এমন অসংখ্য মানুষ আমি দেখেছি আমার পরিচিতজনদের মধ্যে, যারা একই সাথে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিস এই তিনটি রোগেই আক্রান্ত। উদাহরণ দিতে চাই না। কারণ আমার দেয়া উদাহরণ শুধু আমার পরিচিতজনরাই যাচাই করে দেখার সুযোগ পাবে সহজে, অন্যরা নয়। তাই উদাহরণ খুঁজে নেয়ার দায়িত্ব সকলের উপর ছেড়ে দিচ্ছি। আপনার পরিচিত যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, দেখবেন তাদের অনেকে উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ এই দু’টির একটি বা উভয়টিতেও আক্রান্ত, আবার যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, তাদের অনেকে দেখবেন ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এই দু’টি রোগের একটি বা উভয়টিতেও আক্রান্ত, আবার যারা হৃদরোগে আক্রান্ত, তাদের অনেককে দেখবেন উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস এই দু’টি রোগের একটি বা উভয়টিতেও আক্রান্ত। তবে হৃদরোগে অনেকে আক্রান্ত হবার পর বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে না বলে সমগোত্রীয় অন্য রোগে আক্রান্ত হবার সুযোগই পায় না বলে হৃদরোগে আক্রান্তদের মধ্যে এ জাতীয় অন্য রোগ দেখা যায় কম। আবার অনেক হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বাইপাস সার্জারী করে অনেকটা সুস্থ হয়ে যাবার কারণে বা নিয়মিত কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ঔষধ সেবন করার ফলে তাদেরকে সমজাতীয় অন্য রোগ আক্রমণ করতে সময় লেগে যায়। তবে হৃদরোগে আক্রান্ত অধিকাংশ ব্যক্তিকে দেখবেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত না হলেও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত।
অনেক মানুষ প্রথমে আক্রান্ত হয় উচ্চ রক্তচাপে, তা নিয়ন্ত্রণে ত্রুটি করলে অন্য দু’টি রোগের কোনো একটি বা উভয়টি তাকে একসময় আক্রমণ করে বসে। অনেককে প্রথমে আক্রমণ করে ডায়াবেটিস, তা নিয়ন্ত্রণ না করলে একসময় হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপ তাকে আক্রমণ করে বসে। অনেকে আবার প্রথমে আক্রান্ত হয় হৃদরোগে, তা নিয়ন্ত্রণে ত্রুটি করলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস এই দু’টি রোগের একটি বা উভয়টি একসময় আক্রমণ করে বসে।
তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ প্রথমে আক্রান্ত হয় উচ্চ রক্তচাপে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ না করলে তাদেরকে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এই দু’টি রোগের কোনো একটি বা উভয়টি আক্রমণ করে। খুব কম লোক এমন পাওয়া যায়, যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার পর তা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার পরও ১০-১৫ বছর ধরে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এই দু’টি রোগের কোনো একটি বা উভয়টি থেকে নিরাপদ ছিলেন।
একটু খুঁজলেই আমাদের আশেপাশে এমন অসংখ্য লোক পাওয়া যাবে, যাদের কেউ এরকম দু’টি রোগে, কেউ আবার একই সাথে তিনটি রোগেই আক্রান্ত। এই রোগগুলোর কোনো একটিতে ১০ বছর ধরে আক্রান্ত এক হাজার রোগীর খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের অন্তত ৮০০ জন লোক এজাতীয় একাধিক রোগে আক্রান্ত। কারণ? কারণ হলো, রোগ তিনটির মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব রয়েছে।
রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে কিছু মতামত
বিষয়টা আরো স্পষ্টভাবে বুঝার জন্য রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক। রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে আমি অনেক গবেষণা প্রতিবেদন এবং পত্রপত্রিকায় ডাক্তারের লেখা অনেক নিবন্ধ পড়েছি। অনেক মানুষের মুখেও রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে অনেক কথা শোনা যায়। দুঃখজনক হচ্ছে, রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার তিন-চারটি প্রকৃত কারণ ছাড়াও অনেকগুলো কারণকে গড়পড়তাভাবে রোগগুলোর জন্য দায়ী বলে প্রচার করা হয়। যেমন: পূর্বপুরুষদের কারো রোগগুলো থাকা, বয়স ৪৫ বা তার বেশি হওয়া, টেনশন বা মানসিক অস্থিরতা, ধূমপান, মদপান, চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার বেশি খাওয়া, লবণ খাওয়া, খাদ্যে ফরমালিন বা ভেজাল, অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম ইত্যাদি। দু’একটা নমুনা দেখা যাক:
৮ অক্টোবর ২০১৬ তারিখের দৈনিক আমাদের সময়ে ডা: এম শমশের আলী একটি নিবন্ধ লেখেন ‘হাই প্রেসার ও হৃদরোগ’ শিরোনামে। সেখানে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে বলা হয়, ‘যারা বেশি টেনশনের কাজ করেন, যাদের কাজের চাপ খুব বেশি, যারা কাজের চাপের জন্য শরীরের যত্ন নিতে পারেন না, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম বা ঘুমাতে পারেন না, তাদের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। দুশ্চিন্তা, অবসন্ন, বংশগত প্রবণতা, অতিমাত্রায় ধূমপান ও মদ্যপান উচ্চ রক্তচাপের কারণ হিসেবে বিবেচিত। যারা খুব বেশি প্রতিযোগী মনোভাবাপন্ন, তাদেরও এ রোগে ভোগার আশঙ্কা রয়েছে। কায়িক শ্রমের অভাব বা অলস জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অতিমাত্রায় লবণ খাওয়ার অভ্যাস, শারীরিক ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস ও রক্তে উচ্চ মাত্রায় কোলেস্টেরল উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।... অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ বিভিন্নভাবে হৃদরোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং যাদের অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা শতভাগ।’
১১ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘হৃদরোগের লক্ষণ ও তা থেকে বাঁচার উপায়’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়, যা লিখেছেন ঢাকার ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট, কার্ডিওলজিস্ট ও সিসিইউ ইনচার্জ ডা. মাহবুবর রহমান। সেখানে বলা হয়, ‘গবেষণায় দেখা যায়, পারিবারিক ইতিহাস ও জেনেটিক বৈশিষ্ট্যই হৃদরোগের ক্ষেত্রে প্রধান ও নিয়ন্ত্রণের অযোগ্য কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিয়ন্ত্রণযোগ্য কারণেই মানুষ আজকাল হৃদরোগে আক্রান্ত হন বেশি। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ এবং অতিরিক্ত ওজন।’
১৭ মে ২০১৮ তারিখের দৈনিক সমকালে ‘বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস’ উপলক্ষ্যে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘আজ বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস’ শিরোনামে। সেখানে বলা হয়, ‘এক গবেষণায় দেখা গেছে, ওজন বাড়লে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার হার দুই থেকে ছয়গুণ বেড়ে যায়। এ ছাড়া অতিরিক্ত লবণ খাওয়া, ধূমপান, মদপানও উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টিতে দায়ী।’
এ লেখার ‘উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে ভুল ধারণা’ শিরোনামের অধ্যায়ে ‘উচ্চ রক্তচাপে করণীয়’ শিরোনামে ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখের দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি লেখার অংশবিশেষ উল্লেখ করা হয়েছে। লেখাটিতে ‘৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না’ বলা হলেও উচ্চ রক্তচাপের আশংকা বাড়ায়, এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ করা হয়। যথা: বংশানুক্রমিক, ধূমপান, অতিরিক্ত লবণ গ্রহন, অধিক ওজন ও অলস জীবনযাত্রা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত মদপান, ডায়াবেটিস ও অতিরিক্ত উৎকন্ঠা।
‘আপনি কি ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন?’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয় ৮ অক্টোবর ২০১৭ তারিখের প্রথম আলোয়। লিখেছেন ঢাকার বিআইএইচএস জেনারেল হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিশেষজ্ঞ ডা. এ হাসনাত শাহীন। আট ধরনের মানুষকে লেখাটিতে ডায়াবেটিসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়। যথা: ১. বয়স ৪৫ বা তার বেশি ২. স্থূল ব্যক্তি ৩. রক্ত-সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়ের ডায়াবেটিস থাকলে ৪. শারীরিক পরিশ্রমের ঘাটতি ৫. গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা অধিক ওজনের সন্তান প্রসবের পূর্ব ইতিহাস ৬. পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম ৭. উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক বা হৃদরোগ এবং ৮. রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেশি এবং এইচডিএলের মাত্রা কম থাকলে। [https://www.prothomalo.com/life-style/article/1339441]
‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে যেসব জানা জরুরি’ শিরোনামে বিবিসি বাংলায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৩ নভেম্বর ২০১৮। সেখানে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কিছু উপায় উল্লেখ করা হয়। ‘প্রতিরোধের উপায়’ আর ‘কারণ’ প্রকারান্তরে একই কথা। বলা হয়, ‘ডায়াবেটিস যদিও জেনেটিক এবং আপনার জীবন যাপনের স্টাইলের ওপর নির্ভরশীল তারপরেও আপনি চেষ্টা করলে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারেন। সেজন্যে আপনাকে খাবার গ্রহণের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে এবং আপনাকে হতে হবে অত্যন্ত সক্রিয় একজন মানুষ। প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। মসৃন শাদা আটার রুটির পরিবর্তে খেতে হবে ভুষিওয়ালা আটার রুটি। এটাই প্রথম ধাপ। এড়িয়ে চলতে হবে হোয়াইট পাস্তা, প্যাস্ট্রি, ফিজি ড্রিংকস, চিনি জাতীয় পানীয়, মিষ্টি ইত্যাদি।
আর স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে রয়েছে শাক সব্জি, ফল, বিন্স এবং মোটা দানার খাদ্য শস্য। স্বাস্থ্যকর তেল, বাদাম খাওয়াও ভালো। ওমেগা থ্রি তেল আছে যেসব মাছে সেগুলো বেশি খেতে হবে। যেমন সারডিন, স্যামন এবং ম্যাকেরেল।
এক বেলা পেট ভরে না খেয়ে পরিমানে অল্প অল্প করে বিরতি দিয়ে খাওয়া দরকার।
শরীর চর্চা বা ব্যায়াম করার মাধ্যমে রক্তে চিনির মাত্রা কমিয়ে রাখা সম্ভব। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতি সপ্তাহে আড়াই ঘণ্টার মতো ব্যায়াম করা দরকার। তার মধ্যে দ্রুত হাঁটা এবং সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠাও রয়েছে।
ওজন কম রাখলেও চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যদি ওজন কমাতে হয় তাহলে সেটা ধীরে ধীরে করতে হবে। সপ্তাহে আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত।
ধূমপান পরিহার করাও জরুরী। নজর রাখতে হবে কোলস্টেরলের মাত্রার ওপর। এর মাত্রা বেশি হলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।’ [https://www.bbc.com/bengali/news-46194839]
উপরের প্রতিবেদনগুলোতে হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের অনেকগুলো কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কারণগুলোর মধ্যে কিছু আছে, তিনটি রোগের ক্ষেত্রেই যেগুলো অনিবার্যভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন: কায়িক শ্রমের অভাব বা অলস জীবনযাপন, শারীরিক ওজন বৃদ্ধি, রক্তে উচ্চ মাত্রায় কোলেস্টেরল, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি। যেহেতু রোগগুলো কিছু কমন বা সাধারণ কারণে হয়ে থাকে, তাই রোগগুলো অবশ্যই সমগোত্রীয়।
নির্দিষ্ট এ কারণগুলো ছাড়া অন্য যে কারণগুলোকে রোগগুলোর জন্য দায়ী করা হয়েছে, (যেমন: ধূমপান, মদপান, লবণ খাওয়া, চিনি/মিষ্টি খাওয়া, বয়স বেশি হওয়া, বংশের কারো থাকা ইত্যাদি) সেগুলো যে সত্যিই রোগগুলোর জন্য দায়ী নয়, তা শুধু এদিকে লক্ষ্য করলেই বুঝা যায়, সব নিবন্ধ/প্রতিবেদনে এগুলোকে রোগগুলোর জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়নি। একেকটিকে একেক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। যদি এগুলো সত্যিই রোগগুলোর জন্য দায়ী হতো, তাহলে সব লেখায় এগুলোর প্রত্যেকটিকে অপরিহার্যভাবে উল্লেখ করা হতো।
মতামতগুলোর সাথে বাস্তবতার মিল কতটুকু?
এই নিবন্ধ/প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখিত কারণগুলোর কোনটি সত্যিকারের কারণ, আর কোনটি সত্যিকারের কারণ নয়, তা আমরা বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখলেও বুঝতে পারবো। বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, যেসব লোক দিনের বেশির ভাগ সময় শারীরিক পরিশ্রমেই কাটিয়ে দেয় বা রুটিনমাফিক দৈনিক দুএক ঘন্টা ব্যায়াম করে, তারা ফাস্টফুডে আসক্ত হলেও, বয়স বেশি হলেও, ধূমপান করলেও, মাদকের সাথে সম্পর্ক রাখলেও, চিনি/মিষ্টান্ন/লবণ মনমতো খেলেও, এমনকি তাদের জীবনে অনেক মানসিক চাপ থাকলেও তাদের শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে না বলে তারা রোগগুলো থেকে মুক্ত থাকে।
আর যেসব মানুষ পনেরো-বিশ বছর ধরে এমন পেশায় নিযুক্ত, যেখানে সারাক্ষণ বসে বসেই কাজ করতে হয়, ব্যায়ামে অভ্যস্ত নয়, এককথায় যাদের জীবনে শারীরিক পরিশ্রম তেমন নেই বা থাকলেও খুব কম, তারা ফাস্টফুড বা জাঙ্কফুড খাক বা না খাক, মিষ্টান্ন/চিনি/লবণ বেশি বা কম খাক, ধূমপান করুক বা না করুক, মদপান করুক বা না করুক, তাদের টেনশন কম থাক বা বেশি থাক বা না থাক, তাদের বাবা-মা এরকম রোগে আক্রান্ত হোক বা না হোক, তারা এসব রোগ থেকে রক্ষা পায় না। এমনকি, এমরকম একটা রোগে আক্রান্ত হবার পরও যখন তাদের টনক না নড়ে, তা নিয়ন্ত্রণে একটু গড়িমসি বা অবহেলা করে, তখন এ জাতীয় অন্য রোগও তাকে পেয়ে বসে।
এক কথায় এটাই বাস্তব, শারীরিক পরিশ্রম যে যত বেশি করে, তার নিকট থেকে এসব রোগ তত বেশি দূরে থাকে আর শারীরিক পরিশ্রম থেকে যে যত বেশি দূরে থাকে, সে তত বেশি এসব রোগে আক্রান্ত হয়। রোগগুলোর সম্পর্ক শুধুই পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম করা বা না করার সাথে। মূলত এখানে এসেই রোগগুলো এক সূতোয় গেঁথে যায়।
রোগগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কিছু মতামত
বিষয়টা আরো পরিষ্কারভাবে বুঝার জন্য বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এই রোগ তিনটির মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন ও নিবন্ধে বর্ণিত মতামত উল্লেখ করা হলো। আশা করি এগুলো পড়ার পর এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ থাকবে না, রোগগুলো যে একই সূত্রে গাঁথা।
প্রথমে ডায়াবেটিস থেকে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে:
‘উচ্চ রক্তচাপের কারণ ও প্রতিকার' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় জার্মানির জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলে বাংলার ওয়েবসাইটে ২৬ জুন ২০১৩ তারিখে, যা লিখেছেন নুরুননাহার সাত্তার। প্রতিবেদনটির ‘উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার কারণ অনেক' শিরোনামের পরিচ্ছেদে বলা হয়, ‘‘উচ্চ রক্তচাপের ঠিক আসল কারণ কী তা সেভাবে প্রমাণ হয়নি। তবে অতিরিক্ত ওজন, স্ট্রেস, বেশি মাত্রায় মদ্য পান, ধূমপান, ডায়েবেটিস-২ যাঁদের রয়েছে এবং বয়স- এসবই এর প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। তাছাড়া জেনেটিক কারণও রয়েছে। অর্থাৎ মা-বাবার হাই প্রেশার থাকলে সন্তানদেরও হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।''
[https://www.dw.com/bn/g-16909656]
ডায়াবেটিসের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্কের বিষয়ে বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন' অনুষ্ঠানের ২৯২৪ তম পর্বে কথা বলেন ঢাকার ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. এম এ রশীদ। এনটিভির ওয়েবসাইটে ১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে অনুষ্ঠানটির ভিডিওসহ অনুষ্ঠানটির বিষয়বস্তু লিখিত আকারে ‘
ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের সম্পর্ক কী?' শিরোনামে প্রকাশ করা হয়। আলোচনায় অধ্যাপক ডা. এম এ রশীদ বলেন, ‘ডায়াবেটিসের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে উচ্চ রক্তচাপের। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা বেশি।' [https://www.ntvbd.com/health/169113]
ঢাকার বারডেম হাসপাতালের ল্যাবরেটরী সার্ভিসেসের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরীর একটি লেখা প্রকাশিত হয় দৈনিক ইত্তেফাকে ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে ‘ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ' শিরোনামে। সেখানে তিনি বলেন, ‘যাদের ডায়াবেটিস নেই, তাদের তুলনায় যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ দেখা যায় বেশি। এমন দেখা যায়, পূর্ণবয়স্ক তিন জন ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে দুই জনেরই থাকে উচ্চ রক্তচাপ। ডায়াবেটিস থাকলে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকিও দ্বিগুণ। চিকিৎসা না হলে উচ্চ রক্তচাপ থেকে হতে পারে হার্ট এ্যাটাক ও স্ট্রোক।' [https://archive.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDlfMjFfMTNfNF80N18xXzcyODgy]
দৈনিক যুগান্তরে ২৮ জুলাই ২০১৮ তারিখে ‘ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ' শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ও সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘২০০৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরের বেশি বয়সী ডায়াবেটিস রোগীর ৭৩ শতাংশই উচ্চ রক্তচাপেও ভুগছিল।' [https://www.jugantor.com/todays-paper/features/stay-well/74630]
এবার ডায়াবেটিস থেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে:
‘ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ' শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয় ১৩ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে, যা লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাকা) ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট অধ্যাপক এস এম মুস্তফা জামান। সেখানে তিনি বলেন, ‘গবেষণা বলছে ৭০ শতাংশ ডায়াবেটিসের রোগী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই অকালে মৃত্যুবরণ করে থাকেন। ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ- এ দুটো পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যে বিষয়গুলো ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত, যেমন: অতি ওজন, ধূমপান, মন্দ খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা বা বংশগতি, এগুলো হৃদরোগেরও ঝুঁকি। তাই এ দুটো সমস্যা পরস্পরের হাত ধরেই চলে। একটির ঝুঁকি কমালে অপরটির ঝুঁকিও কমে আসে।'
‘ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের সম্পর্ক কী?' শিরোনামে এনটিভির ওয়েবসাইটে ০১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত যে ফিচারটির একটি অংশ একটু আগে উল্লেখ করা হয়, সে ফিচারটির আরেকটি অংশ এখানে উল্লেখ করতে হচ্ছে।
"প্রশ্ন : ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ দুটোর মধ্যে সম্পৃক্ততা কোথায়?
উত্তর : বিষয়টি কিন্তু অত্যন্ত মূল্যবান। ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ দুটো রোগই কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য।... ডায়াবেটিসের সঙ্গে হৃদরোগের ব্যাপক সম্পর্ক রয়েছে। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি।"
ফিচারটির দুটো বক্তব্য একত্র করলে যোগফল এই দাঁড়ায়, রোগ তিনটি একে অন্যের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত।
বাংলাদেশ প্রতিদিনে ৬ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে 'হৃদরোগ যখন ডায়াবেটিস রোগীর' শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. এম শমশের আলী। তিনি সেখানে বলেন, 'ডায়াবেটিস রোগীর হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি শতভাগ। আপনি যদি হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে চান তবে প্রথম অবস্থা থেকেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে আপনাকে বেশ তৎপর হতে হবে।'
এবার উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে:
'উচ্চ রক্তচাপে কেন ওষুধ ব্যর্থ হয়' শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় দৈনিক কালের কণ্ঠে ২৮ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে। সেখানে বলা হয়, 'সারা বিশ্বে মানুষের একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় এখন হৃদরোগ। যদি আপনার উচ্চ রক্তচাপ থাকে তবে আপনাকে এই রোগের বিপদ সম্পর্কে নিশ্চয়ই চিকিৎসকরা সতর্ক করেছেন।
উচ্চ রক্তচাপে রক্তনালীর বেষ্টনীর বিরুদ্ধে রক্তের চাপ খুব বেশি হয়। ফলে হৃদযন্ত্র এবং রক্তনালীকে বাড়তি কাজ করতে হয়। এতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।'
বাংলাদেশ প্রতিদিনে ১৯ মে ২০১৮ তারিখে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় 'উচ্চ রক্তচাপ : নীরব ঘাতক' শিরোনামে, যা লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের অধ্যাপক ও ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, 'দিন দিন উচ্চ রক্তচাপ মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ চারটি অঙ্গে মারাত্মক ধরনের জটিলতা হতে পারে। যেমন হৃৎপিন্ড, কিডনি, মস্তিষ্ক ও চোখ। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদযন্ত্রের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ফলে হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করতে পারে না এবং এই অবস্থাকে বলা হয় হার্ট ফেইলিওর।’
এবার উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে:
জার্মানীর জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের ওয়েবসাইটে 'হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ চিনুন, জীবন বাঁচান' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৫ আগস্ট ২০১৪ তারিখে, যা তৈরি করেন নুরুননাহার সাত্তার । সেখানে 'হার্ট অ্যাটাকের কারণ বা ঝুঁকিগুলো কী?’ শিরোনামের পরিচ্ছেদে বলা হয়, 'অতিরিক্ত ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, মদ্যপান, স্ট্রেস বা মানসিক চাপ, কম হাঁটা-চলা, ডায়বেটিস ইত্যাদি।' [https://www.dw.com/overlay/media/bn/17856309/40942842]
'হার্টের অসুখ প্রতিরোধ করা যায়' শিরোনামে দৈনিক কালের কন্ঠে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় 'বিশ্ব হার্ট দিবস' উপলক্ষ্যে, যা লিখেছেন এম এইচ শমরিতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের (ঢাকা) হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ। সেখানে বলা হয়, 'বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, জীবনযাত্রা যত আধুনিক হচ্ছে হার্টের অসুখে আক্রান্তের হার তত বাড়ছে। নিবন্ধটির শেষদিকে হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য যে বিষয়গুলো মেনে চলার কথা বলা হয়, সেগুলোর একটি হচ্ছে-
উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস থাকলে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।''
'ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ' শিরোনামে একটি লেখা দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত হয় ৯ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে, যা লিখেন, ডা. হাফিজা লুনা। তাতে বলা হয়, 'ডায়াবেটিস রোগীরা অধিকহারে ও তীব্রতরভাবে হৃদরোগের শিকার হয়।...যাদের ডায়াবেটিস টাইপ-২ হয়েছে, তাদের উচ্চ রক্তচাপে ভোগার সমূহ সম্ভাবনা আছে। একই সাথে রক্তের লিপিডের অস্বাভাবিকতা, দৈহিক স্থূলতা ইত্যাদিও ২ থেকে ৪ গুণ হারে বৃদ্ধি পায়। সর্বোপরি হৃদরোগ সামগ্রিকভাবে কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমাদের দেশের টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের ৭০ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপ, ৯৭ শতাংশ রক্তে লিপিডের অস্বাভাবিকতা ও ৮০ শতাংশ দৈহিক ওজনজনিত সমস্যায় ভোগেন। এসব রোগ একই সূত্রে বাঁধা- এমনো মতামত দেয়া হয়। এরূপ চক্রকে মেটাবলিক সিনড্রোম বলে।’
রোগ তিনটি যে পরস্পরের হাত ধরাধরি করে চলে, এ ব্যাপারে আর কারো সংশয়ের অবকাশ থাকার কথা নয়।