লোডশেডিং যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম বাধা

 লোডশেডিং যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম বাধা 

নূর আহমদ
বিদ্যুতের ঘাটতি বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাগুলোর অন্যতম। যুগের পর যুগ ধরে বাংলাদেশে লোডশেডিং সগৌরবে বিদ্যমান। যখন ছোট ছিলাম, ১৯৯০ সালের দিকে আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। তখনও লোডশেডিং ছিল, এখনও আছে। অসত্য বলার কী দরকার, তখন লোডশেডিং এখনকার মতো ছিল না, আরও কম ছিল। দিন যতই গেল, লোডশেডিং ততই বাড়ল। সামনের অবস্থা চিন্তা করলে শংকিতই হতে হয়। আমরা যারা গ্রামাঞ্চলে থাকি, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা এ দেশের তৃতীয়, চতুর্থ বা আরও নীচু শ্রেণীর নাগরিক বলে গণ্য। অভিজাত এলাকাসহ দেশের অনেক নির্দিষ্ট এলাকায় লোডশেডিং যখন নেই বললেই চলে, তখন আমাদের সঙ্গে লোডশেডিং সব সময় এক তামাশার খেলা খেলেই চলে! আমরা কি মানুষ, নাকি অপাঙ্ক্তেয় কোনো জীব, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাই মাঝে মাঝে। জেলখানার মানুষের সঙ্গেও এমন আচরণ করা মনে হয় ঠিক নয়। আমাদের জেলাশহরে পর্যন্ত এত লোডশেডিং নেই, যা গ্রামবাসীর ভাগ্যে বরাদ্দ রাখা হয়! গ্রামে বসবাস করা কি অপরাধ?
গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ না থাকা অবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষে কী অসহনীয় কষ্টের মধ্যে সময় কাটায়, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। বিদ্যুতের একটা তামাশাপূর্ণ আচরণ হল, শীতকালে যখন বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবহার নেই, তখন লোডশেডিংয়ের পরিমাণ কম থাকে; আর গরমকালে যখন চব্বিশ ঘণ্টা বৈদ্যুতিক পাখা চালানোর প্রয়োজন হয়, তখন লোডশেডিংয়ের মাত্রা চরমভাবে বেড়ে যায়। বিদ্যুৎ অবশ্য তখন বারবার চলে যায়- এমন নয়, মাঝে মাঝে আসে কেবল! বৈদ্যুতিক পাখা থাকা সত্ত্বেও তা চালাতে না পেরে নিজেদের কত যে অসহায় মনে হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বিদ্যুতের তামাশাপূর্ণ আচরণের আরেকটি দিক হল, দিনের বেলা কলকারখানা, দোকানপাট, অফিস-আদালত সব একসঙ্গে খোলা থাকে বলে চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিতে পারে, কিন্তু রাতে যখন এসব কিছুই খোলা থাকে না, তখন তো অন্তত বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। অথচ তখন ছাত্রছাত্রীরা পড়তে বসে বা মানুষ দিনের পরিশ্রম শেষে একটু ঘুমাতে যায়, বিদ্যুৎ তখনও অপ্রত্যাশিতভাবে দিনের মতোই আসা-যাওয়ার খেলা খেলেই চলে; শান্তিমতো কিছুই করা যায় না।
অনেকেই লোডশেডিংয়ের সময় রিচার্জেবল লাইট বা ফ্যান ব্যবহার করে। বিদ্যুৎ থাকা সত্ত্বেও, যথারীতি বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা সত্ত্বেও এসব বাড়তি খরচ কেন করতে হবে? বিত্তশালী কেউ কেউ আবার আইপিএস ব্যবহার করে। কিন্তু নিয়মিত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করাই যাদের জন্য চ্যালেঞ্জ, তারা কোথায় পাবে আইপিএস! অবশ্য মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ফিরে আসতে এত গড়িমসি করে যে, আইপিএসও নিজের পক্ষ থেকে লোডশেডিং ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। বিষয়টা এমন, কুইনাইন জ্বর সারাবে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে? লোডশেডিংয়ের এই দেশে বিদ্যুতের সঙ্গে যাদের ব্যবসার সরাসরি সম্পর্ক, দিনের বেলা পিক আওয়ারে বসে বসে তাদের আঙুল চোষা ছাড়া করার কিছুই থাকে না। কাস্টমার আছে, মেশিনও সব ঠিকঠাক আছে; শুধু বিদ্যুৎ নেই!
বর্তমান সরকারের একটা বিশেষ প্রতিশ্রুতি ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। এটা অবশ্যই অভাবনীয় এক সৌভাগ্যের বিষয় আমাদের জন্য। সরকার এ প্রতিশ্র“তি পূরণের জন্য যে পুরোপুরি আন্তরিক, তা বোঝা যাচ্ছে সরকারের এ সংক্রান্ত নানা পদক্ষেপ দেখে। ব্যাংক-বীমাসহ প্রায় সব অফিস-আদালত অনলাইন হচ্ছে। গত কয়েক বছরে কয়েক কোটি মানুষ ইন্টারনেটে যুক্ত হয়েছে; রীতিমতো অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সুবিধা ভোগ করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রযুক্তিনির্ভর পাঠদানের জন্য সরকার কোটি কোটি টাকার উপকরণ সরবরাহ করছে। তবে..., তবে ডিজিটালাইজেশনের প্রাণ যেহেতু বিদ্যুৎ, তাই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে দেশকে ডিজিটাল করার প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যেমন- মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে পাঠদান করতে গিয়ে বিদ্যুৎ না থাকলে ল্যাপটপ চলে ঠিকই, কিন্তু প্রজেক্টর অচল হয়ে যায়, লাভ কী! এভাবে অনেক উচ্চবিদ্যালয় এবং কলেজে সরকারের সরবরাহকৃত কম্পিউটারগুলো স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায়। বেসরকারিভাবে ডিজিটাল হওয়ার প্রচেষ্টাও স্বাভাবিক গতিতে এগোচ্ছে না লোডশেডিংয়ের অভিশাপে। বর্তমান সরকার দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তেও বদ্ধপরিকর। দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়া যত কঠিন বা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, লোডশেডিংমুক্ত একটি সত্যিকার ডিজিটাল দেশ গড়া ততটা কঠিন অবশ্যই নয়। দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য দেশের মানুষ নিজেরা কাজ করতে পারে, করেও; কিন্তু লোডশেডিং থেকে মুক্তি পাওয়ার কাজটা শুধুই সরকারের হাতে। চব্বিশ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ যতদিন নিশ্চিত না হবে, ততদিন বাংলাদেশকে ডিজিটাল করার প্রক্রিয়া পঙ্গু হয়েই থাকবে।
শিক্ষক, রোকনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বশিকপুর, লক্ষ্মীপুর

[লেখাটি দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয় ১৫ জুলাই ২০১৫]

No comments:

Post a Comment