কোটা প্রথা মেধাবীদেরকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে

 

বাংলাদেশে সমস্যার অভাব নেই। অসংখ্য জাতীয় সমস্যায় জর্জরিত দেশের জনগণ। এগুলোর মধ্যে অন্যতম বেকার সমস্যা। আর বেকার সমস্যার অন্যতম কারণ বিভিন্ন নিয়োগের ক্ষেত্রে নানারকম কোটা সংরক্ষণ করা। কোটা প্রথার গ্যাঁড়াকলে পড়ে অনেক শিক্ষিত তরুণ বেকার হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং অনেক মেধাবী লোক উপযুক্ত পদে চাকরি না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে। অন্যদিকে কোটার ফাঁক দিয়ে অযোগ্য ব্যক্তিরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদকে অলঙ্কৃত না করে বরং কলুষিত করে।

কোটা প্রথার যৌক্তিকতা খুঁজতে হলে প্রথমে দেখতে হবে কেন এ প্রথা। আমাদের দেশে কোটা প্রথার উদ্দেশ্য বিভিন্ন। এক. দুর্বল বা অসহায় নাগরিকদের সুযোগ প্রদান, যেমন প্রতিবন্ধী কোটা; দুই. শিক্ষিত হওয়ার প্রতি উৎসাহিতকরণ, যেমন মহিলা কোটা; তিন. বিশিষ্ট নাগরিকদের সম্মান প্রদান, যেমন মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য কোটা ইত্যাদি। উদ্দেশ্যগুলো বিবেচনা করলে প্রচলিত কোটা সংরক্ষণ যৌক্তিক মনে হতে পারে। তবে যখন দেখা যায় কিছু নাগরিকের জন্য এসব কোটা সংরক্ষণ করতে গিয়ে অন্য নাগরিকদের প্রতি অবিচার করা হয় বা রাষ্ট্রে অন্য কোনো বড় সমস্যা দেখা দেয়, তখন কোটা প্রথা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক প্রতীয়মান হয়। যেমন বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী কোটা রয়েছে ৬০ শতাংশ, আর ২০ শতাংশ রয়েছে পোষ্য, প্রতিবন্ধী ইত্যাদি কোটা। এই ৮০ শতাংশ কোটা পূরণ করতে গিয়ে কোটার বাইরে মেধাবীদের জন্য অবশিষ্ট থাকে শুধুই ২০ শতাংশ পদ! তার মানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ হয় মাত্র ২০ শতাংশ! দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান তাহলে কী করে উন্নত হবে? নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে গিয়ে দেশের প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা এখন বড় শোচনীয়।

বিসিএসে মেধা তালিকা থেকে মাত্র ৪৫ শতাংশ নিয়োগ দেয়া হয়। বাকি ৫৫ শতাংশ আসে কোটা থেকে। এছাড়া নন-ক্যাডার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও একই কোটা সংরক্ষণ করা হয়। আর তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মেধা তালিকা থেকে মাত্র ৩০ শতাংশ পূরণ করা হয়! মেধাবীদের আসন এভাবে সীমিত করে দেয়ায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী তার মেধাকে রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করতে পারে না। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী আবার বিদেশ গিয়ে বিদেশের জন্য তার মেধা খরচ করে, আমরা যাকে বলি মেধা পাচার। এই মেধা পাচার যে আমাদের সিস্টেমেটিক ত্র“টির কারণে হয়, তা নীতিনির্ধারকদের বুঝতে মনে হয় আরও কয়েক যুগ লেগে যাবে!

২০০৬ সালে আমি বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রভাষক পদে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। এ পদে সে বছর পুরো দেশ থেকে মাত্র ৮৬ জন উত্তীর্ণ হয়েছিল, তবু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তখন ৩০ শতাংশ মহিলা কোটা পূরণ আবশ্যক হওয়ায় আমি ওই সনদ দিয়ে এখনও একটি চাকরি পাইনি। কী ছিল আমার অপরাধ? এদেশে আমার মতো কত হতভাগা এভাবে প্রথম শ্রেণীর সার্টিফিকেট নিয়েও তৃতীয় শ্রেণীর জীবনযাপন করে, তার হিসাব কে রাখে!

আমরা আমাদের সমস্যাগুলো সমাধানের কোনো যৌক্তিক পন্থা না খুঁজে মনগড়া পন্থাই বেশি অবলম্বন করি। যার ফলে দেশে একটি সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে নতুন অনেক সমস্যার জন্ম হয়। নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করার জন্য চাকরিতে তাদের জন্য ৬০ বা ৩০ শতাংশ আসন রাখার কি কোনো বিকল্প ছিল না? নারী শিক্ষাকে সম্পূর্ণ অবৈতনিক ও উপবৃত্তিমূলক করেই একে উৎসাহিত করা যেত, নারীদের জন্য চাকরিতে পৃথক কোটা সংরক্ষণের প্রয়োজন হতো না। এভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযুক্ত ভাতা নির্ধারণ করেই তাদের অসহায়ত্ব দূর করা যেত, তাদের জন্য চাকরিতে কোটা রাখার প্রয়োজন হতো না।

দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের সন্তানদের জন্যও সম্মানজনক ও উপযুক্ত ভাতা বা প্রয়োজনে আবাসনের ব্যবস্থা করা হলে তাদের প্রতি যথেষ্ট সুবিচার করা হতো, তাদের জন্য পদে পদে কোটা রাখা আবশ্যক হতো না।

২১ অক্টোবর যুগান্তরের একটি প্রতিবেদনে কোটা প্রথা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য কোটা থাকলেও নাতি-পুতিদের জন্য নয়।’ এমন সাহসী বক্তব্য বাংলাদেশে খুব কমই উচ্চারিত হয়। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য পর্যাপ্ত ও সম্মানজনক ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে; কিন্তু চাকরিতে তাদের জন্য আলাদা কোটা না রেখে সবার জন্য চাকরিতে প্রবেশের সমান সুযোগ রাখা উচিত।

আমার কথার অর্থ এই নয় যে, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনি, নারী, প্রতিবন্ধী এদের চাকরিতে প্রবেশাধিকার দেয়া উচিত নয়। আমার কথা হচ্ছে, কোনো কোটা ছাড়াই দেশের সব নাগরিকের জন্য চাকরিতে প্রবেশের সমান সুযোগ রাখা উচিত। প্রতিযোগিতা করে- মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হোক বা কৃষকের সন্তান হোক, প্রতিবন্ধী কি নারী হোক- মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীরাই যখন চাকরি পাবে, তখন কমে যাবে বৈষম্য, বেকার সমস্যা এবং মেধা পাচার। আশা করি, দেশ সে পথেই এগোবে। আর ভুল পথে চলা নয়।

উল্লেখ্য, লেখাটি দৈনিক যুগান্তরের উপসম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত হয়েছে ২৫ অক্টোবর, ২০১৬ তারিখে ‘‘কোটা নয়, মেধার হোক জয়’’ শিরোনামে।

শিশুদের পরীক্ষা তুলে নেয়ায় লাভ, নাকি ক্ষতি?

 

শিশুশিক্ষার্থীদের উপর পরীক্ষাটা অনেক আগ থেকেই আমার কাছে একটা বোঝা বলে মনে হচ্ছিল। তাই ‘পরীক্ষার ভারে পিষ্ট শৈশব’ এ রকম শিরোনামে একটা লেখায় হাত দেয়ার সুযোগ খুঁজছিলাম। শেষে ২০ মার্চ যুগান্তরে দেখলাম একটি অভাবিত সংবাদ- ‘তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা থাকছে না।’

পরদিন ২১ মার্চ প্রথম আলোয়ও একই শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীতে সব ধরনের পরীক্ষা তুলে নিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। অনেক খুশি হলাম প্রধানমন্ত্রীর এ চমৎকার নির্দেশের কথা জেনে।

আমার বিশ্বাস, দেশের অধিকাংশ মানুষ প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশের গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হবেন। দু-তিনজনের সঙ্গে আলোচনা করে আমার বিশ্বাসের বাস্তবতাও টের পেলাম। বাংলাদেশে এমন অনেক অনিয়ম আছে, যুগ যুগ ধরে যেগুলো চলতে থাকার কারণে মানুষ এখন অনিয়মগুলোকেই নিয়ম বলে চূড়ান্তভাবে বিশ্বাস করে ফেলেছে। তাই এসব কোনো অনিয়মকে নিয়মে আনতে গেলে চারদিকে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়।

আরো পড়ুন: প্রাথমিকের ইংরেজি প্রশ্নকাঠামো কেমন হওয়া উচিত?

একটা বিষয় খুব কম মানুষই উপলব্ধি করেন, শৈশবকালটা মেধা বিকাশের সময়; মেধা যাচাইয়ের সময় নয়। শুধু এজন্য পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের কোনো পরীক্ষা নেয়া হয় না। এসময় শিশুরা খেলবে, শিখবে, আনন্দ করবে। শুনে শিখবে, দেখে শিখবে, পড়ে শিখবে। কিছু শিখতে না শিখতেই কোমলমতি শিশুদের জ্ঞান যাচাই করতে যাওয়াটা ঠিক কিনা, একবার ভেবে দেখলেই শিশুদের পরীক্ষা করার অযৌক্তিকতা সহজেই হৃদয়ঙ্গম হবে।

আমাদের কাছের দেশ হলেও জাপানের কথা আমরা অনেকেই জানি না। জাপানে ১৯৮৮ সালে পড়তে যাওয়া আশির আহমেদ নামক এক বাংলাদেশি এখন জাপানের কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। ‘জাপান কাহিনি’ নামক একটা বই তিনি বের করেন ২০১৫ সালে। এরপর প্রতিবছর বইটির নতুন নতুন খণ্ড বের হতে থাকে। এ বছর বইমেলায় বইটির ৫ম খণ্ড বের হয়েছে। বইটিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘(জাপানে) প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। শিশুদের এসময়টি মেধা বিকাশের সময়, মেধা যাচাইয়ের সময় নয়।’ [পৃষ্ঠা-৩৪]

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে আলোচনায় তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা বন্ধের নির্দেশ দেন, সে আলোচনায় ফিনল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ওইসব দেশে বাচ্চাদের কোনো পরীক্ষা নেই।’ [যুগান্তর, ২০ মার্চ ২০১৯] মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশের কথা জেনে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। একটি প্রশ্ন হল- তাহলে বছর শেষে শিক্ষার্থীদের কোনো পরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণীতে প্রমোশন দেয়া হবে কীভাবে? আমি জানি না, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর এ ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেবে। তবে বিষয়টা এমন নয় যে, পরীক্ষা ছাড়া শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শ্রেণীতে প্রমোশন দেয়ার কোনো যৌক্তিক উপায় নেই।

একটা উপায় এমন হতে পারে- প্রত্যেক বিষয়ের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শ্রেণী পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে একটা নম্বর দেবেন, সেই নম্বরের ওপরই শিক্ষার্থীদের প্রমোশন দেয়া, না দেয়াটা নির্ভর করবে। আরেকটা প্রশ্ন হচ্ছে- যদি একটা শ্রেণীতে ৫০ জন শিক্ষার্থী থাকে, তাহলে তাদের মেধাক্রম কি শিক্ষকদের ওই অনুমান করা নম্বরের ওপর ভিত্তি করে সহজে নির্ণয় করা যাবে। প্রশ্নটির উত্তরের জন্য দেখুন ‘জাপান কাহিনি’ বইটির প্রথম খণ্ড।

সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ক্লাসে কে ধনী, কে গরিব, কে প্রথম, কে দ্বিতীয়- এসব বৈষম্য যেন তৈরি না হয়; তার জন্য যথেষ্ট সতর্ক থাকেন (জাপানের) স্কুল কর্তৃপক্ষ। ক্লাসে রোল নং ১ মানে এই নয় যে, একাডেমিক পারফরমেন্স তার সবচেয়ে ভালো। রোল নং তৈরি হয় নামের বানানের ক্রমানুসারে। [জাপান কাহিনি ১ম খণ্ড, আশির আহমেদ, ঐতিহ্য, পৃষ্ঠা-৫৯]

পড়তে পারেন: প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য বন্ধ করুন!

শিক্ষকদের মূল্যায়নে যেসব শিক্ষার্থী প্রমোশন পাবে, তারা ওপরের শ্রেণীতে উঠে যাবে। তাদের রোল নং হবে তাদের নামের বানানের ক্রমানুসারে। যাদের নামের প্রথম অক্ষর ‘এ’, তাদের নাম ডাকা হবে আগে, যাদের নামের প্রথম অক্ষর ‘বি’, তাদের নামগুলো আসবে এরপর। যেভাবে সেলফোনের ‘ফোনবুকে’ সেভকরা নামগুলো এ, বি, সি, ডি ক্রমানুসারে সাজানো হয়ে থাকে। এতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এক অনর্থক প্রতিযোগিতার মনোভাবও দূর হবে। শিক্ষার্থীরা খুশি মনে, খেলার ছলে, খুব স্বাধীনভাবে শিখবে; মেধার বিকাশ ঘটাবে।

শৈশবেই শিশুদের পরীক্ষার মতো যুদ্ধে নামিয়ে দিলে শিশুদের জীবন হয়ে যায় কঠিন। আমাদের দেশে অবস্থা এমন- অভিভাবকরা শিশুর জন্মের পর যত আগে তাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারেন, মনে করেন শিক্ষার্থীরা তত বেশি এগিয়ে যাবে।

এটা ভাবেন না- প্লে­, নার্সারি নামের শ্রেণীগুলোতে পড়ে তার শিশুটি অনার্স, মাস্টার্স পাস করে ফেলবে না। অথচ জাপানে ‘শতকরা ১০০ ভাগ শিশুই ৬ বছর বয়সে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়। কারও বয়স জানতে সিমপ্লি­ জিজ্ঞাসা করুন, সে কোন ক্লাসে পড়ে। তার সঙ্গে ৫ যোগ করে ফেলুন।’ [জাপান কাহিনি, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৯]

আমরা উন্নত হচ্ছি না শুধু গৎবাঁধা ধারণা নিয়ে বসে থাকার কারণে। পাশের দেশে কী হচ্ছে, তা খোঁজ রাখার আগ্রহ নেই। আশা করি, এ কথাগুলো জানার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতে কেউ কুণ্ঠাবোধ করবে না।

লেখাটি দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয় ৩ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে ‘‘শিশুদের পরীক্ষা তুলে নেয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ’’ শিরোনামে।

কোটাপ্রথা কেন বাতিল করা উচিত?

কোটা প্রথা নিয়ে দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে তুমুল আন্দোলন হচ্ছে। বিশেষ করে কোটা সংস্কার নিয়ে। কিন্তু কোটা বাতিল নিয়ে খুব কম মানুষ কথা বলছে। শেষে কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলনের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী কোটা ‘পুরোপুরি বাতিল’ করার ঘোষণা দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় আপাতত আন্দোলন বন্ধ আছে। এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু প্রজ্ঞাপন জারির আগে অনেকে কোটা বাতিল না করে কোটা সংস্কারের কথা বলছেন।

এটা ঠিক, দেশের সব মানুষ কোটাপ্রথার বিরুদ্ধে নয়। বেশির ভাগই তারা, যারা কোনো-না-কোনো কোটার আওতায় আছেন। যারা কোনো রকম কোটার আওতায় নেই, আমার মনে হয় না, তারা কেউ কোটা বহাল রাখা বা কোটা সংস্কারের পক্ষে। যারা কোনো রকম কোটার আওতায় নেই, দেশের সেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বছরের পর বছর কোটাভুক্ত মানুষের দাপটে সরকারি চাকরি লাভ করা থেকে একধাপ পিছিয়ে থাকেন, অনেকটা বঞ্চিত হন, সেদিকে কি লক্ষ করা জরুরি নয়? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বা চাকরিতে বিভিন্নভাবে যারা কোটার সুবিধা নিচ্ছেন, দেশের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর তুলনায় তাদের সংখ্যা খুবই কম। সরকারি চাকরিতে পদসংখ্যাও সীমিত। এই সীমিতসংখ্যক পদের জন্য কোটার সুবিধাপ্রাপ্ত সীমিতসংখ্যক মানুষ সব সময় অগ্রাধিকার লাভের কারণে দেশের মেধাবী ও দক্ষ বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সব সময় উপেক্ষিত থাকছে, নিজেদের অকর্মণ্য ভাবছে এবং হতাশ জীবন কাটাচ্ছে। এ জন্য কোটাপ্রথা সংস্কার না করে পুরোপুরি বাতিল করাই উচিত। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা এ হিসেবে ঠিকই। কোটাপ্রথার মতো একটি মেধাপরিপন্থী প্রথা দেশ থেকে বিতাড়িত করার এখনই সময়। দেশের বেশির ভাগ মানুষ কোটা বাতিলের পক্ষে। অনেকে হয়তো মুখে সংস্কারের কথা বলছেন। কিন্তু অন্তরে অন্তরে ঠিকই চান, কোটাপ্রথা পুরোপুরি বাতিল হোক। সব রকম কোটা বাদ দিয়ে বেসরকারি চাকরির মতোই সরকারি চাকরিতেও পুরোপুরি যোগ্যতা এবং মেধার ভিত্তিতেই জনবল নিয়োগ দেয়া উচিত।

কোটা সংস্কার না করে পুরোপুরি বাতিল করে দিলে যারা এখন বিভিন্ন কোটার আওতায় আছেন, তারা কি একেবারে অচল হয়ে যাবেন? ভর্তি বা চাকরিতে তাদের জন্য কোটা রাখাই কি তাদের প্রতি রাষ্ট্রের একমাত্র করণীয়? তা ছাড়া অনেক কোটা সংরক্ষণের উপযোগিতা এখন নেই বললেই চলে।

সরকারি চাকরিতে মহিলাদের জন্য আলাদা কোটা সংরক্ষণ করা হয়। ভিন্ন ভিন্ন চাকরিতে ভিন্ন ভিন্ন হারে। একটা সময় ছিল, যখন নারীশিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিল কম। নারীশিক্ষার প্রতি দেশের মানুষকে আগ্রহী করে তুলতেই তখন বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে নারীদের জন্য কোটা চালু করা হয়। মহিলা কোটার সর্বোচ্চ ক্ষেত্র হচ্ছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে ৬০ শতাংশ মহিলা কোটা সংরক্ষণ করা হয়। ফলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, দেশে এখন এমন অসংখ্য প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে একজন পুরুষ শিক্ষকও নেই, শতভাগ মহিলা শিক্ষক! বিষয়টা অনেকেই জানেন। কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রায় প্রতি গ্রামেই রয়েছে।

সময় বদলে গেছে। চাকরিতে মহিলা কোটা সংরক্ষণ করাসহ নারীশিক্ষার ব্যাপারে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে দেশে নারীশিক্ষার হার অনেক বেড়েছে। সরকার নারীদের জন্য স্নাতক পর্যন্ত উপবৃত্তি চালু করেছে। নারীশিক্ষাকে সম্পূর্ণ অবৈতনিক করার কারণে তারা এখন শিক্ষার প্রতি খুবই আগ্রহী। নারীদের জন্য চাকরিতে কোটা না রাখলেও তারা নিজ মেধা ও যোগ্যতায় চাকরি লাভ করতে পারে। তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ, ব্যাংক-বীমাসহ বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান, যেখানে মহিলা কোটা বা অন্য কোনো কোটা নেই, তবু শত শত নারী এখন বেশ দক্ষতা ও সুনামের সাথে চাকরি করছেন। সরকারি চাকরির বাজারটাও এখন সবার জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত করে দিলে নারী হোক বা পুরুষ, কেবল যোগ্য ও মেধাবীরাই সরকারি পদগুলো অলঙ্কৃত করার সুযোগ পাবে। এতে দেশের সামগ্রিক উন্নতি ত্বরান্বিত হবে। আরেকটা কথা হচ্ছে, নারীদের জন্য কোটা রাখলে পুরুষরা কি পিছিয়ে পড়ে না? অবহেলিত হয় না? বিষয়টা নারী-পুরুষ সমানাধিকারের পরিপন্থী কি না, তা ভেবে দেখা দরকার।

শারীরিকভাবে অক্ষম দেশের নাগরিকরা, যাদের প্রতিবন্ধী বলা হয়, তাদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা রাখার পক্ষে অনেকেই সোচ্চার। বলে থাকেন, তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনস্বরূপ এবং তারা যাতে নিজেদের সমাজ, রাষ্ট্র বা পরিবারের বোঝা মনে না করে, তাই তাদের জন্য চাকরিতে কোটা রাখা উচিত। কিন্তু এটা ভাবেন না যে, কেবল চাকরিতে কোটা রাখাই তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের পথ নয় বরং শারীরিকভাবে অক্ষম যারা পড়াশোনায় আগ্রহী, তাদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব রকম সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা, তাদের সব শিক্ষা উপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ করা এবং তাদের পর্যাপ্ত উপবৃত্তির ব্যবস্থা রাখা হলে তারা শিক্ষিত হয়ে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হওয়ার সুযোগ পাবে। পড়াশুনা শেষে তারা নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করবে। চাকরি পেলে তো ভালো, না পেলে তাদের জন্য পর্যাপ্ত ভাতার ব্যবস্থা করা হলে তারা তাদের জীবনকে অভিশপ্ত মনে করবে না। তা ছাড়া শারীরিক প্রতিবন্ধী সবাই আর পড়াশোনা করার সুযোগ পায় না। অনেক অশিক্ষিত মানুষ প্রতিবন্ধী হয় পরিণত বয়সে এসে বিভিন্ন দুর্ঘটনায়। তাদের জন্য চাকরিতে কোটা রাখলেও তারা উপকৃত হওয়ার সুযোগ পাবে না। সুতরাং প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা না রেখে তাদের চলার মতো সম্মানজনক ভাতা প্রদান করাই হবে যুক্তিযুক্ত।

আর প্রতিবন্ধীদের মধ্যে যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে শিক্ষিত হবে, তাদের জন্য আর ১০ জনের মতো চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ তো থাকছেই।

কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটার পরিণতি নিয়ে অনেককে বেশ সরব হতে দেখা যায়। কারো কারো বক্তব্যে মনে হয়, কোটা মানেই যেন শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছাড়া দেশে আর কোনো কোটা নেই! এমনকি প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের ঘোষণা দেয়ার কারণে কোটাবিরোধী আন্দোলন স্থগিত হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’ বহাল রাখার পক্ষে নতুন করে আন্দোলন হতে দেখা যায়। এতে মনে হয়, মুক্তিযোদ্ধারা এবং তাদের পরিবার রাষ্ট্র থেকে আর কোনো রকম সুবিধা ভোগ করছে না। চাকরিতে তাদের জন্য কোটা সংরক্ষণের দায়িত্বই শুধু রাষ্ট্র তাদের জন্য পালন করছে! বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রাষ্ট্রীয় অনেক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি মাসে সম্মানজনক সম্মানী ভাতা দেয়া হচ্ছে (তাদেরকে বিজয় দিবস ভাতা প্রদানের কথাও উঠেছে সম্প্রতি), মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ বছর করা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে পৃথক মন্ত্রণালয়ও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এমনকি মাঝে মধ্যে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য আলাদাভাবে নিয়োগের ব্যবস্থাও করা হয়, যেখানে অন্যরা আবেদন করতে পারে না।

এটা অনস্বীকার্য, মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। তারা এবং তাদের বংশধরেরা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিভিন্ন রকম সুযোগ পাওয়ার দাবি রাখেন। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে কোটা ছাড়া যে সুবিধাগুলো তারা পাচ্ছেন, সেগুলোর সাথে আরো কিছু যোগ করা যেতে পারে। যেমন জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা আরো বৃদ্ধি করা যেতে পারে, মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের প্রত্যেকের জন্য সম্মানী ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে এবং মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের বংশধরের জন্য সরকারিভাবে আবাসনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এসব করা হলে সরকারি চাকরিতে তাদের জন্য আলাদা কোটা না রাখলেও চলবে। বরং চাকরিতে প্রবেশের পথ সবার জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত থাকলে শুধু মেধাবীরাই দেশের সেবা করার সুযোগ পাবে, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হোক বা না হোক।

দেশের আরো কিছু দুর্বল ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী আছে, তাদের জন্য চাকরিতে কোটা ছাড়াও অনেক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সরকার নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু করতে পারে, দেশের বড় বড় শহরে বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার তৈরি করতে পারে, দেশকে ডিজিটাল দেশে রূপান্তরের জন্য অভাবনীয় সব পদক্ষেপ নিতে পারে, সে সরকার দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা ব্যতীত অনেক কিছুই করতে পারে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণই বিশেষ, দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করার একমাত্র পন্থা নয়।

কোটার ফাঁদে পড়ে দেশের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। দেশের মেধা কাজে লাগছে অন্য দেশে। এ মেধাবী শিক্ষার্থীদের দেশে ধরে রাখার জন্য কোটাপ্রথা পুরোপুরি বাতিলের বিকল্প নেই। দেশে বেকার সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনেও কোটাপ্রথার কিছুটা হলেও দায় রয়েছে। তাই সার্বিক বিবেচনায় কোটাপ্রথাকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করলে পুরো জাতি উপকৃত হবে; সবাই নিজ মেধা ও যোগ্যতাবলে চাকরিতে প্রবেশের চেষ্টা করবে, কোটার ফাঁকে কম মেধাবীরা সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসার সুযোগ পাবে না।

nurahmad786@gmail.com

লেখাটি দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত হয় ১২ জুন ২০১৮ তারিখে ‘‘কোটা বাতিল নয়, সংস্কার করা উচিত’’ শিরোনামে।

প্রাথমিকে কেন ‘পাবলিক পরীক্ষা’?

পঞ্চম শ্রেণি-শেষে বেশ কয়েক বছর ধরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সারা দেশব্যাপী একযোগে সমাপনী পরীক্ষা হচ্ছে। কিছু দিন আগে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা এবং অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা দুটি নাকি কোনো পাবলিক পরীক্ষা নয়, এগুলো শ্রেণি-উত্তীর্ণের পরীক্ষা মাত্র। অথচ দেখা যায় সম্পূর্ণরূপে অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষার আদলে পরীক্ষা দুটি গ্রহণ করা হয়। যেমন- অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষার মতো পরীক্ষা দুটির জন্য পরীক্ষার্থীরা সরকারিখাতে নির্দিষ্ট ফি প্রদান করতে হয়, নিজ বিদ্যালয়ে নয়, অন্য একটি বিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়, প্রশ্ন তৈরি করা হয় জাতীয় পর্যায়ে, পরীক্ষা চলাকালীন সরকারি কর্মকর্তা কর্তৃক সার্বক্ষণিক পরীক্ষা পরিদর্শন করা হয়, উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয় সরকারিভাবে, সংবাদমাধ্যমে ঘোষণা করে ঢাকঢোল পিটিয়ে নির্দিষ্ট তারিখে ফলাফল প্রকাশ করা হয়, ফলাফল গ্রেডিং পদ্ধতিতে প্রকাশ করা হয়, এমনকি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সরকারি সার্টিফিকেটও প্রদান করা হয়। অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষার সাথে এতো সব মিল থাকা সত্ত্বেও কেন এ পরীক্ষা দুটিকে পাবলিক পরীক্ষা বলা যাবে না, তা বোধগম্য নয়।

আমরা জানি, যেভাবে মাত্র এসএসসি পরীক্ষার সার্টিফিকেট দিয়েই অনেক চাকরি পাওয়া যায়, তেমনি অষ্টম শ্রেণির সার্টিফিকেট দিয়েও বিভিন্ন সরকারি অফিসে চাকরি নেয়া যায়। তবে পঞ্চম শ্রেণির সার্টিফিকেট এখনও কর্মক্ষেত্রে কোনো কাজে আসে না। এজন্য অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার সাথে অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষার উল্লেখযোগ্য কোনো বৈসাদৃশ্য আর থাকে না। শুধু পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার সাথে মাত্র এ একটি পার্থক্য থাকে। মাত্র একটি পার্থক্য দিয়ে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাকে অন্য পাবলিক পরীক্ষাগুলো থেকে আলাদা করা যায় কিভাবে, যখন সেগুলোর সাথে পরীক্ষাটির তাৎপর্যপূর্ণ অনেক মিল রয়েছে?

পরীক্ষা দুটিকে শ্রেণি-উত্তীর্ণের পরীক্ষা বলারও কী অর্থ থাকতে পারে, যখন শ্রেণি-উত্তীর্ণের অন্য পরীক্ষাগুলো থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে এ পরীক্ষা নেয়া হয়? শ্রেণি-উত্তীর্ণের পরীক্ষা বলতে হলে পরীক্ষাগুলো আগের মতো তৃতীয়, চতুর্থ বা ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার মতোই নিতে হবে। যতোদিন এগুলো আগের মতো নেয়া না হবে, ততোদিন এগুলোকে ‘পাবলিক পরীক্ষা’ হিসেবেই মানুষ গুরুত্ব দেবে।

আরো পড়ুন: প্রাথমিকের ইংরেজি প্রশ্নকাঠামো কেমন হওয়া উচিত?

২০১৫ সালের পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় আমাদের বিদ্যালয়ের চারজন খুব মেধাবী শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়নি মাত্র ইংরেজিতে ‘এ’ গ্রেড পাবার কারণে। অথচ অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থী সবগুলো বিষয়ে ‘এ প্লাস’ না পেলেও জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাও এক্ষেত্রে অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষার মতোই। শুধু প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা ব্যতিক্রম। পঞ্চম শ্রেণীতে যখন মাত্র এক বিষয়ে ‘এ’ গ্রেড পেলেই তার ‘এ প্লাস’ মিস হয়ে যায়, তখন অষ্টম, এসএসসি, এইচএসসি এসব পরীক্ষায় তিন-চার বিষয়ে ‘এ’ গ্রেড পেলেও গড় ফলাফলে ‘এ প্লাস’ কিন্তু মিস হয় না! এদিক থেকে বলা যায় পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাটা অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষার চেয়েও উচ্চস্তরের পাবলিক পরীক্ষা!

দেখা যায়, পঞ্চম শ্রেণিতে একজন শিক্ষার্থী এক বা একাধিক (সর্বোচ্চ পাঁচ) বিষয়ে ৯০ বা ৯৫-এর উপরে নাম্বার পাবার পরও অন্য একটি বিষয়ে ৮০ থেকে একটু কম নাম্বার পাবার কারণে ‘এ’ গ্রেডে উত্তীর্ণ হয়, অথচ কেউ কেউ সব বিষয়ে মাত্র ৮০ থেকে ৮৫ নাম্বার পেয়েও ‘এ প্লাসে’ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। এটা কি মেধাবী শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের কোনো মাপকাঠি হলো? এসব কারণে এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অযৌক্তিক কারণে অনাকাক্সিক্ষত ফলাফল করে মেধাবী শিক্ষার্থীরা যেমন হতাশ হয়, তেমনি সংশ্লিষ্ট শিক্ষক এবং অভিভাবকগণও যারপরনাই ব্যথিত ও হতাশ হন। পঞ্চম শ্রেণিতে অতিরিক্ত বিষয় বা গ্রুপিয়াল বিষয় না থাকলেও সমস্যাটির কোনো যৌক্তিক সমাধান কি নেই? উপযুক্ত কোনো সমাধান খুঁজে না পেলে অযৌক্তিক পরীক্ষাটি থেকে শিশু, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মুক্তি দেয়াই শ্রেয়।

পড়তে পারেন: প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য বন্ধ করুন!

শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধের জন্য সরকার খুবই আন্তরিক। ঝরে পড়া রোধের জন্য সরকারের নানা উদ্যোগ প্রশংসনীয়। সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক শিক্ষায় পরিণত করেছে, বিনামূল্যে বই দিচ্ছে, উপবৃত্তি প্রদান করছে, অনেক বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিলের ব্যবস্থাও করেছে। তবু ঝরে পড়ার কিছু ক্ষেত্র থেকেই যাচ্ছে। চতুর্থ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়া এক শিক্ষার্থীর মা সেদিন আমাদের বিদ্যালয় অফিসে এসে কান্নামাখা কণ্ঠে বললেন, তার ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ না হবার কারণে তার স্বামী নাকি তাকে এবং তার ছেলেটিকে প্রহার করেছে। এরকম অপ্রীতিকর ঘটনার কথা আমরা আর কখনো শুনিনি। প্রমোশন না দিলে ছেলেটি পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে বখে যাবে এমন আশঙ্কা তার বাবা-মা উভয়ের। কিন্তু তিন তিনটি বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়া ছেলেটিকে পঞ্চম শ্রেণিতে প্রমোশন দিলে সে সমাপনী পরীক্ষায়ও অনুত্তীর্ণ হবার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ সবার মেধা সমান হয় না প্রকৃতিগত কারণেই। আর শত ফিডব্যাকেও কিছু কিছু শিক্ষার্থীকে পাশের যোগ্য করে গড়ে তোলা যায় না। এজন্য সমস্যা উভয়ের- শিক্ষক এবং অভিভাবক। এরকম শিক্ষার্থীদের প্রমোশন না দিলে এরা অনেক সময় ঝরে পড়ে আবার প্রমোশন দিলে সমাপনী পরীক্ষায় এদের পাশ করানো নিয়ে শিক্ষকরা মহাদুশ্চিন্তায় পড়ে যান। অনেক বিদ্যালয়ে এরকম অতি দুর্বল শিক্ষার্থীদের তাই প্রমোশন না দেয়ার ঘটনাও ঘটে। সমাপনী পরীক্ষা না হলে এসব শিক্ষার্থী তাই অন্ততঃ আরেকটা শ্রেণিতে অধ্যয়নের সুযোগ পেতো।

পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে আরো কিছু কথা রয়েছে। অনেক অভিভাবক তাদের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়–য়া বাচ্চার উপর পড়ালেখার জন্য অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে থাকেন যাতে খেলার সময়টুকুতেও বাচ্চাটি স্বচ্ছন্দ্যে খেলতে পারে না, সময়মতো ঘুমোতে যেতে পারে না। বাচ্চা যেনো জিপিএ-৫ পেতে পারে, সেজন্য তাকে একাধিক টিউটরের কাছে পড়তে দিয়ে অভিভাবকগণ একদিকে যেমন নিজেদের পকেট খালি করেন, অপরদিকে বাচ্চার সামান্য অবসর সময়টুকুও ছিনিয়ে নেন। অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা পঞ্চম শ্রেণির জন্য কোচিংয়ের ব্যবস্থা করেন এবং মোটা অংকের কোচিং ফিও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করেন। অনেক বিদ্যালয়ে আবার শিক্ষকরা পঞ্চম শ্রেণিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্যান্য শ্রেণিতে ঠিকমতো পাঠদান করতে পারেন না। অধিক যোগ্য শিক্ষকরা পঞ্চম শ্রেণিকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। সমাপনী পরীক্ষাই শিশুদেরকে সরকার-নির্ধারিত বিনামূল্যে সরবরাহকৃত ছয়টি পাঠ্যবইয়ের বাইরে বিশালাকৃতির দামী গাইডবই কিনতে এবং বহন করতে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছে। শুধু গাইড নয়, ‘মডেল টেস্ট’, ‘টেস্ট পের্পাস’ এরকম অনেক অতিরিক্ত বই কিনতেও অনেকটা বাধ্য করছে এ সমাপনী পরীক্ষা। সমাপনী পরীক্ষার জন্য প্রশ্নকাঠামো এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়, শিক্ষার্থীরা শুধু পাঠ্যবই অধ্যয়ন করে সমাপনী পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার অবকাশ থাকে না। পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্নগুলো সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য এবং সেগুলো চর্চা করার জন্য তারা গাইড-মডেল টেস্ট এসবের দ্বারস্থ হতেই হয়।

আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার কেন্দ্র সাধারণতঃ প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন কোনো উচ্চ বিদ্যালয়ে হয়ে থাকে। দেখা যায় অনেক কেন্দ্রে স্বাগতিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সংশ্লিষ্ট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের (যিনি কেন্দ্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন) যোগসাজশে নিজেদের পরীক্ষার্থীদের কক্ষে পরিচিত কক্ষ-পর্যবেক্ষক দিয়ে থাকেন এবং নিজেদের বাচ্চাদের ভালো ফলাফল নিশ্চিত করেন, যা প্রতিযোগিতায় পার্শ্ববর্তী অন্যান্য বিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে দেয়। সেক্ষেত্রে পার্শ¦বর্তী বিদ্যালয়গুলোর ফলাফল স্বাগতিক বিদ্যালয়ের অস্বাভাবিক ফলাফলের তুলনায় ম্লান হয়ে যাওয়ায় সেসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ ব্যথিত এবং হতাশ হন। ২০১৫ সালে একটা কেন্দ্রে এমনও হয়েছে বলে জানা যায়, একজন কক্ষ-পর্যবেক্ষককে পরপর চার দিন একই কক্ষে (স্বাগতিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থীদের কক্ষ) দেখে কেন্দ্রের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা চতুর্থদিন তাকে সেখান থেকে সরিয়ে অন্য কক্ষে নিয়ে যান। এছাড়া মফস্বলে বা গ্রামাঞ্চলে অনেক কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীরা একজন অন্যজন থেকে দেখে দেখে পরীক্ষা দেয়ার জন্য সুযোগ করে দেয়া হয়, যাতে কেউ অন্ততঃ ফেল না করে। কোথাও কোথাও আবার কক্ষ পর্যবেক্ষকগণ অতি উৎসাহী হয়ে পরীক্ষার্থীদেরকে ‘পাস নাম্বার’ বলে দেয়ার কথাও শোনা যায়। তাছাড়া পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নেও ছাড় এবং শিথিলতার জন্য পরীক্ষকদের জন্য ‘উপর’ থেকে নানারকম লিখিত ও মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়ে থাকে, যা এমনকি বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার বেলায়ও হয় না। কিছুদিন আগে মিডিয়ায় বেশ সাড়া জাগানো একটা গবেষণায়ও এমন চমকপ্রদ কিছু তথ্য বেরিয়ে আসে। এমন ঢিলেঢালা ‘পাবলিক পরীক্ষা’ চালু রাখার কী প্রয়োজন?

নতুন শিক্ষা আইনে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করা হচ্ছে। অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাই হবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। পঞ্চম শ্রেণিতে বর্তমানে প্রচলিত এই সমাপনী পরীক্ষা আর থাকছে না। ২০১৮ সালের মধ্যে প্রাথমিককে অষ্টম শ্রেনিতে উন্নীত করার জন্য সরকার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থবহ এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে। প্রাথমিককে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার প্রক্রিয়া যখন চলছেই তখন পঞ্চম শ্রেণির এই সমাপনী পরীক্ষা চালু রেখে আর কী লাভ? ২০১৬ সাল থেকেই পরীক্ষাটি বন্ধ করে দেয়া হোক। অন্যদিকে অষ্টম শ্রেণির সার্টিফিকেট যেহেতু অনেক সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়, তাই অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষাটি চলমান রাখা যেতে পারে।

লেখাটি দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত হয় ১৭ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে ‘‘পঞ্চম শ্রেণিতে ‘পাবলিক পরীক্ষা’ আর নয়’’ শিরোনামে।

চাকরিতে প্রবেশের বয়স কেন উন্মুক্ত রাখা উচিত?

চাকরিতে প্রবেশের বয়স নিয়ে আমাদের দেশে অনেক আগ থেকে আন্দোলন চলছে। লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু এখনও এতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আমাদের দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স নির্ধারিত। ৩০ বছর বয়সের মধ্যেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করা যাবে, ৩০ বছর পূর্ণ হয়ে গেলে একজন শিক্ষার্থী যত মেধাবী আর উচ্চশিক্ষিতই হোক না কেন, সরকারি চাকরিতে তার আর আবেদন করারই যোগ্যতা নেই! যুগের পর যুগ ধরে চালু থাকা এ নিয়ম পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে দেশের মানুষ নানাভাবে আন্দোলন করে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো ফল হচ্ছে না। কেউ পাত্তা দিচ্ছে না তাদের যৌক্তিক দাবিকে।

৩০ বছর বয়স হয়ে গেলেই কি একজন মানুষের চাকরি করার সব কর্মশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়? ৫৯ বছর বয়সে চাকরি থেকে অবসরে গিয়েও আমাদের দেশের অনেক সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে নতুন করে চাকরি নিতে দেখা যায়। ৫৯ বছর বয়স হয়ে গেলেও, চাকরি না করলেও চলে, এমন অসংখ্য মানুষ যে দেশে নতুন কোনো চাকরিতে প্রবেশ করতে পারে, সে দেশে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হওয়া একজন উচ্চশিক্ষিত বেকারের, যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছে ভালো একটা চাকরির স্বপ্নে, তার জন্য শুধু ৩০ বছর পূর্ণ হয়ে যাওয়ার কারণে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের পথ বন্ধ করে দেয়ার পেছনে কী যুক্তি থাকতে পারে!

আরো পড়ুন: কোটাপ্রথা কেন বাতিল করা উচিত?

সেশান জট, নানারকম অবাঞ্চিত ছুটি, হরতাল, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনির্দিষ্টকালের জন্য ভার্সিটি বন্ধ, যেকোনো অজুহাতে পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন যে দেশে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, সে দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমিত করার মানে যে মেধাবী বা উচ্চশিক্ষিত শিক্ষার্থীদের চাকরি করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা, কথাটি বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

“...অস্ট্রেলিয়ান শিক্ষার্থীরা জানেই না ‘সেশন জট’ কাকে বলে, ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা’ বলতে কী বোঝায় বা কিভাবে করতে হয় ‘পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন’।” কথাগুলো অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী প্রদীপ দেব নামে এক বাংলাদেশীর লেখা ‘ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন’ নামক একটি বই থেকে মীরা প্রকাশন, পৃ-৮৪ নেয়া। অস্ট্রেলিয়া বা অন্য কোনো উন্নত দেশ, যেখানে ২৫-২৬ বছর বয়সে অনেকে শুধু মাস্টার্স নয়, পিএইচডিও সম্পন্ন করে ফেলে, সেসব দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০-এর মধ্যে সীমিত করলে উচ্চশিক্ষিত শিক্ষার্থীরা কাক্সিক্ষত চাকরিতে প্রবেশে তেমন কোনো বেগ পেতে হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে অনেকের স্নাতকোত্তর শেষ হতে না হতে বয়স ৩০-এর কাছাকাছি চলে যায়।

মালেশিয়ার সাম্প্রতিক নির্বাচনে ৯২ বছর বয়সী সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহাথির মোহাম্মদ নতুন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্প ৭০ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ৬০ বছর বয়সে বিশ্বের একটি উন্নত দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে বাধাগ্রস্ত হননি। আমাদের দেশেও অনেক এমপি-মন্ত্রী আছেন, যারা ৬০-৭০ বা তার চেয়েও বেশি বয়সে এসব পদে নির্বাচিত হয়েছেন। কী অসুবিধা? কোনো অসুবিধা যদি না থাকে, তাহলে একজন শিক্ষিত তরুণ বেকার তার ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য একটি চাকরি নিতে বয়সের বাধ্যবাধকতার মুখোমুখি হবে কেন? যতদিন মানুষের কর্মশক্তি থাকে, তত দিন মানুষ কাজ করবে, এটাই হওয়া উচিত নিয়ম। কিন্তু অল্প বয়সেই মানুষকে অকর্মণ্য, অযোগ্য, আনফিট গণ্য করে মানুষের জীবনকে হতাশাগ্রস্ত করার কী প্রয়োজন আছে! এতে তো হাতে ধরে দেশে বেকার সংখ্যা বাড়ানো হয়। ৩০ বছর বয়সী একজন তরুণকে চাকরিতে প্রবেশের আগেই অযোগ্যের কাতারে ফেলে দেয়াটা কতটুকু সঠিক, কতটুকু মানবিক, তা গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার।

আমাদের দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৩০ বছর বয়সের পরও চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ থাকে। অন্য সব প্রতিষ্ঠানে যখন সম্ভব, সরকারি চাকরিতে আরো বেশি সম্ভব হওয়া দরকার। কারণ মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ একটি সরকারি চাকরি। বিশ্বের অনেক দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়স সম্পর্কে আমরা অনেকে জানি না। কানাডিয়ান সিভিল সার্ভিসে প্রবেশের বয়স ২০ থেকে ৬০ বছর, শ্রীলঙ্কায় চাকরিতে প্রবেশের বয়স ১৮ থেকে ৪৫ বছর, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ডে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ২০ থেকে ৫৯ বছর। বিশ্বের আরো অনেক দেশে এরকম চাকরিতে প্রবেশের পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়া হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ সংবাদগুলো অবশ্যই অবাক করার মতো, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চাকরিতে প্রবেশের এ অবাধ সুযোগই যৌক্তিক এবং স্বাভাবিক।

[লেখাটি দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত হয় ০৪ জুন ২০১৮।]

বেশি আরাম স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর


মানুষ এখন অতিরিক্ত আরামপ্রিয় হয়ে গেছে। একটা সময় ছিল মানুষ যখন আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যায়াম করতো না বটে, তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে মানুষের অনেক বেশি ব্যায়াম হয়ে যেতো। এখন অনেক মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবার পর ডাক্তারের পরামর্শে নয়, বলতে গেলে ডাক্তারের নির্দেশে যে পরিমাণ ব্যায়াম করে থাকে, তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি ব্যায়াম হতো। কিভাবে? হ্যাঁ, পরিশ্রমের কাজ করে করে। মানুষ আগে বেশি পরিশ্রমী ছিল। তাছাড়া অনেক রকম পরিশ্রম করতে মানুষ বাধ্যও হতো। যেমন : কৃষিসংক্রান্ত নানারকম কাজ করা, হেঁটে হেঁটে দূরের পথ পাড়ি দেয়া, সাংসারিক বিভিন্ন রকম পরিশ্রমের কাজ করা, মহিলাদের ঢেঁকিতে বিভিন্ন কাজ করা, গৃহস্থলীর অনেক শ্রমসাধ্য কাজ করা ইত্যাদি। এক কথায় আগেকার দিনে মানুষের শারীরিক শ্রমের কাজ ছিল বেশি। মানুষ খেতোও বেশি, পরিশ্রমও করতো বেশি। কিন্তু এখন মানুষের পরিশ্রমের কাজ অনেক কমে গেছে। পরিশ্রমের কাজ কমে যাওয়ার পাশাপাশি মানুষ অলসও হয়ে গেছে। দূরের পথ পাড়ি দেয়ার জন্য মানুষ এখন হাঁটতে হয় না, হরেক রকম যানবাহন মানুষকে বসিয়ে বসিয়ে দ্রুত পৌঁছে দিচ্ছে গন্তব্যে। দূরের পথ নয়, সামান্য পথও মানুষ এখন হেঁটে যেতে চায় না। কয়েকমাস আগে একদিন আমি ট্যাক্সিতে করে বাসায় ফিরছিলাম। আমার পাশে একটা সিট খালি ছিল। পথে একজন ট্যাক্সিতে উঠলো। এক কিলোমিটার নয়, আধা কিলোমিটার যেতে না যেতেই তার গন্তব্য এসে গেলো! কেনো, এ সামান্য পথ কি তিনি হেঁটে ঁেহটে আসতে পারতেন না? এটা আমাদের আলসেমী বা আরামপ্রিয় হবার চরম বহিঃপ্রকাশ।

মহিলাদের এখন আর ঢেঁকিতে কাজ করতে হয় না, মেশিনেই সবকিছু হয়। আর ঢেঁকি তো ইতোমধ্যে যাদুঘরের আবশ্যকীয় উপাদানই হয়ে গেছে। জামাকাপড় এখন ধোয়া হয় ওয়াশিং মেশিনে। শুধু কাজ হচ্ছে বাজার থেকে কিনে আনবে আর গ্যাসের অটো চুলায় রান্না করে করে খাবে। বাজার থেকে আগে পুরুষরা বাজারের ব্যাগটাও হাতে বহন করে নিয়ে আসতো। কিছু পরিশ্রম হতো, ঘাম ঝরতো। আর এখন বাজারের ব্যাগ হাতে করে নিয়ে আসা দূরের কথা, অফিসের সামান্য পথও রিকশা বা গাড়িতে করে না গেলে প্রেষ্টিজ যেনো পুরোই পাংচার হয়ে যায়! যেসব বিল্ডিংয়ে লিফট আছে, সেসব বিল্ডিংয়েও মাত্র এক ফ্লোর উপরে বা নিচে যেতেও আমরা সিঁড়ি ব্যবহার না করে লিফট ব্যবহার করি!

পুরুষ-মহিলা সবাই পরিশ্রমের কাজ কমিয়ে দিয়ে আরামের জীবন বেছে নেয়ার এবং বসে বসে খাওয়ার পরিণতি আমরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বেশি বেশি মুটিয়ে যাচ্ছি আর অল্প বয়সেই শরীরে বাসা বাঁধছে বিপজ্জনক সব রোগ। যেমন : ডায়াবেটিস, প্রেসার, হার্ট ব্লক বা হার্ট অ্যাটাক। রোগগুলোতে যারা ইতোমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন, তারা জানেন জীবনটা তাদের কাছে কতো জটিল মনে হচ্ছে। চলাফেরায় সাবধান থাকতে হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে, খাওয়া-দাওয়ায় নানারকম বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, পছন্দনীয় খাবার মনভরে খাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া সার্বক্ষণিক ডাক্তারের পরামর্শ নিতে আর ওষুধ খেয়ে যেতে হচ্ছে। এ এক বড় দুর্বিষহ জীবন।

আরামপ্রিয় হয়ে আমাদের সুস্থ-সবল জীবন এখন ব্যারামে ব্যারামে বিধ্বস্ত। ঘামঝরানো শ্রম ছেড়ে দিয়ে আমরা এখন ভয়াবহ সব রোগে জর্জরিত। আমাদের অনেকের এখনো হুঁশ হয়নি। আমরা অনেকে এখনো মনে করি ডায়াবেটিস হচ্ছে বংশানুক্রমিক রোগ। বংশের কারো থাকলে নিজের এ রোগ হবার সম্ভাবনা বেশি। আমাদের এ ধারণা কিভাবে সৃষ্টি হলো, বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে শতকরা কয়জনের এ রোগ ছিলো, আর এখন শতকরা কয়জনের এ রোগ, তা একটু পরখ করলেই দেখা যাবে, উত্তরপুরুষদের এ রোগ বেশি; পূর্বপুরুষদের এ রোগ ছিলোই না বলতে গেলে। তাহলে উত্তরপুরুষদের কোত্থেকে এ রোগ ব্যাপকাকারে আক্রমণ করলো? শুধুমাত্র পরিশ্রম না করে বসে বসে খাওয়ার প্রবণতাই এ রোগ সৃষ্টি হবার জন্য প্রধানত দায়ী; বংশের কারো থাক বা না থাক।

পরিশ্রম না করলে যে হার্টের রোগ হবার সম্ভাবনাও বেশি, তা নিয়েও একটু কথা বলা যাক। আমরা জানি, সাইকেল চালানোতেও বেশ পরিশ্রম হয়। কিন্তু সাইকেল চালানোর উপকারিতা-অপকারিতা নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক অজ্ঞতা কাজ করে। আমরা অনেকেই মনে করি সাইকেল চালানো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অনেকেই মনে করি সাইকেল বেশি চালালে হার্টের সমস্যা হয় বা হার্ট দুর্বল হয়ে যায়। আমি ছোটবেলা থেকে অনেক মানুষের মুখেই এমন কথা শুনেছি। কখনো বিষয়টা নিয়ে ভালোভাবে চিন্তা করিনি। কয়েকমাস আগে একদিন আমি কর্মস্থল থেকে ফিরছিলাম। পথে আমার বন্ধু স্থানীয় এক লোকের সাথে দেখা হলো। কথায় কথায় তিনি আমাকে বললেন, ‘ভাই, সাইকেল না চালানোই ভালো। কারণ সাইকেল চালালে হার্টের সমস্যা হয়।’ তার কথা শুনে আমি সামান্য ভাবলাম। ভেবে তাকে বিনয়ের সাথে বললাম, ‘ভাই, সাইকেল চালানোর কারণে হার্টের সমস্যা হয়েছে, আপনি দেখেছেন, এমন মাত্র একটা লোক আমাকে দেখিয়ে দিন, বেশি নয়।’ আমার কথার কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। তাহলে তিনি কথাটি বললেন কেনো? তিনি বলেছেন, কারণ সবাই এমন কথাই বলে। কিন্তু এটার কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের দেশে আমরা শুধু সাইকেল চালানোর অপকারিতার কথা বলে বেড়াই। চীন বা জাপানে মানুষ শুধু সাইকেল চালানোর উপকারিতার কথাই জানে। এজন্য তারা বেশি বেশি সাইকেল চালায়। ‘জাপান কাহিনী’ নামক একটা বইতে দেখলাম, জাপানে নাকি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সপ্তম শ্রেণি থেকে সকল শিক্ষার্থীকে সাইকেল চালিয়ে প্রতিষ্ঠানে আসতে হয়, তাদের বাবা যতো বড় ধনী হোক না কেনো। সাইকেল বেশি বেশি চালায় বলেই এসব দেশের লোক মুটিয়ে যায় না, এদের শারীরিক ফিটনেসও দীর্ঘদিন ঠিক থাকে, এদের গড় আয়ুও সঙ্গত কারণেই বেশি। আর আমরা সাইকেল চালানোকে নিরুৎসাহিত করি বলে বেশি বেশি মুটিয়ে যাচ্ছি, বিভিন্ন রোগে অল্প বয়সে আক্রান্ত হয়ে মারাও যাচ্ছি। আমাদের দেশে এখন তো রিকশাগুলোতে মটর লাগিয়ে চালানো হয়। কিন্তু এর আগে বছরের পর বছর মানুষ পায়ে চেপেই রিকশা চালাতো। অন্তত বিশ বছর এভাবে রিকশা চালিয়েছে, এমন লোকের হার্টের সমস্যা হবার ঘটনা নেই বললেই চলে। কোনো? কারণ রিকশা চালাতে যথেষ্ট ঘামঝরানো শ্রম হয়। এই ঘামঝরানো শ্রম আমরা যতো বেশি করবো, আমাদের হার্ট ভালো থাকার সম্ভাবনা ততো বৃদ্ধি পাবে।

প্রেসারের অন্যতম কারণও আমার মনে হয় পরিশ্রম না করে বসে বসে খাওয়া। অধিকাংশ প্রেসারের রোগীর মধ্যে এমন প্রবণতা লক্ষ্য করা। আর যেসব লোক হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে, তাদের ডায়াবেটিস, হার্ট উইকনেস যেমন খুব একটা হয় না, প্রেসারও তেমন একটা হয় না। এজন্য যারা রোগগুলো থেকে এখনও মুক্ত আছেন, তাদের উচিত বেশি বেশি কায়িক শ্রমের কাজ করা। শ্রম মানুষের শরীরকে সুঠাম রাখে, রোগব্যাধি থেকে নিরাপদ রাখে। মনে রাখতে হবে, কায়িক শ্রম বলতে বুঝায় শরীর থেকে ঘাম বের হয় এমন কাজ করা। আপনি আপনার অফিসে বসে আছেন, বিদ্যুৎ নেই বলে আপনার শরীর থেকে ঘাম বের হচ্ছে, এটা নিশ্চয়ই কোনো পরিশ্রমের কাজ নয়! আপনি কিভাবে নিয়মিত পরিশ্রম করবেন, আপনিই ঠিক করে নিন। অফিস যদি দু’তিন কিলোমিটারের মধ্যে হয়, সম্ভব হলে প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে যাতায়াত করুন, না হয় সাইকেল চালিয়ে। বাজারের ব্যাগটি অতিরিক্ত ওজন না হলে হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটেই বাসায় নিয়ে আসুন। মনে রাখবেন, প্রেষ্টিজ রক্ষা করা আপনার স্বাস্থ্য রক্ষার চেয়ে অধিক মূল্যবান নয়। শেষে একটি সুখবর দিয়ে লেখা শেষ করছি। বসে বসে বেশি খেলে আপনি রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শেষে খেতেই পারবেন না। আর পরিশ্রম করে বেশি বেশি খেলেও আপনার শরীরে বিপজ্জনক কোনো রোগ বাসা বাঁধবে না। আপনি খেয়ে যেতে পারবেন দীর্ঘদিন, নিশ্চিন্তে। সুতরাং বেশি বেশি খাওয়ার জন্য বেশি বেশি পরিশ্রম করুন!

লেখাটি দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত হয় ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।


এমএস ওয়ার্ডে বা মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে গুণ ও ভাগ (×, ÷) চিহ্ন

মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে যোগ ও বিয়োগ এসব চিহ্ন টাইপ করার জন্য কীবোর্ডেই কী দেয়া আছে। কিন্তু গুণ ও ভাগ চিহ্ন ( × ও ÷) সরাসরি টাইপ করার জন্য কোনো কী নেই। দেয়া আছে * এবং / এই দু’টি কী।

এইজন্য গণিতের কোনো লেখা টাইপ করতে গিয়ে আমাদেরকে বেকায়দায় পড়তে হয়। ইনসার্টে প্রবেশ করতে হয়। ইনসার্টে প্রবেশ না করেই শুধু কীবোর্ড দিয়ে এই চিহ্ন দু’টি টাইপ করতে হলে আগে আপনাকে কীবোর্ডে ইংরেজি টাইপ করার অপশনগুলো সচল করতে হবে। Control+Alter+B দিয়ে ইংরেজি টাইপ করার অপশন চালুর পাশাপাশি ফন্টে গিয়েও Times New Roman চালু করে দিতে হবে।

এরপর গুণ চিহ্নের জন্য কি বোর্ডে Alt চেপে ধরে পর পর টাইপ করতে হবে 0215 সংখ্যাগুলো। তাহলেই ওয়ার্ডে পেইজে টাইপ হয়ে যাবে × চিহ্ন।

একইভাবে ভাগ চিহ্নের জন্য কি বোর্ডে Alt চেপে ধরে পর পর টাইপ করতে হবে 0247 সংখ্যাগুলো। তাহলেই ওয়ার্ডের পেইজে টাইপ হয়ে যাবে ÷ চিহ্ন।

একবার প্র্যাক্টিস করে দেখুন।

পড়তে পারেন একটি বিশেষ নিবন্ধ: ভাইরাস এবং রোগজীবাণুর ধারণা বিজ্ঞান-সৃষ্ট ভুত!

প্রথমবার গুণ বা ভাগ কোনো চিহ্ন টাইপ করার পর চিহ্নগুলো কপি পেস্ট করেও পরে একই ডকুমেন্টে ব্যবহার করতে পারবেন।

ধন্যবাদ সবাইকে।

আমার দু’টি বই পড়তে পারবেন অনলাইনেই।

১. দীর্ঘজীবন লাভের উপায়

লিঙ্ক: https://waytogainlonglife.blogspot.com/2019/03/blog-post.html

২. করোনাভাইরাস কি সত্যিই কোনো ভাইরাস?

[করোনাভাইরাস : কোত্থেকে ছড়ালো? সত্যিই কি ছোঁয়াচে? সত্যিই কি কোনো ‘ভাইরাস’? মহামারী প্রতিরোধে করণীয়]

লিঙ্ক: https://coronavirusnurahmed.blogspot.com/2020/06/blog-post.html

৩. আল্লাহকে বিশ্বাস করি কেন?

লিঙ্ক: https://biliefingod.blogspot.com/2020/08/blog-post.html

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার মোট কারণ মাত্র ৩টি!

মহামারীর চেয়েও ভয়ঙ্কর এক রোগ ডায়াবেটিস
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষ্যে প্রথম আলোয় ১৪ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে ‘ডায়াবেটিস: প্রতিটি পরিবারের যুদ্ধ’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রতিদিন সকালটা ফিলিস্তিনের শিশু আহমেদের শুরু হয় একটু পরই গুলির শব্দ হবে, এ শঙ্কা নিয়ে। আর অন্যদিকে ভারতের শিশু মালিনীর সকাল শুরু হয় অন্য রকম ভয় নিয়ে। তাকে ইনসুলিন নিতে হবে, চামড়া ভেদ করে রক্তাক্ত করে ইনসুলিন দেওয়া হবে; এ আতঙ্কে দিন কাটে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এই শিশুর। যুদ্ধ, সহিংসতা আর হানাহানিতে মানুষের মৃত্যু যেমন দিন দিন পৃথিবীকে করে তুলছে ভয়ংকর; তেমনি পৃথিবীতে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী ১০টি রোগ এ মুহূর্তে হয়ে উঠেছে আশঙ্কাজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে সবচেয়ে উদ্বেগজনক ১০টি স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে অন্যতম ডায়াবেটিস। পৃথিবীতে এ মুহূর্তে ৪৫ কোটির অধিক লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রায় ৮০ লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।’
‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে যেসব জানা জরুরি’ শিরোনামে ১৩ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ১৯৮০ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ১১ কোটি। ২০১৪ সালে সেটা বেড়ে হয় ৪২ কোটিরও বেশি। ১৯৮০ সালে ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের ডায়াবেটিস হওয়ার হার ছিল ৫ শতাংশেরও কম কিন্তু ২০১৪ সালের তাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ।’
আরেকটা প্রতিবেদনের একটা অংশ উল্লেখ করা খুব সংগত মনে হচ্ছে। ‘ঘরে ঘরে ডায়াবেটিস’ শিরোনামে যা দৈনিক সমকালে ১৪ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শুধু বয়স্ক বা মধ্যবয়সী নয়, শিশুরাও এখন এই নীরব ঘাতকের শিকার হচ্ছে। শহর থেকে গ্রাম- সর্বত্র প্রায় সমান হারে ছড়িয়ে পড়ছে ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস এখন প্রায় প্রতিটি ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে।’
সেখানে আরও বলা হয়, ‘দ্রুত নগরায়নের ফলে পরিবর্তিত জীবনযাপনের কারণে বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। আইডিএফের (ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশন) ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪৩ কোটি। ১৯৮৫ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র তিন কোটি। গত আড়াই দশকে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৩ গুণ বেড়েছে। সংস্থাটি দুই বছর পরপর আক্রান্ত মানুষের তথ্য প্রকাশ করে। তাদের ধারণা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৪ কোটিতে উন্নীত হবে।’ এ তথ্যগুলো আমাদেরকে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সতর্ক হবার বার্তা দেয় নিঃসন্দেহে।

ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে বিভ্রান্তি

প্রথমে আমাদের জানা দরকার ডায়াবেটিস কেন হয়?
খুবই হতাশ হই, যখন দেখি ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী মানুষকে সঠিক ধারণা দেয়ার পরিবর্তে ভুল ধারণা দেয়া হয় খুব বেশি। ডায়াবেটিস নিয়ে বিশ্বের নামকরা সব প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত যত গবেষণা করেছে, কোনো গবেষণা ডায়াবেটিসের নির্ভেজাল কারণ খুঁজে বের করতে পারেনি।  দু’একটা উদাহরণ দেখা যাক:
১৭ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখের প্রথম আলোয় ‘গ্রামে ডায়াবেটিস সচেতনতা কম’ শিরোনামে গবেষণা-তথ্যভিত্তিক (গবেষণা তথ্যটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট-এর) একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ‘গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রায় তিনজনের একজন ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত অথবা রোগের ঝুঁকিতে আছেন। ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অপ্রতুল কায়িক পরিশ্রম ডায়াবেটিস হওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।’
এই অধ্যায়ের শুরুতে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘ডায়াবেটিস: প্রতিটি পরিবারের যুদ্ধ’ শিরোনামের যে প্রতিবেদনের কথা বলা হয়েছে, সেখানে আরও বলা হয়, ‘ডায়াবেটিস রোগের সবচেয়ে বড় কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। খাদ্যাভ্যাসে অসচেতনতা, কম শারীরিক কর্মকান্ড, পরিবেশগত বিভিন্ন উপাদান এবং বংশগত বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে জিনগত অস্বাভাবিকতা। বিশ্বের মোট ডায়াবেটিসের শতকরা ৯০ ভাগ টাইপ-২ জাতীয় ডায়াবেটিসে এবং বিশ্বে বর্তমানে ৩০ কোটির অধিক লোক এই প্রকার ডায়াবেটিসে ভুগছে।... তাহলে প্রশ্ন হলো ডায়াবেটিসের কি কোনো সমাধান নেই? অবশ্যই আছে। সুস্থ জীবনযাপন। অতিরিক্ত চিনি কিংবা চর্বিজাতীয় খাবার পরিহার করা, হাঁটা কিংবা ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সচল রাখা, অতিরিক্ত ওজন কমানোর চেষ্টা, ফাস্ট ফুড বা জাঙ্কফুড ও অতিরিক্ত মদপান পরিহার করা।’


বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত যে প্রতিবেদনের কথা এ অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে আরও বলা হয়, ‘ডায়াবেটিস যদিও জেনেটিক এবং আপনার জীবন যাপনের স্টাইলের ওপর নির্ভরশীল তারপরেও আপনি চেষ্টা করলে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারেন।
সেজন্যে আপনাকে খাবার গ্রহণের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে এবং আপনাকে হতে হবে অত্যন্ত সক্রিয় একজন মানুষ।
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। মসৃণ শাদা আটার রুটির পরিবর্তে খেতে হবে ভুষিওয়ালা আটার রুটি। এটাই প্রথম ধাপ।
এড়িয়ে চলতে হবে হোয়াইট পাস্তা, প্যাস্ট্রি, ফিজি ড্রিংকস, চিনি জাতীয় পানীয়, মিষ্টি ইত্যাদি।
আর স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে রয়েছে শাক সব্জি, ফল, বিন্স এবং মোটা দানার খাদ্য শস্য।
স্বাস্থ্যকর তেল, বাদাম খাওয়াও ভালো। ওমেগা থ্রি তেল আছে যেসব মাছে সেগুলো বেশি খেতে হবে। যেমন সারডিন, স্যামন এবং ম্যাকেরেল।
এক বেলা পেট ভরে না খেয়ে পরিমানে অল্প অল্প করে বিরতি দিয়ে খাওয়া দরকার।
শরীর চর্চ্চা বা ব্যায়াম করার মাধ্যমে রক্তে চিনির মাত্রা কমিয়ে রাখা সম্ভব।
চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতি সপ্তাহে আড়াই ঘণ্টার মতো ব্যায়াম করা দরকার। তার মধ্যে দ্রুত হাঁটা এবং সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠাও রয়েছে।
শারীরিকভাবে থাকতে হবে সক্রিয়। ওজন কম রাখলেও চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যদি ওজন কমাতে হয় তাহলে সেটা ধীরে ধীরে করতে হবে। সপ্তাহে আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত।
ধূমপান পরিহার করাও জরুরী। নজর রাখতে হবে কোলস্টেরলের মাত্রার ওপর। এর মাত্রা বেশি হলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।’ [https://www.bbc.com/bengali/news-46194839]


ডায়াবেটিসের কারণ এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে আমি আরও অনেকগুলো প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিতে পারি, যেগুলোতে ডায়াবেটিসের আরও ভিন্ন ভিন্ন কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করতে চাই না। শুধু এ তিনটি প্রতিবেদনেই ডায়াবেটিসের অনেকগুলো কারণ বলা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি এতোগুলো কারণেই ডায়াবেটিস হয় এবং মানুষকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার জন্য এতোগুলো উপায় অবলম্বন করতে হয়, তাহলে কয়জনের ধৈর্যে কুলাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার? শুধু এ কারণেই, আমার খুব শক্তভাবে মনে হয়, বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগের প্রকোপ কমছে না, বরং হু হু করে বাড়ছেই। মহামারীর চেয়েও ভয়াবহ মাত্রায় ডায়াবেটিস সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি এখানে ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে শুধু একটি ধারণা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করবো এবং ডায়াবেটিসের মূল কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করবো। ডায়াবেটিসের কারণ বলে প্রচারিত সব কারণগুলোর স্বরূপ উন্মোচনের জন্য এই লেখার বিভিন্ন জায়গায় আরো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

এখানে প্রথম আলোয় প্রকাশিত "গ্রামে ডায়াবেটিস সচেতনতা কম" শিরোনামের প্রতিবেদনে ডায়াবেটিসের তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, যার প্রথমটি হচ্ছে ধূমপান। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, "ধূমপান পরিহার করাও জরুরী।" আমি ডায়াবেটিস সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় আরো অনেক লেখায় পড়েছি, বলা হচ্ছে, ধূমপানও নাকি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার একটি অন্যতম কারণ।

আমার বড় দুভাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বেশ কয়েক বছর ধরে। আমার মেঝো ভাইয়ের স্ত্রীও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আমাদের বিদ্যালয়ের ঝুনু রানী পাল নামক একজন মহিলা শিক্ষক অনেক বছর ধরে ডায়াবেটিসের সাথে যুদ্ধ করছেন। আমার শাশুড়িরও আছে ডায়াবেটিস। মাদ্রাসা শিক্ষিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত আমার পরিচিত অনেক লোক আছেন, যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আমার মেঝো ভাবীর বাবা-মাও অনেক বছর ধরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এভাবে আমার প্রতিবেশী এবং আত্মীয়সহ কাছের এবং দূরের পরিচিত অনেক লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যাদের সাথে ধূমপানের কোনো সম্পর্কই নেই। ধূমপান করা ছাড়াই তাদের তাহলে ডায়াবেটিস হলো কী করে?! বলতে পারেন, যাদের কথা এখানে বলা হয়েছে, তারা প্রত্যক্ষ ধূমপানের সাথে জড়িত না হলেও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। কিন্তু না, এদের কেউ পরোক্ষ ধূমপানের শিকারও নন। বরং একটা তথ্য জেনে সবাই অবাক হতে পারেন, আমার যে সহকর্মীর ডায়াবেটিস, তাঁর স্বামী নিয়মিত ধূমপান করেন, কিন্তু এখনো ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত। যিনি ধূমপান করেন, তিনি যদি ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত থাকেন, তাহলে তাঁর ধূমপানের পরোক্ষ শিকার কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবেন কিভাবে?!

"বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে ডায়াবেটিস কেন বাড়ছে?" শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় বিবিসি বাংলায় ১৪ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে। সেখানে বলা হয়, "বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি বলছে, বর্তমানে ৩৫ লাখের বেশি নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সংস্থাটি বলছে, এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশের নারীরাই সন্তান জন্মদানের জন্য সক্ষম অবস্থায় (অর্থাৎ কম বয়সে) এ রোগে আক্রান্ত হন" প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, "বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসক মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা দেখেছেন প্রতি দশ জন নারীর মধ্যে একজনের ডায়াবেটিস আছে। আর এজন্য এখনকার জীবনযাত্রাকেই সবচেয়ে বড় কারণ বলে তিনি মনে করেন।
"মূল কারণ আমাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন। কায়িক পরিশ্রম নাই, বসে থাকা হয় বেশি। আর নারীদের আক্রান্ত বেশি হবার কারণ, তারা সংসারের অনেক কাজ করেন, সংসার সামলানো, সন্তান প্রতিপালনসহ সব করার পরে নিজের দিকে নজর দেন না তারা। ডায়াবেটিস হলেও সেটার চিকিৎসায় নজর দেন না অনেকেই।"
এখানে বলা হয়েছে, বর্তমানে ৩৫ লাখের বেশি নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে যারা বসবাস করেন এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে যারা একটু ভালোভাবে জানেন, তারা জানেন, বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা নেই বললেই চলে। উপজাতীয়দের মধ্যে কোনো কোনো মহিলা ধূমপান করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ভার্সিটি পড়–য়া কিছু কিছু তরুণীর মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এখানে যে ৩৫ লাখ নারীর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার কথা বলা হয়েছে, আমার মনে হয়, এদের মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যা খুঁজতে গেলে সর্বোচ্চ এক হাজার জনও পাওয়া যাবে না। তাহলে এই লক্ষ লক্ষ নারী ধূমপান ছাড়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেন কী করে?! নাকি সবার স্বামীই ধূমপায়ী বলেই ধূমপানের পরোক্ষ শিকার হয়ে এরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন? এটাও সম্ভব নয়। কারণ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অনেক মহিলার স্বামীও ধূমপান করেন না। বাংলাদেশে যারা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করেছেন বলে ধর্মীয় চেতনা ধারণ করেন, তাঁরা ধূমপানকে রীতিমতো ঘৃণাই করেন, ধূমপান দূরের কথা। এ ধরনের ধর্মীয় ভাবধারার অসংখ্য মানুষও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাহলে ধূমপানের সাথে সম্পর্ক না থাকার পরও এরা কেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন?

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সাথে ধূমপানের সম্পর্কের বিষয়টা নিয়ে যে কেউ একটু নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই দেখবেন, এর কোনো ভিত্তি নেই। ধূমপানের সাথে সত্যিই যদি ডায়াবেটিসের সম্পর্ক থাকতো, তাহলে বিশ্বব্যাপী শুধু ধূমপায়ীরাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতেন, অধূমপায়ী কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত না হতেন। এখন তো দেখা যায় অনেক ১০-১৫ বছর বয়সী শিশু, যাদের সাথে এখনো ধূমপানের কোনো সম্পর্কই নেই, তারাও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। বিশ্বের যে কোনো দেশে নতুন করে বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করলে এটাই শতভাগ সত্য প্রমাণিত হবে, ডায়াবেটিসের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপানের কোনো সম্পর্ক নেই। বিষয়টা শতভাগ অবাস্তব।

ডায়াবেটিসের প্রকৃত কারণ

গত চার বছরের বেশি সময় ধরে ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। কারণ রোগগুলো সারাবিশ্বেই কোটি কোটি মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন করছে। শুধু ডায়াবেটিসের কথাই বলছি। আমার আত্মীয় এবং পরিচিত অনেকেই রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে কঠিন জীবন যাপন করছে, অনেকে ইতোমধ্যে মারাও গেছে। আমাদের বাড়ির আমার এক জেঠাতো ভাই, নাম আবুল বাশার, ২০১৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা বৃদ্ধি পেয়ে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পরই আরেক জেঠাতো ভাইয়ের স্ত্রী আকস্মিক ডায়াবেটিস বেড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আরো অনেক আত্মীয় ডায়াবেটিসে ভুগে কঠিন জীবন পার করছেন, যে কোনো সময় মারা যেতে পারেন।
ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অনেক ডাক্তারের লেখা ও অনেক গবেষণা প্রতিবেদনে এবং মানুষের মুখে অনেক রকম মন্তব্য পাওয়া যায়। মন্তব্যগুলোর সাথে বাস্তবতার মিল খুঁজতে গিয়ে আমি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হতাশ হয়েছি। দেখেছি, যে কারণগুলোকে ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী করা হয়, বাস্তবতার সাথে তার অনেকগুলোরই মিল নেই।
ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে বিশ্বের অনেক বড় বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ফলাফল মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। দুঃখজনক হচ্ছে, কোনো গবেষণা-ফলাফলেই ডায়াবেটিসের মূল কারণ কয়টি, তা চিহ্নিত করতে দেখা যায় না এবং ডায়াবেটিসের মোট কারণ কয়টি, তা-ও সুনির্দিষ্টভাবে খুঁজে বের করতে পারে না কোনো গবেষণা। একেক গবেষণায় একক কারণকে ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়। কিছু কারণ অনেক সময় মিলে যায়, কিছু কারণ আবার মিলে না। সবগুলো কারণ একত্র করলে মানুষ ডায়াবেটিস থেকে বাঁচার আশা বাদ দিয়ে ভাববে, এতোগুলো কারণ পরিহারের চেয়ে ডায়াবেটিসে ধুঁকে ধুঁকে মরাই বরং ভালো!
মাফ করবেন, আমি কোনো ডাক্তার নই, কোনো গবেষকও নই, তবু এমন মন্তব্য করে ফেললাম। কারণ এমন মন্তব্য করার মতো শক্তি আমার আছে। আমি যে মন্তব্য করেছি, তা খুব ভালোভাবে প্রমাণ করে দেখাতে পারবো বলেই মন্তব্য করার সাহস পেয়েছি।
আমি দেখেছি, ডায়াবেটিসের মূল কারণ মাত্র ১টি এবং ডায়াবেটিস সর্বমোট তিন কারণে হয়। ডায়াবেটিস মূলতঃ যে কারণে হয়, মানুষ তা থেকে দূরে থাকতে পারলে মানুষকে ডায়াবেটিস আক্রমণ করতে পারবে খুব কম। আর ডায়াবেটিস মোট যে তিনটি কারণে হয়, সবগুলো এড়িয়ে চললে নিশ্চিতভাবে মানুষ ডায়াবেটিস থেকে রক্ষা করতে পারবে নিজের মূল্যবান জীবনকে।

আমি দীর্ঘদিন ধরে শুধু একটা বিষয় দেখেছি চরম সত্য হিসেবে, ডায়াবেটিস শুধু ঐসব মানুষের হয়, যারা শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকে বা করলেও পরিমাণে কম করে। পাশাপাশি যারা বেশি বেশি খায় বা মনের চাহিদামতো খায় বা ভোজনপ্রিয় এবং যারা মোটা শরীরের, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বেশি বেশি। এককথায় ডায়াবেটিসের মূল কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা এবং অন্য দুকারণ হচ্ছে বেশি খাওয়া বা মনের চাহিদামতো খাওয়া এবং মুটিয়ে যাওয়া। এই তিনটি কারণ যার মধ্যে নেই, সে কখনো কোনোভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। তবে যারা মোটা হওয়া সত্ত্বেও এবং বেশি বেশি খাওয়া সত্ত্বেও শারীরিক পরিশ্রম করে বেশি বেশি, তারাও খুব কমই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। আবার চিকন লোকও যখন শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকে, অনেক সময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই এতে কোনো সন্দেহ নেই, ডায়াবেটিসের মূল কারণ শারীরিক পরিশ্রম না করা বা কম করা। এককথায় পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম যারা করে, তারা কখনো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। আমার এ বক্তব্যে পুরো আস্থা রাখার জন্য চার শ্রেণির লোকের দিকে লক্ষ্য করার অনুরোধ করছি।
১. বাংলাদেশের ঐসব "পায়েচালিত" রিকশাচালক, যারা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে (অনেকে ৩০-৪০ বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে চালায়) রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এমন এক হাজার বা দশ হাজার রিকশাচালকের খোঁজ নিয়ে দেখুন, দেখবেন তারা কেউই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নন। এমনও দেখা যেতে পারে, তাদের অনেকের পিতামাতা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন বা কোনো সন্তান ইতোমধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এমনও দেখা যাবে, তাদের অধিকাংশই ধূমপান করছেন, নয়তো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার জন্য প্রচারিত অন্য কোনো কারণ অনেকের মধ্যে বিরাজমান, তবু তারা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে না।
২. বিশ্বের সব দেশেই শ্রমজীবি মানুষ আছে। যারা মাটি কাটার কাজ করে বা ফসলের জমি কিংবা কারখানায় হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কাজ করে, এককথায় সেসব শ্রমজীবি মানুষ, যারা শারীরিক শ্রমনির্ভর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে, এমন শ্রম, যা এদেরকে মোটা হতে দেয় না। পনেরো-বিশ বছরের বেশি সময় ধরে যেসব শ্রমজীবি মানুষ এভাবে পরিশ্রম করছেন দিনের একটা বড় অংশ, তারা কেউ দেখবেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নন।
৩. যেসব অ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদ পেশাগতভাবে শারীরিক শ্রমনির্ভর বিভিন্ন খেলা (যেমন: ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, সাঁতার, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি) খেলে যাচ্ছেন ১০ বছরের বেশি সময় ধরে, তাদের খোঁজ নিয়ে দেখুন, দেখবেন ডায়াবেটিসে তারা কেউ আক্রান্ত নন। এরা অনেকে হয়তো ধূমপানও করেন, অনেকে হয়তো ফাস্টফুডেও আসক্ত, অনেকের বাবা-মা কারো হয়তো ডায়াবেটিস ছিল, তবু এরা ডায়াবেটিসের ছোবল থেকে মুক্ত।
৪. বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীতে যারা চাকরি করেন এবং বাধ্যগতভাবে রুটিনমাফিক নিয়মিত পর্যাপ্ত ব্যায়াম করেন, অতিরিক্ত ব্যায়ামের কারণে মোটা হতেও পারছেন না, তাদের কাউকেও দেখবেন না ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে।
এ চার শ্রেণির মানুষের ডায়াবেটিস না হওয়াটা প্রমাণ করে, ডায়াবেটিসের মূল কারণ শারীরিক শ্রম থেকে দূরে থাকা, অন্য কিছু নয়।
মানুষ যখন শারীরিক পরিশ্রম কম করে, মনের চাহিদামতো খায়, একসময় এসব কারণে মুটিয়ে যায়। আর মুটিয়ে গেলে শরীরে চর্বি বা কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। কোলেস্টেরলের মধ্যেই জন্ম নেয় ডায়াবেটিস। অনেক মানুষ মোটা না হলেও নিয়মিত শারীরিক শারীরিক পরিশ্রম না করার কারণে শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
তিনটি কারণে মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। প্রথম কারণ পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করা, দ্বিতীয় কারণ বেশি খাওয়া, তৃতীয় কারণ মুটিয়ে যাওয়া। যে তিনটি কারণে মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়, সেই তিনটি কারণেই মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ যে কোনো কারণে কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। তাই যেসব মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে না পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের কারণে, সেসব মানুষ ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকে।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শতভাগ লোকের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে যে, সে পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম করে না। অনেকের মধ্যে এটা পাওয়া যাবে যে, তারা মোটা বা বেশি বেশি খায়। কিন্তু অন্য কোনো কারণ, যেগুলোকে ডায়াবেটিসের কারণ বলে প্রচার করা হয়, শতভাগ লোকের মধ্যে পাওয়া যাবে না। আমি ধূমপান এবং ডায়াবেটিসের সম্পর্ক নিয়ে আগেই বলেছি, ধূমপানকে তখনই ডায়াবেটিসের কারণ বলে বিশ্বাস করা যেতো, যখন দেখা যেতো ধূপায়ীরাই (সবাই না হলেও অনেকেই) শুধু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় এবং অধূমপায়ী কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। কথাটি প্রচারিত অন্য কারণগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন বলা হয়, ডায়াবেটিস নাকি বংশগতভাবেও হয়। ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ তখনই বলা যাবে,  যখন দেখা যাবে: ১. কারো পূর্বপুরুষ শুধু এক সিঁড়ি নয়, একাধিক সিঁড়ি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল, ২. পিতা/মাতা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, শুধু এমন লোকেরাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বেশি বেশি এবং ৩. পূর্বপুরুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নয়, এমন মানুষ খুব কমই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলা সম্পর্কে এ লেখায় আরো অনেক আলোচনা আছে। এখানে আরো দুএকটা কথা না বললেই নয়। এ অধ্যায়ের শুরুতে ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা সম্পর্কে অনেক পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে। একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, "ইডিএফের ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪৩ কোটি। ১৯৮৫ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র তিন কোটি। গত আড়াই দশকে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৩ গুণ বেড়েছে। সংস্থাটি দুই বছর পরপর আক্রান্ত মানুষের তথ্য প্রকাশ করে। তাদের ধারণা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৪ কোটিতে উন্নীত হবে।"

দৈনিক যুগান্তরে ২৮ ফেব্রুয়াারি ২০১৮ তারিখে "ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস" উপলক্ষ্যে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "এক জরীপ মতে বিশ্বে প্রতি সাত সেকেন্ডে একজন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে এই রোগ এখন মহামারী রূপ নিচ্ছে। দেশে বর্তমানে ৮৪ লাখেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
ডায়াবেটিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৪২ দশমিক ৫ কোটি। অথচ ১৯৮৫ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ কোটি। এখনই এই রোগ প্রতিরোধ করা না গেলে ২০৩৫ সালের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৫৯ কোটিতে পৌঁছানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে।"
এই রকম পরিসংখ্যানগুলো কী নির্দেশ করে, তা আমরা সহজে বুঝতে পারি না বলে ডায়াবেটিসকে বংশগত বা জিনগত রোগ বলে নিজেদের সর্বনাশ করছি। এই রকম পরিসংখ্যানগুলো বলে- যত পেছনের সময়ে যাওয়া যায়, দেখা যায় তখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সমাজে তত কম ছিল। এভাবে যেতে যেতে এমন একটা সময় দেখা যাবে, তখন তেমন কারো ডায়াবেটিস ছিল না। যদি এক সময় পৃথিবীতে তেমন কারো ডায়াবেটিস না থাকে, তাহলে কোন্ সব পূর্বপুরুষ থেকে রোগটি আমাদেরকে সংক্রমিত করেছে? পূর্বপুরুষ কারো তো একসময় ডায়াবেটিস ছিলই না পরিসংখ্যান মতে!
ডায়াবেটিসকে জিনগত রোগ বলে আমরা নিজেদেরকে ধোঁকা দিচ্ছি। যখন দেখছি আমাদের বাবা-মা কারো রোগটি ছিল, তখন ভাবছি রোগটি তো আমার হওয়া অবশ্যম্ভাবী, তাহলে কী আর করার আছে! এটা ভেবে রোগটির নিকট আমরা অসহায় আত্মমসমর্পণ করছি। রোগটি সময় মতো আমাদের আক্রমণ করে বসছে। যারা ডায়াবেটিসকে জিনগত রোগ বলছে, তারা মানবজাতির সর্বনাশ করছে।
আমরা যদি দেখতাম, যত পেছনের সময়ে যাওয়া যায়, মানুষের জীবন তত কষ্টসাধ্য ছিল; মানুষ হেঁটে হেঁটেই তখন চলে যেতো অনেক দূরের গন্তব্যে, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অধিকাংশ কাজ করতে হতো শারীরিক শ্রমের বিনিময়ে; আর মানব সমাজে তখন থেকেই ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, যখন থেকে মানুষের শারীরিক পরিশ্রমের কাজ কমে যেতে শুরু করেছে, যখন থেকে মানুষ মেশিন-নির্ভর হয়ে পড়তে শুরু করেছে; যখন থেকে আরামপ্রিয়তা মানুষের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে; যখন থেকে মানুষ দশ মাইল দূরের কথা, এক মাইল দূরে যাবার জন্যেও গাড়ি ব্যবহার করছে বা করতে পারছে; আমরা বুঝতাম, ডায়াবেটিস আগেকার কোনো ডায়াবেটিস রোগী থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত রোগ নয়, বরং ডায়াবেটিস আরামপ্রিয় মানুষের রোগ; আরামপ্রিয় মানুষের সংখ্যা সমাজে যত বাড়ছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও আনুপাতিকহারে তত বাড়ছে; আমরা খুব সহজে বুঝতাম, ডায়াবেটিস শুধু শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা মানুষদেরকেই আক্রমণ করে, পাশাপাশি যারা পরিমিত খায় না এবং মোটা, তাদেরকে।
টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসকে যারা বংশগত মনে করে, তারা ভাবে না, একসময় সমাজে তেমন কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতো না। পরে আরামপ্রিয় হয়ে যাবার পর থেকেই মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত হতে শুরু করছে। এখন থেকে যদি বিশে^র সকল ডায়াবেটিসমুক্ত মানুষ শারীরিক পরিশ্রমে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় ব্যয় করার মাধ্যমে একযোগে রোগটি প্রতিহত করা শুরু করে, এদের সন্তানরা বা সামনের প্রজন্মের কেউ আর টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত হবে না। তাছাড়া পরিসংখ্যান মতে, টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা সমাজের মোট ডায়াবেটিস রোগীর দশ শতাংশ। এ অধ্যায়ের শুরুতেও প্রথম আলোয় প্রকাশিত "ডায়াবেটিস: প্রতিটি পরিবারের যুদ্ধ" শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বের মোট ডায়াবেটিস রোগীর শতকরা ৯০ ভাগ টাইপ-২ জাতীয় ডায়াবেটিসে ভুগছে।
যদি শুধু এই দশ শতাংশ টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীকে বংশগত ডায়াবেটিস রোগী ধরে নেয়া হয়, তবু বাকি নব্বই শতাংশ টাইপ টু ডায়াবেটিস রোগীর বিবেচনায় টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা একেবারে নগণ্য। তাই রোগটিকে জিনগত না বলাই ভালো।রোগটিকে বংশগতভাবেও হয়, এমন রোগের কাতারে ফেললে যাদের বাবা-মা কারো ডায়াবেটিস, তারা আতঙ্কে জীবন কাটাবে এবং যাদের বাবা-মা কারো ডায়াবেটিস হয়নি, তারা নিশ্চিন্তে জীবন কাটাবে। উভয় শ্রেণিই একসময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়বে কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ফলে।

ডায়াবেটিসের মূল কারণ সম্পর্কে কিছু প্রতিবেদনের বক্তব্য

ডায়াবেটিসের মূল কারণ যে শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা, কথাটির সমর্থনে কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করছি।
(১) ৭ এপ্রিল ২০১৬ তারিখের বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত "বিশ্ব ডায়াবেটিসের ''ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের'' ঝুঁকিতে" শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, "বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সারা বিশ্বে এখন প্রতি ১১ জনে একজন ব্যক্তি ডায়াবেটিস আক্রান্ত। ২০১৪ সালে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪২২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়ষ্ক ব্যক্তি, যা ১৯৮০-তে আক্রান্তের তুলনায় ৪ গুণ বেশি। ৭ই এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রাক্কালে প্রকাশিত সংস্থাটির প্রথম গ্লোবাল রিপোর্টে বলা হয়েছে প্রতি বছর রক্তে উচ্চমাত্রার গ্লুকোজ বা ডায়াবেটিসের কারণে বিশ্বে মারা যাচ্ছে ৩৭ লক্ষ মানুষ।
২০১২ সালে ১৫ লাখ লোক প্রত্যক্ষভাবে ডায়াবেটিসের কারণে মারা যান।"
আরো বলা হয়, "বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে এখনই ''দৃঢ় পদক্ষেপ'' না নিলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।"
এই রিপোর্টে টাইপ-১ এবং টাইপ-২ - দুধরনের ডায়াবেটিস আক্রান্তদের কথাই বলা হয়েছে। তবে এটাও বলা হয়েছে যে ধরনের ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে তারা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের শিকার, যার মূল কারণ অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন।"
(২) জার্মানির জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের (বাংলা) ওয়েবসাইটে ২১ এপ্রিল ২০১২ তারিখে প্রকাশিত "ভারতে ডায়বেটিসের প্রকোপ" শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, "বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাব্লিউএইচও"র তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ৩৪৬ মিলিয়ন মানুষ ডায়বেটিসে আক্রান্ত। ২০৩০ সাল নাগাদ গোটা বিশ্বে আনুমানিক ৭.৮ শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বর্তমানে চীন ও ভারতে দেখা যাচ্ছে এর প্রকোপ। নতুন সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে ৫১ মিলিয়ন মানুষ ডায়বেটিসে ভুগছেন। আগামী ২০ বছরে এই সংখ্যা ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দিল্লি, মুম্বই ও কলকাতার মতো বড় বড় শহরে ডায়াবেটিস রোগীরা একই ধরনের সমস্যার কথা বলেন চিকিৎসকের কাছে, যেমন অফিসে চেয়ারে বসেই কাজ করতে হয় অনেকটা সময়, খেলাধুলা ও স্বাস্থ্যকর খাবারের সুযোগ সুবিধাও কম। পুষ্টিকর খাদ্য দ্রব্য ও রান্নাবান্নার সময়ও পান না অনেকে। চারিদিকে, কোকাকোলা, পিৎসা ও বার্গারের মতো ফাস্টফুডের বিজ্ঞাপন। একটু স্বচ্ছল হলেই গাড়ি কেনার প্রবণতা। ঘরকন্নার সাহায্যে থাকে কাজের লোক। শারীরিক পরিশ্রমের পাল্লাটা অনেক কম ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এসবই বহুমূত্র রোগের দিকে ঠেলে দেয় মানুষকে।"
(৩) ডয়চে ভেলের (বাংলা) ওয়েবসাইটে আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৩ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে "ডায়াবেটিস ও ইনসুলিন" শিরোনামে। সেখানে বলা হয়, "সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। এর কারণ হল বেশি খাওয়া ও কম দৌড়ঝাঁপ বা হাঁটাচলা করা। যার ফলে ডায়াবেটিস আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গী হয়ে উঠেছে। সারা বিশ্বে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। তবে খাওয়াদাওয়া ঠিক রাখলে আর নিয়মিত ব্যায়াম করলে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।"
(৪) ভারত থেকে প্রকাশিত xiaomi.dailyhunt.in (শাওমী ডট ডেইলীহান্ট ডট আইএন) নামক অনলাইন পত্রিকায় ‘ইনসুলিনের অভাবে ভুগবে বিশ্ব’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বর্তমান বিশ্বের অন্যতম জীবনঘাতী রোগ বলা হয় ডায়াবেটিসকে। এই রোগের কারণে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪২ কোটি ৫০ লাখ। আর প্রতিবছরই আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বেড়ে ২০৩০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৫১ কোটি ১০ লাখে। তবে সেই হারে বাড়বে না এই রোগে আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় জীবনরক্ষাকারী ওষুধ ইনসুলিনের সরবরাহ। ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের চার কোটির বেশি রোগী ইনসুলিন পাবেন না। এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ওশেনিয়া অঞ্চলে ভয়াবহ প্রভাবের আশঙ্কা করছেন গবেষকরা।
ল্যানসেট ডায়াবেটিস ও এন্ডোক্রায়োনোলজি জার্নালের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।’
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, ‘গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার সঞ্জয় বসু বলেন, ছোঁয়াচে নয় এমন রোগ বিশেষ করে ডায়াবেটিসের বিস্তার রোধে জাতিসংঘের নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও বর্তমানে চাহিদার তুলনায় ইনসুলিনের প্রাপ্যতা অনেক কম। আগামী ১২ বছরে বার্ধক্য, নগরায়ন, খাদ্যাভাস ও শারীরিক কাজকর্মের ধরনে নানা পরিবর্তনের কারণে গোটা বিশ্বেই টাইপ টু ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে।’
(৫) ‘ডায়েবেটিস থেকে সাবধান!’ শিরোনামে ডয়চে ভেলের ওয়েবসাইটে ২৭ মে ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ার মূল কারণ, অতিরিক্ত ওজন।’ [https://www.dw.com/overlay/media/bn/38965147/41071625]
(৬) ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে "নিয়মিত জীবনযাপন দূর করবে ডায়াবেটিস" শিরোনামে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি দিয়েছেন বোলপুরের চিকিৎসক প্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়। সাক্ষাৎকারের একটি অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে।
"প্রশ্ন: ডায়াবেটিস কেন হয়?
উত্তর: হাইপারটেনশন, থাইরয়েড, হার্টের অসুখ, ফ্যাটি লিভার, আর্থারাইটিজের মতোই ডায়াবেটিস মূলত একটি "লাইফস্টাইল ডিজিজ"। জীবনশৈলীর কারণে যে অসুখগুলো হয় তার মধ্যে অন্যতম হল ডায়াবেটিস। এখন মানুষ কায়িক পরিশ্রম কম করে, অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া করে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই এই ধরনের অসুখের মূলে। আগেকার দিনে ফ্রিজ, এসি, গাড়ি, কম্পিউটার, টিভি, মোবাইলের ব্যবহার কম ছিল। এখন মানুষ মাঠে খেলাধুলোর বদলে কম্পিউটারে গেমে মনোনিবেশ করে। সাইকেলের বদলে স্কুটি ব্যবহার করে। আগে সব ক্ষেত্রেই পরিশ্রম অনেক বেশি ছিল। বর্তমানে গাড়ি চড়া, না হাঁটা, রেস্তোরাঁতে খাওয়া সব দিক থেকে মানুষের জীবনশৈলী বদলেছে। মাছ, ভাত, শাক, পোস্তার জায়গায় খাবার হিসেবে এসেছে পাস্তা, পেস্ট্রি, কোল্ড ড্রিংকস, আইসক্রিম, নুডলস যেগুলি মূলত হাই ক্যালোরির খাবার। এই সমস্ত খাবার বেশি করে খাওয়া এবং কম পরিশ্রম করার ফলে চাইল্ডহুড ওবেসিটি হচ্ছে। এই ওবেসিটিই হচ্ছে ভবিষ্যতে সুগার, প্রেসার, হার্টের অসুখের প্রবেশ পথ। আগেকার থেকে এখন মানুষের জীবনযাত্রা অনেক জটিল হয়েছে। বেড়েছে মানসিক চিন্তা। সমাজ, সংসার, কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপও ডায়াবেটিসের মূলে।"

এই ছয়টি নিবন্ধ-প্রতিবেদনের প্রথমটিতে ডায়াবেটিসের মূল কারণ বলা হয় অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনকে, দ্বিতীয়টিতে ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয় আরামপ্রিয় জীবনযাপন এবং শারীরিক পরিশ্রম কম করাকে, তৃতীয়টিতে ডায়াবেটিসের কারণ বলে মনে করা হয় বেশি খাওয়া, দৌড়ঝাঁপ বা হাঁটাচলা কম করা এবং নিয়মিত ব্যায়াম না করাকে, চতুর্থটিতে বার্ধক্য, নগরায়ন, খাদ্যাভাস ও শারীরিক কাজকর্মের ধরনে নানা পরিবর্তনের কারণে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বলে মনে করা হয়, পঞ্চমটিতে ডায়াবেটিসের মূল কারণ বলা হয় অতিরিক্ত ওজনকে, আর ষষ্ঠটিতে ডায়াবেটিসকে "লাইফস্টাইল ডিজিজ" বলেই আখ্যা দেয়া হয়। লাইফস্টাইল হিসেবে বলা হয়, "এখন মানুষ কায়িক পরিশ্রম কম করে, অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া করে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই এই ধরনের অসুখের মূলে। আগেকার দিনে ফ্রিজ, এসি, গাড়ি, কম্পিউটার, টিভি, মোবাইলের ব্যবহার কম ছিল। এখন মানুষ মাঠে খেলাধুলোর বদলে কম্পিউটারে গেমে মনোনিবেশ করে। সাইকেলের বদলে স্কুটি ব্যবহার করে। আগে সব ক্ষেত্রেই পরিশ্রম অনেক বেশি ছিল। বর্তমানে গাড়ি চড়া, না হাঁটা, রেস্তোরাঁতে খাওয়া সব দিক থেকে মানুষের জীবনশৈলী বদলেছে।"
এই প্রতিবেদনগুলোতে কিন্তু ডায়াবেটিসকে বংশগতভাবেও হয়, এমন রোগ বলা হয়নি; ডায়াবেটিসের সাথে ধূমপান, মদপান, চিনি/মিষ্টি/লবণ বেশি খাওয়ার সম্পর্ক আছে বলেও বলা হয়নি। তবে শুধু শেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ডায়াবেটিসের সাথে মানসিক চাপের সম্পর্কের কথা। শুধু একটা কথাই বলবো, এ অধ্যায়ে যে চার শ্রেণির ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত থাকার কথা বলা হয়েছে, শারীরিক পরিশ্রমে যুক্ত থাকা ছাড়া জীবনের অন্য বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে এরা কি আর সব মানুষের মতো নয়? আর সব মানুষের মতো এদের জীবনেও হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের সাথে মানসিক চাপও নিশ্চয়ই আছে। তাহলে মানসিক চাপ এদেরকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত করতে পারছে না কেন? কারণ মানসিক চাপ কাউকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত করতে পারে তখন, যখন মানুষ পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করার ফলে শরীরে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পায়। যেসব মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে না, তারা শুধু ডায়াবেটিস নয়, হার্ট অ্যাটাক এবং উচ্চ রক্তচাপ থেকেও বেঁচে থাকে। তাই মানসিক চাপ ডায়াবেটিসসহ এ তিনটি রোগের প্রত্যক্ষ কারণ নয়। বরং এসব রোগের প্রত্যক্ষ কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা বা আরামপ্রিয় জীবন যাপন করা। আরামে থাকলেই মানুষকে রোগগুলো আক্রমণ করার সুযোগ পায়।

হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপেরও মূল কারণ ১টি, মোট কারণ ৩টি

এর আগের অধ্যায়ের আগের অধ্যায়ে এটা স্পষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ এই রোগ তিনটি একই সূত্রে গাঁথা। রোগ তিনটির কারণ যেহেতু একই, এগুলো থেকে বেঁচে থাকার উপায়ও একই। আর সর্বশেষ অধ্যায় থেকে সবাই আশা করি স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছেন, ডায়াবেটিসের মূল কারণ ১টি, আর মোট কারণ ৩টি।

যেহেতু ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ এই তিনটি রোগ সমগোত্রীয়, সেহেতু ডায়াবেটিসের মূল কারণ যা, বাকি দু’টি রোগের মূল কারণও তা-ই এবং ডায়াবেটিস যেহেতু মোট তিনটি কারণে মানুষের হয়ে থাকে, অন্য রোগ দু’টিও মোট তিনটি কারণেই মানুষের হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে এর আগের অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, তাই বাড়তি কিছু বলার মনে হয় প্রয়োজন নেই।


‘‘দীর্ঘজীবন লাভের উপায়’’ শিরোনামে একটি বইয়ের অংশ বিশেষ এই লেখাটি। পুরো বই অনলাইনে পড়তে হলে যেতে হবে এই লিঙ্কে: দীর্ঘজীবন লাভের উপায় : পর্ব-১

ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক এবং হাই ব্লাড প্রেসার রোগগুলো পরস্পর সম্পর্কিত

ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ এই রোগগুলোর একটার সাথে আরেকটার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। রোগগুলো একই সূত্রে গাঁথা। কাউকে এরকম একটা রোগ আক্রমণ করলে অন্য রোগগুলোও তাকে আক্রমণ করার সম্ভাবনা খুব বেড়ে যায় এবং আক্রমণ করেও প্রায়ই। কারণ একই ধরনের কারণে রোগগুলো মানুষকে আক্রমণ করে। যাদেরকে রোগগুলো আক্রমণ করে, খুঁজলে দেখা যায়, তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং জীবনযাত্রা প্রায় একই। তাই রোগগুলো যে সমগোত্রীয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে যারা এরকম কোনো একটি বা দু’টি রোগে আক্রান্ত হবার পর সেগুলো নিয়ন্ত্রণের যথাসাধ্য চেষ্টা করে, তাদেরকে সমগোত্রীয় অন্য কোনো রোগ সহজে আক্রমণ করতে পারে না। কিন্তু যারা অবহেলা করে, রোগ নিয়ন্ত্রণের তেমন চেষ্টা করে না, তাদেরকে খুব দ্রুত অন্য রোগগুলো আক্রমণ করে বসে। বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে হলে প্রথমে আমরা বাস্তবতার দিকে একটু চোখ বুলাই।

বাস্তবতা কী বলে?

এমন অসংখ্য মানুষ আমি দেখেছি আমার পরিচিতজনদের মধ্যে, যারা একই সাথে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিস এই তিনটি রোগেই আক্রান্ত। উদাহরণ দিতে চাই না। কারণ আমার দেয়া উদাহরণ শুধু আমার পরিচিতজনরাই যাচাই করে দেখার সুযোগ পাবে সহজে, অন্যরা নয়। তাই উদাহরণ খুঁজে নেয়ার দায়িত্ব সকলের উপর ছেড়ে দিচ্ছি। আপনার পরিচিত যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, দেখবেন তাদের অনেকে উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ এই দু’টির একটি বা উভয়টিতেও আক্রান্ত, আবার যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, তাদের অনেকে দেখবেন ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এই দু’টি রোগের একটি বা উভয়টিতেও আক্রান্ত, আবার যারা হৃদরোগে আক্রান্ত, তাদের অনেককে দেখবেন উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস এই দু’টি রোগের একটি বা উভয়টিতেও আক্রান্ত। তবে হৃদরোগে অনেকে আক্রান্ত হবার পর বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে না বলে সমগোত্রীয় অন্য রোগে আক্রান্ত হবার সুযোগই পায় না বলে হৃদরোগে আক্রান্তদের মধ্যে এ জাতীয় অন্য রোগ দেখা যায় কম। আবার অনেক হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বাইপাস সার্জারী করে অনেকটা সুস্থ হয়ে যাবার কারণে বা নিয়মিত কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ঔষধ সেবন করার ফলে তাদেরকে সমজাতীয় অন্য রোগ আক্রমণ করতে সময় লেগে যায়। তবে হৃদরোগে আক্রান্ত অধিকাংশ ব্যক্তিকে দেখবেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত না হলেও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত।

অনেক মানুষ প্রথমে আক্রান্ত হয় উচ্চ রক্তচাপে, তা নিয়ন্ত্রণে ত্রুটি করলে অন্য দু’টি রোগের কোনো একটি বা উভয়টি তাকে একসময় আক্রমণ করে বসে। অনেককে প্রথমে আক্রমণ করে ডায়াবেটিস, তা নিয়ন্ত্রণ না করলে একসময় হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপ তাকে আক্রমণ করে বসে। অনেকে আবার প্রথমে আক্রান্ত হয় হৃদরোগে, তা নিয়ন্ত্রণে ত্রুটি করলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস এই দু’টি রোগের একটি বা উভয়টি একসময় আক্রমণ করে বসে।
তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ প্রথমে আক্রান্ত হয় উচ্চ রক্তচাপে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ না করলে তাদেরকে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এই দু’টি রোগের কোনো একটি বা উভয়টি আক্রমণ করে। খুব কম লোক এমন পাওয়া যায়, যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার পর তা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার পরও ১০-১৫ বছর ধরে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এই দু’টি রোগের কোনো একটি বা উভয়টি থেকে নিরাপদ ছিলেন।

একটু খুঁজলেই আমাদের আশেপাশে এমন অসংখ্য লোক পাওয়া যাবে, যাদের কেউ এরকম দু’টি রোগে, কেউ আবার একই সাথে তিনটি রোগেই আক্রান্ত। এই রোগগুলোর কোনো একটিতে ১০ বছর ধরে আক্রান্ত এক হাজার রোগীর খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের অন্তত ৮০০ জন লোক এজাতীয় একাধিক রোগে আক্রান্ত। কারণ? কারণ হলো, রোগ তিনটির মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব রয়েছে।

রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে কিছু মতামত

বিষয়টা আরো স্পষ্টভাবে বুঝার জন্য রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক। রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে আমি অনেক গবেষণা প্রতিবেদন এবং পত্রপত্রিকায় ডাক্তারের লেখা অনেক নিবন্ধ পড়েছি। অনেক মানুষের মুখেও রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে অনেক কথা শোনা যায়। দুঃখজনক হচ্ছে, রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার তিন-চারটি প্রকৃত কারণ ছাড়াও অনেকগুলো কারণকে গড়পড়তাভাবে রোগগুলোর জন্য দায়ী বলে প্রচার করা হয়। যেমন: পূর্বপুরুষদের কারো রোগগুলো থাকা, বয়স ৪৫ বা তার বেশি হওয়া, টেনশন বা মানসিক অস্থিরতা, ধূমপান, মদপান, চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার বেশি খাওয়া, লবণ খাওয়া, খাদ্যে ফরমালিন বা ভেজাল, অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম ইত্যাদি। দু’একটা নমুনা দেখা যাক:

৮ অক্টোবর ২০১৬ তারিখের দৈনিক আমাদের সময়ে ডা: এম শমশের আলী একটি নিবন্ধ লেখেন ‘হাই প্রেসার ও হৃদরোগ’ শিরোনামে। সেখানে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে বলা হয়, ‘যারা বেশি টেনশনের কাজ করেন, যাদের কাজের চাপ খুব বেশি, যারা কাজের চাপের জন্য শরীরের যত্ন নিতে পারেন না, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম বা ঘুমাতে পারেন না, তাদের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। দুশ্চিন্তা, অবসন্ন, বংশগত প্রবণতা, অতিমাত্রায় ধূমপান ও মদ্যপান উচ্চ রক্তচাপের কারণ হিসেবে বিবেচিত। যারা খুব বেশি প্রতিযোগী মনোভাবাপন্ন, তাদেরও এ রোগে ভোগার আশঙ্কা রয়েছে। কায়িক শ্রমের অভাব বা অলস জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অতিমাত্রায় লবণ খাওয়ার অভ্যাস, শারীরিক ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস ও রক্তে উচ্চ মাত্রায় কোলেস্টেরল উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।... অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ বিভিন্নভাবে হৃদরোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং যাদের অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা শতভাগ।’

১১ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘হৃদরোগের লক্ষণ ও তা থেকে বাঁচার উপায়’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়, যা লিখেছেন ঢাকার ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট, কার্ডিওলজিস্ট ও সিসিইউ ইনচার্জ ডা. মাহবুবর রহমান। সেখানে বলা হয়, ‘গবেষণায় দেখা যায়, পারিবারিক ইতিহাস ও জেনেটিক বৈশিষ্ট্যই হৃদরোগের ক্ষেত্রে প্রধান ও নিয়ন্ত্রণের অযোগ্য কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিয়ন্ত্রণযোগ্য কারণেই মানুষ আজকাল হৃদরোগে আক্রান্ত হন বেশি। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ এবং অতিরিক্ত ওজন।’

১৭ মে ২০১৮ তারিখের দৈনিক সমকালে ‘বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস’ উপলক্ষ্যে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘আজ বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস’ শিরোনামে। সেখানে বলা হয়, ‘এক গবেষণায় দেখা গেছে, ওজন বাড়লে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার হার দুই থেকে ছয়গুণ বেড়ে যায়। এ ছাড়া  অতিরিক্ত লবণ খাওয়া, ধূমপান, মদপানও উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টিতে দায়ী।’

এ লেখার ‘উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে ভুল ধারণা’ শিরোনামের অধ্যায়ে  ‘উচ্চ রক্তচাপে করণীয়’ শিরোনামে ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখের দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি লেখার অংশবিশেষ উল্লেখ করা হয়েছে। লেখাটিতে ‘৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না’ বলা হলেও উচ্চ রক্তচাপের আশংকা বাড়ায়, এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ করা হয়। যথা: বংশানুক্রমিক, ধূমপান, অতিরিক্ত লবণ গ্রহন, অধিক ওজন ও অলস জীবনযাত্রা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত মদপান, ডায়াবেটিস ও অতিরিক্ত উৎকন্ঠা।

‘আপনি কি ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন?’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয় ৮ অক্টোবর ২০১৭ তারিখের প্রথম আলোয়। লিখেছেন ঢাকার বিআইএইচএস জেনারেল হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিশেষজ্ঞ ডা. এ হাসনাত শাহীন। আট ধরনের মানুষকে লেখাটিতে ডায়াবেটিসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়। যথা: ১. বয়স ৪৫ বা তার বেশি ২. স্থূল ব্যক্তি ৩. রক্ত-সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়ের ডায়াবেটিস থাকলে ৪. শারীরিক পরিশ্রমের ঘাটতি ৫. গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা অধিক ওজনের সন্তান প্রসবের পূর্ব ইতিহাস ৬. পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম ৭. উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক বা হৃদরোগ এবং ৮. রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেশি এবং এইচডিএলের মাত্রা কম থাকলে। [https://www.prothomalo.com/life-style/article/1339441]

‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে যেসব জানা জরুরি’ শিরোনামে বিবিসি বাংলায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৩ নভেম্বর ২০১৮। সেখানে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কিছু উপায় উল্লেখ করা হয়। ‘প্রতিরোধের উপায়’ আর ‘কারণ’ প্রকারান্তরে একই কথা। বলা হয়, ‘ডায়াবেটিস যদিও জেনেটিক এবং আপনার জীবন যাপনের স্টাইলের ওপর নির্ভরশীল তারপরেও আপনি চেষ্টা করলে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারেন। সেজন্যে আপনাকে খাবার গ্রহণের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে এবং আপনাকে হতে হবে অত্যন্ত সক্রিয় একজন মানুষ। প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। মসৃন শাদা আটার রুটির পরিবর্তে খেতে হবে ভুষিওয়ালা আটার রুটি। এটাই প্রথম ধাপ। এড়িয়ে চলতে হবে হোয়াইট পাস্তা, প্যাস্ট্রি, ফিজি ড্রিংকস, চিনি জাতীয় পানীয়, মিষ্টি ইত্যাদি।
আর স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে রয়েছে শাক সব্জি, ফল, বিন্স এবং মোটা দানার খাদ্য শস্য। স্বাস্থ্যকর তেল, বাদাম খাওয়াও ভালো। ওমেগা থ্রি তেল আছে যেসব মাছে সেগুলো বেশি খেতে হবে। যেমন সারডিন, স্যামন এবং ম্যাকেরেল।
এক বেলা পেট ভরে না খেয়ে পরিমানে অল্প অল্প করে বিরতি দিয়ে খাওয়া দরকার।
শরীর চর্চা বা ব্যায়াম করার মাধ্যমে রক্তে চিনির মাত্রা কমিয়ে রাখা সম্ভব। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতি সপ্তাহে আড়াই ঘণ্টার মতো ব্যায়াম করা দরকার। তার মধ্যে দ্রুত হাঁটা এবং সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠাও  রয়েছে।
ওজন কম রাখলেও চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যদি ওজন কমাতে হয় তাহলে সেটা ধীরে ধীরে করতে হবে। সপ্তাহে আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত।
ধূমপান পরিহার করাও জরুরী। নজর রাখতে হবে কোলস্টেরলের মাত্রার ওপর। এর মাত্রা বেশি হলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।’ [https://www.bbc.com/bengali/news-46194839]

উপরের প্রতিবেদনগুলোতে হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের অনেকগুলো কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কারণগুলোর মধ্যে কিছু আছে, তিনটি রোগের ক্ষেত্রেই যেগুলো অনিবার্যভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন: কায়িক শ্রমের অভাব বা অলস জীবনযাপন, শারীরিক ওজন বৃদ্ধি, রক্তে উচ্চ মাত্রায় কোলেস্টেরল, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি। যেহেতু রোগগুলো কিছু কমন বা সাধারণ কারণে হয়ে থাকে, তাই রোগগুলো অবশ্যই সমগোত্রীয়।

নির্দিষ্ট এ কারণগুলো ছাড়া অন্য যে কারণগুলোকে রোগগুলোর জন্য দায়ী করা হয়েছে, (যেমন: ধূমপান, মদপান, লবণ খাওয়া, চিনি/মিষ্টি খাওয়া, বয়স বেশি হওয়া, বংশের কারো থাকা ইত্যাদি) সেগুলো যে সত্যিই রোগগুলোর জন্য দায়ী নয়, তা শুধু এদিকে লক্ষ্য করলেই বুঝা যায়, সব নিবন্ধ/প্রতিবেদনে এগুলোকে রোগগুলোর জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়নি। একেকটিকে একেক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। যদি এগুলো সত্যিই রোগগুলোর জন্য দায়ী হতো, তাহলে সব লেখায় এগুলোর প্রত্যেকটিকে অপরিহার্যভাবে উল্লেখ করা হতো।

মতামতগুলোর সাথে বাস্তবতার মিল কতটুকু?

এই নিবন্ধ/প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখিত কারণগুলোর কোনটি সত্যিকারের কারণ, আর কোনটি সত্যিকারের কারণ নয়, তা আমরা বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখলেও বুঝতে পারবো। বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, যেসব লোক দিনের বেশির ভাগ সময় শারীরিক পরিশ্রমেই কাটিয়ে দেয় বা রুটিনমাফিক দৈনিক দুএক ঘন্টা ব্যায়াম করে, তারা ফাস্টফুডে আসক্ত হলেও, বয়স বেশি হলেও, ধূমপান করলেও, মাদকের সাথে সম্পর্ক রাখলেও, চিনি/মিষ্টান্ন/লবণ মনমতো খেলেও, এমনকি তাদের জীবনে অনেক মানসিক চাপ থাকলেও তাদের শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে না বলে তারা রোগগুলো থেকে মুক্ত থাকে।

আর যেসব মানুষ পনেরো-বিশ বছর ধরে এমন পেশায় নিযুক্ত, যেখানে সারাক্ষণ বসে বসেই কাজ করতে হয়, ব্যায়ামে অভ্যস্ত নয়, এককথায় যাদের জীবনে শারীরিক পরিশ্রম তেমন নেই বা থাকলেও খুব কম, তারা ফাস্টফুড বা জাঙ্কফুড খাক বা না খাক, মিষ্টান্ন/চিনি/লবণ বেশি বা কম খাক, ধূমপান করুক বা না করুক, মদপান করুক বা না করুক, তাদের টেনশন কম থাক বা বেশি থাক বা না থাক, তাদের বাবা-মা এরকম রোগে আক্রান্ত হোক বা না হোক, তারা এসব রোগ থেকে রক্ষা পায় না। এমনকি, এমরকম একটা রোগে আক্রান্ত হবার পরও যখন তাদের টনক না নড়ে, তা নিয়ন্ত্রণে একটু গড়িমসি বা অবহেলা করে, তখন এ জাতীয় অন্য রোগও তাকে পেয়ে বসে।

এক কথায় এটাই বাস্তব, শারীরিক পরিশ্রম যে যত বেশি করে, তার নিকট থেকে এসব রোগ তত বেশি দূরে থাকে আর শারীরিক পরিশ্রম থেকে যে যত বেশি দূরে থাকে, সে তত বেশি এসব রোগে আক্রান্ত হয়। রোগগুলোর সম্পর্ক শুধুই পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম করা বা না করার সাথে। মূলত এখানে এসেই রোগগুলো এক সূতোয় গেঁথে যায়।

রোগগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কিছু মতামত

বিষয়টা আরো পরিষ্কারভাবে বুঝার জন্য বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এই রোগ তিনটির মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন ও নিবন্ধে বর্ণিত মতামত উল্লেখ করা হলো। আশা করি এগুলো পড়ার পর এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ থাকবে না, রোগগুলো যে একই সূত্রে গাঁথা।

প্রথমে ডায়াবেটিস থেকে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে:

উচ্চ রক্তচাপের কারণ ও প্রতিকার' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় জার্মানির জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলে বাংলার ওয়েবসাইটে ২৬ জুন ২০১৩ তারিখে, যা লিখেছেন নুরুননাহার সাত্তার। প্রতিবেদনটির উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার কারণ অনেক' শিরোনামের পরিচ্ছেদে বলা হয়, উচ্চ রক্তচাপের ঠিক আসল কারণ কী তা সেভাবে প্রমাণ হয়নি। তবে অতিরিক্ত ওজন, স্ট্রেস, বেশি মাত্রায় মদ্য পান, ধূমপান, ডায়েবেটিস-২ যাঁদের রয়েছে এবং বয়স- এসবই এর প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। তাছাড়া জেনেটিক কারণও রয়েছে। অর্থাৎ মা-বাবার হাই প্রেশার থাকলে সন্তানদেরও হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।''
[https://www.dw.com/bn/g-16909656]

ডায়াবেটিসের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্কের বিষয়ে বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন' অনুষ্ঠানের ২৯২৪ তম পর্বে কথা বলেন ঢাকার ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. এম এ রশীদ। এনটিভির ওয়েবসাইটে ১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে অনুষ্ঠানটির ভিডিওসহ অনুষ্ঠানটির বিষয়বস্তু লিখিত আকারে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের সম্পর্ক কী?' শিরোনামে প্রকাশ করা হয়। আলোচনায় অধ্যাপক ডা. এম এ রশীদ বলেন, ডায়াবেটিসের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে উচ্চ রক্তচাপের। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা বেশি।' [https://www.ntvbd.com/health/169113]

ঢাকার বারডেম হাসপাতালের ল্যাবরেটরী সার্ভিসেসের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরীর একটি লেখা প্রকাশিত হয় দৈনিক ইত্তেফাকে ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ' শিরোনামে। সেখানে তিনি বলেন, যাদের ডায়াবেটিস নেই, তাদের তুলনায় যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ দেখা যায় বেশি। এমন দেখা যায়, পূর্ণবয়স্ক তিন জন ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে দুই জনেরই থাকে উচ্চ রক্তচাপ। ডায়াবেটিস থাকলে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকিও দ্বিগুণ। চিকিৎসা না হলে উচ্চ রক্তচাপ থেকে হতে পারে হার্ট এ্যাটাক ও স্ট্রোক।' [https://archive.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDlfMjFfMTNfNF80N18xXzcyODgy]

দৈনিক যুগান্তরে ২৮ জুলাই ২০১৮ তারিখে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ' শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ও সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ২০০৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরের বেশি বয়সী ডায়াবেটিস রোগীর ৭৩ শতাংশই উচ্চ রক্তচাপেও ভুগছিল।' [https://www.jugantor.com/todays-paper/features/stay-well/74630]

এবার ডায়াবেটিস থেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে:

ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ' শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয় ১৩ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে, যা লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাকা) ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট অধ্যাপক এস এম মুস্তফা জামান। সেখানে তিনি বলেন, গবেষণা বলছে ৭০ শতাংশ ডায়াবেটিসের রোগী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই অকালে মৃত্যুবরণ করে থাকেন। ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ- এ দুটো পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যে বিষয়গুলো ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত, যেমন: অতি ওজন, ধূমপান, মন্দ খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা বা বংশগতি, এগুলো হৃদরোগেরও ঝুঁকি। তাই এ দুটো সমস্যা পরস্পরের হাত ধরেই চলে। একটির ঝুঁকি কমালে অপরটির ঝুঁকিও কমে আসে।'

ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের সম্পর্ক কী?' শিরোনামে এনটিভির ওয়েবসাইটে ০১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত যে ফিচারটির একটি অংশ একটু আগে উল্লেখ করা হয়, সে ফিচারটির আরেকটি অংশ এখানে উল্লেখ করতে হচ্ছে।
"প্রশ্ন : ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ দুটোর মধ্যে সম্পৃক্ততা কোথায়?
উত্তর : বিষয়টি কিন্তু অত্যন্ত মূল্যবান। ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ দুটো রোগই কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য।... ডায়াবেটিসের সঙ্গে হৃদরোগের ব্যাপক সম্পর্ক রয়েছে। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি।"

ফিচারটির দুটো বক্তব্য একত্র করলে যোগফল এই দাঁড়ায়, রোগ তিনটি একে অন্যের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত।

বাংলাদেশ প্রতিদিনে ৬ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে 'হৃদরোগ যখন ডায়াবেটিস রোগীর' শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. এম শমশের আলী। তিনি সেখানে বলেন, 'ডায়াবেটিস রোগীর হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি শতভাগ। আপনি যদি হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে চান তবে প্রথম অবস্থা থেকেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে আপনাকে বেশ তৎপর হতে হবে।'

এবার উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে:

'উচ্চ রক্তচাপে কেন ওষুধ ব্যর্থ হয়' শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় দৈনিক কালের কণ্ঠে ২৮ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে। সেখানে বলা হয়, 'সারা বিশ্বে মানুষের একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় এখন হৃদরোগ। যদি আপনার উচ্চ রক্তচাপ থাকে তবে আপনাকে এই রোগের বিপদ সম্পর্কে নিশ্চয়ই চিকিৎসকরা সতর্ক করেছেন।
উচ্চ রক্তচাপে রক্তনালীর বেষ্টনীর বিরুদ্ধে রক্তের চাপ খুব বেশি হয়। ফলে হৃদযন্ত্র এবং রক্তনালীকে বাড়তি কাজ করতে হয়। এতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।'

বাংলাদেশ প্রতিদিনে ১৯ মে ২০১৮ তারিখে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় 'উচ্চ রক্তচাপ : নীরব ঘাতক' শিরোনামে, যা লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের অধ্যাপক ও ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, 'দিন দিন উচ্চ রক্তচাপ মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ চারটি অঙ্গে মারাত্মক ধরনের জটিলতা হতে পারে। যেমন হৃৎপিন্ড, কিডনি, মস্তিষ্ক ও চোখ। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদযন্ত্রের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ফলে হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করতে পারে না এবং এই অবস্থাকে বলা হয় হার্ট ফেইলিওর।

এবার উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে:

জার্মানীর জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের ওয়েবসাইটে 'হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ চিনুন, জীবন বাঁচান' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৫ আগস্ট ২০১৪ তারিখে, যা তৈরি করেন নুরুননাহার সাত্তার । সেখানে 'হার্ট অ্যাটাকের কারণ বা ঝুঁকিগুলো কী?’ শিরোনামের পরিচ্ছেদে বলা হয়, 'অতিরিক্ত ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, মদ্যপান, স্ট্রেস বা মানসিক চাপ, কম হাঁটা-চলা, ডায়বেটিস ইত্যাদি।' [https://www.dw.com/overlay/media/bn/17856309/40942842]

'হার্টের অসুখ প্রতিরোধ করা যায়' শিরোনামে দৈনিক কালের কন্ঠে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় 'বিশ্ব হার্ট দিবস' উপলক্ষ্যে, যা লিখেছেন এম এইচ শমরিতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের (ঢাকা) হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ। সেখানে বলা হয়, 'বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, জীবনযাত্রা যত আধুনিক হচ্ছে হার্টের অসুখে আক্রান্তের হার তত বাড়ছে। নিবন্ধটির শেষদিকে হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য যে বিষয়গুলো মেনে চলার কথা বলা হয়, সেগুলোর একটি হচ্ছে-
উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস থাকলে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।''
'ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ' শিরোনামে একটি লেখা দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত হয় ৯ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে, যা লিখেন, ডা. হাফিজা লুনা। তাতে বলা হয়, 'ডায়াবেটিস রোগীরা অধিকহারে ও তীব্রতরভাবে হৃদরোগের শিকার হয়।...যাদের ডায়াবেটিস টাইপ-২ হয়েছে, তাদের উচ্চ রক্তচাপে ভোগার সমূহ সম্ভাবনা আছে। একই সাথে রক্তের লিপিডের অস্বাভাবিকতা, দৈহিক স্থূলতা ইত্যাদিও ২ থেকে ৪ গুণ হারে বৃদ্ধি পায়। সর্বোপরি হৃদরোগ সামগ্রিকভাবে কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমাদের দেশের টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের ৭০ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপ, ৯৭ শতাংশ রক্তে লিপিডের অস্বাভাবিকতা ও ৮০ শতাংশ দৈহিক ওজনজনিত সমস্যায় ভোগেন। এসব রোগ একই সূত্রে বাঁধা- এমনো মতামত দেয়া হয়। এরূপ চক্রকে মেটাবলিক সিনড্রোম বলে।

রোগ তিনটি যে পরস্পরের হাত ধরাধরি করে চলে, এ ব্যাপারে আর কারো সংশয়ের অবকাশ থাকার কথা নয়।

‘‘দীর্ঘজীবন লাভের উপায়’’ শিরোনামে একটি বইয়ের অংশ বিশেষ এই লেখাটি। পুরো বই অনলাইনে পড়তে হলে যেতে হবে এই লিঙ্কে: দীর্ঘজীবন লাভের উপায় : পর্ব-১