত্র সংগঠনগুলোর উদ্যোগে হয়নি।
বরং অনেক আন্দোলন যেমন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারীদের উপর ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হামলার অভিযোগ রয়েছে।’’
এসব আন্দোলনের কোনটাই রাজনৈতিক দলের সহযোগি ছাত্র সংগঠনগুলোর উদ্যোগে হয়নি।
বরং অনেক আন্দোলন যেমন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারীদের উপর ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হামলার অভিযোগ রয়েছে।’’
দেশের সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই চায় না ছাত্ররাজনীতি বহাল থাক। কারণ ছাত্ররাজনীতি যদি কোনো উপকারে আসে বলে স্বীকার করে নেয়া হয়, তবু যেসব ক্ষতি করে, তা উপকারের চেয়ে হাজার গুণে বেশি। ছাত্ররাজনীতির কারণে যেসব ক্ষতি হয়, তন্মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে মানুষ খুন। শুধু একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করাই বিষয়টার ভয়াবহতা উপলব্ধির জন্য হয়তো যথেষ্ট হতে পারে। ১৫ অক্টোবর ২০১৯ তারিখের দৈনিক যুগান্তরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘‘শিক্ষাঙ্গন না রণাঙ্গন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৭ বছরে ৪২ খুন’’ শিরোনামে। শুধু একটি প্রতিষ্ঠানেই যদি শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ ৪২ জন মানুষ খুন হতে পারে ছাত্ররাজনীতির কারণে, তাহলে পুরো দেশে এ পর্যন্ত কত শত মানুষ খুন হয়েছে, তা ভাবলেই আঁতকে উঠবে যে কোনো বিবেকবান মানুষ।
ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও ছাত্র আন্দোলনে তো কোনো বাধা নেই। কারণ ছাত্র আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্কিত নয়। দেশে ছাত্ররাজনীতি বর্তমান থাকার পরও যখন কোটা বিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন, শিক্ষাঙ্গনে নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান বিরোধী আন্দোলন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন হতে পারলো, তখন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের অধিকার প্রশ্নে এবং যে কোনো জাতীয় সংকটে ছাত্ররা আন্দোলন করতে পারবে। ছাত্র আন্দোলনের এখনও কোনো নেতিবাচক দিক দেখা যায়নি, কিন্তু ছাত্ররাজনীতি অন্য কোনো ক্ষতি না করলেও এ পর্যন্ত অসংখ্য মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, যাদের মধ্যে ছিল শিক্ষক এবং মেধাবী অনেক শিক্ষার্থী।
অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি বক্তব্য উল্লেখ করার মাধ্যমে ইতি টানছি এ নিবন্ধের। বক্তব্যটি ১২ অক্টোবর ২০১৯ তারিখের দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত ‘‘একটি হত্যাকান্ড, অনেক প্রশ্ন’’ শিরোনামের একটি কলামের অন্তর্ভুক্ত।
‘‘ফাহাদ হত্যাকান্ড এ যুক্তিকেই জোরালো করল যে, লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। কোনো ক্যাম্পাসে দলীয় ছাত্র রাজনীতি থাকবে না। ছাত্র রাজনীতি থাকতে পারে; কিন্তু তা হতে হবে শুধু ছাত্রদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কিত। ছাত্ররা জাতীয় রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাবে না। জাতীয় রাজনীতির বিষয়টি ছেড়ে দিতে হবে জাতীয় নেতাদের কাছে। কোনো দল কোনো ক্যাম্পাসে তাদের ছাত্রসংগঠনকে স্বীকৃতি দেবে না। জাতীয় দলগুলোর সমর্থক থাকতেই পারে; কিন্তু ক্যাম্পাসে তা প্রকাশ করার কোনো সুযোগ থাকবে না। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করে তা সংসদে পাস করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে এমন একটি আইন প্রণয়ন করা জরুরি, যেখানে দলীয় ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে।’’
নূর আহমদ : শিক্ষকnurahmad786@gmail.com
‘‘ফাহাদ হত্যাকান্ড এ যুক্তিকেই জোরালো করল যে, লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। কোনো ক্যাম্পাসে দলীয় ছাত্র রাজনীতি থাকবে না। ছাত্র রাজনীতি থাকতে পারে; কিন্তু তা হতে হবে শুধু ছাত্রদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কিত। ছাত্ররা জাতীয় রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাবে না। জাতীয় রাজনীতির বিষয়টি ছেড়ে দিতে হবে জাতীয় নেতাদের কাছে। কোনো দল কোনো ক্যাম্পাসে তাদের ছাত্রসংগঠনকে স্বীকৃতি দেবে না। জাতীয় দলগুলোর সমর্থক থাকতেই পারে; কিন্তু ক্যাম্পাসে তা প্রকাশ করার কোনো সুযোগ থাকবে না। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করে তা সংসদে পাস করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে এমন একটি আইন প্রণয়ন করা জরুরি, যেখানে দলীয় ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে।’’
নূর আহমদ : শিক্ষকnurahmad786@gmail.com