খাদ্যে ভেজাল তথা বাজার থেকে কেনা খাদ্যে বিভিন্ন রকম ক্ষতিকর ক্যামিকেল মেশানো বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে অন্যতম আলোচনা-সমালোচনার বিষয়। সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রচেষ্টার পরও খাদ্যে ভেজাল এখনো পুরোপুরি দূর করা যায়নি।
বাজারে বিক্রিত ফলমূল, মাছ, সবজিসহ প্রায় সব খাবারে নানা রকম ক্ষতিকর ক্যামিকেল মেশানো হয়। যেমন: ফরমালিন, প্যারাথিয়ন, মেলামাইন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথোফ্যান, সোডিয়াম কার্বনেট, ফ্লেভার, কৃত্রিম রং, রাসায়নিক কীটনাশক, ইথাইলিন ইত্যাদি। এসব ক্যামিকেলের মধ্যে কিছু আছে, যেগুলো কাঁচা ফলকে পাকিয়ে দেয় অল্প সময়ে; কিছু আছে, ফলে স্বাদ বৃদ্ধি করে; কিছু ক্যামিকেল আছে, যেগুলো মাছ, সবজি, ফল এসবের দ্রুত পঁচন রোধে ব্যবহার করা হয়; কিছু আছে খাদ্যের রংকে কৃত্রিমভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে; কোনো কোনো ক্যামিকেল ফসল বা সবজিতে কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়; কিছু ক্যামিকেল আছে প্রিজারভেটিভ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
এসব ক্যামিকেল মানবদেহের অনেক রকম ক্ষতি করে বলে পত্রপত্রিকায় অনেক লেখা ছাপা হয়। ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখের দৈনিক ইনকিলাবে ‘খাদ্যে ভেজালের ক্ষতিকারক প্রভাব’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যা লিখেছেন ডা. লোকমান হেকিম। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের ডা. আহমদ সাইফুল জব্বার বলেন, মেটাল বেইজড ভেজাল খাবারে কিডনি স্বল্পমাত্রা থেকে সম্পূর্ণ বিকল হতে পারে। পরিপাকতন্ত্রে ভেজাল খাবারের জন্য হজমের গন্ডগোল, ডায়ারিয়া এবং বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের এনেসথেশিয়া ডা. মোঃ মিল্লাত-ই-ইব্রাহীম বলেন, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনের জন্য কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে এ খাবারগুলোতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিষক্রিয়া কার্যকর থাকে। যা রান্না করার পরও অটুট থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার ও ফলমূল আকর্ষণীয় করা ও দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য ক্ষতিকর কার্বাইড, ইন্ডাসট্রিয়াল রং, ফরমালিন, প্যারাথিয়ন ব্যবহার করা হয়। এগুলো গ্রহণের ফলে কিডনি, লিভার ফাংশন, অ্যাজমাসহ বিভিন্ন প্রকার জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ভেজাল খাবারের কারণে যে রোগগুলো দ্বারা মানুষ বেশি আক্রান্ত হয় তাহলো অ্যালার্জি, অ্যাজমা, চর্মরোগ, বমি, মাথাব্যথা, খাদ্য বিষক্রিয়া, অরুচি, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনি ফেলিউর, হার্ট অ্যাটাক প্রভৃতি।’
আরও উল্লেখ করা হয়, ‘পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের ‘বিষাক্ত খাদ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি’ শীর্ষক সেমিনারে বলা হয়, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ।’
নিবন্ধটিতে খাদ্যে ক্ষতিকর ক্যামিকেল মেশানোকে অনেক রোগের জন্য দায়ী করা হয়েছে। মনে হচ্ছে, খাদ্যে ভেজাল মেশানো যখন শুরু হয়নি, তখন মানুষ রোগগুলোতে আক্রান্ত হতো না। হ্যাঁ, খাদ্যে এসব বিষাক্ত ক্যামিকেল মানুষের ক্ষতি করতেই পারে। কিন্তু তাই বলে এমন অসংখ্য শারীরিক সমস্যার জন্য আমরা এখন খাদ্যে ভেজালকে দায়ী করি, খাদ্যে ভেজালের কারণে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হবার বাস্তব প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। ক্যামিকেলযুক্ত কোনো খাবার খেয়ে তাৎক্ষণিক উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, ক্যান্সার এবং ডায়াবেটিস এসব রোগে আক্রান্ত হবার উদাহরণ কেউ দিতে পারবে না। ক্যামিকেলযুক্ত খাবার খেয়ে তাৎক্ষণিক বমি, পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, অজ্ঞান হওয়া, এমনকি মারা যাবার ঘটনাও মাঝে মাঝে আমাদের দেশে ঘটে। যেমন: ১০ জুলাই ২০১৪ তারিখের প্রথম আলোয় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় ‘আম খেয়ে চারজন অসুস্থ’ শিরোনামে। সংবাদে বলা হয়, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় গত মঙ্গলবার রাতে আম খেয়ে তিন ভাইসহ চারজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাতে ভাত খাওয়ার পর আম খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সবার পেটে ব্যথা শুরু হয়। এরপর বমি ও কয়েকবার পায়খানা হয়।
২১ আগস্ট ২০১৩ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘আম খেয়ে একই পরিবারের ৯ জন হাসপাতালে’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ক্যামিকেল মেশানো আম খেয়ে অসুস্থ হয়ে একই পরিবারের শিশু ও মহিলাসহ নয় জন গুরুতর অসুস্থ হয়েছে। পরে তাদেরকে কলাপাড়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদের অধিকাংশই অর্ধচেতন অবস্থায় রয়েছে। ওই পরিবারের সদস্য শিমুল জানান, কলাপাড়া পৌর শহরের সদর রোড এলাকার এক বিক্রেতার কাছ থেকে তার শ্বশুর গত সোমবার আম ক্রয় করেন। রাতে সবাই ওই আম খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। দফায় দফায় বমি ও পায়খানা করতে থাকে সবাই।
১৪ জুলাই ২০১৬ তারিখের দৈনিক যুগান্তরে ‘লাখাইয়ে আম খেতে গিয়ে শিশুর মৃত্যু’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার শিবপুর গ্রামে আম খেতে গিয়ে শারমিন নামে সাড়ে ৩ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সে ওই গ্রামের কৃষক রবিউল ইসলামের মেয়ে। সোমবার বেলা আড়াইটায় এ ঘটনা ঘটে।
তার পরিবার ও এলাকাবাসী থেকে জানা যায়, কৃষক রবিউল ইসলাম রোববার বিকালে কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলার আদমপুর বাজার থেকে এক কেজি ফজলি আম কিনে আনেন। সোমবার দুপুরে তার মেয়ে শারমিন একটি আম খাওয়া শুরু করে। খাওয়ার প্রায় শেষ পর্যায়ে সে ছটফট করতে থাকে। এভাবে প্রায় ২০ মিনিট ছটফট করতে করতেই সে মারা যায়।
এরকম ঘটনা অবশ্যই গুরুতর। অন্তত এরকম ঘটনাগুলো প্রতিহতের জন্য খাদ্যে ভেজাল রোধ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু যেহেতু এরকম ঘটনা ছাড়া খাদ্যে ভেজালের অন্য কোনো ক্ষতির বাস্তব উদাহরণ নেই, তাই সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
কোনো একটা নির্দিষ্ট অপরাধে একজন লোক দোষী প্রমাণিত হলো। সমাজে সংঘটিত অন্য অপরাধগুলোর হোতা খুঁজে না পেয়ে সেগুলোর জন্যও ঐ লোককে কোনো প্রমাণ ছাড়া দায়ী করাটা কি ঠিক হবে? খাদ্যে ক্যামিকেলের জন্য বমি, পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, অজ্ঞান হওয়া, এমনকি ক্যামিকেলের বিষক্রিয়ায় তাৎক্ষণিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটারও প্রমাণ আছে। কিন্তু ক্যামিকেলযুক্ত খাবার খাওয়ার কারণে ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ফাংশন, অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনি ফেইলিউর, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হবার বাস্তব উদাহরণ যখন খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন এসব রোগের জন্যও খাদ্যে ভেজালকে দায়ী করা কখনোই উচিত নয়।
অনেকে বলে থাকেন, বমি, পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, অজ্ঞান হওয়া এসব হচ্ছে ক্যামিকেলযুক্ত খাবার খাওয়ার তাৎক্ষণিক ক্ষতি। আর ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ফাংশন, অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনি ফেইলিউর, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি রোগ হচ্ছে খাদ্যে ভেজালের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি। কিন্তু যারা এসব কথা বলেন, তারা তাদের কথার পক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারবেন? তারা কি বলতে পারবেন, যেসব দেশে আমাদের দেশের মতো খাদ্যে বিষাক্ত ক্যামিকেল মেশানো হয় না, সেসব দেশে কি ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ফাংশন, অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনি ফেইলিউর, হার্ট অ্যাটাক এসব রোগে কেউ আক্রান্ত হয় না? বাংলাদেশে খাদ্যে ক্যামিকেল মেশানো যদি পুরোপুরি রোধ করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ কি ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ফাংশন, অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনি ফেইলিউর, হার্ট অ্যাটাক এসব রোগ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ হয়ে যাবে?
অনেক সাধারণ মানুষকেও প্রায়ই বলতে শুনি, খাদ্যে ভেজালের কারণে আমরা ডায়াবেটিসসহ বিপজ্জনক সব রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। অনুরোধ, মনগড়া মন্তব্য করে কাউকে বিভ্রান্ত করবেন না।
‘‘দীর্ঘজীবন লাভের উপায়’’ শিরোনামে একটি বইয়ের অংশ বিশেষ এই লেখাটি। পুরো বই অনলাইনে পড়তে হলে যেতে হবে এই লিঙ্কে: https://waytogainlonglife.blogspot.com/2019/03/blog-post.html
No comments:
Post a Comment