প্রাথমিক শিক্ষায় পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করা উচিত নয়

প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি। যে শিক্ষার মাধ্যমে সে শিখতে শুরু করে, তাই প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার মানে এ নয় যে, সে শিখে ফেলেছে অনেক-অনেক কিছু। প্রকৃতপক্ষে একজন শিক্ষার্থীর জন্য জ্ঞানের বিশাল রাজ্যে প্রবেশের উপযুক্ত সময় হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন যেদিন শেষ হবে, ঠিক সেদিন থেকে তার অবশিষ্ট জীবন।

আমার এক বিজ্ঞ শিক্ষক বলেছিলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটা হচ্ছে একেবারে সীমিত শিক্ষা। এটা মূলত জ্ঞানার্জনের নিয়মগুলো জানার জন্যই। একজন শিক্ষার্থী তার প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে জ্ঞানার্জনের নিয়মগুলোই শুধু শিখে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ থেকে কঠিন কবিতাগুলোর কিছু ‘নমুনা’ মাত্র একজন শিক্ষার্থীকে প্রথম থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যসব কবিতা সে পড়বে কোন সময়? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন স্তরের কবিতা সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা অর্জিত হওয়ার পরই তার অবশিষ্ট জীবনে।’


অথচ আমাদের দেশে অনেকে বুঝতেই পারে না প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্দেশ্য। এজন্যই একটি শিশু কিছু শিখতে না শিখতেই পাঠ্যবইবহির্ভূত বিষয়ে তার দক্ষতা-যাচাই আরম্ভ হয়ে যায়! মাত্র তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে, এমন শিক্ষার্থীকেও বাংলা পাঠ্যবইবহির্ভূত একটা অনুচ্ছেদ দিয়ে তার পরীক্ষা নেয়া হয়। হায়! এ বয়সে কী শিখেছে সে বাংলা ভাষার! যখন একটা-একটা শব্দ করে, একটা-একটা বাক্য করে সে শিখতে আরম্ভ করে, পাঠ্যবইয়ের যা সে ঘুণাক্ষরেও পড়েনি, সে সম্পর্কে তার জ্ঞান যাচাই করতে যাওয়ার কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে! পাঠ্যবইয়ের শব্দ বা বাক্যগুলো সে বুঝেছে কিনা, তা যাচাই করাই মূলত প্রয়োজন; কিন্তু পাঠ্যবইবহির্ভূত যে পড়াটা সে কখনও পড়েনি, যে শব্দার্থগুলো তাকে কখনও পড়ানো হয়নি, তার ওপর পরীক্ষা নেয়ার প্রয়োজন আছে কি?
অথচ আমাদের তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা এবং ইংরেজি প্রশ্নে এখন যুগপৎভাবে পাঠ্যবইয়ের অন্তর্গত এবং পাঠ্যবইবহির্ভূত দু’রকম দুটি অনুচ্ছেদের ওপর পরীক্ষা নেয়া হয়।
ইংরেজির কথায় আসি। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর ইংরেজি প্রশ্নকাঠামোতে এখন একটি Passage আসে, যা পাঠ্যবইয়ে নেই। ২০১৩ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ইংরেজি প্রশ্নে দেখলাম, বিশাল একটি Unseen Passage এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পেসেজটিকে পঞ্চম শ্রেণীর ইংরেজি পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত পেসেজের সমপর্যায়ের মনে করা হলেও এ পেসেজের Vocabulary গুলো কি শিক্ষার্থীরা পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্যবই থেকে শিখতে পেরেছে? না শিখে থাকলে তারা এ পেসেজের অর্থ উদ্ধার করবে কিভাবে? এ পেসেজের Sentence গুলোর কাঠামো কি তারা এ পর্যন্ত চর্চার সুযোগ পেয়েছে? তাহলে এ পেসেজের ওপর বিভিন্ন প্রশ্নের তারা উত্তর দেবে কিভাবে?
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। শিশুরা শৈশব থেকে বাংলা শুনতে এবং বাংলায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত কোনো শিশু বাংলা ভাষায় রচিত পাঁচ-পাঁচটি বইয়ের বিপরীতে একটিমাত্র ইংরেজি বই অধ্যয়নের সুযোগ পায়। আমাদের শ্রেণীকক্ষের ভাষাও কিন্তু ইংরেজি নয়। তবু বাংলার মতোই ইংরেজিতেও পাঠ্যবইবহির্ভূত বিষয়ের ওপর প্রশ্ন করাটা কতটা যৌক্তিক?
একটা কৌতুক মনে পড়ছে। হাসপাতালের বেডে শায়িত সদ্য জ্ঞান ফিরে পাওয়া একজন ট্রাকচালককে ট্রাকটির মালিক জিজ্ঞেস করলেন-
: দুর্ঘটনাটি কিভাবে হয়েছে?
চালক বললেন-
: ট্রাকটি স্টার্ট দেয়ার কিছুক্ষণ পর দেখি সামনের দিক থেকে একটি বাস আসছে, তাকে সাইড দিলাম; এরপর দেখি একটি ট্রাক আসছে, তাকেও সাইড দিলাম; এরপর দেখি একটি ব্রিজ আসছে, তাকেও সাইড দিলাম; এরপর আর কিছু মনে নেই!
বাংলার মতো ইংরেজিতেও পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করাটা এরকম সবকিছুকে একই মাপকাঠিতে পরিমাপ করার মতোই বিপজ্জনক।
পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করলে করা যেতে পারে গণিতে। পাঠ্যবইয়ের একটা অংকের সংখ্যা পরিবর্তন করে প্রশ্ন করা যেতে পারে। তাহলে বোঝা যাবে, এরকম অন্য একটা সমস্যার সমাধান সে করতে পারে কিনা। কিন্তু এরকম প্রশ্ন না করে বরং ‘যোগ্যতাভিত্তিক’ নাম দিয়ে পাঠ্যবইয়ের একটা সমস্যাকে ভেঙে সমস্যাটির চারটি শাখা বের করা হয়। বড়ই অদ্ভুত ধারণা। মাঝে মাঝে ভাবি, যারা এভাবে একটি অংককে চার বা পাঁচ ভাগে বিভক্ত করে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন তৈরির অভিনব নিয়মটি প্রবর্তন করলেন, শৈশবে তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে কোনো অংকই কি শিখতে পারেননি? অংক নিয়ে এত নাটকের কী প্রয়োজন? ঐকিক নিয়মের একটি অংক পাঠ্যবইয়ে যেভাবে আছে, একইভাবে পরীক্ষায় প্রশ্ন করে কি শিক্ষার্থীদের ঐকিক নিয়মের জ্ঞান যাচাই করা সম্ভব নয়? এত শাখা-প্রশাখা বের করে শিশু-শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করার কী প্রয়োজন? প্রাথমিকের ইংরেজি বা বাংলায় পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করাটা কোনোক্রমেই সঙ্গত নয়। শিক্ষাজীবনের শেষ পর্যায়ে, স্নাতক বা স্নাতকোত্তরে এমন প্রশ্ন করা যেতে পারে। কারণ সে পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ভাষা সম্পর্কে কিছুটা পারদর্শিতা অর্জন করে। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, আমাদের প্রাথমিকের তৃতীয় শ্রেণীর বাংলায় পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করা হলেও স্নাতকের বাংলায় পাঠ্যবইবহির্ভূত কোনো প্রশ্ন করা হয় না, এমনকি পাঠ্যবই থেকেও যোগ্যতাভিত্তিক কোনো প্রশ্ন করা হয় না। সবই সেই প্রাগৈতিহাসিক মুখস্থ বিদ্যা! এর কি অর্থ এটাই যে, আমাদের স্নাতকের শিক্ষার্থীদের চেয়ে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা বাংলায় বেশি দক্ষ!
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় গাইডবই নিষিদ্ধ। কিন্তু ওপেন সিক্রেট হচ্ছে- গাইড ব্যবহার করে না, এমন শিক্ষার্থী আবিষ্কার করা বর্তমান সময়ে বেশ কষ্টকর! কেন? প্রশ্নকাঠামো পাঠ্যবইভিত্তিক নয় বলেই। ২০১৫ সালের সমাপনী পরীক্ষার জন্য ‘জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি’ যে প্রশ্নকাঠামো নির্ধারণ করেছে, তাতে পাঠ্যবই থেকে মাত্র একটি পেসেজ আসার কথা বলা হয়েছে মাত্র, আর কিছু নয়। এ পেসেজ ছাড়া প্রশ্নকাঠামোর অন্য আইটেমগুলো শিক্ষার্থীরা চর্চা করবে কোত্থেকে? এজন্যই গাইডনির্ভরতা।
আমি মনে করি, পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করে গাইড বা মডেল টেস্টের প্রয়োজনীয়তাই প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে প্রকারান্তরে। ২০১৩ সালের ইংরেজি প্রশ্নকাঠামোতে পাঠ্যবইবহির্ভূত অনুচ্ছেদটি ব্যতীত অন্য প্রশ্নগুলো যেভাবে পাঠ্যবইভিত্তিক ছিল, পুরো প্রশ্নকাঠামো এভাবে পাঠ্যবইভিত্তিক করা হলে এসবের প্রয়োজনীয়তা শূন্য হয়ে যাবে। তাই অন্তত ‘প্রাথমিক’ শিক্ষায় পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করা কোনোভাবেই উচিত নয়। বাংলা এবং ইংরেজি ব্যতীত অন্য চারটি বিষয়ে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন যেভাবে শুধু পাঠ্যবই থেকেই করা হয়, বাংলা এবং ইংরেজিতেও এভাবে শুধু পাঠ্যবই থেকেই যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন করা উচিত।
নূর আহমদ
শিক্ষক, রোকনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
বশিকপুর, লক্ষ্মীপুর
nurahmad786@gmail.com

[লেখাটি দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছে ০৪ নভেম্বর ২০১৫

No comments:

Post a Comment