দেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফলাফল আগে প্রকাশ করা হতো বিভাগ বা শ্রেণিভেদে। কয়েক যুগ এভাবে ছিল। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে তা গ্রেডিং পদ্ধতিতে প্রকাশ করা হচ্ছে। উচ্চ মাধ্যমিকের পরের স্তরগুলোতে গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফলাফল প্রকাশ না করে এখনো ‘শ্রেণী’ ভেদে প্রকাশ করা হয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ফলাফল প্রকাশের আগের প্রথাটা কেন এখনো রয়ে গেল, জানি না। সনাতন পদ্ধতির তুলনায় গ্রেডিং পদ্ধতির অনেক না হলেও কিছু ইতিবাচক দিক আছে। যেমনÑ সনাতন পদ্ধতিতে প্রতি বোর্ডে সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত মাত্র ২০ জনকে সর্বোচ্চ মেধাবী বলে স্বীকৃতি দেয়া হতো। আর এখন ৮০ বা তদূর্ধ্ব নম্বরপ্রাপ্ত সবাইকে সর্বোচ্চ মেধাবী বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এটা অবশ্যই মেধাবীদের মূল্যায়নের এক উৎকৃষ্ট পন্থা। কিন্তু গ্রেডিং পদ্ধতির বড় একটি খারাপ দিক হচ্ছে, এ পদ্ধতিতে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী তাদের চেয়ে দুর্বল অনেক শিক্ষার্থীর তুলনায় খারাপ ফলাফল করে, হতাশ হয়। তাদের অভিভাবকেরাও ব্যথিত ও হতাশ হন। আর তাদের শিক্ষক, যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নিজেদের সুনামের জন্য শিক্ষার্থীদের পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন, তাদের কথা না-ই বা বললাম।
প্রথমে পঞ্চম শ্রেণীর ফলাফলের ক্ষেত্রে আসি। পঞ্চম শ্রেণীতে মোট বিষয় ছয়টি। এই ছয় বিষয়ের সব ক’টিতে যে শিক্ষার্থী ৮০ বা তার বেশি নম্বর পাবে, তার গ্রেড হবে ‘এ প্লাস’। আর যদি কোনো শিক্ষার্থী ছয় বিষয়ের কোনো একটিতে ৮০ নম্বরের কম (৭০-এর বেশি) পায়, তার গ্রেড হবে ‘এ’।
এই হিসাবে অনেক সময় এমনো হতে পারে, একজন শিক্ষার্থী পাঁচ বিষয়ে ১০০ করে আর মাত্র একটি বিষয়ে ৭৯সহ মোট ৫৭৯ নম্বর পাওয়ার কারণে পায় ‘এ’ গ্রেড। আরেকজন শিক্ষার্থী সব বিষয়ে ৮০ করে পেয়ে ছয় বিষয়ে মোট ৪৮০ নম্বর পাওয়ার ফলে পায় যায় ‘এ প্লাস’!
কত সহজ ‘এ প্লাস’ পাওয়া! ৯৯ নম্বর বেশি(!) পেয়ে একজন যেখানে পায় ‘এ’ গ্রেড, সেখানে আরেকজন তার চেয়ে ৯৯ নম্বর কম পেয়েও পেয়ে যায় ‘এ প্লাস’! কী উদ্ভট নিয়ম!
এভাবে কত মেধাবী শিক্ষার্থী গ্রেডিং পদ্ধতি প্রবর্তনের পর থেকে তাদের মেধা ও পরিশ্রমের পরিবর্তে হতাশার আগুনে দগ্ধ হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। আমাদের বিদ্যালয় থেকে ২০১৫ সালে এমন চার-পাঁচজন বেশ মেধাবী শিক্ষার্থী মাত্র একটি বিষয়ে ৮০ না পাওয়ার কারণে ‘এ প্লাস’ পায়নি, যাদের চেয়ে অনেক দুর্বল শিক্ষার্থী ওই বছর ‘এ প্লাস’ পেয়েছে বলে আমার প্রবল বিশ্বাস। এর কৈফিয়ত কে দেবে?
এবার পঞ্চম শ্রেণী ছাড়া অন্য পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফলাফলে আসি। যেগুলোতে ‘এ প্লাসের’ ওপরেও আরেকটা গ্রেড রয়েছেÑ ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ নামে। এসব পরীক্ষায় যে শিক্ষার্থী সব বিষয়ে পৃথক পৃথকভাবে ৮০ বা তার চেয়ে বেশি নম্বর পাবে, তার ফলাফল হবে ‘গোল্ডেন এ প্লাস’, আর যে শিক্ষার্থী সব বিষয়ে গড়ে ৮০ নম্বর পাবে, তার ফলাফল হবে ‘এ প্লাস’। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। হিসাবটা সহজ করার জন্য ধরা যাক তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছেÑ গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন। একজন শিক্ষার্থী গণিত ও পদার্থে পেয়েছে ১০০ করে; কিন্তু রসায়নে পেয়েছে ৭৯, তার ফলাফল হবে ‘এ প্লাস’। যদিও তার মোট নম্বর ২৭৯। আরেকজন শিক্ষার্থী তিনটি বিষয়েই পেয়েছে ৮০ করে, তার ফলাফল কিন্তু ‘গোল্ডেন এ প্লাস’! অথচ তার মোট নম্বর মাত্র ২৪০।
মাত্র তিনটি বিষয়ে ৩৯ নম্বর কম পেয়েও একজন শিক্ষার্থী প্রচলিত গ্রেডিং পদ্ধতিতে পেয়ে যায় ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ আর ৩৯ নম্বর বেশি পাওয়া সত্ত্বেও আরেকজন পায় শুধু ‘এ প্লাস’। সব বিষয়ের ক্ষেত্রে মোট নম্বরে অনেক বড় পার্থক্যের সম্ভাবনাও থেকে যায়। এ রকম সব বিষয়ে কাঁটায় কাঁটায় ৮০ নম্বর পেয়ে ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ পাওয়া একজন শিক্ষার্থীর চেয়ে ১৪০-১৫০’র মতো নম্বর বেশি পেয়েও অনেক শিক্ষার্থী ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ পায় না, পায় মাত্র ‘এ প্লাস’। দেশের সেরা মেধাবীদের প্রতি এটা কি তামাশা নয়? এটা কি প্রকৃত মেধাবীদের মূল্যায়ন, নাকি অবমূল্যায়ন? বছরের পর বছর দেশের সেরা অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী এভাবে অবমূল্যায়নের শিকার হয়ে আসছে। বিষয়টি গভীরভাবে যাচাই করে দেখার মনে হয় কেউ নেই!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একবার এ বিষয়ে একটি লেখা লিখেছি। প্রায় সবাই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু একজন পাঠক মন্তব্য করে বসলেন, ‘ছেলে নাইনটি নাইন পার্সেন্ট ভালো। শুধু মাঝে মাঝে নাইট ক্লাবে যায়। নিশ্চয় এই ছেলেকে আপনি ভালো বলবেন না।’ আমি তাকে উত্তরে লিখলাম, ‘৭৯ বা ৮০ পাওয়া-না-পাওয়ার সাথে নাইট ক্লাবে যাওয়া-না-যাওয়ার তুলনা করা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম এক নির্বুদ্ধিতা।’ ওই পাঠক এর পরও প্রচলিত গ্রেডিং পদ্ধতির ভ্রান্তি সুস্পষ্টভাবে বুঝতে না পেরে পুনরায় মন্তব্য করলেন, ‘একজন ওভার-অল ভালো। আরেকজন শারীরিক শিক্ষা, কৃষি আর বাংলায় ভালো। গণিত আর ইংরেজিতে খারাপ। অথচ আপনি আন্দোলনে নামলেন শেষের বলদকে ডগায় তুলার জন্য। হা হা হা। ভালোই...।’ তার কথার জবাবে এবার বললাম, ‘০১. খারাপ বলতে কি এমন খারাপ যে, সে গণিত বা ইংরেজিতে ফেল করেছে বা ৭০ থেকেও কম পেয়েছে? ০২. এবার বলুন, একজন গণিত ও ইংরেজিতে ১০০ করে পেয়ে শারীরিক শিক্ষায় পেয়েছে ৭৯, সে কি ওই শিক্ষার্থীর চেয়ে খারাপ, যে সব বিষয়ে পেয়েছে ৮০ করে?... ০৩. আপনার কথা শুনে মনে হলো, যারা গ্রেডিং সিস্টেমটা এভাবে সাজিয়েছে, তারাও আপনার মতোই অতি উর্বর মস্তিষ্কের অধিকারী। না হয়, সিস্টেমটা সবার জন্যই কল্যাণকর হতো।’ আমার এ রিপ্লাইয়ের পর ওই পাঠক অকপটে নিজের ভুল স্বীকার করে লিখলেন, ‘আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। ধন্যবাদ...।’
প্রচলিত গ্রেডিং পদ্ধতির আরেকটা ত্রুটি আমার কাছে মনে হয় ৮০ থেকে ১০০ পর্যন্ত মাত্র একটি গ্রেড রাখা। ৮০ থেকে নিচের দিকে প্রায় প্রতি ১০ নম্বরের ব্যবধানে একটা গ্রেড পরিবর্তন হয়। কিন্তু ৮০ থেকে এর পরে মোট ২১ নম্বরে একটাই গ্রেড। একজন শিক্ষার্থী সব বিষয়ে ৮০ থেকে সামান্য বেশি করে নম্বর পেয়ে যে গ্রেড পায়, আরেকজন শিক্ষার্থী সব বিষয়ে ৯০-৯৫ বা এর চেয়ে বেশি নম্বর পেয়েও সেই একই গ্রেড পায়। এটা কি সুবিচার? এ জন্য আমার মনে হয় সবরকম পাবলিক পরীক্ষায় যে শিক্ষার্থী সব বিষয়ে গড়ে ৮০ থেকে ৮৯ নম্বর পাবে, তাকে দেয়া উচিত ‘এ প্লাস’ আর যে শিক্ষার্থী সব বিষয়ে গড়ে ৯০ থেকে ১০০ নম্বর পাবে, তাকে দেয়া উচিত ‘গোল্ডেন এ প্লাস’। তাহলে মেধাবীদের প্রতি কোনো রকম অবিচার হবে না এবং উপরে উল্লিখিত উভয় সমস্যারই যুক্তিযুক্ত সমাধান হবে।
ইংরেজি GPA কথাটি মূলত Grading Point Average-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। মানে গড় পয়েন্টের ওপর ভিত্তি করে গ্রেড দেয়া। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এখন ‘গোল্ডেন এ প্লাসের’ ক্ষেত্রে কোনো গড় করাই হয় না। সব বিষয়ে ৮০ বা তার চেয়ে বেশি নম্বর পেতে হবে। তাহলে এটা Average বা গড় হলো কেমন করে? অনেক বিষয়ে ৯০ বা তার চেয়ে বেশি পাওয়া একজন শিক্ষার্থী কোনো এক বিষয়ে ৮০ থেকে একটু কম নম্বর পেতেই পারে। সে কি ওই শিক্ষার্থী থেকে খারাপ হয়ে গেল, যে সব বিষয়ে ৮০ থেকে বেশি পেয়েছে বটে, তবে কোনো বিষয়েই ৯০ বা তার চেয়ে বেশি পায়নি? এ জন্য মোট নম্বরে গড় বিবেচনা করে গ্রেডিং করা হলে কোনো মেধাবী শিক্ষার্থীই তার পরিশ্রমের বিনিময়ে হতাশ হবে না। বিষয়টির প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখাটি দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত হয় ১০ জুলাই ২০১৮ তারিখে ‘‘গ্রেডিং পদ্ধতিকে মেধাবীবান্ধব করুন’’ শিরোনামে।
No comments:
Post a Comment