মহামারীর চেয়েও ভয়ঙ্কর এক রোগ ডায়াবেটিস
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষ্যে প্রথম আলোয় ১৪ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে ‘ডায়াবেটিস: প্রতিটি পরিবারের যুদ্ধ’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রতিদিন সকালটা ফিলিস্তিনের শিশু আহমেদের শুরু হয় একটু পরই গুলির শব্দ হবে, এ শঙ্কা নিয়ে। আর অন্যদিকে ভারতের শিশু মালিনীর সকাল শুরু হয় অন্য রকম ভয় নিয়ে। তাকে ইনসুলিন নিতে হবে, চামড়া ভেদ করে রক্তাক্ত করে ইনসুলিন দেওয়া হবে; এ আতঙ্কে দিন কাটে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এই শিশুর। যুদ্ধ, সহিংসতা আর হানাহানিতে মানুষের মৃত্যু যেমন দিন দিন পৃথিবীকে করে তুলছে ভয়ংকর; তেমনি পৃথিবীতে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী ১০টি রোগ এ মুহূর্তে হয়ে উঠেছে আশঙ্কাজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে সবচেয়ে উদ্বেগজনক ১০টি স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে অন্যতম ডায়াবেটিস। পৃথিবীতে এ মুহূর্তে ৪৫ কোটির অধিক লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রায় ৮০ লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।’
‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে যেসব জানা জরুরি’ শিরোনামে ১৩ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ১৯৮০ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ১১ কোটি। ২০১৪ সালে সেটা বেড়ে হয় ৪২ কোটিরও বেশি। ১৯৮০ সালে ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের ডায়াবেটিস হওয়ার হার ছিল ৫ শতাংশেরও কম কিন্তু ২০১৪ সালের তাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ।’
আরেকটা প্রতিবেদনের একটা অংশ উল্লেখ করা খুব সংগত মনে হচ্ছে। ‘ঘরে ঘরে ডায়াবেটিস’ শিরোনামে যা দৈনিক সমকালে ১৪ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শুধু বয়স্ক বা মধ্যবয়সী নয়, শিশুরাও এখন এই নীরব ঘাতকের শিকার হচ্ছে। শহর থেকে গ্রাম- সর্বত্র প্রায় সমান হারে ছড়িয়ে পড়ছে ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস এখন প্রায় প্রতিটি ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে।’
সেখানে আরও বলা হয়, ‘দ্রুত নগরায়নের ফলে পরিবর্তিত জীবনযাপনের কারণে বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। আইডিএফের (ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশন) ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪৩ কোটি। ১৯৮৫ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র তিন কোটি। গত আড়াই দশকে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৩ গুণ বেড়েছে। সংস্থাটি দুই বছর পরপর আক্রান্ত মানুষের তথ্য প্রকাশ করে। তাদের ধারণা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৪ কোটিতে উন্নীত হবে।’ এ তথ্যগুলো আমাদেরকে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সতর্ক হবার বার্তা দেয় নিঃসন্দেহে।
ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে বিভ্রান্তি
প্রথমে আমাদের জানা দরকার ডায়াবেটিস কেন হয়?
খুবই হতাশ হই, যখন দেখি ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী মানুষকে সঠিক ধারণা দেয়ার পরিবর্তে ভুল ধারণা দেয়া হয় খুব বেশি। ডায়াবেটিস নিয়ে বিশ্বের নামকরা সব প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত যত গবেষণা করেছে, কোনো গবেষণা ডায়াবেটিসের নির্ভেজাল কারণ খুঁজে বের করতে পারেনি। দু’একটা উদাহরণ দেখা যাক:
১৭ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখের প্রথম আলোয় ‘গ্রামে ডায়াবেটিস সচেতনতা কম’ শিরোনামে গবেষণা-তথ্যভিত্তিক (গবেষণা তথ্যটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট-এর) একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ‘গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রায় তিনজনের একজন ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত অথবা রোগের ঝুঁকিতে আছেন। ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অপ্রতুল কায়িক পরিশ্রম ডায়াবেটিস হওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।’
এই অধ্যায়ের শুরুতে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘ডায়াবেটিস: প্রতিটি পরিবারের যুদ্ধ’ শিরোনামের যে প্রতিবেদনের কথা বলা হয়েছে, সেখানে আরও বলা হয়, ‘ডায়াবেটিস রোগের সবচেয়ে বড় কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। খাদ্যাভ্যাসে অসচেতনতা, কম শারীরিক কর্মকান্ড, পরিবেশগত বিভিন্ন উপাদান এবং বংশগত বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে জিনগত অস্বাভাবিকতা। বিশ্বের মোট ডায়াবেটিসের শতকরা ৯০ ভাগ টাইপ-২ জাতীয় ডায়াবেটিসে এবং বিশ্বে বর্তমানে ৩০ কোটির অধিক লোক এই প্রকার ডায়াবেটিসে ভুগছে।... তাহলে প্রশ্ন হলো ডায়াবেটিসের কি কোনো সমাধান নেই? অবশ্যই আছে। সুস্থ জীবনযাপন। অতিরিক্ত চিনি কিংবা চর্বিজাতীয় খাবার পরিহার করা, হাঁটা কিংবা ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সচল রাখা, অতিরিক্ত ওজন কমানোর চেষ্টা, ফাস্ট ফুড বা জাঙ্কফুড ও অতিরিক্ত মদপান পরিহার করা।’
বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত যে প্রতিবেদনের কথা এ অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে আরও বলা হয়, ‘ডায়াবেটিস যদিও জেনেটিক এবং আপনার জীবন যাপনের স্টাইলের ওপর নির্ভরশীল তারপরেও আপনি চেষ্টা করলে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারেন।
সেজন্যে আপনাকে খাবার গ্রহণের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে এবং আপনাকে হতে হবে অত্যন্ত সক্রিয় একজন মানুষ।
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। মসৃণ শাদা আটার রুটির পরিবর্তে খেতে হবে ভুষিওয়ালা আটার রুটি। এটাই প্রথম ধাপ।
এড়িয়ে চলতে হবে হোয়াইট পাস্তা, প্যাস্ট্রি, ফিজি ড্রিংকস, চিনি জাতীয় পানীয়, মিষ্টি ইত্যাদি।
আর স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে রয়েছে শাক সব্জি, ফল, বিন্স এবং মোটা দানার খাদ্য শস্য।
স্বাস্থ্যকর তেল, বাদাম খাওয়াও ভালো। ওমেগা থ্রি তেল আছে যেসব মাছে সেগুলো বেশি খেতে হবে। যেমন সারডিন, স্যামন এবং ম্যাকেরেল।
এক বেলা পেট ভরে না খেয়ে পরিমানে অল্প অল্প করে বিরতি দিয়ে খাওয়া দরকার।
শরীর চর্চ্চা বা ব্যায়াম করার মাধ্যমে রক্তে চিনির মাত্রা কমিয়ে রাখা সম্ভব।
চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতি সপ্তাহে আড়াই ঘণ্টার মতো ব্যায়াম করা দরকার। তার মধ্যে দ্রুত হাঁটা এবং সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠাও রয়েছে।
শারীরিকভাবে থাকতে হবে সক্রিয়। ওজন কম রাখলেও চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যদি ওজন কমাতে হয় তাহলে সেটা ধীরে ধীরে করতে হবে। সপ্তাহে আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত।
ধূমপান পরিহার করাও জরুরী। নজর রাখতে হবে কোলস্টেরলের মাত্রার ওপর। এর মাত্রা বেশি হলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।’ [https://www.bbc.com/bengali/news-46194839]
ডায়াবেটিসের কারণ এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে আমি আরও অনেকগুলো প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিতে পারি, যেগুলোতে ডায়াবেটিসের আরও ভিন্ন ভিন্ন কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করতে চাই না। শুধু এ তিনটি প্রতিবেদনেই ডায়াবেটিসের অনেকগুলো কারণ বলা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি এতোগুলো কারণেই ডায়াবেটিস হয় এবং মানুষকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার জন্য এতোগুলো উপায় অবলম্বন করতে হয়, তাহলে কয়জনের ধৈর্যে কুলাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার? শুধু এ কারণেই, আমার খুব শক্তভাবে মনে হয়, বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগের প্রকোপ কমছে না, বরং হু হু করে বাড়ছেই। মহামারীর চেয়েও ভয়াবহ মাত্রায় ডায়াবেটিস সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি এখানে ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে শুধু একটি ধারণা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করবো এবং ডায়াবেটিসের মূল কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করবো। ডায়াবেটিসের কারণ বলে প্রচারিত সব কারণগুলোর স্বরূপ উন্মোচনের জন্য এই লেখার বিভিন্ন জায়গায় আরো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
এখানে প্রথম আলোয় প্রকাশিত "গ্রামে ডায়াবেটিস সচেতনতা কম" শিরোনামের প্রতিবেদনে ডায়াবেটিসের তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, যার প্রথমটি হচ্ছে ধূমপান। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, "ধূমপান পরিহার করাও জরুরী।" আমি ডায়াবেটিস সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় আরো অনেক লেখায় পড়েছি, বলা হচ্ছে, ধূমপানও নাকি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার একটি অন্যতম কারণ।
আমার বড় দুভাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বেশ কয়েক বছর ধরে। আমার মেঝো ভাইয়ের স্ত্রীও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আমাদের বিদ্যালয়ের ঝুনু রানী পাল নামক একজন মহিলা শিক্ষক অনেক বছর ধরে ডায়াবেটিসের সাথে যুদ্ধ করছেন। আমার শাশুড়িরও আছে ডায়াবেটিস। মাদ্রাসা শিক্ষিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত আমার পরিচিত অনেক লোক আছেন, যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আমার মেঝো ভাবীর বাবা-মাও অনেক বছর ধরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এভাবে আমার প্রতিবেশী এবং আত্মীয়সহ কাছের এবং দূরের পরিচিত অনেক লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যাদের সাথে ধূমপানের কোনো সম্পর্কই নেই। ধূমপান করা ছাড়াই তাদের তাহলে ডায়াবেটিস হলো কী করে?! বলতে পারেন, যাদের কথা এখানে বলা হয়েছে, তারা প্রত্যক্ষ ধূমপানের সাথে জড়িত না হলেও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। কিন্তু না, এদের কেউ পরোক্ষ ধূমপানের শিকারও নন। বরং একটা তথ্য জেনে সবাই অবাক হতে পারেন, আমার যে সহকর্মীর ডায়াবেটিস, তাঁর স্বামী নিয়মিত ধূমপান করেন, কিন্তু এখনো ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত। যিনি ধূমপান করেন, তিনি যদি ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত থাকেন, তাহলে তাঁর ধূমপানের পরোক্ষ শিকার কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবেন কিভাবে?!
"বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে ডায়াবেটিস কেন বাড়ছে?" শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় বিবিসি বাংলায় ১৪ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে। সেখানে বলা হয়, "বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি বলছে, বর্তমানে ৩৫ লাখের বেশি নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সংস্থাটি বলছে, এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশের নারীরাই সন্তান জন্মদানের জন্য সক্ষম অবস্থায় (অর্থাৎ কম বয়সে) এ রোগে আক্রান্ত হন।" প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, "বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসক মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা দেখেছেন প্রতি দশ জন নারীর মধ্যে একজনের ডায়াবেটিস আছে। আর এজন্য এখনকার জীবনযাত্রাকেই সবচেয়ে বড় কারণ বলে তিনি মনে করেন।
"মূল কারণ আমাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন। কায়িক পরিশ্রম নাই, বসে থাকা হয় বেশি। আর নারীদের আক্রান্ত বেশি হবার কারণ, তারা সংসারের অনেক কাজ করেন, সংসার সামলানো, সন্তান প্রতিপালনসহ সব করার পরে নিজের দিকে নজর দেন না তারা। ডায়াবেটিস হলেও সেটার চিকিৎসায় নজর দেন না অনেকেই।"
এখানে বলা হয়েছে, বর্তমানে ৩৫ লাখের বেশি নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে যারা বসবাস করেন এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে যারা একটু ভালোভাবে জানেন, তারা জানেন, বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা নেই বললেই চলে। উপজাতীয়দের মধ্যে কোনো কোনো মহিলা ধূমপান করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ভার্সিটি পড়–য়া কিছু কিছু তরুণীর মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এখানে যে ৩৫ লাখ নারীর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার কথা বলা হয়েছে, আমার মনে হয়, এদের মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যা খুঁজতে গেলে সর্বোচ্চ এক হাজার জনও পাওয়া যাবে না। তাহলে এই লক্ষ লক্ষ নারী ধূমপান ছাড়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেন কী করে?! নাকি সবার স্বামীই ধূমপায়ী বলেই ধূমপানের পরোক্ষ শিকার হয়ে এরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন? এটাও সম্ভব নয়। কারণ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অনেক মহিলার স্বামীও ধূমপান করেন না। বাংলাদেশে যারা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করেছেন বলে ধর্মীয় চেতনা ধারণ করেন, তাঁরা ধূমপানকে রীতিমতো ঘৃণাই করেন, ধূমপান দূরের কথা। এ ধরনের ধর্মীয় ভাবধারার অসংখ্য মানুষও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাহলে ধূমপানের সাথে সম্পর্ক না থাকার পরও এরা কেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন?
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সাথে ধূমপানের সম্পর্কের বিষয়টা নিয়ে যে কেউ একটু নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই দেখবেন, এর কোনো ভিত্তি নেই। ধূমপানের সাথে সত্যিই যদি ডায়াবেটিসের সম্পর্ক থাকতো, তাহলে বিশ্বব্যাপী শুধু ধূমপায়ীরাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতেন, অধূমপায়ী কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত না হতেন। এখন তো দেখা যায় অনেক ১০-১৫ বছর বয়সী শিশু, যাদের সাথে এখনো ধূমপানের কোনো সম্পর্কই নেই, তারাও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। বিশ্বের যে কোনো দেশে নতুন করে বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করলে এটাই শতভাগ সত্য প্রমাণিত হবে, ডায়াবেটিসের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপানের কোনো সম্পর্ক নেই। বিষয়টা শতভাগ অবাস্তব।
ডায়াবেটিসের প্রকৃত কারণ
গত চার বছরের বেশি সময় ধরে ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। কারণ রোগগুলো সারাবিশ্বেই কোটি কোটি মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন করছে। শুধু ডায়াবেটিসের কথাই বলছি। আমার আত্মীয় এবং পরিচিত অনেকেই রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে কঠিন জীবন যাপন করছে, অনেকে ইতোমধ্যে মারাও গেছে। আমাদের বাড়ির আমার এক জেঠাতো ভাই, নাম আবুল বাশার, ২০১৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা বৃদ্ধি পেয়ে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পরই আরেক জেঠাতো ভাইয়ের স্ত্রী আকস্মিক ডায়াবেটিস বেড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আরো অনেক আত্মীয় ডায়াবেটিসে ভুগে কঠিন জীবন পার করছেন, যে কোনো সময় মারা যেতে পারেন।
ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অনেক ডাক্তারের লেখা ও অনেক গবেষণা প্রতিবেদনে এবং মানুষের মুখে অনেক রকম মন্তব্য পাওয়া যায়। মন্তব্যগুলোর সাথে বাস্তবতার মিল খুঁজতে গিয়ে আমি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হতাশ হয়েছি। দেখেছি, যে কারণগুলোকে ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী করা হয়, বাস্তবতার সাথে তার অনেকগুলোরই মিল নেই।
ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে বিশ্বের অনেক বড় বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ফলাফল মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। দুঃখজনক হচ্ছে, কোনো গবেষণা-ফলাফলেই ডায়াবেটিসের মূল কারণ কয়টি, তা চিহ্নিত করতে দেখা যায় না এবং ডায়াবেটিসের মোট কারণ কয়টি, তা-ও সুনির্দিষ্টভাবে খুঁজে বের করতে পারে না কোনো গবেষণা। একেক গবেষণায় একক কারণকে ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়। কিছু কারণ অনেক সময় মিলে যায়, কিছু কারণ আবার মিলে না। সবগুলো কারণ একত্র করলে মানুষ ডায়াবেটিস থেকে বাঁচার আশা বাদ দিয়ে ভাববে, এতোগুলো কারণ পরিহারের চেয়ে ডায়াবেটিসে ধুঁকে ধুঁকে মরাই বরং ভালো!
মাফ করবেন, আমি কোনো ডাক্তার নই, কোনো গবেষকও নই, তবু এমন মন্তব্য করে ফেললাম। কারণ এমন মন্তব্য করার মতো শক্তি আমার আছে। আমি যে মন্তব্য করেছি, তা খুব ভালোভাবে প্রমাণ করে দেখাতে পারবো বলেই মন্তব্য করার সাহস পেয়েছি।
আমি দেখেছি, ডায়াবেটিসের মূল কারণ মাত্র ১টি এবং ডায়াবেটিস সর্বমোট তিন কারণে হয়। ডায়াবেটিস মূলতঃ যে কারণে হয়, মানুষ তা থেকে দূরে থাকতে পারলে মানুষকে ডায়াবেটিস আক্রমণ করতে পারবে খুব কম। আর ডায়াবেটিস মোট যে তিনটি কারণে হয়, সবগুলো এড়িয়ে চললে নিশ্চিতভাবে মানুষ ডায়াবেটিস থেকে রক্ষা করতে পারবে নিজের মূল্যবান জীবনকে।
আমি দীর্ঘদিন ধরে শুধু একটা বিষয় দেখেছি চরম সত্য হিসেবে, ডায়াবেটিস শুধু ঐসব মানুষের হয়, যারা শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকে বা করলেও পরিমাণে কম করে। পাশাপাশি যারা বেশি বেশি খায় বা মনের চাহিদামতো খায় বা ভোজনপ্রিয় এবং যারা মোটা শরীরের, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বেশি বেশি। এককথায় ডায়াবেটিসের মূল কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা এবং অন্য দুকারণ হচ্ছে বেশি খাওয়া বা মনের চাহিদামতো খাওয়া এবং মুটিয়ে যাওয়া। এই তিনটি কারণ যার মধ্যে নেই, সে কখনো কোনোভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। তবে যারা মোটা হওয়া সত্ত্বেও এবং বেশি বেশি খাওয়া সত্ত্বেও শারীরিক পরিশ্রম করে বেশি বেশি, তারাও খুব কমই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। আবার চিকন লোকও যখন শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকে, অনেক সময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই এতে কোনো সন্দেহ নেই, ডায়াবেটিসের মূল কারণ শারীরিক পরিশ্রম না করা বা কম করা। এককথায় পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম যারা করে, তারা কখনো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। আমার এ বক্তব্যে পুরো আস্থা রাখার জন্য চার শ্রেণির লোকের দিকে লক্ষ্য করার অনুরোধ করছি।
১. বাংলাদেশের ঐসব "পায়েচালিত" রিকশাচালক, যারা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে (অনেকে ৩০-৪০ বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে চালায়) রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এমন এক হাজার বা দশ হাজার রিকশাচালকের খোঁজ নিয়ে দেখুন, দেখবেন তারা কেউই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নন। এমনও দেখা যেতে পারে, তাদের অনেকের পিতামাতা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন বা কোনো সন্তান ইতোমধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এমনও দেখা যাবে, তাদের অধিকাংশই ধূমপান করছেন, নয়তো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার জন্য প্রচারিত অন্য কোনো কারণ অনেকের মধ্যে বিরাজমান, তবু তারা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে না।
২. বিশ্বের সব দেশেই শ্রমজীবি মানুষ আছে। যারা মাটি কাটার কাজ করে বা ফসলের জমি কিংবা কারখানায় হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কাজ করে, এককথায় সেসব শ্রমজীবি মানুষ, যারা শারীরিক শ্রমনির্ভর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে, এমন শ্রম, যা এদেরকে মোটা হতে দেয় না। পনেরো-বিশ বছরের বেশি সময় ধরে যেসব শ্রমজীবি মানুষ এভাবে পরিশ্রম করছেন দিনের একটা বড় অংশ, তারা কেউ দেখবেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নন।
৩. যেসব অ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদ পেশাগতভাবে শারীরিক শ্রমনির্ভর বিভিন্ন খেলা (যেমন: ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, সাঁতার, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি) খেলে যাচ্ছেন ১০ বছরের বেশি সময় ধরে, তাদের খোঁজ নিয়ে দেখুন, দেখবেন ডায়াবেটিসে তারা কেউ আক্রান্ত নন। এরা অনেকে হয়তো ধূমপানও করেন, অনেকে হয়তো ফাস্টফুডেও আসক্ত, অনেকের বাবা-মা কারো হয়তো ডায়াবেটিস ছিল, তবু এরা ডায়াবেটিসের ছোবল থেকে মুক্ত।
৪. বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীতে যারা চাকরি করেন এবং বাধ্যগতভাবে রুটিনমাফিক নিয়মিত পর্যাপ্ত ব্যায়াম করেন, অতিরিক্ত ব্যায়ামের কারণে মোটা হতেও পারছেন না, তাদের কাউকেও দেখবেন না ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে।
এ চার শ্রেণির মানুষের ডায়াবেটিস না হওয়াটা প্রমাণ করে, ডায়াবেটিসের মূল কারণ শারীরিক শ্রম থেকে দূরে থাকা, অন্য কিছু নয়।
মানুষ যখন শারীরিক পরিশ্রম কম করে, মনের চাহিদামতো খায়, একসময় এসব কারণে মুটিয়ে যায়। আর মুটিয়ে গেলে শরীরে চর্বি বা কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। কোলেস্টেরলের মধ্যেই জন্ম নেয় ডায়াবেটিস। অনেক মানুষ মোটা না হলেও নিয়মিত শারীরিক শারীরিক পরিশ্রম না করার কারণে শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
তিনটি কারণে মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। প্রথম কারণ পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করা, দ্বিতীয় কারণ বেশি খাওয়া, তৃতীয় কারণ মুটিয়ে যাওয়া। যে তিনটি কারণে মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়, সেই তিনটি কারণেই মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ যে কোনো কারণে কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। তাই যেসব মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে না পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের কারণে, সেসব মানুষ ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকে।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শতভাগ লোকের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে যে, সে পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম করে না। অনেকের মধ্যে এটা পাওয়া যাবে যে, তারা মোটা বা বেশি বেশি খায়। কিন্তু অন্য কোনো কারণ, যেগুলোকে ডায়াবেটিসের কারণ বলে প্রচার করা হয়, শতভাগ লোকের মধ্যে পাওয়া যাবে না। আমি ধূমপান এবং ডায়াবেটিসের সম্পর্ক নিয়ে আগেই বলেছি, ধূমপানকে তখনই ডায়াবেটিসের কারণ বলে বিশ্বাস করা যেতো, যখন দেখা যেতো ধূপায়ীরাই (সবাই না হলেও অনেকেই) শুধু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় এবং অধূমপায়ী কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। কথাটি প্রচারিত অন্য কারণগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন বলা হয়, ডায়াবেটিস নাকি বংশগতভাবেও হয়। ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ তখনই বলা যাবে, যখন দেখা যাবে: ১. কারো পূর্বপুরুষ শুধু এক সিঁড়ি নয়, একাধিক সিঁড়ি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল, ২. পিতা/মাতা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, শুধু এমন লোকেরাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বেশি বেশি এবং ৩. পূর্বপুরুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নয়, এমন মানুষ খুব কমই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলা সম্পর্কে এ লেখায় আরো অনেক আলোচনা আছে। এখানে আরো দুএকটা কথা না বললেই নয়। এ অধ্যায়ের শুরুতে ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা সম্পর্কে অনেক পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে। একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, "আইডিএফের ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪৩ কোটি। ১৯৮৫ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র তিন কোটি। গত আড়াই দশকে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৩ গুণ বেড়েছে। সংস্থাটি দুই বছর পরপর আক্রান্ত মানুষের তথ্য প্রকাশ করে। তাদের ধারণা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৪ কোটিতে উন্নীত হবে।"
দৈনিক যুগান্তরে ২৮ ফেব্রুয়াারি ২০১৮ তারিখে "ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস" উপলক্ষ্যে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "এক জরীপ মতে বিশ্বে প্রতি সাত সেকেন্ডে একজন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে এই রোগ এখন মহামারী রূপ নিচ্ছে। দেশে বর্তমানে ৮৪ লাখেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
ডায়াবেটিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৪২ দশমিক ৫ কোটি। অথচ ১৯৮৫ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ কোটি। এখনই এই রোগ প্রতিরোধ করা না গেলে ২০৩৫ সালের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৫৯ কোটিতে পৌঁছানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে।"
এই রকম পরিসংখ্যানগুলো কী নির্দেশ করে, তা আমরা সহজে বুঝতে পারি না বলে ডায়াবেটিসকে বংশগত বা জিনগত রোগ বলে নিজেদের সর্বনাশ করছি। এই রকম পরিসংখ্যানগুলো বলে- যত পেছনের সময়ে যাওয়া যায়, দেখা যায় তখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সমাজে তত কম ছিল। এভাবে যেতে যেতে এমন একটা সময় দেখা যাবে, তখন তেমন কারো ডায়াবেটিস ছিল না। যদি এক সময় পৃথিবীতে তেমন কারো ডায়াবেটিস না থাকে, তাহলে কোন্ সব পূর্বপুরুষ থেকে রোগটি আমাদেরকে সংক্রমিত করেছে? পূর্বপুরুষ কারো তো একসময় ডায়াবেটিস ছিলই না পরিসংখ্যান মতে!
ডায়াবেটিসকে জিনগত রোগ বলে আমরা নিজেদেরকে ধোঁকা দিচ্ছি। যখন দেখছি আমাদের বাবা-মা কারো রোগটি ছিল, তখন ভাবছি রোগটি তো আমার হওয়া অবশ্যম্ভাবী, তাহলে কী আর করার আছে! এটা ভেবে রোগটির নিকট আমরা অসহায় আত্মমসমর্পণ করছি। রোগটি সময় মতো আমাদের আক্রমণ করে বসছে। যারা ডায়াবেটিসকে জিনগত রোগ বলছে, তারা মানবজাতির সর্বনাশ করছে।
আমরা যদি দেখতাম, যত পেছনের সময়ে যাওয়া যায়, মানুষের জীবন তত কষ্টসাধ্য ছিল; মানুষ হেঁটে হেঁটেই তখন চলে যেতো অনেক দূরের গন্তব্যে, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অধিকাংশ কাজ করতে হতো শারীরিক শ্রমের বিনিময়ে; আর মানব সমাজে তখন থেকেই ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, যখন থেকে মানুষের শারীরিক পরিশ্রমের কাজ কমে যেতে শুরু করেছে, যখন থেকে মানুষ মেশিন-নির্ভর হয়ে পড়তে শুরু করেছে; যখন থেকে আরামপ্রিয়তা মানুষের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে; যখন থেকে মানুষ দশ মাইল দূরের কথা, এক মাইল দূরে যাবার জন্যেও গাড়ি ব্যবহার করছে বা করতে পারছে; আমরা বুঝতাম, ডায়াবেটিস আগেকার কোনো ডায়াবেটিস রোগী থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত রোগ নয়, বরং ডায়াবেটিস আরামপ্রিয় মানুষের রোগ; আরামপ্রিয় মানুষের সংখ্যা সমাজে যত বাড়ছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও আনুপাতিকহারে তত বাড়ছে; আমরা খুব সহজে বুঝতাম, ডায়াবেটিস শুধু শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা মানুষদেরকেই আক্রমণ করে, পাশাপাশি যারা পরিমিত খায় না এবং মোটা, তাদেরকে।
টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসকে যারা বংশগত মনে করে, তারা ভাবে না, একসময় সমাজে তেমন কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতো না। পরে আরামপ্রিয় হয়ে যাবার পর থেকেই মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত হতে শুরু করছে। এখন থেকে যদি বিশে^র সকল ডায়াবেটিসমুক্ত মানুষ শারীরিক পরিশ্রমে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় ব্যয় করার মাধ্যমে একযোগে রোগটি প্রতিহত করা শুরু করে, এদের সন্তানরা বা সামনের প্রজন্মের কেউ আর টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত হবে না। তাছাড়া পরিসংখ্যান মতে, টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা সমাজের মোট ডায়াবেটিস রোগীর দশ শতাংশ। এ অধ্যায়ের শুরুতেও প্রথম আলোয় প্রকাশিত "ডায়াবেটিস: প্রতিটি পরিবারের যুদ্ধ" শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বের মোট ডায়াবেটিস রোগীর শতকরা ৯০ ভাগ টাইপ-২ জাতীয় ডায়াবেটিসে ভুগছে।
যদি শুধু এই দশ শতাংশ টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীকে বংশগত ডায়াবেটিস রোগী ধরে নেয়া হয়, তবু বাকি নব্বই শতাংশ টাইপ টু ডায়াবেটিস রোগীর বিবেচনায় টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা একেবারে নগণ্য। তাই রোগটিকে জিনগত না বলাই ভালো।রোগটিকে বংশগতভাবেও হয়, এমন রোগের কাতারে ফেললে যাদের বাবা-মা কারো ডায়াবেটিস, তারা আতঙ্কে জীবন কাটাবে এবং যাদের বাবা-মা কারো ডায়াবেটিস হয়নি, তারা নিশ্চিন্তে জীবন কাটাবে। উভয় শ্রেণিই একসময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়বে কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ফলে।
ডায়াবেটিসের মূল কারণ সম্পর্কে কিছু প্রতিবেদনের বক্তব্য
ডায়াবেটিসের মূল কারণ যে শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা, কথাটির সমর্থনে কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করছি।
(১) ৭ এপ্রিল ২০১৬ তারিখের বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত "বিশ্ব ডায়াবেটিসের ''ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের'' ঝুঁকিতে" শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, "বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সারা বিশ্বে এখন প্রতি ১১ জনে একজন ব্যক্তি ডায়াবেটিস আক্রান্ত। ২০১৪ সালে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪২২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়ষ্ক ব্যক্তি, যা ১৯৮০-তে আক্রান্তের তুলনায় ৪ গুণ বেশি। ৭ই এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রাক্কালে প্রকাশিত সংস্থাটির প্রথম গ্লোবাল রিপোর্টে বলা হয়েছে প্রতি বছর রক্তে উচ্চমাত্রার গ্লুকোজ বা ডায়াবেটিসের কারণে বিশ্বে মারা যাচ্ছে ৩৭ লক্ষ মানুষ।
২০১২ সালে ১৫ লাখ লোক প্রত্যক্ষভাবে ডায়াবেটিসের কারণে মারা যান।"
আরো বলা হয়, "বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে এখনই ''দৃঢ় পদক্ষেপ'' না নিলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।"
এই রিপোর্টে টাইপ-১ এবং টাইপ-২ - দুধরনের ডায়াবেটিস আক্রান্তদের কথাই বলা হয়েছে। তবে এটাও বলা হয়েছে যে ধরনের ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে তারা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের শিকার, যার মূল কারণ অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন।"
(২) জার্মানির জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের (বাংলা) ওয়েবসাইটে ২১ এপ্রিল ২০১২ তারিখে প্রকাশিত "ভারতে ডায়বেটিসের প্রকোপ" শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, "বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাব্লিউএইচও"র তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ৩৪৬ মিলিয়ন মানুষ ডায়বেটিসে আক্রান্ত। ২০৩০ সাল নাগাদ গোটা বিশ্বে আনুমানিক ৭.৮ শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বর্তমানে চীন ও ভারতে দেখা যাচ্ছে এর প্রকোপ। নতুন সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে ৫১ মিলিয়ন মানুষ ডায়বেটিসে ভুগছেন। আগামী ২০ বছরে এই সংখ্যা ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দিল্লি, মুম্বই ও কলকাতার মতো বড় বড় শহরে ডায়াবেটিস রোগীরা একই ধরনের সমস্যার কথা বলেন চিকিৎসকের কাছে, যেমন অফিসে চেয়ারে বসেই কাজ করতে হয় অনেকটা সময়, খেলাধুলা ও স্বাস্থ্যকর খাবারের সুযোগ সুবিধাও কম। পুষ্টিকর খাদ্য দ্রব্য ও রান্নাবান্নার সময়ও পান না অনেকে। চারিদিকে, কোকাকোলা, পিৎসা ও বার্গারের মতো ফাস্টফুডের বিজ্ঞাপন। একটু স্বচ্ছল হলেই গাড়ি কেনার প্রবণতা। ঘরকন্নার সাহায্যে থাকে কাজের লোক। শারীরিক পরিশ্রমের পাল্লাটা অনেক কম ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এসবই বহুমূত্র রোগের দিকে ঠেলে দেয় মানুষকে।"
(৩) ডয়চে ভেলের (বাংলা) ওয়েবসাইটে আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৩ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে "ডায়াবেটিস ও ইনসুলিন" শিরোনামে। সেখানে বলা হয়, "সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। এর কারণ হল বেশি খাওয়া ও কম দৌড়ঝাঁপ বা হাঁটাচলা করা। যার ফলে ডায়াবেটিস আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গী হয়ে উঠেছে। সারা বিশ্বে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। তবে খাওয়াদাওয়া ঠিক রাখলে আর নিয়মিত ব্যায়াম করলে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।"
(৪) ভারত থেকে প্রকাশিত xiaomi.dailyhunt.in (শাওমী ডট ডেইলীহান্ট ডট আইএন) নামক অনলাইন পত্রিকায় ‘ইনসুলিনের অভাবে ভুগবে বিশ্ব’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বর্তমান বিশ্বের অন্যতম জীবনঘাতী রোগ বলা হয় ডায়াবেটিসকে। এই রোগের কারণে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪২ কোটি ৫০ লাখ। আর প্রতিবছরই আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বেড়ে ২০৩০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৫১ কোটি ১০ লাখে। তবে সেই হারে বাড়বে না এই রোগে আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় জীবনরক্ষাকারী ওষুধ ইনসুলিনের সরবরাহ। ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের চার কোটির বেশি রোগী ইনসুলিন পাবেন না। এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ওশেনিয়া অঞ্চলে ভয়াবহ প্রভাবের আশঙ্কা করছেন গবেষকরা।
ল্যানসেট ডায়াবেটিস ও এন্ডোক্রায়োনোলজি জার্নালের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।’
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, ‘গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার সঞ্জয় বসু বলেন, ছোঁয়াচে নয় এমন রোগ বিশেষ করে ডায়াবেটিসের বিস্তার রোধে জাতিসংঘের নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও বর্তমানে চাহিদার তুলনায় ইনসুলিনের প্রাপ্যতা অনেক কম। আগামী ১২ বছরে বার্ধক্য, নগরায়ন, খাদ্যাভাস ও শারীরিক কাজকর্মের ধরনে নানা পরিবর্তনের কারণে গোটা বিশ্বেই টাইপ টু ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে।’
(৫) ‘ডায়েবেটিস থেকে সাবধান!’ শিরোনামে ডয়চে ভেলের ওয়েবসাইটে ২৭ মে ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ার মূল কারণ, অতিরিক্ত ওজন।’ [https://www.dw.com/overlay/media/bn/38965147/41071625]
(৬) ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে "নিয়মিত জীবনযাপন দূর করবে ডায়াবেটিস" শিরোনামে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি দিয়েছেন বোলপুরের চিকিৎসক প্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়। সাক্ষাৎকারের একটি অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে।
"প্রশ্ন: ডায়াবেটিস কেন হয়?
উত্তর: হাইপারটেনশন, থাইরয়েড, হার্টের অসুখ, ফ্যাটি লিভার, আর্থারাইটিজের মতোই ডায়াবেটিস মূলত একটি "লাইফস্টাইল ডিজিজ"। জীবনশৈলীর কারণে যে অসুখগুলো হয় তার মধ্যে অন্যতম হল ডায়াবেটিস। এখন মানুষ কায়িক পরিশ্রম কম করে, অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া করে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই এই ধরনের অসুখের মূলে। আগেকার দিনে ফ্রিজ, এসি, গাড়ি, কম্পিউটার, টিভি, মোবাইলের ব্যবহার কম ছিল। এখন মানুষ মাঠে খেলাধুলোর বদলে কম্পিউটারে গেমে মনোনিবেশ করে। সাইকেলের বদলে স্কুটি ব্যবহার করে। আগে সব ক্ষেত্রেই পরিশ্রম অনেক বেশি ছিল। বর্তমানে গাড়ি চড়া, না হাঁটা, রেস্তোরাঁতে খাওয়া সব দিক থেকে মানুষের জীবনশৈলী বদলেছে। মাছ, ভাত, শাক, পোস্তার জায়গায় খাবার হিসেবে এসেছে পাস্তা, পেস্ট্রি, কোল্ড ড্রিংকস, আইসক্রিম, নুডলস যেগুলি মূলত হাই ক্যালোরির খাবার। এই সমস্ত খাবার বেশি করে খাওয়া এবং কম পরিশ্রম করার ফলে চাইল্ডহুড ওবেসিটি হচ্ছে। এই ওবেসিটিই হচ্ছে ভবিষ্যতে সুগার, প্রেসার, হার্টের অসুখের প্রবেশ পথ। আগেকার থেকে এখন মানুষের জীবনযাত্রা অনেক জটিল হয়েছে। বেড়েছে মানসিক চিন্তা। সমাজ, সংসার, কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপও ডায়াবেটিসের মূলে।"
এই ছয়টি নিবন্ধ-প্রতিবেদনের প্রথমটিতে ডায়াবেটিসের মূল কারণ বলা হয় অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনকে, দ্বিতীয়টিতে ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয় আরামপ্রিয় জীবনযাপন এবং শারীরিক পরিশ্রম কম করাকে, তৃতীয়টিতে ডায়াবেটিসের কারণ বলে মনে করা হয় বেশি খাওয়া, দৌড়ঝাঁপ বা হাঁটাচলা কম করা এবং নিয়মিত ব্যায়াম না করাকে, চতুর্থটিতে বার্ধক্য, নগরায়ন, খাদ্যাভাস ও শারীরিক কাজকর্মের ধরনে নানা পরিবর্তনের কারণে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বলে মনে করা হয়, পঞ্চমটিতে ডায়াবেটিসের মূল কারণ বলা হয় অতিরিক্ত ওজনকে, আর ষষ্ঠটিতে ডায়াবেটিসকে "লাইফস্টাইল ডিজিজ" বলেই আখ্যা দেয়া হয়। লাইফস্টাইল হিসেবে বলা হয়, "এখন মানুষ কায়িক পরিশ্রম কম করে, অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া করে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই এই ধরনের অসুখের মূলে। আগেকার দিনে ফ্রিজ, এসি, গাড়ি, কম্পিউটার, টিভি, মোবাইলের ব্যবহার কম ছিল। এখন মানুষ মাঠে খেলাধুলোর বদলে কম্পিউটারে গেমে মনোনিবেশ করে। সাইকেলের বদলে স্কুটি ব্যবহার করে। আগে সব ক্ষেত্রেই পরিশ্রম অনেক বেশি ছিল। বর্তমানে গাড়ি চড়া, না হাঁটা, রেস্তোরাঁতে খাওয়া সব দিক থেকে মানুষের জীবনশৈলী বদলেছে।"
এই প্রতিবেদনগুলোতে কিন্তু ডায়াবেটিসকে বংশগতভাবেও হয়, এমন রোগ বলা হয়নি; ডায়াবেটিসের সাথে ধূমপান, মদপান, চিনি/মিষ্টি/লবণ বেশি খাওয়ার সম্পর্ক আছে বলেও বলা হয়নি। তবে শুধু শেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ডায়াবেটিসের সাথে মানসিক চাপের সম্পর্কের কথা। শুধু একটা কথাই বলবো, এ অধ্যায়ে যে চার শ্রেণির ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত থাকার কথা বলা হয়েছে, শারীরিক পরিশ্রমে যুক্ত থাকা ছাড়া জীবনের অন্য বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে এরা কি আর সব মানুষের মতো নয়? আর সব মানুষের মতো এদের জীবনেও হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের সাথে মানসিক চাপও নিশ্চয়ই আছে। তাহলে মানসিক চাপ এদেরকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত করতে পারছে না কেন? কারণ মানসিক চাপ কাউকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত করতে পারে তখন, যখন মানুষ পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করার ফলে শরীরে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পায়। যেসব মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে না, তারা শুধু ডায়াবেটিস নয়, হার্ট অ্যাটাক এবং উচ্চ রক্তচাপ থেকেও বেঁচে থাকে। তাই মানসিক চাপ ডায়াবেটিসসহ এ তিনটি রোগের প্রত্যক্ষ কারণ নয়। বরং এসব রোগের প্রত্যক্ষ কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা বা আরামপ্রিয় জীবন যাপন করা। আরামে থাকলেই মানুষকে রোগগুলো আক্রমণ করার সুযোগ পায়।
হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপেরও মূল কারণ ১টি, মোট কারণ ৩টি
এর আগের অধ্যায়ের আগের অধ্যায়ে এটা স্পষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ এই রোগ তিনটি একই সূত্রে গাঁথা। রোগ তিনটির কারণ যেহেতু একই, এগুলো থেকে বেঁচে থাকার উপায়ও একই। আর সর্বশেষ অধ্যায় থেকে সবাই আশা করি স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছেন, ডায়াবেটিসের মূল কারণ ১টি, আর মোট কারণ ৩টি।
যেহেতু ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ এই তিনটি রোগ সমগোত্রীয়, সেহেতু ডায়াবেটিসের মূল কারণ যা, বাকি দু’টি রোগের মূল কারণও তা-ই এবং ডায়াবেটিস যেহেতু মোট তিনটি কারণে মানুষের হয়ে থাকে, অন্য রোগ দু’টিও মোট তিনটি কারণেই মানুষের হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে এর আগের অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, তাই বাড়তি কিছু বলার মনে হয় প্রয়োজন নেই।
‘‘দীর্ঘজীবন লাভের উপায়’’ শিরোনামে একটি বইয়ের অংশ বিশেষ এই লেখাটি। পুরো বই অনলাইনে পড়তে হলে যেতে হবে এই লিঙ্কে: দীর্ঘজীবন লাভের উপায় : পর্ব-১
No comments:
Post a Comment