জাতীয় বেতন কাঠামোর বৈষম্য দূর করার উপায়




আমার চাকরি শুরু হয়েছে ১৫ তম গ্রেডে ৯৭০০ টাকা স্কেলে। পিটিআইতে সি-ইন-এড প্রশিক্ষণের পর এক গ্রেড উন্নীত হয়ে ১৪ তম গ্রেডে এসেছে। বেতন তো বৃদ্ধি পাবার কথা স্বাভাবিকভাবেই। সত্যিই, মূল বেতন বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু মোট বেতন গেছে কমে! কিভাবে?

আগে বাড়ি ভাড়া ছিল ৫০ শতাংশ। মাত্র এক গ্রেড বাড়তে না বাড়তেই এবার তা হয়ে গেছে ৪৫ শতাংশ! মূল বেতন বাড়লেও মোট বেতন কমে গেছে। বেতন বৃদ্ধির কথা বলে বরং বেতন কমিয়ে দেয়া হয়েছে! একে কি তামাশা বলবেন, নাকি প্রহসন বলবেন, নাকি বঞ্চনা বলবেন, নাকি বলবেন ধোঁকা? যা-ই বলবেন, সবই ঠিক।

২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর সরকার অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলের গেজেট প্রকাশ করে। প্রাথমিক অবস্থায় যখন দেখেছি সরকার চাকরিজীবিদের বেতন আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করে দিয়েছে, তখন বেতন স্কেলের অন্য দিকগুলো নিয়ে তেমন ভাববার প্রয়োজন মনে হয়নি। যেমন: আগে আট বছর পর যে টাইম স্কেল দেওয়া হতো, তা বাদ দিয়ে নতুন কাঠামোয় ১০ বছরে একটা গ্রেড বৃদ্ধির নিয়ম করা হয়।

আমার চাকরি শুরু মে ২০০৯ সালে। সেই হিসেবে ৮ বছরের জায়গায় ১০ বছরে, মানে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে একটা গ্রেড বৃদ্ধি পাবার কথা ছিল। কিন্তু ১১ বছর পার হয়ে যাবার পরও এখনো তার কোনো নাম-গন্ধও নেই। ‘‘প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়’’ এবং ‘‘প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর’’ এর মতো দুই দুইটি বড় প্র্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও এমন হওয়াটা কোনোভাবেই কাম্য হবার কথা ছিল না।
কথা সেটা নয়। কথা হচ্ছে, ৮ বছরের জায়গায় ১০ বছরের দীর্ঘ অপেক্ষার পর একটা গ্রেড পরিবর্তন হয়ে উন্নীত গ্রেডে যাবার পর আমাদের বেতন কত বৃদ্ধি পেতো?
বর্তমান বেতন কাঠামো বা গ্রেডগুলো সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই, তাদেরকে এ সম্পর্কে অনুমান করতে বললে তাদের অধিকাংশ মানুষের অনুমানের সাথে বাস্তবতার দূরত্ব অনেক অনেক বেশি হবে, সন্দেহ নেই। কারণ তারা সবাই ভাববে, প্রথমতঃ সরকারি চাকরি, দ্বিতীয়তঃ ১০ বছর চাকরি করার পর একটা গ্রেড বৃদ্ধি পাবে, নিশ্চয়ই অনেক টাকা বাড়বে।

কিন্তু বাস্তবতা কী বলে?
সেজন্য দেখতে হবে বর্তমান বেতন কাঠামো, যা প্রণয়ন করেছে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী কিছু প্রবীণ আমলা।
‘‘২০ তম গ্রেডের বেতন ৮২৫০ থেকে ২৫০ টাকা বেড়ে ১৯ তম গ্রেডে বেতন হয় ৮৫০০ টাকা, ১৯ তম গ্রেড থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে ১৮ তম গ্রেডে বেতন হয় ৮৮০০ টাকা, ১৮ তম গ্রেড থেকে ২০০ টাকা বেড়ে ১৭ তম গ্রেডে বেতন হয় ৯০০০ টাকা, ১৭ তম গ্রেড থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে ১৬ তম গ্রেডে বেতন হয় ৯৩০০ টাকা, ১৬ তম গ্রেড থেকে ৪০০ টাকা বেড়ে ১৫ তম গ্রেডে বেতন হয় ৯৭০০ টাকা, ১৫ তম গ্রেড থেকে ৫০০ টাকা বেড়ে ১৪ তম গ্রেডে বেতন হয় ১০২০০ টাকা, ১৪ তম গ্রেড থেকে ৮০০ টাকা বেড়ে ১৩ তম গ্রেডে বেতন হয় ১১০০০ টাকা, ১৩ তম গ্রেড থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে ১২ তম গ্রেডে বেতন হয় ১১৩০০ টাকা, ১২ তম গ্রেড থেকে ১২০০ টাকা বেড়ে ১১ তম গ্রেডে বেতন হয় ১২৫০০ টাকা, ১১ তম গ্রেড থেকে ৩৫০০ টাকা বেড়ে ১০ম গ্রেডে বেতন হয় ১৬০০০ টাকা, ১০ম গ্রেড থেকে ৬০০০ টাকা বেড়ে ৯ম গ্রেডে বেতন হয় ২২০০০ টাকা, ৯ম গ্রেড থেকে ১০০০ টাকা বেড়ে ৮ম গ্রেডে বেতন হয় ২৩০০০ টাকা, ৮ম গ্রেড থেকে ৬০০০ টাকা বেড়ে ৭ম গ্রেডে বেতন হয় ২৯০০০ টাকা, ৭ম গ্রেড থেকে ৬৫০০ টাকা বেড়ে ৬ষ্ঠ গ্রেডে বেতন হয় ৩৫৫০০ টাকা, ৬ষ্ঠ গ্রেড থেকে ৭৫০০ টাকা বেড়ে ৫ম গ্রেডে বেতন হয় ৪৩০০০ টাকা, ৫ম গ্রেড থেকে ৭০০০ টাকা বেড়ে ৪র্থ গ্রেডে বেতন হয় ৫০০০০ টাকা, ৪র্থ গ্রেড থেকে ৬৫০০ টাকা বেড়ে ৩য় গ্রেডে বেতন হয় ৫৬৫০০ টাকা, ৩য় গ্রেড থেকে ৯৫০০ টাকা বেড়ে ২য় গ্রেডে বেতন হয় ৬৬০০০ টাকা, ২য় গ্রেড থেকে ১২০০০ টাকা বেড়ে ১ম গ্রেডে বেতন হয় ৭৮০০০ টাকা।’’

তার মানে ১৪ তম গ্রেডে যারা আছেন, তারা ১০ বছর চাকরি করার পর একটা গ্রেড বৃদ্ধি পাবার ফলে তাদের বেতন বাড়বে ৮০০ টাকা! ১০ বছর পর ‘মাত্র’ ৮০০ টাকা বেতন বৃদ্ধি করাটা কি রীতিমতো তামাশার বিষয় নয়?
পরবর্তী গ্রেড? পরবর্তী গ্রেডে অবশ্য ৮০০ টাকাও নয়, মাত্র ৩০০ টাকা বৃদ্ধির নিয়ম করা হয়েছে। একজন লোক যত অভিজ্ঞ হয়, চাকরি যত গাঢ় হয়, চাকরি করতে করতে একজন লোক যত দক্ষ হয়, তার বেতন বৃদ্ধির হার তত বাড়বে, এটই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের বেতন কাঠামোর চিত্র তার ঠিক উল্টো মেরুতে

১২ তম গ্রেড থেকে ১১তম গ্রেডে গেলে ৩০০ টাকা থেকে লাফ দিয়ে বেতন বাড়ে ১২০০ টাকা (আগের তুলনায় ৪গুণ), আবার ১১তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে বেতন বাড়ে ৩৫০০ টাকা (তিন গুণ প্রায়)! এই ১৪ তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে যাবার পথে বেতন কাঠামো কোনো ফর্মুলা বা ব্যাকরণ-ই অনুসরণ করেনি। কেন? এমন মনগড়া কাঠামো প্রণয়নের কী দরকার ছিল? প্রশ্ন জাগে, এমন ‘মনগড়া ও যাচ্ছেতাই’ বেতন কাঠামো প্রণয়নের জন্য দেশের ‘সর্বোচ্চ মেধাবী কিছু প্রবীণ আমলা’কে নিয়োগ করার কি কোনো আবশ্যকতা ছিল? এজন্য তো এসএসসি পাস কয়েকজনকে নিয়োগ দিলেই কাজটা তারা অল্পসময়ে করে দিতে পারতো! প্রশ্ন জাগে, বেতন কাঠামো কি বৃটিশ বা পাকিস্তানী আমলারা প্রণয়ন করেছে? এখনও কি এদেশে বৃটিশ বা পাকিস্তানী আমল চলছে? মোটেই না।

এই কাঠামো অল্পশিক্ষিত কেউ যেমন প্রণয়ন করেনি, বৃটিশ বা পাকিস্তানী আমলারাও করেনি, করেছে এদশেরই কিছু ‘উচ্চশিক্ষিত স্বার্থপর’ মানুষ, কাজেকর্মে যারা বৃটিশ বা পাকিস্তানী শাসনরীতিই অনুসরণ করে; যারা বৃটিশ বা পাকিস্তানী আমলা না হলেও বৃটিশ বা পাকিস্তানী শাসকদের প্রেতাত্মার মতোই কাজটি করেছে। জমিদারী প্রথা আমরা দেখিনি, কিন্তু চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, এখনো কাজেকর্মে আমাদের অনেকেই আমাদের সাথে জমিদারদের মতোই আচরণ করছে। এরা সেইসব জমিদারদের আক্ষরিক অর্থে উত্তরসূরী না হলেও তাদের প্রেতাত্মা, কোনো সন্দেহ নেই।

বর্তমান বেতন কাঠামোকে ‘মনগড়া ও যাচ্ছেতাই’ বলা এবং এই কাঠামো প্রণেতাদেরকে ‘বৃটিশ-পাকিস্তানী শাসকদের প্রেতাত্মা’ বা ‘জমিদারদের প্রেতাত্মা’ বলার কারণ সম্পর্কে উপরে সামান্যই বলা হয়েছে। আমরা এবার এই কাঠামোর আরো কিছু ‘মনগড়া ও যাচ্ছেতাই’ বিষয় এবং কাঠামো-প্রণেতাদের স্বার্থপরতার আরো কিছু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখবো।

২০ তম গ্রেড থেকে ১২তম গ্রেড পর্যন্ত মোট ৮টা গ্রেড মিলিয়ে যেখানে বেতন বাড়ে মাত্র ৩০৫০ টাকা, সেখানে ৭ম গ্রেড থেকে মাত্র ১টা গ্রেড বেড়ে ৬ষ্ঠ গ্রেডে গেলেই বেতন বাড়ে ৬৫০০ টাকা, দ্বিগুণেরও বেশি! একটা গ্রেড পরিবর্তনে যেখানে সর্বোচ্চ বেতন বাড়ে ১২০০০ টাকা, সেখানে শেষের দশটা গ্রেড মিলিয়ে বেতন বাড়ে মাত্র ৭৭০০ টাকা!

আমরা উপরে বেতন কাঠামোয় গ্রেডে গ্রেডে বেতন বৃদ্ধির ধারা দেখেছি। বেতন বৃদ্ধির এই ধারা (২৫০<৩০০>২০০<৩০০<৪০০<৫০০<৮০০>৩০০<১২০০<৩৫০০<৬০০০>১০০০<৬০০০<৬৫০০<৭৫০০>৭০০০>৬৫০০<৯৫০০<১২০০০) কি বিজ্ঞানের কোনো সূত্র অনুসরণ করেছে, নাকি গণিতের কোনো সূত্র অনুসরণ করেছে, বুঝতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এটাকে লুডু খেলার মইয়ের সাথে তুলনা করারও সুযোগ নেই। কারণ সেখানে যে-কারও ভাগে বড় মইও পড়তে পারে, ছোট মইও পড়তে পারে। কিন্তু এখানে অন্যদের জন্য নির্দিষ্ট (ফিক্স) করে দেয়া হয়েছে শুধু বিভিন্ন আকারের ছোট ছোট মই, আর যারা কাঠামোটি প্রণয়ন করেছে, তাদের নিজেদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে সব বড় বড় মই। এখানে প্রতিপক্ষের জন্য বড় মইয়ে ওঠার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি আর যারা খেলাটা আয়োজন করেছে, তাদের ভাগে ছোট মই পড়ার কোনো সম্ভাবনাই রাখা হয়নি। এটাকে ‘বৃটিশ-পাকিস্তানী শাসকদের প্রেতাত্মা’দের কাজ মনে না করার সুযোগ কোথায়! এটাকে ‘মনগড়া ও যাচ্ছেতাই’ না বলেও কি কোনো উপায় আছে?

বেতন বৃদ্ধির এই ধারায় ২৫০ টাকা থেকে বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে ২০০ টাকায় নেমে গেছে, আবার বাড়তে বাড়তে ৮০০ টাকা পর্যন্ত গিয়ে পা পিছলে হঠাৎ নেমে গেছে ৩০০ টাকায়, আবার বাড়তে বাড়তে ৬০০০ টাকায় গিয়ে শেয়ার বাজারের মতো হঠাৎ নেমে গেছে ১০০০ টাকায়! এভাবে নাটকের পর নাটক হয়েছে মাত্র ২০টা গ্রেডের একটা কাঠামোতে। এটা কি শেয়ার বাজারের দরের উঠানামা? এটা সবার বিশ্বাস হবে, যারা এই কাঠামোটা করেছে, তাদের কাছে এই ‘উঠানামা’র পক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো যুক্তি নেই। এটা সম্পূর্ণ মনগড়া, যাচ্ছেতাই। স্বার্থপরতার সর্বোচ্চ প্রদর্শনী। বিমূর্ত কবিতা সম্পর্কে একটি রম্যরচনা পড়েছিলাম অনেক আগে একটি দৈনিক পত্রিকায়। সেখানে একটি গল্প উল্লেখ করা হয় এরকম, ইংল্যান্ডের একজন প্রসিদ্ধ কবির একটি কবিতার অনুষ্ঠানে এক পাঠক ঐ কবিকে তাঁর একটি কবিতার দু’টি চরণ উল্লেখ করে প্রশ্ন করলো, ‘স্যার, এই দু’টি চরণ দ্বারা আপনি কী বুঝিয়েছেন?’ কবি জবাবে বললেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, কবিতাটি যখন লিখেছিলাম, তখন এই চরণ দু’টির অর্থ শুধু আমি আর ঈশ্বর জানতাম, কিন্তু এখন দেখি শুধু ঈশ্বরই জানেন!’

আমার এক সহকর্মী বললো, ‘১২তম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেডে বেতন পায় কর্মচারী ও কামলারা, তাই তাদের গ্রেডে বাড়ে ২০০/৩০০ টাকা করে আর ১ম গ্রেড থেকে ১১তম গ্রেডে বেতন পায় কর্মকর্তা ও আমলারা, এই জন্য তাদের বেতন বাড়ে ৬০০০/৭০০০ টাকা করে।’

আমলা ছাড়া যারা এই বেতন কাঠামোর সুবিধার আওতার বাইরে, এমন ১ লক্ষ সচেতন মানুষের মতামত নেয়া হলে এমন ১ জনও খুঁজে পেতে কষ্ট হতে পারে, যে এরকম ধাপ নির্ধারণকে নিঃস্বার্থ, পক্ষপাতহীন ও যৌক্তিক বলে মতামত দেবে।

আমার মতো যারা ১৫তম গ্রেডে চাকরি শুরু করেছেন, তাদের (কিছু কিছু ডিপার্টমেন্টে ভিন্ন হতে পারে) চাকরির ১০ম বছরে নতুন গ্রেডে উন্নীত হবার সময় ইনক্রিমেন্ট পেয়ে পেয়ে মূল বেতনের সাথে যোগ হয়েছে ৪৯২০ টাকা। অথচ ১০ বছর পর উন্নীত গ্রেডে যাবার ফলে তার চেয়ে বেশি না বেড়ে যদি মাত্র ৮০০ টাকা বাড়ে, তাহলে বিষয়টা কি পুরোপুরি তামাশা হয়ে যায় না? ১০ বছরে ইনক্রিমেন্ট পেয়ে পেয়ে যা বেড়েছে, উন্নীত গ্রেডে তার চেয়ে বেশি বাড়লেই ১০ বছর অপেক্ষা করাটা সার্থক হতো। সকল শ্রেণির চাকরিজীবির ক্ষেত্রেই কথাটা প্রযোজ্য। এই দৃষ্টিকোণ থেকেও বর্তমান কাঠামোকে ‘যাচ্ছেতাই ও তামাশাপূর্ণ’ বলার সুযোগ থাকে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমান সরকার দেশকে উন্নত দেশের কাতারে শামিল করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আমার মনে হয়, দেশের উন্নত হবার পথে এক বড় বাধার নাম আমলাতন্ত্র। জাপানের একটা বিষয় লক্ষ্য করলে আমার এই মতামতের সত্যতা প্রমাণিত হবে। জাপানে শ্রমের মূল্য অনেক বেশি। সেখানে একজন মুচি বা নাপিতের আয়ও দেশের প্রথম সারির পেশাজীবিদের গড় আয়ের অনেকটা কাছাকাছি। দেশের সব নাগরিকের হাতে যেন পর্যাপ্ত টাকা থাকে, সে জন্য জাপান সরকার বিভিন্ন রকম পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। সেখানে একজন নাপিতের গড় আয় মাসে ২০০০ ডলার। [দেখুন, জাপান কাহিনি ২য় খন্ড, আশির আহমেদ, ঐতিহ্য, পৃষ্ঠা-৬০] জাপানের মতো কোরিয়াতেও মানুষের আয়বৈষম্য নিরসনে সরকার সবসময় সচেষ্ট থাকে। অন্যরা যখন আয়বৈষম্য নিরসনের চেষ্টায় লিপ্ত, আমরা তখন আয়বৈষম্য বৃদ্ধির অপচেষ্টায় লিপ্ত, যার উজ্জ্বল উদাহরণ জাতীয় বেতন কাঠামো।
অস্ট্রেলিয়ায় যান। দেখবেন, সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের বেতন যা, একজন সাধারণ শ্রমজীবি মানুষের বেতনও তার প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু বাংলাদেশে সব শ্রেণির মানুষের হাতে পর্যাপ্ত টাকা থাক, এটা অন্তত এদেশের আমলাশ্রেণির মানুষ চায় না। এরা মারাত্মক স্বার্থপর, সঙ্কীর্ণ মনের অধিকারী। যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ এই চরম বৈষম্যমূলক বেতন কাঠামো, যেখানে নিচের শ্রেণির এক গ্রেড পরিবর্তনে বেতন বাড়ে ৩০০/৮০০ টাকা করে আর উপরের শ্রেণির এক গ্রেড পরিবর্তনে বেতন বাড়ে ৬০০০/৭০০০ টাকা করে। কেন, সব গ্রেডে যদি আনুপাতিকহারে সমানভাবে বেতন বাড়ে, উপরের গ্রেডে চাকরিজীবিদের কি মস্ত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে বা নিচের গ্রেডের চাকরিজীবিদের বেতন কি উপরের গ্রেডে চাকরিজীবিদের চেয়ে বেড়ে যেতে পারে?
উপরের গ্রেডের চাকরিজীবিরা হয়তো বলতে পারেন, নিচের দিকের গ্রেডগুলোতে জনবল বেশি। তাই তাদেরকে বেশি বেতন দিতে গেলে দেশের অর্থনীতির উপর চাপ পড়তে পারে। যদি দেশের প্রতি তাদের এতোই মায়া থাকে, তাহলে নিজেদের গ্রেডগুলোর মধ্যকার ব্যবধান এত বেশি রেখেছেন কেন? এমনিতেই উপরের দিকের গ্রেডে চাকরি করছেন, এরপর বেতন বৃদ্ধিটা যদি নিচের দিকের গ্রেডগুলোর চেয়ে দু’তিন গুণ বেশি হতো, তবু কম হতো না। কিন্তু তাদের বেতন বাড়ে নিচের দিকের গ্রেডগুলোর চেয়ে ২০/২৫ গুণ বেশি করে। তাদেরকে এতো বেতন দিতে গেলে দেশের অর্থনীতির উপর কি চাপ পড়ে না? আসলে এসব হচ্ছে বাহানা। নিজেরা বেতন কম নিয়ে দেশপ্রেমের কথা বললে তা সত্যিকার দেশপ্রেম হতো।

বর্তমান বেতনকাঠামো অনুযায়ী মাস-শেষে সরকারের যে টাকা খরচ হয়, সবার বেতন আনুপাতিক হারে সমানভাবে (পদ্ধতি নিচে উল্লেখ করা হলো) বৃদ্ধি করলেও সরকারের খরচ বেশ একটা বাড়বে না। তাছাড়া দেশের সব নাগরিকের প্রতি সুবিচার করতে গেলে যদি দেশের কিছু টাকা বাড়তি খরচ হয়, তা তো আর উপরের গ্রেডের চাকরিজীবিদের পকেট থেকে যাবে না! এদেশে সরকার যতো রাজস্ব পায়, তার বেশির ভাগ পায় সাধারণ মানুষ থেকে। উপরের গ্রেডের অল্প সংখ্যক চাকরিজীবি মুঠোফোনে কথা বলে প্রতি মাসে সরকারকে যা রাজস্ব দেয়, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি রাজস্ব দেয় নিচের দিকের চাকরিজীবিরা।

দেশের তৃণমূলে সরকারি দায়িত্ব পালন করছে নিচের দিকের চাকরিজীবিরা। উপরের শ্রেণির চাকরিজীবিদের কেউ কেউ শুয়ে-বসেই বেতন নিচ্ছে, পাচ্ছে বাড়তি অনেক সুবিধাও। একজন ইউএনও বা জেলা প্রশাসককে কখনো কি দেখেছেন কোনো উপজেলা বা জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হবার পর এক মাসের মধ্যে পুরো উপজেলা বা জেলা ঘুরে দেখেছে, সেই উপজেলা বা জেলায় কয়টি রাস্তা, কয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুরবস্থায় আছে, কয়টি সংস্কারযোগ্য ক্ষেত্র আছে? কখনো কি দেখা যায়, একজন ইউএনও বা জেলা প্রশাসক কোনো এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হবার পর অল্প সময়ের মধ্যে সেই এলাকার প্রতিটা গ্রাম/ইউনিয়ন ভিত্তিক মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদের সাথে পরিচিত হতে, তাদের সমস্যার কথা একান্তে শুনার ব্যবস্থা করতে? দেখা যায় না। এরা মূলত মিটিংয়ে মিটিংয়েই সময় কাটায়। এদের দৃশ্যমান কাজ খুব অল্প। যেমন: পাবলিক পরীক্ষা পরিদর্শন, বাল্যবিয়ে ভেঙ্গে দেয়া, কারেন্ট জাল নিধন, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা, বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা পরিচালনা ইত্যাদি।

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির নাম, কিংবা একজন সংসদ সদস্য বা উপজেলা চেয়ারম্যানের নাম যেভাবে সংশ্লিষ্ট এলাকার সবাই জানে, একজন ইউএনও বা জেলা প্রশাসকের নাম সংশ্লিষ্ট উপজেলা বা জেলার মানুষ সেভাবে জানে না। এরা কোনো উপজেলা বা জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হবার পর কয়েক বছর চাকরি করলেও সংশ্লিষ্ট উপজেলা বা জেলার অধিকাংশ মানুষ এদেরকে চেনা দূরের কথা, এদের নামটা পর্যন্ত জানে না। আক্ষরিক অর্থে এরা মানুষের খুব কম কাজেই লাগে। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণির চাকরিজীবিরা শিক্ষা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের সেবা করে, খুব কমই এরা শুয়ে-বসে থাকতে পারে। কিন্তু বেতনের ক্ষেত্রে সুবিধাগুলো নিয়ে নেয় প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবিরা। এটাই বৃটিশ বা পাকিস্তানী মানসিকতা, এটাই জমিদারসুলভ আচরণের প্রতিফলন।

উপরের গ্রেডে চাকরিজীবিদের স্বার্থপরতার কাছেই জিম্মি হয়ে আছে দেশের সামগ্রিক মানুষের জীবনমানের উন্নতি। একটা বিশেষ শ্রেণির হাতে দেশের টাকা চলে যাচ্ছে বেশি। সরকার বিষয়টা যতদিন বিবেচনায় না নেবে, ততদিন দেশ সত্যিকার উন্নতির পথ খুঁজে পাবে না।

বেতন কাঠামোর বৈষম্য নিরসনের উদ্যোগ যখনই নেয়া হয়, তখন অথবা পরবর্তী পে-স্কেল যখনই দেয়া হয়, তখন কিছু প্রস্তাব বিবেচনায় নেয়ার অনুরোধ থাকবে।

১. প্রতি গ্রেডে ব্যবধান যেন আনুপাতিকহারে সমান করে দেয়া হয়। এতে উপরের দিকের গ্রেডে যারা চাকরি করে, তাদের কোনো ক্ষতি হবার কথা নয়। কারণ তারা তো বড় স্কেলেই চাকরি শুরু করেছে।
‘আনুপাতিকহারে সমান’ করার প্রক্রিয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের মতামত চাইলে অনেক রকম মতামত আসতে পারে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, পক্ষপাতহীন ও নিঃস্বার্থ মতামত হতে পারে প্রতি গ্রেডে শতকরা হারে বেতন বৃদ্ধি করার নিয়ম রাখা হলে। যেমন: প্রতি গ্রেডে ২০ শতাংশ বা ২৫ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি করা হলে গ্রেডে গ্রেডে ‘ব্যবধান’কে কোনোভাবে ‘বৈষম্য’ বলার সুযোগ থাকবে না; কোনো শ্রেণির চাকরিজীবি এতে অসন্তুষ্ট হবে না; সবাই যার যার স্কেল এবং উন্নীত গ্রেড নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে। এটা ঠিক বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের মতো।
সর্বশেষ গ্রেড (২০ তম বা ১৬ তম) নির্ধারণ করে সেখান থেকে শতকরা হারে উপরের সব গ্রেডের বেতন নির্ধারণ করা হোক। সর্বশেষ গ্রেডে ৯০০০ বা ১০,০০০ টাকা হলে সহজে উপরের গ্রেডগুলো ১৫ শতাংশ বা ২০ শতাংশ বা ২৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করে নির্ধারণ করা যাবে।
২. ২০ গ্রেড থেকে কমিয়ে ১৬ গ্রেড করা হলে অনেক দিক থেকে ভালো হতে পারে।
. প্রতি ৮ বছর পর পর যেন সকল চাকরিজীবির বেতন গ্রেড পরিবর্তন করা হয়, চাকরিজীবনে ন্যূনতম ৩ বার যেন উন্নীত গ্রেডে যাবার সুযোগ থাকে। এতে যেসব পদে প্রমোশনের সুযোগ নেই, সেসব পদে চাকরিজীবিদের মনে হতাশা কমবে। যেমন: তৃতীয় শ্রেণির চাকরিজীবি যারা, তারা ১২ তম গ্রেডে চাকরি শুরু করবে, এরপর প্রতি ৮ বছর পর পর নতুন গ্রেডে যেতে যেতে শেষে ৯ম গ্রেড পর্যন্ত পৌঁছবে, এভাবে ১ম শ্রেণির চাকরিজীবিরা ৪র্থ গ্রেডে চাকরি শুরু করবে, এরপর প্রতি ৮ বছর পর পর নতুন গ্রেডে যেতে যেতে ১ম গ্রেড পর্যন্ত পৌঁছবে। এতে কোনো শ্রেণির চাকরিজীবি নিজের শ্রেণি অতিক্রম করে উপরের শ্রেণি স্পর্শ করার সম্ভাবনাও থাকবে না, যা বর্তমান কাঠামোয় আছে এবং অযৌক্তিক।
৪. সরকারি চাকরিতে যেহেতু মোট ৪টি শ্রেণি, গ্রেড কমিয়ে ১৬টি করে নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৬টি গ্রেডকে ৪ শ্রেণি দিয়ে ভাগ করে প্রতি শ্রেণির প্রান্তিক গ্রেডকে সেই শ্রেণিতে নিয়োগের প্রারম্ভিক গ্রেড হিসেবে নির্ধারণ করা হোক। যেমন: প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবিদের নিয়োগ হবে ৪র্থ গ্রেডে, দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিজীবিদের নিয়োগ হবে ৮ম গ্রেডে। তাহলে সব শ্রেণির চাকরিজীবিই নিজের পদ, সম্মান ও বেতন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে; বর্তমান কাঠামোর অনেক জটিলতা এবং অসঙ্গতিও দূর হবে।

৫. বেতন কাঠামোয় বর্তমান ২০ গ্রেডের ভেতরে ভেতরে যেসব খুচরা খুচরা ধাপ রাখা হয়েছে, সেগুলো রাখার কোনো যৌক্তিকতা আছে কিনা, সে ব্যাপারে জনমত যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এগুলোর যৌক্তিকতা বা প্রয়োজনীয়তা নেই বলেই অধিকাংশ মানুষ মতামত দিতে পারে। সর্বশেষ গ্রেডের মূল বেতন ৯০০০ বা ১০,০০০ টাকা নির্ধারণ করে ১৫/২০/২৫ শতাংশ হারে প্রতি গ্রেডে বৃদ্ধি করা হলে খুচরা খুচরা ধাপগুলোর প্রয়োজনীয়তা একেবারে দূর হয়ে যাবে।

৬. বর্তমান কাঠামোয় গ্রেড উন্নীতকরণের পাশাপাশি বাড়িভাড়া কমানোর নিয়ম রাখায় উন্নীত গ্রেডে যাওয়াটা অনেকের জন্য বঞ্চনা ও হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাড়িভাড়া তো দিন দিন বাড়েই, কমে না। তাহলে কেন বাড়িভাড়া কমানো হবে? বাড়িভাড়া কমানোর নিয়ম উন্নীত গ্রেডে যাবার সাথে সাংঘর্ষিক। তাই এই নিয়ম বাতিল করা উচিত।

তবে এখনকার মতো ২০টি গ্রেড রাখলেও বড় ধরনের সমস্যা নেই। তখন প্রতিটি শ্রেণির জন্য গ্রেড হবে ৫টি। প্রতি গ্রেডের চাকরিজীবিকে নিয়োগ দেয়া হবে সেই শ্রেণির প্রাথমিক গ্রেডে। যেমন প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবিদের নিয়োগ হবে ৫ম গ্রেডে, তৃতীয় শ্রেণির চাকরিজীবিদের নিয়োগ হবে ১৫তম গ্রেডে। সেক্ষত্রে প্রত্যেক শ্রেণির চাকরিজীবিদেরকে চাকরিজীবনে চারবার উন্নীত গ্রেডে যাবার সুযোগ রাখতে হবে।
এককথায় প্রতি গ্রেডের ব্যবধান আনুপাতিক হারে সমান রাখতে হবে এবং সব শ্রেণির চাকরিজীবির জন্য সমান হারে প্রমোশন/উন্নীত গ্রেডে যাবার সুযোগ রাখতে হবে। তাহলেই বৈষম্য দূর হতে পারে।

নূর আহমদ : সরকারি চাকরিজীবি


লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত ও পরামর্শ জানাতে পারেন এই পেইজে: https://www.facebook.com/nurahmad.bangladeshi/posts/104529757819418

ডিম আগে, না মুরগী আগে?- এর উত্তরেই আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়

'ডিম আগে, না মুরগী আগে?' এক শাশ্বত ধাঁধাপূর্ণ প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তরের মীমাংসা নাকি নেই! অথচ এই এক প্রশ্নের আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় অকাট্যভাবে। বিশ্বাস না হলে বাকি অংশ পড়ুন...

কেউ বলে, ডিম আগে; কেউ বলে, মুরগী আগে। উভয় পক্ষের পক্ষে শক্ত (!) যুক্তি থাকার কারণে কোনো পক্ষই প্রতিপক্ষের যুক্তি মেনে নিতে চান না। এখনো বিশ্বের অনেক জ্ঞানী মানুষের কাছে এক সমাধানহীন প্রশ্ন এটি।

যারা মনে করে, ডিম আগে অস্তিত্ব লাভ করেছে,

পরে সেই ডিম থেকেই মুরগী হয়েছে এবং এভাবেই মোরগের বংশ বিস্তার লাভ করেছে, তাদের যুক্তি হলো, যেহেতু ডিম থেকেই মুরগীর বাচ্চা জন্ম নেয়, তাই পৃথিবীতে ডিমই আগে আসার কথা। তাই, যারা বলে মুরগী আগে এসেছে, তাদেরকে বলতে হবে, ডিম ছাড়া কিভাবে সেই মুরগীটি এসেছে?!

                 আরো পড়তে পারেন:     স্র্রষ্টা বলতে কি সত্যিই কিছু আছে?

অন্যদিকে যারা বলে, ডিম নয়, বরং মুরগীই পৃথিবীতে আগে এসেছে, তাদের যুক্তি হলো, মুরগী ছাড়া ডিমের অস্তিত্ব যেহেতু্ সম্ভব নয়, আর মুরগী থেকেই যেহেতু কেবল ডিম হতে পারে, তাই আগে মুরগী অস্তিত্ব লাভ করেছে, এরপর সেই মুরগী ডিম দিয়ে বাচ্চা জন্ম দেয়ার মাধ্যমেই মোরগের বংশ বিস্তার লাভ করেছে। তাই যারা বলে ডিম আগে এসেছে, তাদেরকে বলতে হবে কোনো মুরগী ছাড়া কিভাবে পৃথিবীতে ডিম অস্তিত্ব লাভ করেছে?

প্রকৃতপক্ষে এই প্রশ্নটির অবতারণা প্রথমে যেই ব্যক্তি করেছে এবং এখনো যারা প্রশ্নটির সদুত্তর খুঁজে অস্থির হচ্ছে, তাদের চিন্তাশক্তিএকেবারে অগভীর। কারণ প্রশ্নটি যে একেবারেই অবান্তর! যেহেতু, শুধু একটা ডিম বা একটা মুরগী থেকে পৃথিবীতে মোরগের বংশবিস্তার কখনোই সম্ভব নয়!

যদি শুধু একটা ডিম প্রথমে অস্তিত্বে আসতো, তাহলে ওই ডিমে ‘তা’ দেয়ার জন্য একটি মুরগীর প্রয়োজন নিশ্চয়ই হতো। তাছাড়া ডিম থেকে বাচ্চা হতে হলে যে মুরগীটি ডিম পেড়েছে, ডিম পাড়ার আগে তার সাথে কোনো ‘মোরগ’ -এর শারীরিক সম্পর্ক অবশ্যই প্রয়োজন হতো।

কোনো মুরগী-ই ডিমটিতে ‘তা’ দেয়া ছাড়া এবং ডিম পাড়ার আগে সেই মুরগীর সাথে কোনো একটি মোরগের শারীরিক সম্পর্ক ছাড়া সেটি থেকে বাচ্চা হবার প্রশ্নই আসে না। অপরদিকে যদি মনে করা হয়, প্রথমে একটিমাত্র মুরগী পৃথিবীতে অস্তিত্বলাভ করেছে এবং সেই মুরগীর ডিম থেকেই মোরগের বংশ বিস্তার লাভ করেছে, তাহলে এই প্রশ্ন থেকে যায়, যদি মুরগীটি ডিম দেয়, তাহলে কোনো মোরগের সাথে দৈহিক মিলন ছাড়া তো ডিমগুলোতে বীজ হবে না, তবু কী করে মুরগীটির ডিম থেকে বাচ্চা হলো?!

আসলে কোনো একটি ডিম বা মাত্র একটি মুরগী থেকে পৃথিবীতে মোরগের বংশবিস্তার হয়নি; একইসাথে একজোড়া মোরগ-মুরগীর আবির্ভাবের মাধ্যমেই পৃথিবীতে মোরগের বংশ বিস্তার লাভ করেছে।

এখন প্রশ্ন হলো, ১. অন্য প্রায় সব দিক থেকে একই রকম, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন লিঙ্গের দু’টি প্রাণি একই সাথে পৃথিবীতে কোত্থেকে এলো? ২. মাত্র কোনো এক লিঙ্গের এরকম একটি প্রাণি কেনো এলো না? ৩. তাছাড়া দু’লিঙ্গের দু’টি প্রাণি পৃথিবীর দু’প্রান্তে আবির্ভুত না হয়ে একসাথে একই জায়গায় আবির্ভুত হলো কেনো?

এটা নিশ্চয়ই একটা পরিকল্পিত বিষয়, যা কোনো মহশক্তিশালী সত্ত্বার কাজ। আল্লাহ তায়ালা সূরা ইয়াসিনের ৩৬ নাম্বার আয়াতে বলেন - سُبْحٰنَ الَّذِى خَلَقَ الْأَزْوٰجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنۢبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنفُسِهِمْ وَمِمَّا لَا يَعْلَمُونَ - "পবিত্র ও মহান সে সত্তা যিনি সকল জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছেন, যমীন যা উৎপন্ন করেছে তা থেকে, মানুষের নিজদের মধ্য থেকে এবং সে সব কিছু থেকেও যা তারা জানে না ।" সুবহানাল্লাহ!

পড়তে পারেন একটি বিশেষ নিবন্ধ: ভাইরাস এবং রোগজীবাণুর ধারণা বিজ্ঞান-সৃষ্ট ভুত!

দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত ‘‘ডিম আগে না মুরগি? জানুন সঠিক উত্তর’’ শিরোনামের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘‘২০১০ সালে এক বৃটিশ বিজ্ঞানী এক সুপার কম্পিউটারকে নিযুক্ত করলেন এই চিন্তার জন্য। সুপার কম্পিউটার ও বিজ্ঞানীরা মিলিতভাবে মুরগির জরায়ুতে এক স্পেশাল প্রোটিন পেল ওভোক্লেডিডিন-১৭ নামে। দেখা যাচ্ছে এই প্রোটিন ক্যালসিয়ামকে ক্যালসাইটিন ক্রিস্টাল বানিয়ে ডিমের খোলস বানাচ্ছে।

কুসুমের বৃদ্ধি ও নতুন মুরগির জন্ম হতে এই খোসা ও ফ্লুইড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী শেফিল্ড ও ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা ডিমের গঠন প্রক্রিয়ার ওপর সুপার কম্পিউটার জুম করেন। পরীক্ষা প্রমাণ করেছে ডিমের গঠনের জন্য ওসি-১৭ প্রোটিনের প্রয়োজন আবশ্যক।

এই প্রোটিনের ক্যালসিয়াম কার্বোনেটকে ক্যালসাইট ক্রিস্টালে পরিণত করে যা ডিমের শক্ত খোসার গঠন তৈরি করে। অনেক প্রাণীর শরীরের হাড়ের মধ্যেও ক্যালসাইট ক্রিস্টাল পাওয়া যায়। কিন্তু মুরগির শরীর যে কোনও প্রাণীর থেকে এই ক্রিস্টাল বেশি তাড়াতাড়ি তৈরি করে।

প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৬ গ্রাম করে ক্যালসাইট ক্রিস্টাল তৈরি হয় মুরগির শরীরে। শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিয়ারিং মেটিরিয়াল বিভাগের ড. কলিন ফ্রিম্যান জানিয়েছেন, অনেকদিন ধরেই মনে করা হত ডিম মুরগির আগে এসেছে। কিন্তু এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে মুরগি ডিমের আগে এসেছে।

ভারত ভিত্তিক দেওবন্দ মাদ্রাসার এক মুফতি বলেছেন, আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আ.)। তাকে আল্লাহ পাক পিতা মাতা ছাড়া সৃষ্টি করছেন এবং যুবক বয়স দান করছেন। তার সন্তান হচ্ছি আমরা, এজন্যই আমাদের বলা হয় আদম সন্তান।

এখন সেই সূত্রে প্রমাণিত হয় মানুষের মত সকল জীবের জম্ম মানুষ সৃষ্টির মতই। আদমের (আ.) মাধ্যমে যেমন আমরা ঠিক তেমন মুরগি থেকেই ডিম এবং পরে মুরগির জম্ম। এরকম সব প্রাণী তার পূর্ররূপ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। সুতরাং আমরা বলতে পারি ডিম নয়, মুরগি আগে।

ইরান ভিত্তিক একজন ধর্মীয় নেতা বলছেন, আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তায়ালা পবিত্র কোরআনের ৫১ নম্বর সূরা যারিয়াতের ৪৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন, আমি প্রত্যেক প্রাণী সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায়, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। এতে প্রমাণিত হয় আগে বীজ নয়, প্রাণীকে অর্থাৎ মুরগিকেই আগে পাঠানো হয়েছে।’’

দৈনিক যুগান্তর: ২৫ আগস্ট ২০১৮, লিঙ্ক: https://www.jugantor.com/useful/83496

ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ এগুলো কি বংশগত ভাবে হয়?

বিশ্বের প্রায় সব গবেষণার ফলাফল এবং ডাক্তারের মতামত হলো ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ এই রোগগুলোর একটা প্রধান কারণ বংশের কারো থাকা। বাবা-মা বা পূর্বপুরুষদের কারো থাকলে নাকি সন্তানের এই রোগগুলো হবার সম্ভাবনা খুব বেশি।

‘উচ্চ রক্তচাপে করণীয়’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি লেখায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ উচ্চ রক্তচাপের কারণ সম্পর্কে প্রথমে বলেন, ‘৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না, একে প্রাইমারি বা অ্যাসেন্সিয়াল রক্তচাপ বলে।’ পরে উচ্চ রক্তচাপের আশংকা বাড়ায়, এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ করতে গিয়ে প্রথমেই বলেন, ‘উচ্চ রক্তচাপের বংশগত ধারাবাহিকতা আছে, যদি বাবা-মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তবে সন্তানেরও উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার আশংকা থাকে।’

বাংলাদেশ প্রতিদিনে ২১ জুলাই ২০১৭ তারিখে ‘বংশগত কারণে কি হৃদরোগ হয়?’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি লেখায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট (কার্ডিওলজি)  ডা. এম শমশের আলী বলেন, ‘বাবা অথবা মা যে কোনো একজনের কার্ডিওমাইওপ্যাথি রোগ থাকলে ৫০ ভাগ ছেলেমেয়ে এ রোগে আক্রান্ত হবে এটা স্বতঃসিদ্ধ।
কিছুদিন আগে এক রোগী দেখলাম। বয়স ৪০ থেকে ৪২ বছরের মতো হবে। পুরুষ মানুষ, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। ভদ্রলোক বিগত চার-পাঁচ দিন যাবৎ বুকে ও পিঠে চাপের মতো অনুভব করছেন এবং স্বামী-স্ত্রী দুজনেই এতে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
সামান্য বুক-পিঠ ব্যথায় এত বেশি উদ্বিগ্নতা দেখে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ২-৩ মাস আগে তার বড় ভাই হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং দুই বছর আগে তার জন্মদাতা পিতাও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এখন নিশ্চয়ই আর বুঝতে বাকি থাকল না যে, তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। বেশকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এটা স্পষ্ট হলো যে, রোগীর হার্টের দেয়াল পুরু হয়ে গেছে, তাও আবার সাধারণ মানুষের হার্টের দেয়ালের তুলনায় প্রায় দেড়গুণ। এ ধরনের সমস্যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় কার্ডিওমাইওপ্যাথি বলা হয়। সচরাচর এসব রোগী সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে থাকেন বা তারা নিজেরাও কখনো হার্টের অসুস্থতার কোনোরূপ লক্ষণ তার শরীরে বিদ্যমান আছে, তা অনুভব করেন না। তবে এসব রোগী যদি কখনো অতিমাত্রায় পরিশ্রম করতে যান, তখন কারও কারও বুকে চাপ বা ব্যথা অনুভূত হতে পারে বা অত্যধিক ক্লান্ত হয়ে যেতে পারে, আবার এ সময় অনেকের বুক ধড়ফড় বা মাথা ঘোরাতে পারে। এ ধরনের লক্ষণকে সব সময় মারাত্মক হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং দ্রুততার সঙ্গে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। কার্ডিওমাইওপ্যাথি এমন এক ধরনের হৃদরোগ যাকে পুরোপুরি বংশগত হৃদরোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে এবং বংশগত অনেক হৃদরোগের মধ্যে কার্ডিওমাইওপ্যাথিতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকে। বাবা অথবা মা যে কোনো একজনের কার্ডিওমাইওপ্যাথি রোগ থাকলে ৫০ ভাগ ছেলেমেয়ে এ রোগে আক্রান্ত হবে এটা স্বতঃসিদ্ধ।’

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে দৈনিক যুগান্তরে ‘ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস’ (বাংলাদেশ) উপলক্ষ্যে ‘প্রতিরোধই বাঁচার উপায়’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যা লিখেছেন বাংলাদেশের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান; বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির চিফ কো-অর্ডিনেটর ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। তিনি সেখানে লিখেন, ‘রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে এবং পরিবেশের প্রভাবে হয়।...যাদের বংশে রক্ত-সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স ৪০-এর ওপর এবং যারা শরীরচর্চা করেন না- গাড়ি চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন, তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’

তাছাড়া বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে কোনো ডায়াবেটিস রোগী গেলে প্রায় সব ডাক্তার খুব কমন একটি প্রশ্ন করেন রোগীকে, ‘আপনার বাবা-মা কারো কি ডায়াবেটিস ছিল?’ রোগী ‘হ্যাঁ’ বললেই হলো। ডাক্তার নিশ্চিন্তে এরকম কথা বলে ফেলেন, ‘আপনার রোগটি তাহলে বংশগত।’ ডাক্তারদের এই মন্তব্যগুলো সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন অসংখ্য মানুষ ডায়াবেটিস রোগটিকে বংশগতই মনে করছে।

রোগ তিনটি যে বংশগত নয়, তা নিয়ে এ লেখায় বেশ কয়েকবার আলোচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে ৫ এবং ৬ নং অধ্যায়ে। তবু বিষয়টা সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরো পরিষ্কার করার জন্য ভিন্ন অধ্যায়ে আলোচনা করা প্রয়োজন মনে হয়েছে।

এক. যারা বলে থাকেন রোগ তিনটি বংশগত কারণে অনেকের হয়ে থাকে, তাদের কেউ কি এটা অস্বীকার করেন, এই তিনটি রোগের জন্য শরীরে কোলেস্টেরলের আধিক্য প্রধান দায়ী?
যদি অস্বীকার না করেন, তাহলে বলতে হবে, যেসব মানুষের বাবা-মা বা বংশের পূর্ব-পুরুষের কেউ রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়েছে, যদি সেসব মানুষ শৈশব থেকেই বা রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার আগেই যে কোনো উপায়ে শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে না দেয় (যেমন: নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যায়াম করার ফলে বা কায়িক শ্রমের পেশায় জড়িত থাকার কারণে এমনিতেই দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘন্টা কায়িক শ্রম হয়ে যায়, যার ফলে ওদের শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে না), তবুও কি তাদের শরীরে তাদের পূর্বপুরুষের কারো রোগগুলো থাকার কারণে রোগগুলো জন্ম নেবেই?

দুই. ৫০ বছরের কম বয়সী যেসব লোক এখন এসব রোগে আক্রান্ত, দেখা যাবে তাদের কারো কারো বাবা-মায়েরও হয়তো এসব রোগ ছিল/আছে। কিন্তু ৭০ বছরের বেশি বয়সী যারা এখন এসব রোগে আক্রান্ত, তাদের মধ্যে এমন লোক খুব কম পাওয়া যাবে, যাদের বাবা-মা কেউ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়েছেন বা ডায়াবেটিস/উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মারা গেছেন। দেখা যাবে, এ বয়সী লোকদের প্রায় সবার বাবা-মা অন্য কোনো রোগে মারা গেছেন। তাই ৫০ বছরের কম বয়সী রোগীদের ক্ষেত্রে তাদের রোগটিকে অনেক ডাক্তার বংশগত বলার সুযোগ থাকলেও ৭০ বছরের বেশি বয়সী রোগীদের ক্ষেত্রে রোগটিকে বংশগত বলবেন কিভাবে!

তিন. আমার যে ভগ্নিপতির কথা দিয়ে এ লেখা শুরু করা হয়েছে, তিনি উচ্চ রক্তচাপের পাশাপাশি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কষ্টকর জীবন যাপন করছেন। তাঁর দু’জন বোনের একজন হার্ট অ্যাটাকেই মারা গেছেন, আরেকজন হার্ট অ্যাটাক এবং সমজাতীয় রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়ে কষ্টকর জীবন কাটাচ্ছেন। তাঁর আরও দু’ভাই হার্ট অ্যাটাক এবং সমজাতীয় রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়ে শেষে হার্ট অ্যাটাকেই মারা যান। তাঁর বাবা বা মা যদি হার্ট অ্যাটাকে মারা যেতেন, ডাক্তাররা অবশ্যই তাঁর বা তাঁর ভাই-বোনদের হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়াকে বংশগত রোগ বলে দিতেন নির্দ্বিধায়। কিন্তু তাঁর বাবা-মা কেউই হার্ট অ্যাটাকে মারা যাননি, তাঁকে জিজ্ঞেস করে বিষয়টা জানতে পেরেছি।

আমাদের বিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের নাম মরিয়ম বেগম। তাঁর একটা ছেলে ২০১৬ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠার কিছুদিনের মধ্যেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে বসে। ছেলেটি তখন স্থূল ছিল। ডাক্তারের কাছে নেয়ার পর ডাক্তার অবশ্য তার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়াকে বংশগত বলেননি। হয়তো বলতেন যদি তার বাবা-মা কারো রোগটি থাকতো। তার বাব-মা অবশ্য পরে কখনো রোগটিকে যে আক্রান্ত হবে না, তা বলা যায় না। জানি না, তখন আবার ডাক্তার বলে বসেন কিনা, ওর ডায়াবেটিস হওয়ার কারণেই ওর বাবা-মা ডায়াবেটিস হয়েছে?!

আমার মেঝো ভাইয়ের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার কথাও এ লেখায় বলা হয়েছে। তিনি উচ্চ রক্তচাপে যখন আক্রান্ত হন, তখন আমার বাবা-মা কারো উচ্চ রক্তচাপ ছিল না। পরে একসময় আমার বাবা-মা সাংসারিক কাজকর্ম অনেকটা ছেড়ে দেয়ার পর উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন। এখন কি বলা যাবে, সন্তানের উচ্চ রক্তচাপ তার বাবা-মায়ের শরীরেও সংক্রমিত হয়?!

আমার ছোট বোনের একমাত্র ননদের স্বামী ৩৫ বছরের মতো বয়সে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে কর্মরত অবস্থায় হার্ট অ্যাটাকে মারা যান বছর তিনেক আগে, যখন তাঁর বাবা-মা কেউ হার্ট অ্যাটাক বা সমজাতীয় বাকি রোগ দু’টিতে আক্রান্ত হয়নি। বাংলাদেশে এমন অসংখ্য মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা চল্লিশ বছর বয়সের আগেই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন, অথচ তাদের বাবা-মা কেউ তখনো হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্তও হননি, মারা যাওয়া দূরের কথা। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী এরকম লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের বাবা-মা কেউ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতে না হতে নিজেরা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে যায় কি ভুলবশত? অর্থাৎ তাদের বাবা-মা আগে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হবার কথা, তারা আক্রান্ত হলে তাদের সন্তানরা উত্তরাধিকার সূত্রে পরে আক্রান্ত হবে। কিন্তু হার্ট অ্যাটাক ভুল করে আগে সন্তানকে আক্রমণ করে বসেছে! এমন হওয়া কি সম্ভব? সম্ভব না হলে রোগগুলোকে বংশগত বলা যাবে কিভাবে?

চার. যেসব লোকের ক্ষেত্রে বলা হয়, তারা তাদের বাবা-মায়ের কেউ এসব রোগে আক্রান্ত হবার কারণেই রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়েছে, সেসব লোকের বাবা-মায়ের পূর্বপুরুষেরও এসব রোগ ছিল কিনা, তা কি কোনো ডাক্তার যাচাই করে দেখেন? যদি তৃতীয় পক্ষ (শেষ প্রজন্ম) বাবা-মায়ের পক্ষ থেকে এসব রোগের উত্তরাধিকারী হয়, তাহলে দ্বিতীয় পক্ষও নিশ্চয় তাদের বাবা-মা থেকে এসব রোগের উত্তরাধিকারী হবার কথা। কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যায়, এখন যারা এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের তেমন কারোই দাদা-দাদী বা নানা-নানী এসব রোগে আক্রান্ত হয়নি। তাহলে তাদের রোগগুলো বংশগত বা জিনগত হলো কিভাবে?! ‘জিনগতভাবেও রোগগুলো বংশপরম্পরায় সংক্রমিত হয়’, কথাটি তখনই সত্য হবে, যখন কারো রোগগুলো হবার পর দেখা যায়, তার পূর্বপুরুষদের যত সিঁড়ির খবর নেয়া যায়, সবাই রোগগুলোতে আক্রান্ত ছিল। যদি শুধু বাবা-মা কারো থাকে, কিন্তু দাদা-দাদী কারো না থাকে, তাহলে রোগগুলোকে বংশগত বলা হবে চরম ভুল।

পাঁচ. ২০ বছরের কম বয়সী যেসব শিশু-কিশোর এখন ডায়াবেটিস বা সমগোত্রীয় কোনো রোগে আক্রান্ত, যদি ওরা ওদের বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাবে এদের বাবা-মা কেউই এখনো রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়নি। তবে প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাবে, এরা স্থূল (বেশি বেশি খাওয়ার কারণে বা শারীরিক পরিশ্রমের সাথে খুব কম জড়িত থাকার কারণে)। এসব শিশু-কিশোরের অধিকাংশের পিতামাতা-ই যদি এখনো ডায়াবেটিসসহ সমগোত্রীয় রোগগুলোতে আক্রান্ত না হয়ে থাকে, তাহলে অল্প অংশের উপর ভিত্তি করে এদের এসব রোগে আক্রান্ত হওয়াকে বংশগত বলা কিভাবে ঠিক হবে? আর যেহেতু এদের প্রায় সবাই স্থূল, আর স্থূলতা থেকেই অনেকে এসব রোগে আক্রান্ত হয়, তাই স্থূলতাকে এদের এসব রোগে আক্রান্ত হবার জন্য দায়ী করতে অসুবিধা কোথায়?

আর ২০ বছরের কম বয়সী যেসব শিশু-কিশোর এসব রোগে আক্রান্ত, সে প্রথম সন্তান হোক বা শেষ সন্তান হোক, যদি দেখা যায় ওর বাবা-মাও এসব রোগে আক্রান্ত, দেখা যাবে ওর বাবা-মা শারীরিকভাবে স্থূল, না হয় শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে বা খাওয়া-দাওয়ায় রসিক। ওর বাবা-মা যে কারণে রোগগুলোতে আক্রান্ত, সে-ও একই কারণে রোগগুলোতে আক্রান্ত হতে পারে। ওর রোগটাকে তখন বংশগত বলার কোনো মানে নেই।

ছয়. বিষয়টা নিয়ে আগের আলোচনায় একটা যুক্তি দেয়া হয়েছে এভাবে, ডাক্তাররা এমন অসংখ্য মানুষের এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়াকে বংশগত বলে থাকেন, যারা জন্মের সময় তাদের বাবা-মা কারো রোগগুলো ছিল না, তাদের থাকা তো দূরের কথা। পরে তাদের বাবা মা হয়তো ৬০-৭০ বছর বয়সে রোগগুলোতে আক্রান্ত হলো এবং তারা রোগগুলোতে আক্রান্ত হলো তাদের বয়স যখন ৩০-৪০ বছর। তাদের জন্মের সময় তাদের বাবা-মায়ের যে রোগগুলো ছিল না, তাদের জন্মের ৩০-৪০ বছর পর তাদের বাবা-মাকে যে রোগগুলো আক্রমণ করলো, সে রোগগুলো তাদের জন্মের ৩০-৪০ বছর পর তাদের বাবা-মায়ের শরীর থেকে তাদের শরীরে আসে কিভাবে?! বায়ুবাহিত না হলে এমন হওয়া সম্ভব নয়।

এই লেখায় এ কথাটা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে বলা হয়েছে, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ এই তিনটি রোগের মূল কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা। যদি শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরের থাকার পাশাপাশি কেউ বেশি বেশি খায় বা মুটিয়ে যায়, তার এ রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রায় শতভাগ।

যদি কারো বাবা-মা বা পূর্বপুরুষ কেউ রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়, আর সে এখনো রোগগুলোতে আক্রান্ত না হয়, তাহলে নিয়মিত অন্তত এক ঘন্টা যে কোনো উপায়ে শারীরিক পরিশ্রম করলে সে এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ থাকার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। কোনো কারণে যদি কেউ কখনো শারীরিক পরিশ্রম করতে অক্ষম হয়ে পড়ে, তখনই শুধু সে রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।
রোগগুলোকে বংশগত রোগ বলার কারণে কমপক্ষে দুই শ্রেণির মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়- (১) যাদের এখনো রোগগুলো হয়নি, তারা যখন জানে রোগগুলো বংশগত, তখন দেখে নিজের বাবা-মা কারো রোগগুলো হয়েছে কিনা। যদি দেখে হয়নি, তখন সে রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়া থেকে নিশ্চিন্ত থাকে, রোগগুলো প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করে না। এভাবে একসময় সে রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, সত্যিকারার্থে যে কারণে রোগগুলো হয় সে কারণে। (২) যেসব লোকের বাবা-মা কেউ রোগগুলোতে ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়ে গেছে, তারা যখন জানে, রোগগুলো বংশগত, তখন তাদের মনে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, কখন তারা আবার রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়ে বসে! এই আতঙ্ক তাদের মন থেকে কোনোভাবে দূর করা যায় না এবং রোগগুলো প্রতিরোধের কোনো চেষ্টাই তারা করে না। কারণ রোগগুলো যে বংশগত! এভাবে একসময় এরাও রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

এই দু’রকম ঘটনা এখন সমাজে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে শুধুই রোগগুলোকে বংশগত বলে অপপ্রচারের কারণে। আশা করি এই অপপ্রচার বন্ধ হবে।

হ্যাঁ, রোগগুলোকে তখনই বংশগত বলার সুযোগ থাকবে, যখন দেখা যাবে কোনো শিশু মাতৃগর্ভে আসার পর থেকে মায়ের দুধ খাওয়া পর্যন্ত সময়ে ওর বাবা-মা কারো রোগগুলো থাকে এবং শিশুটি ভুমিষ্ট হবার পর পরই বা মায়ের দুধ পান করা শেষ হতে না হতেই রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। শিশুটি মাতৃগর্ভে আসার পর থেকে মায়ের দুধ খাওয়া পর্যন্ত সময়ে যদি ওর বাবা-মা কারো রোগগুলো না থাকে এবং ভুমিষ্ট হবার কয়েক বছর পর বা মায়ের দুধ পান শেষ হবার কয়েক বছর পর যদি ওর বাবা-মা কারো শরীরে রোগগুলো দেখা দেয়ার পর পরে কখনো শিশুটিও রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়, তখন শিশুটির রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়াকে বংশগত বলার কোনো সুযোগই থাকবে না। কারণ বাবা-মায়ের ঐসব রোগই কেবল সন্তানের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে, যেসব রোগ সন্তান মাতৃগর্ভে আসার পর থেকে মায়ের দুধ খাওয়া পর্যন্ত সময়ে বাবা/মা কারো থাকে এবং ঐ সময়েই সন্তানের দেহে সংক্রমিত হয়। এসময় যদি বাবা-মা কারো শরীরে রোগগুলো না থাকে বা থাকলেও সন্তানের শরীরে সংক্রমিত না হয়, তাহলে পরে আর সংক্রমিত হবার কোনো সুযোগ থাকে না। বায়ুবাহিত রোগ হলে ভিন্ন কথা। কিন্তু ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ এগুলো বায়ুবাহিত রোগ নয়।

শিশু মাতৃগর্ভে আসার পর থেকে মায়ের দুধ খাওয়া পর্যন্ত সময়ে যদি বাবা/মা কারো রোগগুলো থাকে এবং তাদের শরীর থেকে তার শরীরে এরকম কোনো রোগ সংক্রমিত না হয়, তাহলে পরে যতদিন সে বেঁচে থাকে, যদি সে নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম (খেলাধুলা, হাঁটা, সাঁতার, শারীরিক শ্রমের যে কোনো কাজ ইত্যাদি) করার পাশাপাশি স্থূলতা, বেশি খাওয়া থেকে দূরে থাকতে পারে, তার শরীরে রোগগুলো জন্ম নিতে পারবে না। আর যদি কোনো সন্তান জন্মের অনেক বছর পর ওর বাবা-মা কেউ রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়, তাহলে তো কোনোভাবেই রোগগুলো সন্তানের শরীরে সংক্রমিত হতে পারবে না।

ডাক্তারদের মধ্যে একটা সাধারণ প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে, যা মানুষকে মারাত্মকভাবে বিভ্রান্ত করছে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগে আক্রান্ত কোনো রোগী ডাক্তারের কাছে গেলে অনেক সময় ডাক্তার প্রথমে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার বাবা/মা কারো কি রোগটি ছিল?’ রোগী ‘হ্যাঁ’ বললে ডাক্তার সাথে সাথে মন্তব্য করে, ‘তাহলে আপনার রোগটি বংশগত’। কিন্তু রোগী যদি ‘না’ বলেন, তখন ডাক্তার অন্য কোনো কারণে রোগটি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, যেসব রোগীর বাবা/মা কারো রোগটি ছিল না, সেসব রোগী যে কারণে রোগটিতে আক্রান্ত হয়েছে, ঐ একই কারণেই ঐসব রোগীও কি রোগটিতে আক্রান্ত হতে পারে না, যাদের বাবা/মা কারো রোগটি ছিল?
কোনো রোগের সঠিক কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা না করে রোগটি রোগীর বাবা/মা কারো থাকার কথা জেনেই রোগটিকে বংশগত বলে ফেলা যে ক্ষতিকর, ডাক্তাররা তা বুঝতে পারলে কখনোই এভাবে মন্তব্য করতেন না।

পুরো বই শুরু থেকে পড়তে হলে: https://waytogainlonglife.blogspot.com/2019/03/blog-post.html

ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ এই রোগগুলো কি বয়স বাড়ার সাথে সম্পর্কিত?

ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ এ রোগগুলোকে অনেকে বয়স বাড়ার সাথে সম্পর্কিত করে ফেলেন। বলে থাকেন, বয়স বাড়ার সাথে সাথে রোগগুলো মানুষের শরীরে সৃষ্টি হয়। এরকম কথা শুনলে রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়াকে সবাই ভাগ্যের উপরই ছেড়ে দেবে। মানুষ রোগগুলো থেকে নিজেদেরকে রক্ষার ব্যাপারে হতাশ হবে। রোগগুলো প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করবে না।

jw.org নামক একটি ওয়েবসাইটের বাংলা সংস্করণে প্রকাশিত ব্রাজিলের সচেতন থাক লেখক কর্তৃক লিখিত ‘উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধের ‘(উচ্চ রক্তচাপের) যে কারণগুলো আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না’ শিরোনামের অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন যে, যদি একজন ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনদের উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তা হলে তার ওই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। পরিসংখ্যান দেখায় যে, যেসব যমজ ব্যক্তি দুটো নিষিক্ত ডিম্ব থেকে জন্ম নিয়েছে তাদের তুলনায় একই নিষিক্ত ডিম্ব থেকে জন্ম নেওয়া ব্যক্তিরা উচ্চ রক্তচাপে বেশি আক্রান্ত হয়। একটা গবেষণা “ধমনীয় হাইপারটেনশনের জন্য জিনের অবস্থান দায়ী” বলে নির্দেশ করে, যার সমস্ত কিছুই বংশগতভাবে পাওয়া উপাদানের অস্তিত্বকে নিশ্চিত করে আর তা উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী। এটাও জানা যায় যে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্বাভাবিক উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় এবং এটা কালো চামড়ার পুরুষদের বেলায় বেশি দেখা যায়।’ [https://wol.jw.org/bn/wol/d/r137/lp-be/102002246]

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। দিবসটি উপলক্ষ্যে ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক যুগান্তরে ‘প্রতিরোধই বাঁচার উপায়’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির চিফ কো-অর্ডিনেটর ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। তাতে তিনি লিখেন, ‘রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে এবং পরিবেশের প্রভাবে হয়। কখনও কখনও অন্যান্য রোগের ফলেও হয়ে থাকে। এ রোগ সব লোকেরই হতে পারে।... যাদের বংশে রক্ত-সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স ৪০-এর ওপর এবং যারা শরীরচর্চা করে না-গাড়ি চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন, তাদের ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা বেশি।’

মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার বাংলা সংস্করণে বয়স বেশি হওয়াকেও হৃদরোগের একটি কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে হৃদরোগ সম্পর্কে একটি পরিচিতিমূলক নিবন্ধে হৃদরোগের ঝুঁকির জন্য যে বিষয়গুলোকে দায়ী করা হয়েছে, তন্মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে বয়স বেশি হবার কথা। বলা হয়েছে, ‘হৃদরোগের পিছনে বয়স সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। দেখা গেছে, ৬৫ বছরের বেশি ব্যক্তিদের ৮২ শতাংশ হৃদরোগে মারা গিয়েছেন।’

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়, এমন কথা বলছে কলকাতার (ভারত) আনন্দবাজার পত্রিকা। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘উচ্চ রক্তচাপ? সাবধান!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি তৈরি করেন রুমি গঙ্গোপাধ্যায়। সেখানে উচ্চ রক্তচাপের ৫টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, যার প্রথমটি হলো- ‘বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে (রক্তচাপ বাড়ে)। বয়সের সঙ্গে রক্তচাপ সমানুপাতিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে প্রতি তিন জনের মধ্যে এক জন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। বয়স ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে হলে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন প্রতি ১০ জনের মধ্যে ১ জন। আর পঞ্চাশের কোঠায় বয়স হলে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন প্রতি ১০ জনে ৫ জন। বয়স ৭০ বা তার বেশি হলে প্রতি দুই জনের মধ্যে এক জনের উচ্চ রক্তচাপ থাকবে।’

৩১ অক্টোবর ২০১৭ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিনে উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ক একটি নিবন্ধ ছাপা হয় ‘উচ্চ রক্তচাপের ১০ কারণ’ শিরোনামে। সেখানে উচ্চ রক্তচাপের ১০টি ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ উল্লেখ করা হয়েছে, যার প্রথমটি হচ্ছে- ‘উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিও বাড়ে। বয়স্ক ব্যক্তি হলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।’

বয়স বাড়ার সাথে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের সম্পর্ক আছে, এমন কথার পক্ষে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নেয়া উপরের বক্তব্যগুলো সম্পর্কে আমি কিছু না বলে প্রথমে কিছু ডাক্তারের বক্তব্য উল্লেখ করছি।

০৯ অক্টোবর ২০১৭ তারিখের প্রথম আলোয় ‘কম বয়সেই উচ্চ রক্তচাপ?’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়, যা লিখেছেন ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শরদিন্দু শেখর রায়। তিনি লেখাটিতে বলেন, ‘অনেকে ভাবেন অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে না। এটা বৃদ্ধদের রোগ। আসলে তা নয়। নানা কারণেই অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। ইদানীং অপেক্ষাকৃত কম বয়সে, ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যেই উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিচ্ছে। এ জন্য নানা বদ অভ্যাসও দায়ী। অতি লবণযুক্ত ফাস্ট ফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ওজন বৃদ্ধি ও কায়িক শ্রমের অভাব অল্পবয়সী মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ...’

২৪ আগস্ট ২০১৭ তারিখের দৈনিক সমকালে ‘ছোটদের ডায়াবেটিস ও করণীয়’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়, যা লিখেছেন ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম। তিনি বলেন, ‘জীবনযাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অল্প বয়সে ডায়াবেটিস রোগ ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছে।... কিছুদিন আগেও অল্প বয়সের ডায়াবেটিসকে টাইপ-১ (ইনসুলিননির্ভর) ডায়াবেটিস বলে প্রায় সর্বক্ষেত্রে ধরা হতো। কিন্তু ইদানীং স্থূলকায় শিশুদেরকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে।... বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মোটা হওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। কারণ ছোটরা পরিশ্রম ও খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত। খাওয়া-দাওয়া প্রধানত এখন চটজলদি ফাস্টফুড বা ফ্রায়েড চিপস্, চকোলেট। খেলাধুলার বদলে টিভিতে কার্টুন দেখেই সময় কাটায় তারা। আর গতিবিধি ফ্ল্যাটের মধ্যে সীমাবদ্ধ।’

বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ৩০৭৯তম পর্বে কথা বলেছেন জালালাবাদ রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আয়েশা রফিক চৌধুরী। অনুষ্ঠানটির অলোচ্য বিষয় ছিল ‘অল্প বয়সে হৃদরোগ কেন হয়?’ এনটিভির ওয়েবসাইটে অনুষ্ঠানটির ভিডিওসহ আলোচ্য বিষয়টি প্রকাশ করা হয় ৬ মে ২০১৮ তারিখে। সেখানে ডা. আয়েশা রফিক চৌধুরীকে অল্প বয়সে হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আগে আমরা ধরে নিতাম হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক শুধু বয়স্কদের সমস্যা। এটা এখন আর বদ্ধমূল ধারণার মধ্যে নেই। দেখা যাচ্ছে, তরুণ প্রজন্ম যারা, যারা ২৫ থেকে ৩৫-এর মধ্যে রয়েছে, একদম তরুণ যাদের আমরা মনে করি, তাদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। এর কারণ হিসেবে দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে আমাদের জীবনযাপনটাই বেশি দায়ী। যেমন আমরা বেশিরভাগ সময়ই বসে থাকি, টিভির পাশে অথবা ল্যাপটপে, অথবা মোবাইলে- এই যে সেডেন্টারি জীবনযাপন, অথবা কাজ না করা বা ব্যায়াম না করা, যেটা আমরা ঠিক করতে পারছি না।...’ [https://www.ntvbd.com/health/194191]

বয়স বাড়ার সাথে রোগগুলো সৃষ্টি হবার কথা যারা বলেন, তারা খুব ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করে যে কথা বলেন না, মনগড়া কথা বলেন, তা এ তিনজন ডাক্তারের বক্তব্য পড়ে তারা উপলব্ধি করবেন আশা করি। তারা বয়স বাড়ার সাথে সাথে রোগগুলো মানুষের শরীরে জন্ম নেবার কথা যখন বলেন, তখন এ দিকে লক্ষ্য করেন না যে, ইদানিং মানুষ অল্প বয়সেও রোগগুলোতে ব্যাপকহারে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে। ‘উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে’ শিরোনামে বিবিসি বাংলায় ১৭ মে ২০১০ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ডা: বদিউজ্জমান বলছেন, সাধারণত ৪০-উর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা দেখা গেলেও এখন আমরা এর চেয়ে কমবয়সীদের মধ্যেও উচ্চ রক্তচাপের প্রবনতা দেখছি।’ [https://www.bbc.com/bengali/news/2010/05/100517_tbbdhypertension]

‘কেন শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগ বাড়ছে’ শিরোনামে বিবিসি বাংলায় ১৩ অগাস্ট ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পাঁচ থেকে নয় বছরের বাচ্চাদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচেছ।’  [https://www.bbc.com/bengali/news-40916558]

কোন বয়সে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি, এ বিষয়ে বাংলাদেশের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৯৭১তম পর্বে কথা বলেন কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নূর আলম। অনুষ্ঠানটির পুরো আলোচনা ফিচার আকারে প্রকাশিত হয় এনটিভির ওয়েবসাইটে ২০ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে ‘কোন বয়সে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি?’ শিরোনামে। আলোচনায় ডা. নূর আলম বলেন, ‘আসলে আগে মনে করা হতো, বয়স কম, হার্ট অ্যাটাক হবে না। মনে করা হতো কম বয়সে হার্ট অ্যাটাক হয় না। সাধারণত প্রবীণদের হার্ট অ্যাটাক হতো, তবে আমরা এখন যেটা দেখছি, তরুণ বয়সেও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এটি স্বাভাবিক। তবে ৩০ থেকে ৪৫, এই বয়সে হার্ট অ্যাটাকটা হয়। খুব প্রবীণদের তুলনায় ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সী যারা, তাদের হার্ট অ্যাটাকটা বেশি হয়। তারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এ বিষয়ে। তবে যেকোনো বয়সেই হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।’

জার্মানীর জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের (বাংলা) ওয়েবসাইটে ১৪.১০.২০১৭ তারিখে ‘ভারতে তরুণ প্রজন্মের পুরুষদের মধ্যে হৃদরোগ বিশ্বে সর্বাধিক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ‘৬৮ শতাংশ কার্ডিওলজিস্ট মনে করেন,  হৃদরোগের কোনো বয়স নেই, যে-কোন বয়সেই তা হতে পারে।’  [https://www.dw.com/bn/a-40942842]

সুতরাং এটাই সত্য, রোগগুলো এখন আর মানুষের বয়স বাড়ার জন্য অপেক্ষা করে না, যতো আগে সুযোগ পায়, মানুষকে আক্রমণ করে বসে। ‘সুযোগ’? কী সেই সুযোগ?

এ লেখার একাদশতম পরিচ্ছেদে (হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের প্রতিষেধক) সুযোগটির কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘মানুষের অলসতা, শারীরিক পরিশ্রম ছেড়ে দেয়া, আরামপ্রিয় লাইফস্টাইল আর শরীরে মেদ-চর্বি বৃদ্ধির সুযোগে যে রোগগুলোর জন্ম, সেগুলোর প্রতিষেধক বিজ্ঞান কিভাবে আবিষ্কার করবে!’ বয়স বাড়ার সুযোগে রোগগুলো মানুষকে আক্রমণ করে না, শারীরিক পরিশ্রম ছেড়ে দেয়ার সুযোগেই রোগগুলো মানুষের শরীরে বাসা বাঁধে।

বয়স বাড়ার পর যদি রোগগুলো মানুষকে আক্রমণ করতো, তাহলে যারা ৬০-৭০ বছর বয়স পর্যন্ত শারীরিক পরিশ্রমের পেশায় নিযুক্ত থাকে, তাদের শরীরে রোগগুলো জন্ম নেয় না কেন? আমাদের দেশে যারা রিকশা (পায়ে চালিত) চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে, বয়স ৭০/৮০ বছর হয়ে গেলেও তাদের কারো শরীরে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপ জন্ম নেয় না। কারণ তারা সারাদিন শারীরিক পরিশ্রম করে, ঘাম ঝরায়; শরীরে চর্বি-কোলেস্টেরল বাড়তে দেয় না।

পক্ষান্তরে যারা আরামে থাকতে পছন্দ করে, বেশি বেশি খায়, স্বাস্থ্যবান (মোটা হওয়াকে আমরা অনেকে স্বাস্থ্যবান মনে করি) হতে পছন্দ করে, শরীরে চর্বি-কোলেস্টেরল জমায়, তারা অনেকে ৩০/৩৫ বছর বয়সেও রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ৬০ বছর বয়সের আগেই এরা অনেকে পৃথিবী ত্যাগ করতেও বাধ্য হয়।
সুতরাং রোগগুলোর সম্পর্ক বয়স বাড়ার সাথে নয়, বরং শারীরিক পরিশ্রমহীন থাকার সাথে; শরীরে চর্বি-কোলেস্টেরল বাড়ার সাথে; বেশি বেশি খাওয়ার সাথে। মনগড়া কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করলে মানবজাতিরই ক্ষতি। মানুষ যতদিন বেশি বেশি শারীরিক পরিশ্রম করবে/পর্যাপ্ত ব্যায়াম করবে, চিকন থাকবে, পরিমিত খাবে, ততদিন রোগগুলো মানুষকে স্পর্শ করার সাহস পাবে না, বয়স যতো বেশি হোক। হাজার বার যাচাই করলেও এই কথাটি ভুল প্রমাণ করা যাবে না।

পুরো বই শুরু থেকে পড়তে হলে: https://waytogainlonglife.blogspot.com/2019/03/blog-post.html

টেনশনে কি হার্ট অ্যাটাক (হৃদরোগ) হয়?

‘টেনশনে কি হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক হয়?’ প্রশ্নটির উত্তর এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার এ লেখায় বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে দেয়া হয়েছে। তবু হয়তো অনেকে আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। অসংখ্য শক্তিশালী গবেষণা, অসংখ্য ডাক্তারের দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য এবং সাধারণ মানুষের খুব কমন ধারণার বিপরীতে গিয়ে আমি এটা বলেছি এবং প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি যে, হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক টেনশন বা মানসিক অস্থিরতার জন্যও হতে পারে, তবে মানসিক অস্থিরতা রোগটির মূল বা প্রত্যক্ষ কারণ নয়। রোগটির মূল কারণ হচ্ছে, কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকা বা কায়িক শ্রম কম করা, আরামপ্রিয় লাইফস্টাইল, মুটিয়ে যাওয়া, মনের চাহিদামতো খাওয়া, সর্বোপরি শরীরে চর্বি/কোলেস্টেরল বাড়তে দেয়া ইত্যাদি।

যেসব লোক দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম করে, শরীর হালকা রাখে, পরিমিত খায়, তারা যত টেনশন করুক, হৃদরোগে আক্রান্ত হয় না। পক্ষান্তরে যারা শারীরিক পরিশ্রমের কাজে জড়িত নয় বা খুব কম জড়িত, স্থূল, খাওয়া-দাওয়ায় সংযম অবলম্বন করে না, শরীরে চর্বি বাড়তে দেয়, তারা টেনশন না করলেও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। এজন্য দেখা যায়, অনেক মানুষ, ব্যক্তিগত জীবনে সুখী, তেমন কোনো মানসিক অস্থিরতা নেই, তারাও প্রায়ই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। অনেকে তাৎক্ষণিক মারা যায়, অনেকে চিকিৎসা পর্যন্ত বেঁচে থাকার সুযোগ পেলেও বাকি জীবন কাটাতে হয় হৃদরোগ নিয়ে। এদের প্রায় সবাই শেষে হৃদরোগেই মারা যায়। অর্থাৎ হৃদরোগের প্রত্যক্ষ কারণ পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করা, আরামপ্রিয় জীবন যাপন করা, বেশি খাওয়া, স্থূল হওয়া এবং চর্বি বাড়তে দেয়া।

যারা নিয়মিত পর্যাপ্ত শারীরিক কার্যক্রম করে না, শরীরে চর্বি বাড়তি হতে দেয়, তারা টেনশন করলে অনেক সময় হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে যায়। এই হার্ট অ্যাটাকের জন্য আমরা তখন সরাসরি টেনশনকে দায়ী করে বসি। মনে করি টেনশনই লোকটি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হবার মূল কারণ। কিন্তু আমরা দেখি না অসংখ্য মানুষ যে টেনশন না করেও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। আমরা লক্ষ্য করি না, টেনশনে যাদের হার্ট অ্যাটাক হয়, তারা শারীরিক পরিশ্রমের সাথে তেমন একটা সম্পর্ক রাখতো না, তাদের শরীরে চর্বির মাত্রা বেশি ছিল।

শারীরিক পরিশ্রহীনতার কারণে চর্বি বেড়ে গিয়ে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করার কারণেই মানুষের হার্ট ব্লক্ড হয়ে যায়। এই হার্ট ব্লক্ড হওয়াকেই হার্ট অ্যাটাক বলা হয়, একে হার্ট ফেলিউরও বলা হয়। এজন্য নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করার কারণে যাদের শরীরে বাড়তি চর্বি হতে পারে না, তারা কোনো কিছু নিয়ে অতিমাত্রায় টেনশন করলেও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় না। টেনশন যে হার্ট অ্যাটাকের প্রত্যক্ষ কারণ নয়, এটা তার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

তবু বিষয়টা পরিষ্কারভাবে বুঝতে যাদের কষ্ট হচ্ছে, তাদের জন্য একটি মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন উল্লেখ করছি, যা ছাপা হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিনে ৮ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে ‘হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে প্রবাসীদের, আমিরাতেই এক বছরে ২৩১ জনের মৃত্যু’ শিরোনামে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের ইউ-এ-ই প্রতিনিধি কামরুল হাসান জনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘নিজ দেশের ভূখন্ড ছেড়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে পরবাসে ঠাঁই নেন প্রবাসীরা। দেশের মায়া ত্যাগ করে হাজার মাইল দূরে শ্রম বিক্রি করা এই প্রবাসীরা স্বপ্ন পূরণের আশায় কাজ করেন বছরের পর বছর। সবারই লক্ষ্য থাকে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হয়ে ফিরে আসবেন দেশে। অথচ শ্রম বিক্রিতে ব্যস্ত প্রবাসীদের কর্মক্ষমতার পাশাপাশি কমতে থাকে আয়ুষ্কাল।

ল্যাম্পপোস্টের আলো দেখে যাদের ভোর হয়, তাদের চোখে রাতও নামে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে। মাঝখানে দিনের আলো শুধুই কর্মযজ্ঞে ব্যস্ততা। ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা কর্মস্থলে ব্যয় করে যখন তারা ঘরে ফেরেন তখনই শুরু হয় নানামুখী চিন্তা। কখনো পারিবারিক চিন্তা, কখনো ভিসার মেয়াদ উর্ত্তীণ হয়ে যাবার চাপ, ভিসা পরিবর্তনের খরচ জোগাতে হিমশম খাওয়া, কখনো বা কোম্পানি বন্ধ হয়ে দেশে ফেরার ভয়। নিদ্রাহীন এসব প্রবাসীদের পেয়ে বসে হৃদরোগ। নিয়তির বিধানে কারো কারো জীবন অবসান ঘটে যায় নিষ্ঠুর পরবাসে। 

হৃদরোগ, সড়ক দুর্ঘটনা, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, হত্যাসহ প্রতিবছরেই মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় হাজারও প্রবাসীর নাম। এ তালিকা লম্বা হয় হৃদরোগে আক্রান্ত প্রবাসীদের নামে। বয়সের ভারে নয় বরং তাজা যুবকরাও হৃদরোগে ঝরে যান অকালে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি ও দুবাইয়ে গত এক বছরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যথাক্রমে শতকরা ৭৭ ভাগ ও ৪৯ ভাগ প্রবাসী মারা গেছেন।

আবুধাবিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) ড. মোহাম্মদ মোকসেদ আলী জানান, গত বছর আবুধাবী ও এর অধীনস্থ শহরগুলোতে বিভিন্নভাবে মারা গেছেন ১৪৪ জন প্রবাসী। তাদের মধ্যে ১১১ জনই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

তিনি আরও বলেন, ‘প্রবাসীরা মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বিশেষ করে ভিসার মেয়াদ শেষে নবায়নের চিন্তা, ভালো কর্মসংস্থান না পাওয়া, মাস শেষে ঠিক মত বেতন না পাওয়াসহ পারিবারিক নানা দুশ্চিন্তা তাদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।’

দুবাই ও উত্তর আমিরাত বাংলাদেশ কনসুলেটের প্রথম সচিব (শ্রম) একেএম মিজানুর রহমান জানান, ‘দুবাই বাংলাদেশ কনসুলেটের অধীনস্থ শহরগুলোতে গত বছর বিভিন্নভাবে ২৪৪ জন প্রবাসীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে হৃদরোগে মারা গেছেন ১২০ জন, সাধারণ মৃত্যু ৫২ জনের, সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০ জন, কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় ১৩ জন, আত্মহত্যা-হত্যা মিলে ১৯ জন প্রবাসীর মৃত্যু হয়েছে।’ 

এছাড়াও সৌদি আরবের জেদ্দা কনসুলেটের দেয়া তথ্য অনুযায়ী গত বছর বিভিন্নভাবে সেখানে মারা যান ৮৩০ প্রবাসী বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে হৃদরোগ ও সাধারণ মৃত্যু ৫৯৯ জন, সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭১ জন, আত্মহত্যা ১৯ জন ও অন্যান্য ৪১ জনের মৃত্যু হয়। বাহরাইন মানামা বাংলাদেশ কনসুলেটের তথ্য অনুযায়ী সেখানে গত বছর বিভিন্নভাবে ১১৩ জন প্রবাসীর মৃত্যু হয়, এতে হৃদরোগ ও সাধারণ মৃতের সংখ্যা ৮২ জন। 

প্রবাসীদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া প্রসঙ্গে রাস আল খাইমা ফজল ক্লিনিকের পরিচালক ডাক্তার ফজলুর রহমান বলেন, ‘প্রবাসে যারা সিটিং চাকরি করে তাদের মধ্যে বেশির ভাগ হৃদরোগের ঝুঁকি থাকে। বর্তমানে যারা সাধারণ শ্রমজীবী তাদের মধ্যেও হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বাড়ছে। কারণ তারা দেশ থেকে অনেক দূরে থাকে, তাদের মধ্যে সারাক্ষণ দেশের পরিবার পরিজনের জন্যে চিন্তা কাজ করে। আর্থিক অস্বচ্ছলতাও এর জন্যে দায়ী। তবে চর্বিযুক্ত খাবার ও সিগারেট সেবনের প্রবণতাও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘হৃদরোগ ও মৃত্যু ঝুঁকি কমাতে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার বাদ দেয়া, নিয়মিত ব্যায়াম ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা, ব্লাড প্রেসার ও ডায়বেটিস চেক করাসহ প্রবাসীদের সচেতন করতে কমিউনিটি সংগঠনগুলোর উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। সপ্তাহে বা মাসে অন্তত একটি করে হলেও সচেতনতামূলক সেমিনার, প্রশ্ন-উত্তর পর্ব করলেও প্রবাসীদের হৃদরোগের ঝুঁকি কিছুটা কমে আসতে পারে।’

আপাতদৃষ্টিতে প্রতিবেদনটি হৃদরোগ সম্পর্কে আমার বক্তব্যের পরিপন্থী। কারণ এখানেও হৃদরোগের জন্য কয়েক জায়গায় মানসিক অস্থিরতাকে দায়ী বলে মতামত দেয়া হয়েছে। কিন্তু তবু প্রতিবেদনটি আমার বক্তব্যকে কিভাবে সমর্থন করে?

এখানে মূলত হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে তিনজনের মতামত আছে। প্রথম জন হলেন প্রতিবেদনটির প্রতিবেদক। তাঁর মতে, নানা রকম দুশ্চিন্তার কারণে প্রবাসীরা হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে ব্যাপকহারে। দ্বিতীয় জন হলেন আবুধাবিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) ড. মোহাম্মদ মোকসেদ আলী। তাঁর মতেও মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান প্রবাসীরা। তৃতীয় জন হলেন রাস আল খাইমা ফজল ক্লিনিকের পরিচালক বাংলাদেশি চিকিৎসক ফজলুর রহমান। তাঁর বক্তব্য হলো, প্রবাসে যারা সিটিং জব করেন, তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি। তবে বর্তমানে যারা সাধারণ শ্রমজীবী তাদের মধ্যেও হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বাড়ছে। এরপর তিনি হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর জন্য পরামর্শ দেন খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার বাদ দিতে, নিয়মিত ব্যায়াম ও বিনোদনের ব্যবস্থা করতে, ব্লাড প্রেসার ও ডায়বেটিস চেক করতে।

হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে একজন প্রতিবেদক ও দূতাবাস কর্মকর্তার বক্তব্য মতে, রোগটি দুশ্চিন্তার কারণে হয়ে থাকে। আর একজন ডাক্তার, যিনি প্রবাসেই থাকেন, প্রবাসী মানুষদেরকে সব সময় কাছ থেকে দেখেন, হয়তো অনেক প্রবাসী বাংলাদেশির চিকিৎসাও করেন, তাঁর মতে, প্রবাসে যারা সিটিং (বসে বসে) চাকরি করে তাদের মধ্যে বেশির ভাগ হৃদরোগের ঝুঁকি থাকে। এখন প্রশ্ন, কার কথা সঠিক হতে পারে?

ডাক্তার ফজলুর রহমান ‘বসে বসে চাকরি করা’ প্রবাসীরা বেশি হৃদরোগে আক্রান্ত হবার কথা বলার পর সাধারণ শ্রমজীবিরাও হৃদরোগে আক্রান্ত হবার যে কথা বললেন, তা কেন বললেন? হয়তো এ কারণে যে, পৃথিবীর সবাই টেনশনকেই হৃদরোগে আক্রান্ত হবার জন্য দায়ী মনে করেন। ব্যাপক প্রচলিত এ ধারণা থেকে তিনিও পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেননি হয়তো। অথবা সাধারণ শ্রমজীবি যাদেরকে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হতে দেখেছেন, তারা যে পরিমাণ পরিশ্রম করে, তার চেয়ে বেশি আরাম করে, খায়। শ্রমের তুলনায় আরাম বেশি হলে, খাওয়া বেশি হলে, তেল-চর্বিজাতীয় খাবার বেশি খেলে মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হতেই পারে। কিন্তু পরিশ্রম বেশি হলে এবং যে পরিমাণ পরিশ্রম মানুষের শরীরে চর্বি-কোলেস্টেরল জমতে বাধা দেয়, সে পরিশ্রম মানুষকে হৃদরোগ থেকেও রক্ষা করবেই। কারণ হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক হয় অতিরিক্ত চর্বির কারণে হার্টে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্থ হবার কারণেই।

তবে সাধারণ শ্রমজীবীদের মধ্যেও হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বাড়ার কথা বলার পরও ডাক্তার ফজলুর রহমান কিন্তু হৃদরোগের ঝুঁকি এড়ানোর উপায় হিসেবে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার কথা না বলে বরং বলেছেন খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার বাদ দিতে, নিয়মিত ব্যায়াম ও বিনোদনের ব্যবস্থা করতে, ব্লাড প্রেসার ও ডায়াবেটিস চেক করতে। এতে বুঝা যায়, তিনি হৃদরোগের জন্য বেশি দায়ী মনে করেন ব্যায়াম বা পরিশ্রম না করা, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখা ইত্যাদিকে, টেনশনকে নয়।

একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, ডাক্তার ফজলুর রহমান কিন্তু ধূমপানকে হৃদরোগের জন্য দায়ী মনে করেন না। কারণ তিনি দেখেছেন, যারা বসে বসে কাজ করে, তারাই বেশি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, বসে বসে যারা কাজ করে, তারা বেশি বেশি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হয়, ক্যান্সার এবং স্ট্রোকে নয়- বিষয়টা এই প্রতিবেদন এবং ডাক্তার ফজলুর রহমানের বক্তব্য থেকে সহজে বুঝা যায়।

এরকম বিষয় নিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১০ মার্চ ২০১৮ তারিখের দৈনিক সমকালে ‘মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশিদের হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে’ শিরোনামে।

এরপরও হৃদরোগের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে আমার বক্তব্য যাদের মানতে কষ্ট হয়, তাদেরকে আবারও বলছি, তারা তাদের পরিচিত বা খুব কাছের যারা অতিসম্প্রতি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখুন। দেখবেন, তাদের মধ্যে শতভাগ লোক শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকতেন বা শারীরিক পরিশ্রম করলেও তা পরিমাণে অল্প ছিল। এদের অধিকাংশকেই দেখবেন মোটা ছিল, অনেককে দেখবেন খাওয়া-দাওয়ায় সংযম ছিল না।

এরপর দেখুন, পরিচিত যারা শারীরিক পরিশ্রমের পেশায় দীর্ঘদিন ধরে নিযুক্ত, তাদের কেউ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছে কিনা? যেমন, পায়েচালিত রিকশা যারা দীর্ঘদিন ধরে চালায়, তারা। দেখবেন তারা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত হলেও হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে না কখনো। আশা করি খুব কাছ থেকে বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করলে এটা সবার নিকট স্পষ্ট হবে, হৃদরোগের মুখ্য কারণ টেনশন নয়, বরং শারীরিক পরিশ্রমহীন জীবন যাপন করা। যারা শারীরিক পরিশ্রমহীন জীবন যাপন করেন বা পরিশ্রম করলেও তা পরিমাণে অল্প হয়, তারা টেনশন না করলেও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। পক্ষান্তরে শারীরিক পরিশ্রমে যাদের দিন কাটে, তারা যত টেনশন করুক, হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক তাদের কখনোই স্পর্শ করতে পারে না।

দশ বছরের বেশি সময় ধরে পেশাদার ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি শারীরিক শ্রমনির্ভর খেলা যারা খেলে যাচ্ছেন, তাদের কারো জীবনে কি টেনশনের কিছু নেই? দেখবেন, তারা কেউই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় না কখনো। হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগের মূল কারণ যে শারীরিক পরিশ্রমহীনতা, তার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে!

যাদের শরীরে যদি চর্বির পরিমাণ বেশি, পাশাপাশি শারীরিক পরিশ্রমের কোনো কাজ বা ব্যায়াম থেকেও দূরে থাকে, তারা টেনশন না করলেও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। হয়তো কেউ দু’দিন আগে, কেউ দু’দিন পরে। হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচতে হলে টেনশন থেকে দূরে থাকার চেয়ে আলসেমি, আরামপ্রিয়তা বা শারীরিক নিষ্ক্রীয়তা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন, নিশ্চিতভাবে রক্ষা পাবেন হার্ট অ্যাটাক থেকে।

মানুষ যতদিন দৈনিক অন্তত এক ঘন্টা শারীরিক পরিশ্রম করবে, ততদিন মানুষ হৃদরোগ থেকে নিরাপদ থাকবে। যদি কখনো কোনো বিপদে/রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ পুরোপুরি বিশ্রামে চলে যায়, শারীরিক পরিশ্রম করতে অক্ষম হয়ে পড়ে, শুধু তখন আক্রান্ত হতে পারে হৃদরোগে।

এ লেখায় বেশ কয়েকবার উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমান পৃথিবীতে হৃদরোগে মৃত্যুর হার অন্য সব রোগের চেয়ে বেশি। হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে প্রচলিত বিভ্রান্তিগুলো দূর করা না গেলে এবং হৃদরোগের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন না করলে বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষের মহামূল্যবান জীবন হৃদরোগ কেড়ে নিতেই থাকবে অকালে; মানুষ কখনো হৃদরোগের মতো বিধ্বংসী রোগ থেকে নিস্তার পাবে না এবং দিন যত যাবে, হৃদরোগ মানুষের গড় আয়ুকে সংক্ষিপ্ত থেকে সংক্ষিপ্ততম করতেই থাকবে।

অবাক লাগে, শুধু সাধারণ মানুষ নয়, অনেক ডাক্তারও অবলীলায় মানসিক উত্তেজনাকে হার্ট অ্যাটাকের সবচেয়ে বড় কারণ বলে প্রচার করেন। দু’একটা উদাহরণ দেখুন:

‘মানসিক উত্তেজনা থেকে হার্ট অ্যাটাক’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ২৯ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত একটি লেখায় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ সাইফউল্লাহ বলেন, ‘প্রাচীনকাল থেকেই হৃৎপিন্ডের সঙ্গে মনের সম্পর্কের কথা বলা হয়ে আসছে। মানসিক উৎকণ্ঠা বা উত্তেজনার সময় দ্রুত হৃৎস্পন্দন, বুক ধড়ফড় করা বা বুকে ব্যথা অনুভূত হয়। অনুভূতির সঙ্গে হৃৎপিন্ডের নিবিড় সম্পর্কের কথা জানা যায়। জীবনের কোনো উত্তেজনাকর বা সংঘাতময় পরিস্থিতিতে কোনো কোনো মানুষ হঠাৎ হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে।

সাময়িক মানসিক উত্তেজনা শরীর সহজেই অ্যাডজাস্ট করে নেয়। একটানা মানসিক উত্তেজনা ও দুশ্চিন্তা হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাকের একটি ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান।...’

২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘মেন্টাল টেনশন ও হার্ট অ্যাটাক’ শিরোনামে একটি লেখায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটির কার্ডিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আবু সিদ্দিক বলেন, ‘মনোবিজ্ঞানীরা সব মানুষকে দুই ধরনের ব্যক্তিত্বে বিভাজন করেছেন। যারা অত্যন্ত প্রতিযোগী, পরিশ্রমী, উচ্চাকাক্সক্ষী তাদের টাইপ 'এ' এবং যারা অল্পে সন্তুষ্ট, টেনশনমুক্ত, ঝামেলামুক্ত জীবন পছন্দ করেন তাদের টাইপ 'বি' বলে অভিহিত করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, টাইপ 'এ'-র লোকেরা অধিকতর পরিমাণে মনপীড়নে ভোগেন এবং এদের মাঝে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা টাইপ 'বি'-র চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। যদিও মনপীড়নের সঙ্গে হার্ট অ্যাটাক বা করোনারি হৃদরোগের সরাসরি সম্পর্ক নির্ণয় করা কঠিন। তবুও এর সঙ্গে যদি করোনারি হৃদরোগের অন্যান্য কারণসমূহ যেমন- রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য, ধূমপান, উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদি যোগ হয় তবে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।’

লেখা দু’টিতেই টেনশন বা মানসিক উত্তেজনাকে হার্ট অ্যাটাকের জন্য ‘সরাসরি’ দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এরকম আরো অনেক ডাক্তারের লেখায় এভাবে টেনশনকে হার্ট অ্যাটাকের প্রত্যক্ষ কারণ বলে দায়ী করা হয়। আমার মনে হয়, এভাবে টেনশনকে হার্ট অ্যাটাকের জন্য দোষারোপ করে আমরা হার্ট অ্যাটাকের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে মানুষের ক্ষতিই করছি।

আমরা জানি, টেনশন কেউ ইচ্ছাকৃত করে না। মানুষের জীবনে কোনো সমস্যা উদয় হলে টেনশন এমনিতেই এসে যায়। টেনশনকে অহেতুক হার্ট অ্যাটাকের জন্য দায়ী করে আমরা আমাদের জন্য হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচার কোনো সুযোগই রাখছি না। কারণ টেনশন প্রতিহত করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। জীবন যতদিন থাকবে, বিপদ বা সমস্যা ততদিন থাকবেই কমবেশ। তাই মানুষ যখন দেখে, প্রায় সব ডাক্তার টেনশনকে হার্ট অ্যাটাকের জন্য দায়ী করছে, তখন যারা কোনো কিছু নিয়ে টেনশনে থাকে, তারা ভাবে আমার হার্ট অ্যাটাক হতে পারে যে কোনো সময়। তাই সে হার্ট অ্যাটাককে নিজের অপরিহার্য নিয়তি বলে ধরে নেয়। হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচার আশা ছেড়ে দেয়। হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধের কোনো উপায় খুঁজে পায় না। অথচ হার্ট অ্যাটাক একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ।

তবে যে দু’টি লেখার অংশ এখানে উল্লেখ করা হলো, তার দ্বিতীয় লেখাটিতে শেষে বলা হয়, ‘যদিও মনপীড়নের সঙ্গে হার্ট অ্যাটাক বা করোনারি হৃদরোগের সরাসরি সম্পর্ক নির্ণয় করা কঠিন। তবুও এর সঙ্গে যদি করোনারি হৃদরোগের অন্যান্য কারণসমূহ যেমন- রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য, ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি যোগ হয় তবে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।’ দ্বিতীয় লেখাটির এ বক্তব্য মূলত প্ররোক্ষভাবে এটাই স্বীকার করে, মনপীড়ন বা টেনশনের কারণে হার্ট অ্যাটাক হয় না, হার্ট অ্যাটাক হয় রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য, ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি কারণে। যেহেতু প্রথমে এটা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, ‘মনপীড়নের সাথে হার্ট অ্যাটাকের সরাসরি সম্পর্ক নির্ণয় করা কঠিন’, তাই পরের অংশ (যদি মনপীড়নের সাথে রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য, ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি যোগ হয় তবে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়) থেকে আমরা ধরে নিতে পারি সেগুলোই মূলত হার্ট অ্যাটাকের কারণ।

দ্বিতীয় লেখাটির এ বক্তব্যে হার্ট অ্যাটাকের সাথে টেনশন ও কোলেস্টেরলের সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে উল্টো দিক থেকে। এখানে বলা হয়েছে, টেনশনে যারা ভোগে, তাদের শরীরে যদি কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি হয়, তখন সে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতে পারে। মূলত টেনশনকেই এখানে ধরা হয়েছে হার্ট অ্যাটাকের মুখ্য কারণ আর কোলেস্টেরলের আধিক্যকে ধরা হয়েছে গৌণ কারণ হিসেবে। হার্ট অ্যাটাকের সাথে টেনশন ও কোলেস্টেরলের প্রকৃত সম্পর্ক হচ্ছে, যখন মানুষের শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকে, তখন টেনশন করলে মানুষ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতে পারে। তাই কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকা হচ্ছে হার্ট অ্যাটাকের মুখ্য কারণ আর টেনশন হচ্ছে গৌণ কারণ।

এখানে ধূমপানকেও হার্ট আ্যটাকের একটি কারণ বলে উল্লেখ করা হয়। ধূমপান সত্যিই হার্ট অ্যাটাকের জন্য দায়ী কিনা, তা উপরে আলাদা অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আর উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হবার কথা এখানে যা বলা হয়েছে, তা একেবারে সঠিক। আমার এই লেখায় আগেই বলা হয়েছে, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ- এ তিনটি রোগ সমগোত্রীয়, একই সূত্রে গাঁথা। কারো এ তিনটি রোগের কোনো একটি হলে যদি মানুষ তা নিয়ন্ত্রণ না করে, তাহলে তাকে অন্য দু’টিও আক্রমণ করে বসে। যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, তারাই বেশি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। এজন্য কেউ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হলে যদি নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ গ্রহণ বা ব্যায়াম/কায়িক শ্রম করে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ না করেন, তারা যে কোনো সময় হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে বসেন। এরকম ভুরি ভুরি ঘটনা বিশ্বব্যাপী প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে।

জার্মানীর জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের (বাংলা) ওয়েবসাইটে ১৪.১০.২০১৭ তারিখে প্রকাশিত ‘ভারতে তরুণ প্রজন্মের পুরুষদের মধ্যে হৃদরোগ বিশ্বে সর্বাধিক’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সব হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে একমত যে, নিয়মিত শরীরচর্চা এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস হৃদরোগ ঠেকানোর অন্যতম উপায়।’

সেখানে আরো বলা হয়, ‘তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, অর্থাৎ তিরিশের আশপাশে যাঁদের বয়স, তাঁদের মধ্যে ইদানিং দেখা যাচ্ছে, হৃদরোগের হার ক্রমশই বাড়ছে। এর কারণ কী? হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ দেবব্রত রায় ডয়চে ভেলেকে এই প্রসঙ্গে বললেন, এর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, লাইফ স্টাইল. কারণ, ছোট থেকেই বাচ্চারা খেলাধুলা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বাড়ছে ফাস্ট ফুড খাওয়া। এরজন্য মোটা হচ্ছে। ওজন বাড়ছে কিশোর বয়স থেকেই। অল্প অল্প করে রক্তে বাড়ছে শর্করা, বাড়ছে কোলেস্টরেল। এর ফলে ধমনির দেওয়ালে কিছু কিছু খারাপ চর্বি জমা হয়। এবার রক্ত স্রোতে যদি একটা ঘূর্ণন তৈরি হয়, তখন সেটা ফেটে গেলে তৈরি হয় জমাট বাঁধা একটা রক্তের ঢেলা। সেটা থেকেই হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা। তখন ২৫-৩০ বছর বয়সেই হয় হার্ট অ্যাটাক।’ [https://www.dw.com/bn/a-40942842]

সবশেষে মানসিক চাপের সাথে হার্ট অ্যাটাকের সম্পর্ক নিয়ে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন উল্লেখ করছি। ১০ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখের বিবিসি বাংলায় ‘মানসিক চাপের সাথে হার্ট অ্যাটাকের সম্পর্ক নেই’ শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘একটা সময় মনে করা হতো মানসিক চাপ, অবসাদ কিংবা অসুখী হলে মানুষের মৃত্যু হয়। কারণ মানসিক চাপে থাকলে সেটি হৃদপিন্ডের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং হার্ট অ্যাটাক হয়।

কিন্তু যুক্তরাজ্যের চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী ল্যানস্যাটে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হচ্ছে অতীতের এই ধারনা ভুল ছিল এবং সেটি মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে।

যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার গবেষকরা গত বারো বছর ধরে যৌথভাবে এই জরিপ চালিয়েছেন।

এই জরিপে উভয় দেশের ১০ লাখ নারীর মতামত নেয়া হয়েছে। এরপর সেটির ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গবেষণায় যে বিষয়টি দেখার চেষ্টা হয়েছে তা হলো- মানুষ কতটা সুখী? সুখী হলেই কি মানুষ বেশি দিন বাঁচে?

যাদের উপর এই গবেষণা চালানো হয়েছে তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- তাদের স্বাস্থ্যগত অবস্থা কেমন? তারা কি সুখী? তাদের মানসিক চাপ কতটা আছে? ইত্যাদি প্রশ্ন।

এই গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক বলছেন, “মানুষ শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকলে অসুখী হয়। কিন্তু অসুখী হলে মানুষ মারা যায় না।” তিনি বলছেন মানুষের মৃত্যুর সাথে অসুখী হবার কোন সরাসরি সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।

এই গবেষণা দলের আরেকজন সদস্য এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার রিচার্ড পিটো বলেন, ১০ বছর ধরে গবেষণা চালানোর সময়টিতে তারা লক্ষ্য করেছেন যারা কম ধূমপান করেন তাদের কম বয়সে মারা যাবার সম্ভাবনা দ্বিগুণ।

আর যারা বেশি ধূমপান করেন তাদের কম বয়সে মারা যাবার সম্ভাবনা তিনগুণ। কিন্তু দশ বছর ধরে যারা মানসিক চাপে ভুগছেন কিংবা অসুখী রয়েছেন তারা মারা যাননি।

গবেষক মি: পিটো বলেন, “কিন্তু অনেকেই মনে করে মানসিক চাপে থাকলে কিংবা অসুখী হলে হার্ট এ্যাটাক হয়। এটা সত্য নয়। আসলে অনেক মানুষ এটা ভাবতে পছন্দ করে।”

তবে গবেষকরা বলছেন কেউ যদি শৈশবে অসুখী থাকে তাহলে সেটি তার উপর দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’

[https://www.bbc.com/bengali/news/2015/12/151210_mental_health?fbclid=IwAR1La57AgggYfkW66IiIyk5ixax4zhWlZROoRalI0cNfZMxuY6VhBR2A_jo]

এই গবেষণা প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়, ‘অনেকেই মনে করে মানসিক চাপে থাকলে কিংবা অসুখী হলে হার্ট এ্যাটাক হয়। এটা সত্য নয়। আসলে অনেক মানুষ এটা ভাবতে পছন্দ করে।’

তবে গবেষণা-ফলাফলটির অন্য কিছু মন্তব্যের সাথে আমার ভিন্নমত রয়েছে। যেমন, এখানে বলা হয়েছে, ‘যারা কম ধূমপান করেন তাদের কম বয়সে মারা যাবার সম্ভাবনা দ্বিগুণ। আর যারা বেশি ধূমপান করেন তাদের কম বয়সে মারা যাবার সম্ভাবনা তিনগুণ।’ কিন্তু আমার এই লেখায় আমি ধূমপানের ক্ষতি সম্পর্কে আলাদা এক অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি, ধূমপানে মারাত্মক যেসব ক্ষতির কথা ব্যাপকভাবে বিশ্বব্যাপী প্রচার করা হয় সেসব ক্ষতির সাথে বাস্তবে ধূমপানের সম্পর্ক নেই। প্রকৃতপক্ষে ধূমপান করা-না করার সাথে দীর্ঘজীবন লাভ করা-না করার তেমন একটা যোগসূত্র নেই। অসংখ্য ধূমপায়ী চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ধরে ধূমপান করেও ধূমপানের কথিত ক্ষতিগুলো থেকে মুক্ত থাকে আবার অনেক অনেক মানুষ ধূমপান থেকে একশ’ হাত দূরে থেকেও ঐসব ক্ষতির সম্মুখীন হয়, ধূমপান করলে যেসব ক্ষতি হয় বলে প্রচার করা হয়। ধূমপান সম্পর্কীয় আমার ওই অধ্যায়টি পড়লে আশা করি সবাই বিষয়টা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবেন।

যাহোক, হার্ট অ্যাটাকের জন্য মানসিক উত্তেজনা যে সরাসরি দায়ী নয়, অন্তত এ কথাটা বিশ্বাস করতে এ গবেষণা প্রতিবেদনও সবাইকে সহায়তা করবে। আমরা নিজেরাও আমাদের আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলে পরিষ্কার বুঝতে পারবো, সুখী মানুষরাই, বিশেষ করে যেসব সুখী মানুষ সুখে থাকার পাশাপাশি আরামে থাকতেও পছন্দ করে, তারাই বেশি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। আর যাদের জীবনে মানসিক অস্থিরতা বেশি, তাদের মধ্যে যারা শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে, তারাই বেশি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। বিষয়টা হাজার বার যাচাই করা হলেও একই ফল মিলবে। আশা করি হার্ট অ্যাটাকের কারণ সম্পর্কে অনর্থক কোনো কিছুকে দোষারোপ করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা থেকে সবাই সতর্ক হবে।


পুরো বই শুরু থেকে পড়তে হলে: https://waytogainlonglife.blogspot.com/2019/03/blog-post.html

‘শিক্ষক নিবন্ধন’ একটি তামাশার নাম

 ‘শিক্ষক নিবন্ধন’ একটি তামাশার নাম

নূর আহমদ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষক নিয়োগে তো এমন নিয়ম হতে পারতো যে, ছাত্রজীবন শেষে যেসব ছাত্র শিক্ষকতায় আগ্রহী তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ জমা দেবে আর ঐ প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শূন্য পদে বা সৃষ্ট পদে প্রয়োজন এবং সময়মতো পর্যায়ক্রমে তাদেরকে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেবে।

কিন্তু আমাদের দেশে নিয়মটা কেমন? একজন ছাত্র যতোই মেধাবী হোক, মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি যত কৃতিত্বের সঙ্গেই নিক, কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু নয়, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্যও তাকে যোগ্য মনে করা হয় না, তাকে এজন্য পুনরায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায়  অংশ নিতে হয়! এর একটা অর্থ কিন্তু এটা দাঁড়ায় যে, একজন নিয়োগপ্রার্থী তার শিক্ষাজীবনে যদি সবগুলো পাবলিক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতেও উত্তীর্ণ হয়, সেও কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়েও শিক্ষকতার যোগ্য নয়! তার যোগ্যতা যাচাইয়ের আরো বাকি থাকে! আরেকটা অর্থ হতে পারে যে, আমাদের দেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলো শিক্ষার্থীদের মেধা বা যোগ্যতা মূল্যায়নে ব্যর্থ; এসব পরীক্ষার সনদগুলো ভুয়া!

আমি বাংলাদেশের স্বনামধন্য দুটি মাদ্রাসা থেকে কামিল পর্যন্ত সবগুলো পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ/শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হই। ২০০৬ সালে নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রভাষক, আরবি পদের জন্য অংশগ্রহণ করি। ফলাফল হাতে পেয়ে মনে আশা জাগলো এবার তাহলে একটা চাকরি পাওয়া সহজ হবে।  কিন্তু আমি কোথাও যোগদানের সুযোগ পাইনি। তাহলে কি আমার পড়ালেখা সব ভুয়া, নাকি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস ভুয়া?

শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষকে নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরাসরি নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা দিলে সমস্যা কোথায়?

নূর আহমেদ,

দক্ষিণ মাগুরী, দত্তপাড়া, লক্ষ্মীপুর

[লেখাটি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয় ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ইং। লিঙ্ক: https://archive1.ittefaq.com.bd/print-edition/letter/2014/09/23/5339.html ]

যৌতুকের জন্য খুন বন্ধ হবে কবে?

 যৌতুকের জন্য খুন বন্ধ হবে কবে?

আহমেদ নূর
প্রায়ই পত্রিকায় যৌতুকের জন্য স্ত্রী খুনের সংবাদ চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে একই দিন দেশের একাধিক স্থানে যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে খুন করার ঘটনাও ঘটে। বিগত ১৮ সেপ্টেম্বর যুগান্তরে প্রকাশিত এ রকম তিনটি ঘটনার শিরোনাম দেখুন : ‘যৌতুক দাবিতে স্বামী-শাশুড়ি মিলে তাহেরাকে পিটিয়ে হত্যা’ (পৃষ্ঠা-২); ‘যৌতুকের দাবিতে সাভারে স্ত্রী হত্যা : স্বামী আটক’ (পৃষ্ঠা-১৫) এবং ‘ফুলপুরে যৌতুকের জন্য প্রাণ গেল গৃহবধূর’ (পৃষ্ঠা-১৮)। শুধুমাত্র যৌতুকের জন্য এভাবে দেশে কত স্ত্রী নিহত হচ্ছে কেউ নিশ্চয়ই হিসাব রাখে না। কত মানুষ তার জীবনসঙ্গিনীর জীবন কেড়ে নিচ্ছে শুধুমাত্র যৌতুকের জন্য, তা ভাবার মতো কোনো দায়িত্বশীল মানুষ এদেশে  আছে বলে মনে হয় না। যাহোক, এতদিন যৌতুক-লোভী অমানুষদের হাতে যৌতুকের শিকার হতে দেখতাম শুধু তাদের অভাগা স্ত্রীদের। কিন্তু এবার যে সংবাদ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম তা হলো- ‘সখীপুরে যৌতুকের দাবিতে শাশুড়িকে পিটিয়ে হত্যা।’ মেয়ের বিয়ের যৌতুকের জন্য এখন শাশুড়িও খুন হতে শুরু করেছে! কোন সমাজে আমরা বাস করছি! কত নিচে নেমে গেছে আমাদের সমাজ!
যৌতুক আমাদের সমাজে বিয়ের একটি ‘মহাগুরুত্বপূর্ণ’ অংশ বলে যেন মনে করা হয়। তা না হলে যৌতুকের জন্য স্ত্রী বা শাশুড়িকে খুন দূরের কথা, যৌতুকজনিত কোনো অঘটন আমাদের সমাজে ঘটারই কথা নয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, যৌতুকের জন্য যারা তাদের স্ত্রীকে শুলিতে চড়ায়, তাদের বিয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে যৌতুক; জীবনসঙ্গী পাওয়া বা বংশ বৃদ্ধি করা এদের বিয়ের কোনো উদ্দেশ্য নয়। বিয়ে হচ্ছে এদের কাছে অন্য কারো সম্পদে ভাগ বসানোর একটা উপায়। এরা হচ্ছে ডাকাত, যারা কারো কাছে টাকা চেয়ে না পেলে তাকে খুন করতে দ্বিধা করে না। এসব ডাকাত থেকে সমাজকে সুরক্ষার জন্য  আমাদের দেশে কারো মাথাব্যথা নেই। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত সবাই। নিরীহ মানুষরা যে এসব ডাকাতের খপ্পরে পড়ে অহরহ প্রাণ হারায়, কেউ নিজেকে এজন্য দায়ী মনে করছে না।
ঢাকা শহরের যানজট দূর করার জন্য নজরকাড়া সব ফ্লাইওভার নির্মিত হচ্ছে, পদ্মা নদীতে বহু কাক্সিক্ষত দীর্ঘ সেতু তৈরি হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনা রোধের জন্য দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোকে একাধিক লেনে উন্নীত করা হচ্ছে, দেশ দিন দিন ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু যে মানুষদের জন্য এসব করা হচ্ছে তারা যে খুবই নাজুক জীবনযাপন করছে সেদিকে মনোযোগের বিশাল ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশে আইন, আদালত, বিচারব্যবস্থা সবই আছে তবু মানুষ এভাবে মরছে কেন? এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন সেদিন পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের চেয়ারপারসন ও মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল। সম্প্রতি নিজের মেয়েকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে দু’পা হারানো কৃষক শাহানুর বিশ্বাসকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘অপরাধীর শাস্তি দেয়ায় রাষ্ট্র দুর্বল।’
অপরাধীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র যদি কঠোর হতো, দেশে অপরাধের সংখ্যা দিন দিন কমে যেত, সন্দেহ নেই। দেশে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ খুন হচ্ছে কিন্তু মামলার দীর্ঘসূত্রিতা এবং আইনের নানা ফাঁক-ফোকর দিয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। আছে ঘুষ আদান-প্রদানেরও অবারিত সুযোগ। তাই দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি না হওয়ায় দেশের অনেক মানুষ পশুতে পরিণত হচ্ছে। তুচ্ছ ঘটনার জন্যেও, সামান্য টাকার জন্যেও কাউকে খুন করতে মানুষ দ্বিধা করছে না।
আমাদের দেশের প্রকৃতি মানুষ বাসের জন্য বেশ উপযোগী এবং ভারসাম্যপূর্ণ হলেও আমরা অনেকেই জানি এদেশের অনেক মানুষ অন্য দেশে থাকার সুযোগ পেলে অন্য দেশে বাস করাকেই প্রাধান্য দেয় বেশি। অনেকেই এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিবারসহ বসবাস করেন, দেশে আসতে চান না। কেন? এখানকার মানুষ বেশ বর্বর, লোভী এবং অমানুষ বলে। দেশের প্রকৃতি জীবনবান্ধব হলেও মানুষগুলো জীবনবান্ধব নয়। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে, যেখানে প্রকৃতি মানুষের জীবন-বিরুদ্ধ হলেও মানুষগুলো শান্ত বলে সেসব দেশের মানুষ নিজেদের দেশে বাস করাকে মোটেই অপছন্দ করে না। সুমন লাহিড়ী নামক নরওয়ে প্রবাসী একজন লেখক বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় সেদেশ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘নরওয়েতে ঠান্ডার তীব্রতা এত বেশি, অনেক মানুষ পথ চলতে গিয়ে বরফে পিছলে পড়ে পা ভেঙ্গে ফেলে।’ আর ইতালীর অবস্থা এমন, সেখানে শীতকালে কখনো কখনো এত বেশি শীত পড়ে, মানুষ থুতু ফেললে তা মাটিতে পড়তে পড়তেই বরফ হয়ে যায়! তবু এসব দেশের মানুষ সভ্য-শান্ত বলেই সবাই বেশ শান্তিতে বসবাস করছে। কিন্তু এসব দেশের তুলনায় আমাদের দেশের প্রকৃতি খুবই জীবন-ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও মানুষগুলোর আচরণ হিংস্র হবার কারণে এখানে মানুষের জীবনে শান্তি নেই। প্রতিদিনই এখানে একজন আরেকজনের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। এমন একদিন পাওয়া যাবে না, যেদিন পত্রিকায় খুন-খারাবীর সংবাদ নেই। এদেশের মানুষের নিকট মানুষ খুন একেবারেই সাধারণ ব্যাপার। যারা জাপান গিয়েছেন তারা জানেন, না গেলে জাপান-প্রবাসী কারো সাথে আলাপ করে জানতে পারবেন, জাপানীরা মানুষ খুনকে কত মারাত্মকভাবে ঘৃণা করে। সেখানে খুনের ঘটনা একেবারেই বিরল। বিষয়টা যাদের জানার উপায় নেই, তাদের জন্য ‘জাপান কাহিনি’ (দ্বিতীয় খন্ড; লেখক: আশির আহমেদ; প্রকাশনায় : ঐতিহ্য) নামক একটি বই থেকে এ সম্পর্কিত একটা লেখার অংশবিশেষ উল্লেখ করছি: ‘(জাপানে) ফাঁসির রায় হওয়া আর ফাঁসি কার্যকর হবার মাঝখানে বিরাট লম্বা সময় থাকে। কারো ১ বছর কারো ২০-৩০ বছর। ...গড়িমসিটা করেন কারা কর্তৃপক্ষ। কারা প্রধানরা নিজের আমলে এই অপ্রিয় কাজটা করতে চান না। জাপানের মাত্র ৭টি কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ আছে। এই সব কারাগারে আসার পরপরই বদলির জন্য তদবির করতে থাকেন কারা প্রধানরা। ...জাপানে  কেউ জল্লাদ হতে চান না। সুস্থ মস্তিষ্কে আরেকটা মানুষ খুন করার দায়িত্ব এড়াতে চান। সারা জীবন নাকি একটা প্রশ্ন জীবন্ত খোঁচাতে থাকবে “তুই খুনি, তুই মানুষ মেরেছিস, তুই মানুষ মেরেছিস, তুই খুনি”।’ [পৃ-৩৬-৩৮]
বইটি থেকে আরও জানা যায়, জাপানে ক্রাইমের সংখ্যা এমনিতেই কম। মৃত্যুদ- কার্যকরের সংখ্যা এক ডিজিটের কোটায়- ২০১৪ সালে ফাঁসি হয়েছে মাত্র ৩ জনের। একেকজন আসামীকে ফাঁসির জন্য জল্লাদ রাখা হয় ৫ জন। ৫ জন পাঁচটা বাটন টেপার পরই আসামীর ফাঁসি নিশ্চিত হয়। একজন লোকের মৃত্যুদ- কার্যকরের জন্য পাঁচজন লোক কেন? যাতে কেউই নিজেকে এজন্য এককভাবে দায়ী মনে না করে, সর্বোচ্চ ৫ ভাগের ১ ভাগ দায়ী মনে করতে পারে। একেকটি বাটন টেপার জন্য ফি হলো বিশ হাজার ইয়েন। এই অর্থও নাকি তারা নেন না, সরাসরি মন্দিরে দিয়ে দেন। [পৃ-৩৮]
জাপানে যেখানে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে একজন ফাঁসির আসামীর মৃত্যুদ- কার্যকর করার পারিশ্রমিকটাও মানুষ ভোগ করতে দ্বিধা করেন, সেখানে আমাদের দেশে বিয়ের মতো পবিত্র একটি সম্পর্কের পর আমরা শ্বশুরবাড়ির সামান্য সম্পদ লাভে ব্যর্থ হয়ে নিজের স্ত্রীকে বা শাশুড়িকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করি না! মোগল স¤্রাট শাহজাহান নিজের স্ত্রীর নামকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তাজমহল নির্মাণ করেছেন, আর আমরা কাপুরুষরা সামান্য অর্থ-সম্পদের লোভে নিজের স্ত্রীর প্রাণ পর্যন্ত কেড়ে নিই! আমাদের এ ঘৃণ্য প্রবণতার বিরুদ্ধে এ রাষ্ট্র পরিচালকদের তেমন কথা  বলতে শুনি না। দেশে যে প্রতিদিন অসংখ্য নারী যৌতুকের শিকার হচ্ছে, কখনো আমাদের কর্তাব্যক্তিদের এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখি না। শুধু রাস্তাঘাট, পুল-সেতু নির্মাণ করাই কি সরকারের কাজ? দেশকে শুধু ডিজিটাল করলেই হবে? মানুষের জীবনকে নিরাপদ রাখার দায়িত্বও অবশ্যই সরকারকে নিতে হবে। 
আমাদের দেশের নারী নেত্রীরাও দেখি যৌতুকের ব্যাপারে তেমন সরব নয়। সমাজকে ধ্বংস করে ফেলছে যৌতুক, সেজন্য তাদের মাথাব্যথা তেমন দেখা যায় না। যৌতুকের জন্য নারীরা প্রতিনিয়ত খুন হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে, নানারকম হেনস্থার শিকার হচ্ছে। কিন্তু তারা দেখেও না দেখার ভান করছেন। কেন? এর কোনো সদুত্তর নেই। মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর নির্ধারণের জন্য এসব নেত্রীকে দেখি বেশ তৎপর। অথচ এটা একটা অযৌক্তিক বিষয়। ১৮ বছর বয়সের আগেই নারীরা বিয়ের জন্য উপযুক্ত হয়ে যায়। সে জন্য জাপানে নারীর বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় সব রাজ্যেই ১৮ বয়সের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে কোর্ট বা তাদের অভিভাবকের সম্মতিতে হতে পারে। কোনো কোনো রাজ্যে এ বিয়ে সর্বনি¤œ ১২ বছরে হয়ে থাকে। এমনকি একটি রাজ্যে বিয়ের কোনো সর্বনি¤œ বয়সসীমা নেই! নারী বা পুরুষের বিয়ের ক্ষেত্রে এটাই হওয়া উচিত কোনো দেশের স্বাভাবিক নিয়ম। কারণ একজন অভিভাবক তার সন্তানকে কখন বিয়ে দেবে তা সম্পূর্ণ তার এখতিয়ারে থাকাটাই ব্যক্তিস্বাধীনতা। এখানে রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি হবার প্রশ্নও জড়িত নেই। তবু আমাদের নারী নেত্রীরা এ নিয়ে বেশ সোচ্চার। কিন্তু তাদেরই মতো অসংখ্য নারী যে প্রতিদিন যৌতুকের শিকার হচ্ছে তারা মনে হয় তা জানতেই পারেন না!
আমাদের পাঠ্যবইগুলোতেও যৌতুক সম্পর্কে তেমন কোনো গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা নেই। কোনো কোনো পাবলিক পরীক্ষায় মাঝে মাঝে দায়সারাভাবে যৌতুক প্রথা সম্পর্কে রচনা লিখতে বলা হয় শুধু। মানুষ খুনকে নিরুৎসাহিতকরণ সম্পর্কেও আমাদের পাঠ্যবইগুলো নিশ্চুপ। এটা, আমি মনে করি, যারা পাঠ্যবই প্রণয়ন করেন, আমাদের সমাজ সম্পর্কে তাদের অসচেতনতার পরিচায়ক।
লেখক: শিক্ষক

লেখাটি দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত হয় 
১২ জানুয়ারি, ২০১৭। লিঙ্ক: https://m.dailyinqilab.com/article/58118