শিশুশিক্ষার্থীদের উপর পরীক্ষাটা অনেক আগ থেকেই আমার কাছে একটা বোঝা বলে মনে হচ্ছিল। তাই ‘পরীক্ষার ভারে পিষ্ট শৈশব’ এ রকম শিরোনামে একটা লেখায় হাত দেয়ার সুযোগ খুঁজছিলাম। শেষে ২০ মার্চ যুগান্তরে দেখলাম একটি অভাবিত সংবাদ- ‘তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা থাকছে না।’
পরদিন ২১ মার্চ প্রথম আলোয়ও একই শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীতে সব ধরনের পরীক্ষা তুলে নিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। অনেক খুশি হলাম প্রধানমন্ত্রীর এ চমৎকার নির্দেশের কথা জেনে।
আমার বিশ্বাস, দেশের অধিকাংশ মানুষ প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশের গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হবেন। দু-তিনজনের সঙ্গে আলোচনা করে আমার বিশ্বাসের বাস্তবতাও টের পেলাম। বাংলাদেশে এমন অনেক অনিয়ম আছে, যুগ যুগ ধরে যেগুলো চলতে থাকার কারণে মানুষ এখন অনিয়মগুলোকেই নিয়ম বলে চূড়ান্তভাবে বিশ্বাস করে ফেলেছে। তাই এসব কোনো অনিয়মকে নিয়মে আনতে গেলে চারদিকে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়।
আরো পড়ুন: প্রাথমিকের ইংরেজি প্রশ্নকাঠামো কেমন হওয়া উচিত?
একটা বিষয় খুব কম মানুষই উপলব্ধি করেন, শৈশবকালটা মেধা বিকাশের সময়; মেধা যাচাইয়ের সময় নয়। শুধু এজন্য পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের কোনো পরীক্ষা নেয়া হয় না। এসময় শিশুরা খেলবে, শিখবে, আনন্দ করবে। শুনে শিখবে, দেখে শিখবে, পড়ে শিখবে। কিছু শিখতে না শিখতেই কোমলমতি শিশুদের জ্ঞান যাচাই করতে যাওয়াটা ঠিক কিনা, একবার ভেবে দেখলেই শিশুদের পরীক্ষা করার অযৌক্তিকতা সহজেই হৃদয়ঙ্গম হবে।
আমাদের কাছের দেশ হলেও জাপানের কথা আমরা অনেকেই জানি না। জাপানে ১৯৮৮ সালে পড়তে যাওয়া আশির আহমেদ নামক এক বাংলাদেশি এখন জাপানের কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। ‘জাপান কাহিনি’ নামক একটা বই তিনি বের করেন ২০১৫ সালে। এরপর প্রতিবছর বইটির নতুন নতুন খণ্ড বের হতে থাকে। এ বছর বইমেলায় বইটির ৫ম খণ্ড বের হয়েছে। বইটিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘(জাপানে) প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। শিশুদের এসময়টি মেধা বিকাশের সময়, মেধা যাচাইয়ের সময় নয়।’ [পৃষ্ঠা-৩৪]
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে আলোচনায় তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা বন্ধের নির্দেশ দেন, সে আলোচনায় ফিনল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ওইসব দেশে বাচ্চাদের কোনো পরীক্ষা নেই।’ [যুগান্তর, ২০ মার্চ ২০১৯] মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশের কথা জেনে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। একটি প্রশ্ন হল- তাহলে বছর শেষে শিক্ষার্থীদের কোনো পরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণীতে প্রমোশন দেয়া হবে কীভাবে? আমি জানি না, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর এ ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেবে। তবে বিষয়টা এমন নয় যে, পরীক্ষা ছাড়া শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শ্রেণীতে প্রমোশন দেয়ার কোনো যৌক্তিক উপায় নেই।
একটা উপায় এমন হতে পারে- প্রত্যেক বিষয়ের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শ্রেণী পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে একটা নম্বর দেবেন, সেই নম্বরের ওপরই শিক্ষার্থীদের প্রমোশন দেয়া, না দেয়াটা নির্ভর করবে। আরেকটা প্রশ্ন হচ্ছে- যদি একটা শ্রেণীতে ৫০ জন শিক্ষার্থী থাকে, তাহলে তাদের মেধাক্রম কি শিক্ষকদের ওই অনুমান করা নম্বরের ওপর ভিত্তি করে সহজে নির্ণয় করা যাবে। প্রশ্নটির উত্তরের জন্য দেখুন ‘জাপান কাহিনি’ বইটির প্রথম খণ্ড।
সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ক্লাসে কে ধনী, কে গরিব, কে প্রথম, কে দ্বিতীয়- এসব বৈষম্য যেন তৈরি না হয়; তার জন্য যথেষ্ট সতর্ক থাকেন (জাপানের) স্কুল কর্তৃপক্ষ। ক্লাসে রোল নং ১ মানে এই নয় যে, একাডেমিক পারফরমেন্স তার সবচেয়ে ভালো। রোল নং তৈরি হয় নামের বানানের ক্রমানুসারে। [জাপান কাহিনি ১ম খণ্ড, আশির আহমেদ, ঐতিহ্য, পৃষ্ঠা-৫৯]
পড়তে পারেন: প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য বন্ধ করুন!
শিক্ষকদের মূল্যায়নে যেসব শিক্ষার্থী প্রমোশন পাবে, তারা ওপরের শ্রেণীতে উঠে যাবে। তাদের রোল নং হবে তাদের নামের বানানের ক্রমানুসারে। যাদের নামের প্রথম অক্ষর ‘এ’, তাদের নাম ডাকা হবে আগে, যাদের নামের প্রথম অক্ষর ‘বি’, তাদের নামগুলো আসবে এরপর। যেভাবে সেলফোনের ‘ফোনবুকে’ সেভকরা নামগুলো এ, বি, সি, ডি ক্রমানুসারে সাজানো হয়ে থাকে। এতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এক অনর্থক প্রতিযোগিতার মনোভাবও দূর হবে। শিক্ষার্থীরা খুশি মনে, খেলার ছলে, খুব স্বাধীনভাবে শিখবে; মেধার বিকাশ ঘটাবে।
শৈশবেই শিশুদের পরীক্ষার মতো যুদ্ধে নামিয়ে দিলে শিশুদের জীবন হয়ে যায় কঠিন। আমাদের দেশে অবস্থা এমন- অভিভাবকরা শিশুর জন্মের পর যত আগে তাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারেন, মনে করেন শিক্ষার্থীরা তত বেশি এগিয়ে যাবে।
এটা ভাবেন না- প্লে, নার্সারি নামের শ্রেণীগুলোতে পড়ে তার শিশুটি অনার্স, মাস্টার্স পাস করে ফেলবে না। অথচ জাপানে ‘শতকরা ১০০ ভাগ শিশুই ৬ বছর বয়সে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়। কারও বয়স জানতে সিমপ্লি জিজ্ঞাসা করুন, সে কোন ক্লাসে পড়ে। তার সঙ্গে ৫ যোগ করে ফেলুন।’ [জাপান কাহিনি, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৯]
আমরা উন্নত হচ্ছি না শুধু গৎবাঁধা ধারণা নিয়ে বসে থাকার কারণে। পাশের দেশে কী হচ্ছে, তা খোঁজ রাখার আগ্রহ নেই। আশা করি, এ কথাগুলো জানার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতে কেউ কুণ্ঠাবোধ করবে না।
লেখাটি দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয় ৩ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে ‘‘শিশুদের পরীক্ষা তুলে নেয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ’’ শিরোনামে।