চাকরিতে প্রবেশের বয়স কেন উন্মুক্ত রাখা উচিত?

চাকরিতে প্রবেশের বয়স নিয়ে আমাদের দেশে অনেক আগ থেকে আন্দোলন চলছে। লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু এখনও এতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আমাদের দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স নির্ধারিত। ৩০ বছর বয়সের মধ্যেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করা যাবে, ৩০ বছর পূর্ণ হয়ে গেলে একজন শিক্ষার্থী যত মেধাবী আর উচ্চশিক্ষিতই হোক না কেন, সরকারি চাকরিতে তার আর আবেদন করারই যোগ্যতা নেই! যুগের পর যুগ ধরে চালু থাকা এ নিয়ম পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে দেশের মানুষ নানাভাবে আন্দোলন করে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো ফল হচ্ছে না। কেউ পাত্তা দিচ্ছে না তাদের যৌক্তিক দাবিকে।

৩০ বছর বয়স হয়ে গেলেই কি একজন মানুষের চাকরি করার সব কর্মশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়? ৫৯ বছর বয়সে চাকরি থেকে অবসরে গিয়েও আমাদের দেশের অনেক সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে নতুন করে চাকরি নিতে দেখা যায়। ৫৯ বছর বয়স হয়ে গেলেও, চাকরি না করলেও চলে, এমন অসংখ্য মানুষ যে দেশে নতুন কোনো চাকরিতে প্রবেশ করতে পারে, সে দেশে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হওয়া একজন উচ্চশিক্ষিত বেকারের, যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছে ভালো একটা চাকরির স্বপ্নে, তার জন্য শুধু ৩০ বছর পূর্ণ হয়ে যাওয়ার কারণে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের পথ বন্ধ করে দেয়ার পেছনে কী যুক্তি থাকতে পারে!

আরো পড়ুন: কোটাপ্রথা কেন বাতিল করা উচিত?

সেশান জট, নানারকম অবাঞ্চিত ছুটি, হরতাল, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনির্দিষ্টকালের জন্য ভার্সিটি বন্ধ, যেকোনো অজুহাতে পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন যে দেশে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, সে দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমিত করার মানে যে মেধাবী বা উচ্চশিক্ষিত শিক্ষার্থীদের চাকরি করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা, কথাটি বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

“...অস্ট্রেলিয়ান শিক্ষার্থীরা জানেই না ‘সেশন জট’ কাকে বলে, ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা’ বলতে কী বোঝায় বা কিভাবে করতে হয় ‘পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন’।” কথাগুলো অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী প্রদীপ দেব নামে এক বাংলাদেশীর লেখা ‘ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন’ নামক একটি বই থেকে মীরা প্রকাশন, পৃ-৮৪ নেয়া। অস্ট্রেলিয়া বা অন্য কোনো উন্নত দেশ, যেখানে ২৫-২৬ বছর বয়সে অনেকে শুধু মাস্টার্স নয়, পিএইচডিও সম্পন্ন করে ফেলে, সেসব দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০-এর মধ্যে সীমিত করলে উচ্চশিক্ষিত শিক্ষার্থীরা কাক্সিক্ষত চাকরিতে প্রবেশে তেমন কোনো বেগ পেতে হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে অনেকের স্নাতকোত্তর শেষ হতে না হতে বয়স ৩০-এর কাছাকাছি চলে যায়।

মালেশিয়ার সাম্প্রতিক নির্বাচনে ৯২ বছর বয়সী সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহাথির মোহাম্মদ নতুন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্প ৭০ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ৬০ বছর বয়সে বিশ্বের একটি উন্নত দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে বাধাগ্রস্ত হননি। আমাদের দেশেও অনেক এমপি-মন্ত্রী আছেন, যারা ৬০-৭০ বা তার চেয়েও বেশি বয়সে এসব পদে নির্বাচিত হয়েছেন। কী অসুবিধা? কোনো অসুবিধা যদি না থাকে, তাহলে একজন শিক্ষিত তরুণ বেকার তার ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য একটি চাকরি নিতে বয়সের বাধ্যবাধকতার মুখোমুখি হবে কেন? যতদিন মানুষের কর্মশক্তি থাকে, তত দিন মানুষ কাজ করবে, এটাই হওয়া উচিত নিয়ম। কিন্তু অল্প বয়সেই মানুষকে অকর্মণ্য, অযোগ্য, আনফিট গণ্য করে মানুষের জীবনকে হতাশাগ্রস্ত করার কী প্রয়োজন আছে! এতে তো হাতে ধরে দেশে বেকার সংখ্যা বাড়ানো হয়। ৩০ বছর বয়সী একজন তরুণকে চাকরিতে প্রবেশের আগেই অযোগ্যের কাতারে ফেলে দেয়াটা কতটুকু সঠিক, কতটুকু মানবিক, তা গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার।

আমাদের দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৩০ বছর বয়সের পরও চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ থাকে। অন্য সব প্রতিষ্ঠানে যখন সম্ভব, সরকারি চাকরিতে আরো বেশি সম্ভব হওয়া দরকার। কারণ মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ একটি সরকারি চাকরি। বিশ্বের অনেক দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়স সম্পর্কে আমরা অনেকে জানি না। কানাডিয়ান সিভিল সার্ভিসে প্রবেশের বয়স ২০ থেকে ৬০ বছর, শ্রীলঙ্কায় চাকরিতে প্রবেশের বয়স ১৮ থেকে ৪৫ বছর, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ডে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ২০ থেকে ৫৯ বছর। বিশ্বের আরো অনেক দেশে এরকম চাকরিতে প্রবেশের পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়া হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ সংবাদগুলো অবশ্যই অবাক করার মতো, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চাকরিতে প্রবেশের এ অবাধ সুযোগই যৌক্তিক এবং স্বাভাবিক।

[লেখাটি দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত হয় ০৪ জুন ২০১৮।]

No comments:

Post a Comment