মেয়েদের বিয়ের জন্য ১৮ বছর বয়সী নয়, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া শর্ত করা উচিত!
মেয়ে বা ছেলের বিয়ের বয়স নিয়ে রাষ্ট্রের মাথাব্যথা কি সঙ্গত? একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে আমার মনে হয় এটাও একটা ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়। বিয়ের পর একটি দম্পতি বাচ্চা নেবে কি নেবে না বা কখন বাচ্চা নেবে, তা যেমন সম্পূর্ণ ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়, তেমনি একজন নাগরিক কখন বিয়ে করবে, ২০ বছর বয়সে, নাকি ৩৫ বছর বয়সে, নাকি ৬৮ বছর বয়সে, নাকি ৮০ বছর বয়সে, নাকি আদৌ বিয়ে করবে না তা নিয়ে মাথাঘামানোও রাষ্ট্রের প্রয়োজন নেই। একজন নাগরিক ব্যবসা করবে নাকি চাকরি করবে; দেশে উপার্জন করবে, নাকি বিদেশ গিয়ে উপার্জন করবে, এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ যেমন অযৌক্তিক, তেমনি একজন নাগরিক তার বিয়ের প্রয়োজন হলে কখন বিয়ে করবে, সেক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের নাক গলানো অনভিপ্রেত। এটা অবশ্যই ব্যক্তিস্বাধীনতায় রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের শামিল। ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হলে রাষ্ট্রের যদি ক্ষতি হতো, তাহলে রাষ্ট্র এ নিয়ে আইন করতে পারতো।
কিন্তু সম্প্রতি দেশে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ নামে ছেলে এবং মেয়ের বিয়ের বয়স রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বিয়ের জন্য মেয়েদের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছর বেঁধে দিয়ে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ করার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। আইনানুযায়ী ১৮ বছর পূর্ণ হবার আগে কোনো মেয়েকে বিয়ে দেয়া যাবে না। এমনকি কোনো মেয়েকে এ বয়সের আগে বিয়ে দিলে তা বাল্যবিবাহ বলে পরিগণিত হবে এবং এটা দন্ডনীয় অপরাধ বলেও সাব্যস্ত হবে! প্রশ্ন হচ্ছে, ১৮ বছর পূর্ণ হবার পরই কি মেয়েরা বিয়ের জন্য উপযুক্ত হয়? ১৮ বছরের আগে উপযুক্ত হয় না?
এটা সবাই জানে যে, একজন মেয়ে বা ছেলে বিয়ের প্রতি আগ্রহী হয় তার শরীরে যৌনশক্তি আসার পর। যৌনশক্তি আসার পর কোনো ছেলে বা মেয়ে আর বালক বা বালিকা থাকে না, হয়ে যায় যুবক-যুবতী। যুবক বা যুবতী হবার পরই তারা বিয়ের জন্য সম্পূর্ণ উপযোগী হয়ে যায়। কোনো বয়সে পৌঁছার আর প্রয়োজন হয় না। আর এটাও আমরা সবাই জানি সব মানুষ কোনো নির্দিষ্ট বয়সে যৌনশক্তির অধিকারী হয় না। একেক জন একের বয়সে এসে যৌনশক্তি লাভ করে। কেনো কোনো মেয়ে ১২ বছর বয়সেও যৌনশক্তি লাভ করে ফেলে আবার কেউ কেউ ১৩, ১৪ বা ১৫ বছর বয়সে এসে যৌনশক্তির অধিকারী হয়ে থাকে। ছেলেরা সাধারণতঃ ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যে যৌনশক্তির অধিকারী হয়ে থকে।
দেশের একজন নাগরিকের পেটে ক্ষুধা লাগলে খাবে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মাথা ঘামানো যেমন বাড়াবাড়ি, একজন নাগরিকের বৈধ পথে যৌনক্ষুধা নিবারণের পথেও রাষ্ট্র বাধা দেয়ার কোনো মানে নেই।
মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর নির্ধারণের জন্য নারীরা কেন আন্দোলন করে, তার উদ্দেশ্য নারী নেত্রীরাও হয়তো ভালোভাবে জানে না। গত ৪ ডিসেম্বর ২০১৬ সংখ্যার দৈনিক যুগান্তরের শেষ পৃষ্ঠায় দেখলাম একটি প্রতিবেদন, ‘১৮ বছরের নিচে কন্যাশিশুদের বিয়ে হবে ‘সর্বনাশা আইন’।’
শিরোনাম দেখে ভাবলাম একটু পড়ে দেখি কিভাবে এটা ‘সর্বনাশা’ হবে! দেখলাম নারী নেত্রীরা বলছেন, ‘যে কোনো পরিস্থিতিতে আঠারোর নিচে কন্যাশিশুদের বিয়ে দেয়া মানে নারী ধর্ষণের পথকে সুগম করা। এ আইনের সুবিধা নেবে কাজী, ম্যাজিস্ট্রেট, প্রভাবশালী ব্যক্তি, বাবা-মা ও ধর্ষক।’ প্রতিবেদনটির শেষদিকে মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানমের বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে, ‘আইন শিথিল করে ১৮ বছরের নিচে কোনো কন্যাকে বিয়ে দেয়া হলে তা হবে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের পথে অন্তরায়।’
নারী নেত্রীদের প্রথম বক্তব্যটি হলো আঠারো বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ রাখার বিরুদ্ধে। এমন সুযোগ রাখা হলে নাকি ধর্ষনের পথ সুগম হবে। প্রশ্ন হলো, এমন সুযোগ না রাখা হলে কি ধর্ষণ কমবে? দৈনিক প্রত্রিকায় প্রতিদিন ধর্ষনের যে সংবাদগুলো প্রকাশিত হয়, নারী নেত্রীরা কি সেগুলো দেখতে পান না? তারা কী করেন সেগুলো বন্ধে? গত ১৯ ডিসেম্বর প্রত্রিকায় দেখলাম ঢাকা থেকে একটি মেয়েকে অপহরণ করে কক্সবাজার নিয়ে একমাস আটক রেখে ধর্ষণ করে মানুষরূপী কিছু পশু। একমাস পর আবার তাকে যেখান থেকে অপহরণ করা হয়েছে, সেখানে রেখে যাওয়া হয়। প্রতিদিনই ধর্ষনের এরকম অনেক সংবাদ দেখি পত্রিকায়। পাঁচ-ছয় বছরের আক্ষরিক অর্থের শিশুরাও প্রায়ই ধর্ষিত হয়। কিন্তু নারী নেত্রীদেরকে এসবের বিরুদ্ধে কঠোর হতে দেখা যায় না। তাহলে ১৮ বছরের আগে বিয়ের সুযোগ রাখা হলে ধর্ষণ নিয়ে তাদের এতো আশংকা কেন?
এবার নারী নেত্রী আয়শা খানমের কথায় আসি। তিনি বলতে চান ১৮ বছরের আগে কোনো মেয়েকে বিয়ে দিলে তা হবে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের পথে অন্তরায়। এর মানে কিন্তু এটাও যে, ১৮ বছর বয়সে বা এরপর বিয়ে হলে তাতে নারীর জীবনমান উন্নত হবে এবং নারী-ক্ষমতায়নের পথ সুগম হবে। এতে মনে হয় নারীর উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়ন ১৮ বছর বয়সের সাথে সম্পর্কিত। এ বয়সের আগে তাদের বিয়ে হয়ে গেলে তাদের জীবনে কোনো উন্নতি আসবে না। বিষয়টা আসলে এমন নয়। বরং নারীর উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োজন নারী শিক্ষাকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর চাহিদা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা। এসব করা হলে নারীর বিয়ে ১৮ বছরের আগে হোক বা পরে, তার জীবনে উন্নতি আসবেই।
১৮ বছর বয়স হলেই মেয়েরা পরিণত হয় বা বিয়ের জন্য উপযুক্ত হয় এবং এর আগে তাদের বিয়ে দিলে তা বাল্যবিবাহ হয়ে যায়, এমন কথার আরেকটি মানে হচ্ছে, মেয়েরা ১৮ বছরের আগে যুবতীই হয় না, তারা বালিকা থেকে যায়! ‘ষোড়শী’ বলে যে একটি শব্দ আছে, সে শব্দের মানে তখন ‘ষোল বছরের যুবতী’ না হয়ে হবে ‘ষোল বছরের শিশুকন্যা’! বড়ই হাস্যকর।
জাপানে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর (‘ঐতিহ্য’ থেকে প্রকাশিত ‘জাপান কাহিনী’, পৃ-৫৯, লেখক: আশির আহমেদ)। আমাদের চেয়ে অনেক অনেক উন্নত দেশ জাপান যদি ষোল বছরের একটি মেয়েকে যুবতী বলে স্বীকৃতি দিতে পারে, আমরা পারবো না কেনো? আঠারো বছর পর্যন্ত একটি মেয়েকে বিয়ে থেকে বাধা দিয়ে রাখায় আমাদের কী লাভ! মেয়ের অভিভাবক যদি মেয়েটি প্রাপ্তবয়ষ্ক হবার পর তার জন্য উপযুক্ত পাত্র পায়, তাহলে তাকে বিয়ে দিতে গিয়ে রাষ্ট্রের বাধার সম্মুখীন হওয়া কোনোভাবেই একটি সভ্য রাষ্ট্রে কাম্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রে যান, দেখবেন সেখানে প্রায় সব রাজ্যেই ১৮ বয়সের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে কোর্ট বা তাদের অভিভাবকের সম্মতিতে হতে পারে। কোনো কোনো রাজ্যে এ বিয়ে সর্বনিম্ন ১২ বছরে হয়ে থাকে। এমনকি একটি রাজ্যে বিয়ের কোনো সর্বনিম্ন বয়সসীমা নেই! (দৈনিক যুগান্তর, পৃ-২৪, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬)। নারী বা পুরুষের বিয়ের ক্ষেত্রে এটাই হওয়া উচিত কোনো দেশের স্বাভাবিক নিয়ম।
যৌন হয়রানী নিয়ে ইদানিং অনেক আলোচনা হচ্ছে। এর কারণ এবং এ থেকে পরিত্রাণের অনেক উপায়ও খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু আমরা ভাবি না, প্রাপ্তবয়ষ্ক হবার পরও মেয়েদেরকে বিয়ে দিতে না পারা এই যৌন হয়রানির একটি প্রধান কারণ। অনেক অভিভাবক তার মেয়ে প্রাপ্তবয়ষ্ক হবার পরও মেয়েটির বয়স ১৮ বছর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার কারণে মেয়েটি পথে ঘাটে বখাটে কর্তৃক ইভটিজিংয়ের শিকার হয়। অনেক মেয়ে অপহরণ এবং ধর্ষণেরও শিকার হয়। রাষ্ট্র যদি একজন অভিভাবক থেকে ১৮ বছরের আগে তার মেয়েকে বিয়ে দেয়ার অধিকার কেড়ে না নিতো, তাহলে সমাজে ইভটিজিং, ধর্ষণ, অপহরণ, ধর্ষণের পর হত্যা, মেয়েদের আত্মহত্যার অনেক ঘটনা ঘটতো না।
পত্রিকার প্রায় প্রতিদিনই দেখি দেশের অনেক জায়গায় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বাল্যবিয়ে (মানে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে, তা ১৭ হোক, ১৬ হোক বা আরো কম) ভন্ডুল করে দিয়ে কখনো বরকে, কখনো কাজীকে, কখনো কনের বাবাকে, কখনো বরের বাবাকে জেল দেয়া হয়েছে বা আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে। আমার মনে হয় না, কোনো অভিভাবক তার মেয়ে প্রাপ্তবয়ষ্ক হবার আগেই শিশুকালে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেয়। হয়তো তার বয়স অল্প; তেরো/চৌদ্দ বা পনেরো/ষোল বছর, তবে অবশ্যই প্রাপ্তবয়ষ্ক। কিন্তু তাতে রাষ্ট্রের কী ক্ষতি? রাষ্ট্র যদি নাগরিকদের কল্যাণ কামনা করে থাকে তাহলে নাগরিকদের নিরুৎসাহিত করতে পারে যাতে তারা খুব অল্প বয়সে বা প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগে তাদের মেয়েদের বিয়ে না দেয়।
অতিরিক্ত জনসংখ্যা একটা রাষ্ট্রে নানা রকম সংকট সৃষ্টি করে। যেখানে সেই জনসংখ্যার আধিক্য রোধ করার জন্য এদেশে রাষ্ট্রীয় শক্ত কোনো আইন নেই, রাষ্ট্র কেবল ‘ছেলে হোক, মেয়ে হোক, দু’টি সন্তানই যথেষ্ট’ জাতীয় শ্লোগান প্রচার করেই ক্ষান্ত থাকে, সেখানে কম বয়সে বিয়ে দিলে রাষ্ট্রে কোনো জটিলতা সৃষ্টি না হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্র এ ব্যাপারে শক্ত আইন করে বসে আছে!
নিবন্ধটি সম্পর্কে আপনার সুচিন্তিত মতামত জানাতে পারেন এই পেইজে গিয়ে: https://www.facebook.com/nurahmad.bangladeshi/posts/168860311386362?__tn__=K-R
Subscribe to:
Posts (Atom)