ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ এই রোগগুলো কি বয়স বাড়ার সাথে সম্পর্কিত?

ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ এ রোগগুলোকে অনেকে বয়স বাড়ার সাথে সম্পর্কিত করে ফেলেন। বলে থাকেন, বয়স বাড়ার সাথে সাথে রোগগুলো মানুষের শরীরে সৃষ্টি হয়। এরকম কথা শুনলে রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়াকে সবাই ভাগ্যের উপরই ছেড়ে দেবে। মানুষ রোগগুলো থেকে নিজেদেরকে রক্ষার ব্যাপারে হতাশ হবে। রোগগুলো প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করবে না।

jw.org নামক একটি ওয়েবসাইটের বাংলা সংস্করণে প্রকাশিত ব্রাজিলের সচেতন থাক লেখক কর্তৃক লিখিত ‘উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধের ‘(উচ্চ রক্তচাপের) যে কারণগুলো আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না’ শিরোনামের অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন যে, যদি একজন ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনদের উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তা হলে তার ওই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। পরিসংখ্যান দেখায় যে, যেসব যমজ ব্যক্তি দুটো নিষিক্ত ডিম্ব থেকে জন্ম নিয়েছে তাদের তুলনায় একই নিষিক্ত ডিম্ব থেকে জন্ম নেওয়া ব্যক্তিরা উচ্চ রক্তচাপে বেশি আক্রান্ত হয়। একটা গবেষণা “ধমনীয় হাইপারটেনশনের জন্য জিনের অবস্থান দায়ী” বলে নির্দেশ করে, যার সমস্ত কিছুই বংশগতভাবে পাওয়া উপাদানের অস্তিত্বকে নিশ্চিত করে আর তা উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী। এটাও জানা যায় যে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্বাভাবিক উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় এবং এটা কালো চামড়ার পুরুষদের বেলায় বেশি দেখা যায়।’ [https://wol.jw.org/bn/wol/d/r137/lp-be/102002246]

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। দিবসটি উপলক্ষ্যে ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক যুগান্তরে ‘প্রতিরোধই বাঁচার উপায়’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির চিফ কো-অর্ডিনেটর ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। তাতে তিনি লিখেন, ‘রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে এবং পরিবেশের প্রভাবে হয়। কখনও কখনও অন্যান্য রোগের ফলেও হয়ে থাকে। এ রোগ সব লোকেরই হতে পারে।... যাদের বংশে রক্ত-সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স ৪০-এর ওপর এবং যারা শরীরচর্চা করে না-গাড়ি চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন, তাদের ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা বেশি।’

মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার বাংলা সংস্করণে বয়স বেশি হওয়াকেও হৃদরোগের একটি কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে হৃদরোগ সম্পর্কে একটি পরিচিতিমূলক নিবন্ধে হৃদরোগের ঝুঁকির জন্য যে বিষয়গুলোকে দায়ী করা হয়েছে, তন্মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে বয়স বেশি হবার কথা। বলা হয়েছে, ‘হৃদরোগের পিছনে বয়স সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। দেখা গেছে, ৬৫ বছরের বেশি ব্যক্তিদের ৮২ শতাংশ হৃদরোগে মারা গিয়েছেন।’

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়, এমন কথা বলছে কলকাতার (ভারত) আনন্দবাজার পত্রিকা। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘উচ্চ রক্তচাপ? সাবধান!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি তৈরি করেন রুমি গঙ্গোপাধ্যায়। সেখানে উচ্চ রক্তচাপের ৫টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, যার প্রথমটি হলো- ‘বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে (রক্তচাপ বাড়ে)। বয়সের সঙ্গে রক্তচাপ সমানুপাতিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে প্রতি তিন জনের মধ্যে এক জন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। বয়স ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে হলে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন প্রতি ১০ জনের মধ্যে ১ জন। আর পঞ্চাশের কোঠায় বয়স হলে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন প্রতি ১০ জনে ৫ জন। বয়স ৭০ বা তার বেশি হলে প্রতি দুই জনের মধ্যে এক জনের উচ্চ রক্তচাপ থাকবে।’

৩১ অক্টোবর ২০১৭ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিনে উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ক একটি নিবন্ধ ছাপা হয় ‘উচ্চ রক্তচাপের ১০ কারণ’ শিরোনামে। সেখানে উচ্চ রক্তচাপের ১০টি ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ উল্লেখ করা হয়েছে, যার প্রথমটি হচ্ছে- ‘উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিও বাড়ে। বয়স্ক ব্যক্তি হলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।’

বয়স বাড়ার সাথে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের সম্পর্ক আছে, এমন কথার পক্ষে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নেয়া উপরের বক্তব্যগুলো সম্পর্কে আমি কিছু না বলে প্রথমে কিছু ডাক্তারের বক্তব্য উল্লেখ করছি।

০৯ অক্টোবর ২০১৭ তারিখের প্রথম আলোয় ‘কম বয়সেই উচ্চ রক্তচাপ?’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়, যা লিখেছেন ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শরদিন্দু শেখর রায়। তিনি লেখাটিতে বলেন, ‘অনেকে ভাবেন অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে না। এটা বৃদ্ধদের রোগ। আসলে তা নয়। নানা কারণেই অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। ইদানীং অপেক্ষাকৃত কম বয়সে, ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যেই উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিচ্ছে। এ জন্য নানা বদ অভ্যাসও দায়ী। অতি লবণযুক্ত ফাস্ট ফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ওজন বৃদ্ধি ও কায়িক শ্রমের অভাব অল্পবয়সী মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ...’

২৪ আগস্ট ২০১৭ তারিখের দৈনিক সমকালে ‘ছোটদের ডায়াবেটিস ও করণীয়’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়, যা লিখেছেন ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম। তিনি বলেন, ‘জীবনযাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অল্প বয়সে ডায়াবেটিস রোগ ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছে।... কিছুদিন আগেও অল্প বয়সের ডায়াবেটিসকে টাইপ-১ (ইনসুলিননির্ভর) ডায়াবেটিস বলে প্রায় সর্বক্ষেত্রে ধরা হতো। কিন্তু ইদানীং স্থূলকায় শিশুদেরকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে।... বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মোটা হওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। কারণ ছোটরা পরিশ্রম ও খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত। খাওয়া-দাওয়া প্রধানত এখন চটজলদি ফাস্টফুড বা ফ্রায়েড চিপস্, চকোলেট। খেলাধুলার বদলে টিভিতে কার্টুন দেখেই সময় কাটায় তারা। আর গতিবিধি ফ্ল্যাটের মধ্যে সীমাবদ্ধ।’

বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ৩০৭৯তম পর্বে কথা বলেছেন জালালাবাদ রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আয়েশা রফিক চৌধুরী। অনুষ্ঠানটির অলোচ্য বিষয় ছিল ‘অল্প বয়সে হৃদরোগ কেন হয়?’ এনটিভির ওয়েবসাইটে অনুষ্ঠানটির ভিডিওসহ আলোচ্য বিষয়টি প্রকাশ করা হয় ৬ মে ২০১৮ তারিখে। সেখানে ডা. আয়েশা রফিক চৌধুরীকে অল্প বয়সে হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আগে আমরা ধরে নিতাম হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক শুধু বয়স্কদের সমস্যা। এটা এখন আর বদ্ধমূল ধারণার মধ্যে নেই। দেখা যাচ্ছে, তরুণ প্রজন্ম যারা, যারা ২৫ থেকে ৩৫-এর মধ্যে রয়েছে, একদম তরুণ যাদের আমরা মনে করি, তাদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। এর কারণ হিসেবে দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে আমাদের জীবনযাপনটাই বেশি দায়ী। যেমন আমরা বেশিরভাগ সময়ই বসে থাকি, টিভির পাশে অথবা ল্যাপটপে, অথবা মোবাইলে- এই যে সেডেন্টারি জীবনযাপন, অথবা কাজ না করা বা ব্যায়াম না করা, যেটা আমরা ঠিক করতে পারছি না।...’ [https://www.ntvbd.com/health/194191]

বয়স বাড়ার সাথে রোগগুলো সৃষ্টি হবার কথা যারা বলেন, তারা খুব ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করে যে কথা বলেন না, মনগড়া কথা বলেন, তা এ তিনজন ডাক্তারের বক্তব্য পড়ে তারা উপলব্ধি করবেন আশা করি। তারা বয়স বাড়ার সাথে সাথে রোগগুলো মানুষের শরীরে জন্ম নেবার কথা যখন বলেন, তখন এ দিকে লক্ষ্য করেন না যে, ইদানিং মানুষ অল্প বয়সেও রোগগুলোতে ব্যাপকহারে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে। ‘উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে’ শিরোনামে বিবিসি বাংলায় ১৭ মে ২০১০ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ডা: বদিউজ্জমান বলছেন, সাধারণত ৪০-উর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা দেখা গেলেও এখন আমরা এর চেয়ে কমবয়সীদের মধ্যেও উচ্চ রক্তচাপের প্রবনতা দেখছি।’ [https://www.bbc.com/bengali/news/2010/05/100517_tbbdhypertension]

‘কেন শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগ বাড়ছে’ শিরোনামে বিবিসি বাংলায় ১৩ অগাস্ট ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পাঁচ থেকে নয় বছরের বাচ্চাদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচেছ।’  [https://www.bbc.com/bengali/news-40916558]

কোন বয়সে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি, এ বিষয়ে বাংলাদেশের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৯৭১তম পর্বে কথা বলেন কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নূর আলম। অনুষ্ঠানটির পুরো আলোচনা ফিচার আকারে প্রকাশিত হয় এনটিভির ওয়েবসাইটে ২০ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে ‘কোন বয়সে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি?’ শিরোনামে। আলোচনায় ডা. নূর আলম বলেন, ‘আসলে আগে মনে করা হতো, বয়স কম, হার্ট অ্যাটাক হবে না। মনে করা হতো কম বয়সে হার্ট অ্যাটাক হয় না। সাধারণত প্রবীণদের হার্ট অ্যাটাক হতো, তবে আমরা এখন যেটা দেখছি, তরুণ বয়সেও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এটি স্বাভাবিক। তবে ৩০ থেকে ৪৫, এই বয়সে হার্ট অ্যাটাকটা হয়। খুব প্রবীণদের তুলনায় ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সী যারা, তাদের হার্ট অ্যাটাকটা বেশি হয়। তারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এ বিষয়ে। তবে যেকোনো বয়সেই হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।’

জার্মানীর জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের (বাংলা) ওয়েবসাইটে ১৪.১০.২০১৭ তারিখে ‘ভারতে তরুণ প্রজন্মের পুরুষদের মধ্যে হৃদরোগ বিশ্বে সর্বাধিক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ‘৬৮ শতাংশ কার্ডিওলজিস্ট মনে করেন,  হৃদরোগের কোনো বয়স নেই, যে-কোন বয়সেই তা হতে পারে।’  [https://www.dw.com/bn/a-40942842]

সুতরাং এটাই সত্য, রোগগুলো এখন আর মানুষের বয়স বাড়ার জন্য অপেক্ষা করে না, যতো আগে সুযোগ পায়, মানুষকে আক্রমণ করে বসে। ‘সুযোগ’? কী সেই সুযোগ?

এ লেখার একাদশতম পরিচ্ছেদে (হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের প্রতিষেধক) সুযোগটির কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘মানুষের অলসতা, শারীরিক পরিশ্রম ছেড়ে দেয়া, আরামপ্রিয় লাইফস্টাইল আর শরীরে মেদ-চর্বি বৃদ্ধির সুযোগে যে রোগগুলোর জন্ম, সেগুলোর প্রতিষেধক বিজ্ঞান কিভাবে আবিষ্কার করবে!’ বয়স বাড়ার সুযোগে রোগগুলো মানুষকে আক্রমণ করে না, শারীরিক পরিশ্রম ছেড়ে দেয়ার সুযোগেই রোগগুলো মানুষের শরীরে বাসা বাঁধে।

বয়স বাড়ার পর যদি রোগগুলো মানুষকে আক্রমণ করতো, তাহলে যারা ৬০-৭০ বছর বয়স পর্যন্ত শারীরিক পরিশ্রমের পেশায় নিযুক্ত থাকে, তাদের শরীরে রোগগুলো জন্ম নেয় না কেন? আমাদের দেশে যারা রিকশা (পায়ে চালিত) চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে, বয়স ৭০/৮০ বছর হয়ে গেলেও তাদের কারো শরীরে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপ জন্ম নেয় না। কারণ তারা সারাদিন শারীরিক পরিশ্রম করে, ঘাম ঝরায়; শরীরে চর্বি-কোলেস্টেরল বাড়তে দেয় না।

পক্ষান্তরে যারা আরামে থাকতে পছন্দ করে, বেশি বেশি খায়, স্বাস্থ্যবান (মোটা হওয়াকে আমরা অনেকে স্বাস্থ্যবান মনে করি) হতে পছন্দ করে, শরীরে চর্বি-কোলেস্টেরল জমায়, তারা অনেকে ৩০/৩৫ বছর বয়সেও রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ৬০ বছর বয়সের আগেই এরা অনেকে পৃথিবী ত্যাগ করতেও বাধ্য হয়।
সুতরাং রোগগুলোর সম্পর্ক বয়স বাড়ার সাথে নয়, বরং শারীরিক পরিশ্রমহীন থাকার সাথে; শরীরে চর্বি-কোলেস্টেরল বাড়ার সাথে; বেশি বেশি খাওয়ার সাথে। মনগড়া কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করলে মানবজাতিরই ক্ষতি। মানুষ যতদিন বেশি বেশি শারীরিক পরিশ্রম করবে/পর্যাপ্ত ব্যায়াম করবে, চিকন থাকবে, পরিমিত খাবে, ততদিন রোগগুলো মানুষকে স্পর্শ করার সাহস পাবে না, বয়স যতো বেশি হোক। হাজার বার যাচাই করলেও এই কথাটি ভুল প্রমাণ করা যাবে না।

পুরো বই শুরু থেকে পড়তে হলে: https://waytogainlonglife.blogspot.com/2019/03/blog-post.html

টেনশনে কি হার্ট অ্যাটাক (হৃদরোগ) হয়?

‘টেনশনে কি হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক হয়?’ প্রশ্নটির উত্তর এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার এ লেখায় বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে দেয়া হয়েছে। তবু হয়তো অনেকে আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। অসংখ্য শক্তিশালী গবেষণা, অসংখ্য ডাক্তারের দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য এবং সাধারণ মানুষের খুব কমন ধারণার বিপরীতে গিয়ে আমি এটা বলেছি এবং প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি যে, হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক টেনশন বা মানসিক অস্থিরতার জন্যও হতে পারে, তবে মানসিক অস্থিরতা রোগটির মূল বা প্রত্যক্ষ কারণ নয়। রোগটির মূল কারণ হচ্ছে, কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকা বা কায়িক শ্রম কম করা, আরামপ্রিয় লাইফস্টাইল, মুটিয়ে যাওয়া, মনের চাহিদামতো খাওয়া, সর্বোপরি শরীরে চর্বি/কোলেস্টেরল বাড়তে দেয়া ইত্যাদি।

যেসব লোক দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম করে, শরীর হালকা রাখে, পরিমিত খায়, তারা যত টেনশন করুক, হৃদরোগে আক্রান্ত হয় না। পক্ষান্তরে যারা শারীরিক পরিশ্রমের কাজে জড়িত নয় বা খুব কম জড়িত, স্থূল, খাওয়া-দাওয়ায় সংযম অবলম্বন করে না, শরীরে চর্বি বাড়তে দেয়, তারা টেনশন না করলেও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। এজন্য দেখা যায়, অনেক মানুষ, ব্যক্তিগত জীবনে সুখী, তেমন কোনো মানসিক অস্থিরতা নেই, তারাও প্রায়ই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। অনেকে তাৎক্ষণিক মারা যায়, অনেকে চিকিৎসা পর্যন্ত বেঁচে থাকার সুযোগ পেলেও বাকি জীবন কাটাতে হয় হৃদরোগ নিয়ে। এদের প্রায় সবাই শেষে হৃদরোগেই মারা যায়। অর্থাৎ হৃদরোগের প্রত্যক্ষ কারণ পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করা, আরামপ্রিয় জীবন যাপন করা, বেশি খাওয়া, স্থূল হওয়া এবং চর্বি বাড়তে দেয়া।

যারা নিয়মিত পর্যাপ্ত শারীরিক কার্যক্রম করে না, শরীরে চর্বি বাড়তি হতে দেয়, তারা টেনশন করলে অনেক সময় হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে যায়। এই হার্ট অ্যাটাকের জন্য আমরা তখন সরাসরি টেনশনকে দায়ী করে বসি। মনে করি টেনশনই লোকটি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হবার মূল কারণ। কিন্তু আমরা দেখি না অসংখ্য মানুষ যে টেনশন না করেও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। আমরা লক্ষ্য করি না, টেনশনে যাদের হার্ট অ্যাটাক হয়, তারা শারীরিক পরিশ্রমের সাথে তেমন একটা সম্পর্ক রাখতো না, তাদের শরীরে চর্বির মাত্রা বেশি ছিল।

শারীরিক পরিশ্রহীনতার কারণে চর্বি বেড়ে গিয়ে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করার কারণেই মানুষের হার্ট ব্লক্ড হয়ে যায়। এই হার্ট ব্লক্ড হওয়াকেই হার্ট অ্যাটাক বলা হয়, একে হার্ট ফেলিউরও বলা হয়। এজন্য নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করার কারণে যাদের শরীরে বাড়তি চর্বি হতে পারে না, তারা কোনো কিছু নিয়ে অতিমাত্রায় টেনশন করলেও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় না। টেনশন যে হার্ট অ্যাটাকের প্রত্যক্ষ কারণ নয়, এটা তার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

তবু বিষয়টা পরিষ্কারভাবে বুঝতে যাদের কষ্ট হচ্ছে, তাদের জন্য একটি মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন উল্লেখ করছি, যা ছাপা হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিনে ৮ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে ‘হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে প্রবাসীদের, আমিরাতেই এক বছরে ২৩১ জনের মৃত্যু’ শিরোনামে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের ইউ-এ-ই প্রতিনিধি কামরুল হাসান জনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘নিজ দেশের ভূখন্ড ছেড়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে পরবাসে ঠাঁই নেন প্রবাসীরা। দেশের মায়া ত্যাগ করে হাজার মাইল দূরে শ্রম বিক্রি করা এই প্রবাসীরা স্বপ্ন পূরণের আশায় কাজ করেন বছরের পর বছর। সবারই লক্ষ্য থাকে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হয়ে ফিরে আসবেন দেশে। অথচ শ্রম বিক্রিতে ব্যস্ত প্রবাসীদের কর্মক্ষমতার পাশাপাশি কমতে থাকে আয়ুষ্কাল।

ল্যাম্পপোস্টের আলো দেখে যাদের ভোর হয়, তাদের চোখে রাতও নামে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে। মাঝখানে দিনের আলো শুধুই কর্মযজ্ঞে ব্যস্ততা। ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা কর্মস্থলে ব্যয় করে যখন তারা ঘরে ফেরেন তখনই শুরু হয় নানামুখী চিন্তা। কখনো পারিবারিক চিন্তা, কখনো ভিসার মেয়াদ উর্ত্তীণ হয়ে যাবার চাপ, ভিসা পরিবর্তনের খরচ জোগাতে হিমশম খাওয়া, কখনো বা কোম্পানি বন্ধ হয়ে দেশে ফেরার ভয়। নিদ্রাহীন এসব প্রবাসীদের পেয়ে বসে হৃদরোগ। নিয়তির বিধানে কারো কারো জীবন অবসান ঘটে যায় নিষ্ঠুর পরবাসে। 

হৃদরোগ, সড়ক দুর্ঘটনা, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, হত্যাসহ প্রতিবছরেই মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় হাজারও প্রবাসীর নাম। এ তালিকা লম্বা হয় হৃদরোগে আক্রান্ত প্রবাসীদের নামে। বয়সের ভারে নয় বরং তাজা যুবকরাও হৃদরোগে ঝরে যান অকালে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি ও দুবাইয়ে গত এক বছরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যথাক্রমে শতকরা ৭৭ ভাগ ও ৪৯ ভাগ প্রবাসী মারা গেছেন।

আবুধাবিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) ড. মোহাম্মদ মোকসেদ আলী জানান, গত বছর আবুধাবী ও এর অধীনস্থ শহরগুলোতে বিভিন্নভাবে মারা গেছেন ১৪৪ জন প্রবাসী। তাদের মধ্যে ১১১ জনই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

তিনি আরও বলেন, ‘প্রবাসীরা মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বিশেষ করে ভিসার মেয়াদ শেষে নবায়নের চিন্তা, ভালো কর্মসংস্থান না পাওয়া, মাস শেষে ঠিক মত বেতন না পাওয়াসহ পারিবারিক নানা দুশ্চিন্তা তাদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।’

দুবাই ও উত্তর আমিরাত বাংলাদেশ কনসুলেটের প্রথম সচিব (শ্রম) একেএম মিজানুর রহমান জানান, ‘দুবাই বাংলাদেশ কনসুলেটের অধীনস্থ শহরগুলোতে গত বছর বিভিন্নভাবে ২৪৪ জন প্রবাসীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে হৃদরোগে মারা গেছেন ১২০ জন, সাধারণ মৃত্যু ৫২ জনের, সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০ জন, কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় ১৩ জন, আত্মহত্যা-হত্যা মিলে ১৯ জন প্রবাসীর মৃত্যু হয়েছে।’ 

এছাড়াও সৌদি আরবের জেদ্দা কনসুলেটের দেয়া তথ্য অনুযায়ী গত বছর বিভিন্নভাবে সেখানে মারা যান ৮৩০ প্রবাসী বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে হৃদরোগ ও সাধারণ মৃত্যু ৫৯৯ জন, সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭১ জন, আত্মহত্যা ১৯ জন ও অন্যান্য ৪১ জনের মৃত্যু হয়। বাহরাইন মানামা বাংলাদেশ কনসুলেটের তথ্য অনুযায়ী সেখানে গত বছর বিভিন্নভাবে ১১৩ জন প্রবাসীর মৃত্যু হয়, এতে হৃদরোগ ও সাধারণ মৃতের সংখ্যা ৮২ জন। 

প্রবাসীদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া প্রসঙ্গে রাস আল খাইমা ফজল ক্লিনিকের পরিচালক ডাক্তার ফজলুর রহমান বলেন, ‘প্রবাসে যারা সিটিং চাকরি করে তাদের মধ্যে বেশির ভাগ হৃদরোগের ঝুঁকি থাকে। বর্তমানে যারা সাধারণ শ্রমজীবী তাদের মধ্যেও হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বাড়ছে। কারণ তারা দেশ থেকে অনেক দূরে থাকে, তাদের মধ্যে সারাক্ষণ দেশের পরিবার পরিজনের জন্যে চিন্তা কাজ করে। আর্থিক অস্বচ্ছলতাও এর জন্যে দায়ী। তবে চর্বিযুক্ত খাবার ও সিগারেট সেবনের প্রবণতাও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘হৃদরোগ ও মৃত্যু ঝুঁকি কমাতে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার বাদ দেয়া, নিয়মিত ব্যায়াম ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা, ব্লাড প্রেসার ও ডায়বেটিস চেক করাসহ প্রবাসীদের সচেতন করতে কমিউনিটি সংগঠনগুলোর উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। সপ্তাহে বা মাসে অন্তত একটি করে হলেও সচেতনতামূলক সেমিনার, প্রশ্ন-উত্তর পর্ব করলেও প্রবাসীদের হৃদরোগের ঝুঁকি কিছুটা কমে আসতে পারে।’

আপাতদৃষ্টিতে প্রতিবেদনটি হৃদরোগ সম্পর্কে আমার বক্তব্যের পরিপন্থী। কারণ এখানেও হৃদরোগের জন্য কয়েক জায়গায় মানসিক অস্থিরতাকে দায়ী বলে মতামত দেয়া হয়েছে। কিন্তু তবু প্রতিবেদনটি আমার বক্তব্যকে কিভাবে সমর্থন করে?

এখানে মূলত হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে তিনজনের মতামত আছে। প্রথম জন হলেন প্রতিবেদনটির প্রতিবেদক। তাঁর মতে, নানা রকম দুশ্চিন্তার কারণে প্রবাসীরা হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে ব্যাপকহারে। দ্বিতীয় জন হলেন আবুধাবিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) ড. মোহাম্মদ মোকসেদ আলী। তাঁর মতেও মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান প্রবাসীরা। তৃতীয় জন হলেন রাস আল খাইমা ফজল ক্লিনিকের পরিচালক বাংলাদেশি চিকিৎসক ফজলুর রহমান। তাঁর বক্তব্য হলো, প্রবাসে যারা সিটিং জব করেন, তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি। তবে বর্তমানে যারা সাধারণ শ্রমজীবী তাদের মধ্যেও হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বাড়ছে। এরপর তিনি হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর জন্য পরামর্শ দেন খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার বাদ দিতে, নিয়মিত ব্যায়াম ও বিনোদনের ব্যবস্থা করতে, ব্লাড প্রেসার ও ডায়বেটিস চেক করতে।

হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে একজন প্রতিবেদক ও দূতাবাস কর্মকর্তার বক্তব্য মতে, রোগটি দুশ্চিন্তার কারণে হয়ে থাকে। আর একজন ডাক্তার, যিনি প্রবাসেই থাকেন, প্রবাসী মানুষদেরকে সব সময় কাছ থেকে দেখেন, হয়তো অনেক প্রবাসী বাংলাদেশির চিকিৎসাও করেন, তাঁর মতে, প্রবাসে যারা সিটিং (বসে বসে) চাকরি করে তাদের মধ্যে বেশির ভাগ হৃদরোগের ঝুঁকি থাকে। এখন প্রশ্ন, কার কথা সঠিক হতে পারে?

ডাক্তার ফজলুর রহমান ‘বসে বসে চাকরি করা’ প্রবাসীরা বেশি হৃদরোগে আক্রান্ত হবার কথা বলার পর সাধারণ শ্রমজীবিরাও হৃদরোগে আক্রান্ত হবার যে কথা বললেন, তা কেন বললেন? হয়তো এ কারণে যে, পৃথিবীর সবাই টেনশনকেই হৃদরোগে আক্রান্ত হবার জন্য দায়ী মনে করেন। ব্যাপক প্রচলিত এ ধারণা থেকে তিনিও পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেননি হয়তো। অথবা সাধারণ শ্রমজীবি যাদেরকে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হতে দেখেছেন, তারা যে পরিমাণ পরিশ্রম করে, তার চেয়ে বেশি আরাম করে, খায়। শ্রমের তুলনায় আরাম বেশি হলে, খাওয়া বেশি হলে, তেল-চর্বিজাতীয় খাবার বেশি খেলে মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হতেই পারে। কিন্তু পরিশ্রম বেশি হলে এবং যে পরিমাণ পরিশ্রম মানুষের শরীরে চর্বি-কোলেস্টেরল জমতে বাধা দেয়, সে পরিশ্রম মানুষকে হৃদরোগ থেকেও রক্ষা করবেই। কারণ হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক হয় অতিরিক্ত চর্বির কারণে হার্টে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্থ হবার কারণেই।

তবে সাধারণ শ্রমজীবীদের মধ্যেও হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বাড়ার কথা বলার পরও ডাক্তার ফজলুর রহমান কিন্তু হৃদরোগের ঝুঁকি এড়ানোর উপায় হিসেবে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার কথা না বলে বরং বলেছেন খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার বাদ দিতে, নিয়মিত ব্যায়াম ও বিনোদনের ব্যবস্থা করতে, ব্লাড প্রেসার ও ডায়াবেটিস চেক করতে। এতে বুঝা যায়, তিনি হৃদরোগের জন্য বেশি দায়ী মনে করেন ব্যায়াম বা পরিশ্রম না করা, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখা ইত্যাদিকে, টেনশনকে নয়।

একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, ডাক্তার ফজলুর রহমান কিন্তু ধূমপানকে হৃদরোগের জন্য দায়ী মনে করেন না। কারণ তিনি দেখেছেন, যারা বসে বসে কাজ করে, তারাই বেশি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, বসে বসে যারা কাজ করে, তারা বেশি বেশি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হয়, ক্যান্সার এবং স্ট্রোকে নয়- বিষয়টা এই প্রতিবেদন এবং ডাক্তার ফজলুর রহমানের বক্তব্য থেকে সহজে বুঝা যায়।

এরকম বিষয় নিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১০ মার্চ ২০১৮ তারিখের দৈনিক সমকালে ‘মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশিদের হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে’ শিরোনামে।

এরপরও হৃদরোগের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে আমার বক্তব্য যাদের মানতে কষ্ট হয়, তাদেরকে আবারও বলছি, তারা তাদের পরিচিত বা খুব কাছের যারা অতিসম্প্রতি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখুন। দেখবেন, তাদের মধ্যে শতভাগ লোক শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকতেন বা শারীরিক পরিশ্রম করলেও তা পরিমাণে অল্প ছিল। এদের অধিকাংশকেই দেখবেন মোটা ছিল, অনেককে দেখবেন খাওয়া-দাওয়ায় সংযম ছিল না।

এরপর দেখুন, পরিচিত যারা শারীরিক পরিশ্রমের পেশায় দীর্ঘদিন ধরে নিযুক্ত, তাদের কেউ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছে কিনা? যেমন, পায়েচালিত রিকশা যারা দীর্ঘদিন ধরে চালায়, তারা। দেখবেন তারা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত হলেও হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে না কখনো। আশা করি খুব কাছ থেকে বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করলে এটা সবার নিকট স্পষ্ট হবে, হৃদরোগের মুখ্য কারণ টেনশন নয়, বরং শারীরিক পরিশ্রমহীন জীবন যাপন করা। যারা শারীরিক পরিশ্রমহীন জীবন যাপন করেন বা পরিশ্রম করলেও তা পরিমাণে অল্প হয়, তারা টেনশন না করলেও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। পক্ষান্তরে শারীরিক পরিশ্রমে যাদের দিন কাটে, তারা যত টেনশন করুক, হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক তাদের কখনোই স্পর্শ করতে পারে না।

দশ বছরের বেশি সময় ধরে পেশাদার ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি শারীরিক শ্রমনির্ভর খেলা যারা খেলে যাচ্ছেন, তাদের কারো জীবনে কি টেনশনের কিছু নেই? দেখবেন, তারা কেউই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় না কখনো। হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগের মূল কারণ যে শারীরিক পরিশ্রমহীনতা, তার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে!

যাদের শরীরে যদি চর্বির পরিমাণ বেশি, পাশাপাশি শারীরিক পরিশ্রমের কোনো কাজ বা ব্যায়াম থেকেও দূরে থাকে, তারা টেনশন না করলেও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। হয়তো কেউ দু’দিন আগে, কেউ দু’দিন পরে। হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচতে হলে টেনশন থেকে দূরে থাকার চেয়ে আলসেমি, আরামপ্রিয়তা বা শারীরিক নিষ্ক্রীয়তা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন, নিশ্চিতভাবে রক্ষা পাবেন হার্ট অ্যাটাক থেকে।

মানুষ যতদিন দৈনিক অন্তত এক ঘন্টা শারীরিক পরিশ্রম করবে, ততদিন মানুষ হৃদরোগ থেকে নিরাপদ থাকবে। যদি কখনো কোনো বিপদে/রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ পুরোপুরি বিশ্রামে চলে যায়, শারীরিক পরিশ্রম করতে অক্ষম হয়ে পড়ে, শুধু তখন আক্রান্ত হতে পারে হৃদরোগে।

এ লেখায় বেশ কয়েকবার উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমান পৃথিবীতে হৃদরোগে মৃত্যুর হার অন্য সব রোগের চেয়ে বেশি। হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে প্রচলিত বিভ্রান্তিগুলো দূর করা না গেলে এবং হৃদরোগের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন না করলে বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষের মহামূল্যবান জীবন হৃদরোগ কেড়ে নিতেই থাকবে অকালে; মানুষ কখনো হৃদরোগের মতো বিধ্বংসী রোগ থেকে নিস্তার পাবে না এবং দিন যত যাবে, হৃদরোগ মানুষের গড় আয়ুকে সংক্ষিপ্ত থেকে সংক্ষিপ্ততম করতেই থাকবে।

অবাক লাগে, শুধু সাধারণ মানুষ নয়, অনেক ডাক্তারও অবলীলায় মানসিক উত্তেজনাকে হার্ট অ্যাটাকের সবচেয়ে বড় কারণ বলে প্রচার করেন। দু’একটা উদাহরণ দেখুন:

‘মানসিক উত্তেজনা থেকে হার্ট অ্যাটাক’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ২৯ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত একটি লেখায় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ সাইফউল্লাহ বলেন, ‘প্রাচীনকাল থেকেই হৃৎপিন্ডের সঙ্গে মনের সম্পর্কের কথা বলা হয়ে আসছে। মানসিক উৎকণ্ঠা বা উত্তেজনার সময় দ্রুত হৃৎস্পন্দন, বুক ধড়ফড় করা বা বুকে ব্যথা অনুভূত হয়। অনুভূতির সঙ্গে হৃৎপিন্ডের নিবিড় সম্পর্কের কথা জানা যায়। জীবনের কোনো উত্তেজনাকর বা সংঘাতময় পরিস্থিতিতে কোনো কোনো মানুষ হঠাৎ হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে।

সাময়িক মানসিক উত্তেজনা শরীর সহজেই অ্যাডজাস্ট করে নেয়। একটানা মানসিক উত্তেজনা ও দুশ্চিন্তা হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাকের একটি ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান।...’

২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘মেন্টাল টেনশন ও হার্ট অ্যাটাক’ শিরোনামে একটি লেখায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটির কার্ডিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আবু সিদ্দিক বলেন, ‘মনোবিজ্ঞানীরা সব মানুষকে দুই ধরনের ব্যক্তিত্বে বিভাজন করেছেন। যারা অত্যন্ত প্রতিযোগী, পরিশ্রমী, উচ্চাকাক্সক্ষী তাদের টাইপ 'এ' এবং যারা অল্পে সন্তুষ্ট, টেনশনমুক্ত, ঝামেলামুক্ত জীবন পছন্দ করেন তাদের টাইপ 'বি' বলে অভিহিত করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, টাইপ 'এ'-র লোকেরা অধিকতর পরিমাণে মনপীড়নে ভোগেন এবং এদের মাঝে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা টাইপ 'বি'-র চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। যদিও মনপীড়নের সঙ্গে হার্ট অ্যাটাক বা করোনারি হৃদরোগের সরাসরি সম্পর্ক নির্ণয় করা কঠিন। তবুও এর সঙ্গে যদি করোনারি হৃদরোগের অন্যান্য কারণসমূহ যেমন- রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য, ধূমপান, উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদি যোগ হয় তবে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।’

লেখা দু’টিতেই টেনশন বা মানসিক উত্তেজনাকে হার্ট অ্যাটাকের জন্য ‘সরাসরি’ দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এরকম আরো অনেক ডাক্তারের লেখায় এভাবে টেনশনকে হার্ট অ্যাটাকের প্রত্যক্ষ কারণ বলে দায়ী করা হয়। আমার মনে হয়, এভাবে টেনশনকে হার্ট অ্যাটাকের জন্য দোষারোপ করে আমরা হার্ট অ্যাটাকের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে মানুষের ক্ষতিই করছি।

আমরা জানি, টেনশন কেউ ইচ্ছাকৃত করে না। মানুষের জীবনে কোনো সমস্যা উদয় হলে টেনশন এমনিতেই এসে যায়। টেনশনকে অহেতুক হার্ট অ্যাটাকের জন্য দায়ী করে আমরা আমাদের জন্য হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচার কোনো সুযোগই রাখছি না। কারণ টেনশন প্রতিহত করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। জীবন যতদিন থাকবে, বিপদ বা সমস্যা ততদিন থাকবেই কমবেশ। তাই মানুষ যখন দেখে, প্রায় সব ডাক্তার টেনশনকে হার্ট অ্যাটাকের জন্য দায়ী করছে, তখন যারা কোনো কিছু নিয়ে টেনশনে থাকে, তারা ভাবে আমার হার্ট অ্যাটাক হতে পারে যে কোনো সময়। তাই সে হার্ট অ্যাটাককে নিজের অপরিহার্য নিয়তি বলে ধরে নেয়। হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচার আশা ছেড়ে দেয়। হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধের কোনো উপায় খুঁজে পায় না। অথচ হার্ট অ্যাটাক একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ।

তবে যে দু’টি লেখার অংশ এখানে উল্লেখ করা হলো, তার দ্বিতীয় লেখাটিতে শেষে বলা হয়, ‘যদিও মনপীড়নের সঙ্গে হার্ট অ্যাটাক বা করোনারি হৃদরোগের সরাসরি সম্পর্ক নির্ণয় করা কঠিন। তবুও এর সঙ্গে যদি করোনারি হৃদরোগের অন্যান্য কারণসমূহ যেমন- রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য, ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি যোগ হয় তবে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।’ দ্বিতীয় লেখাটির এ বক্তব্য মূলত প্ররোক্ষভাবে এটাই স্বীকার করে, মনপীড়ন বা টেনশনের কারণে হার্ট অ্যাটাক হয় না, হার্ট অ্যাটাক হয় রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য, ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি কারণে। যেহেতু প্রথমে এটা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, ‘মনপীড়নের সাথে হার্ট অ্যাটাকের সরাসরি সম্পর্ক নির্ণয় করা কঠিন’, তাই পরের অংশ (যদি মনপীড়নের সাথে রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য, ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি যোগ হয় তবে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়) থেকে আমরা ধরে নিতে পারি সেগুলোই মূলত হার্ট অ্যাটাকের কারণ।

দ্বিতীয় লেখাটির এ বক্তব্যে হার্ট অ্যাটাকের সাথে টেনশন ও কোলেস্টেরলের সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে উল্টো দিক থেকে। এখানে বলা হয়েছে, টেনশনে যারা ভোগে, তাদের শরীরে যদি কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি হয়, তখন সে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতে পারে। মূলত টেনশনকেই এখানে ধরা হয়েছে হার্ট অ্যাটাকের মুখ্য কারণ আর কোলেস্টেরলের আধিক্যকে ধরা হয়েছে গৌণ কারণ হিসেবে। হার্ট অ্যাটাকের সাথে টেনশন ও কোলেস্টেরলের প্রকৃত সম্পর্ক হচ্ছে, যখন মানুষের শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকে, তখন টেনশন করলে মানুষ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতে পারে। তাই কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকা হচ্ছে হার্ট অ্যাটাকের মুখ্য কারণ আর টেনশন হচ্ছে গৌণ কারণ।

এখানে ধূমপানকেও হার্ট আ্যটাকের একটি কারণ বলে উল্লেখ করা হয়। ধূমপান সত্যিই হার্ট অ্যাটাকের জন্য দায়ী কিনা, তা উপরে আলাদা অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আর উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হবার কথা এখানে যা বলা হয়েছে, তা একেবারে সঠিক। আমার এই লেখায় আগেই বলা হয়েছে, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ- এ তিনটি রোগ সমগোত্রীয়, একই সূত্রে গাঁথা। কারো এ তিনটি রোগের কোনো একটি হলে যদি মানুষ তা নিয়ন্ত্রণ না করে, তাহলে তাকে অন্য দু’টিও আক্রমণ করে বসে। যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, তারাই বেশি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। এজন্য কেউ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হলে যদি নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ গ্রহণ বা ব্যায়াম/কায়িক শ্রম করে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ না করেন, তারা যে কোনো সময় হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে বসেন। এরকম ভুরি ভুরি ঘটনা বিশ্বব্যাপী প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে।

জার্মানীর জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের (বাংলা) ওয়েবসাইটে ১৪.১০.২০১৭ তারিখে প্রকাশিত ‘ভারতে তরুণ প্রজন্মের পুরুষদের মধ্যে হৃদরোগ বিশ্বে সর্বাধিক’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সব হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে একমত যে, নিয়মিত শরীরচর্চা এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস হৃদরোগ ঠেকানোর অন্যতম উপায়।’

সেখানে আরো বলা হয়, ‘তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, অর্থাৎ তিরিশের আশপাশে যাঁদের বয়স, তাঁদের মধ্যে ইদানিং দেখা যাচ্ছে, হৃদরোগের হার ক্রমশই বাড়ছে। এর কারণ কী? হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ দেবব্রত রায় ডয়চে ভেলেকে এই প্রসঙ্গে বললেন, এর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, লাইফ স্টাইল. কারণ, ছোট থেকেই বাচ্চারা খেলাধুলা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বাড়ছে ফাস্ট ফুড খাওয়া। এরজন্য মোটা হচ্ছে। ওজন বাড়ছে কিশোর বয়স থেকেই। অল্প অল্প করে রক্তে বাড়ছে শর্করা, বাড়ছে কোলেস্টরেল। এর ফলে ধমনির দেওয়ালে কিছু কিছু খারাপ চর্বি জমা হয়। এবার রক্ত স্রোতে যদি একটা ঘূর্ণন তৈরি হয়, তখন সেটা ফেটে গেলে তৈরি হয় জমাট বাঁধা একটা রক্তের ঢেলা। সেটা থেকেই হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা। তখন ২৫-৩০ বছর বয়সেই হয় হার্ট অ্যাটাক।’ [https://www.dw.com/bn/a-40942842]

সবশেষে মানসিক চাপের সাথে হার্ট অ্যাটাকের সম্পর্ক নিয়ে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন উল্লেখ করছি। ১০ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখের বিবিসি বাংলায় ‘মানসিক চাপের সাথে হার্ট অ্যাটাকের সম্পর্ক নেই’ শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘একটা সময় মনে করা হতো মানসিক চাপ, অবসাদ কিংবা অসুখী হলে মানুষের মৃত্যু হয়। কারণ মানসিক চাপে থাকলে সেটি হৃদপিন্ডের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং হার্ট অ্যাটাক হয়।

কিন্তু যুক্তরাজ্যের চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী ল্যানস্যাটে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হচ্ছে অতীতের এই ধারনা ভুল ছিল এবং সেটি মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে।

যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার গবেষকরা গত বারো বছর ধরে যৌথভাবে এই জরিপ চালিয়েছেন।

এই জরিপে উভয় দেশের ১০ লাখ নারীর মতামত নেয়া হয়েছে। এরপর সেটির ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গবেষণায় যে বিষয়টি দেখার চেষ্টা হয়েছে তা হলো- মানুষ কতটা সুখী? সুখী হলেই কি মানুষ বেশি দিন বাঁচে?

যাদের উপর এই গবেষণা চালানো হয়েছে তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- তাদের স্বাস্থ্যগত অবস্থা কেমন? তারা কি সুখী? তাদের মানসিক চাপ কতটা আছে? ইত্যাদি প্রশ্ন।

এই গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক বলছেন, “মানুষ শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকলে অসুখী হয়। কিন্তু অসুখী হলে মানুষ মারা যায় না।” তিনি বলছেন মানুষের মৃত্যুর সাথে অসুখী হবার কোন সরাসরি সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।

এই গবেষণা দলের আরেকজন সদস্য এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার রিচার্ড পিটো বলেন, ১০ বছর ধরে গবেষণা চালানোর সময়টিতে তারা লক্ষ্য করেছেন যারা কম ধূমপান করেন তাদের কম বয়সে মারা যাবার সম্ভাবনা দ্বিগুণ।

আর যারা বেশি ধূমপান করেন তাদের কম বয়সে মারা যাবার সম্ভাবনা তিনগুণ। কিন্তু দশ বছর ধরে যারা মানসিক চাপে ভুগছেন কিংবা অসুখী রয়েছেন তারা মারা যাননি।

গবেষক মি: পিটো বলেন, “কিন্তু অনেকেই মনে করে মানসিক চাপে থাকলে কিংবা অসুখী হলে হার্ট এ্যাটাক হয়। এটা সত্য নয়। আসলে অনেক মানুষ এটা ভাবতে পছন্দ করে।”

তবে গবেষকরা বলছেন কেউ যদি শৈশবে অসুখী থাকে তাহলে সেটি তার উপর দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’

[https://www.bbc.com/bengali/news/2015/12/151210_mental_health?fbclid=IwAR1La57AgggYfkW66IiIyk5ixax4zhWlZROoRalI0cNfZMxuY6VhBR2A_jo]

এই গবেষণা প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়, ‘অনেকেই মনে করে মানসিক চাপে থাকলে কিংবা অসুখী হলে হার্ট এ্যাটাক হয়। এটা সত্য নয়। আসলে অনেক মানুষ এটা ভাবতে পছন্দ করে।’

তবে গবেষণা-ফলাফলটির অন্য কিছু মন্তব্যের সাথে আমার ভিন্নমত রয়েছে। যেমন, এখানে বলা হয়েছে, ‘যারা কম ধূমপান করেন তাদের কম বয়সে মারা যাবার সম্ভাবনা দ্বিগুণ। আর যারা বেশি ধূমপান করেন তাদের কম বয়সে মারা যাবার সম্ভাবনা তিনগুণ।’ কিন্তু আমার এই লেখায় আমি ধূমপানের ক্ষতি সম্পর্কে আলাদা এক অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি, ধূমপানে মারাত্মক যেসব ক্ষতির কথা ব্যাপকভাবে বিশ্বব্যাপী প্রচার করা হয় সেসব ক্ষতির সাথে বাস্তবে ধূমপানের সম্পর্ক নেই। প্রকৃতপক্ষে ধূমপান করা-না করার সাথে দীর্ঘজীবন লাভ করা-না করার তেমন একটা যোগসূত্র নেই। অসংখ্য ধূমপায়ী চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ধরে ধূমপান করেও ধূমপানের কথিত ক্ষতিগুলো থেকে মুক্ত থাকে আবার অনেক অনেক মানুষ ধূমপান থেকে একশ’ হাত দূরে থেকেও ঐসব ক্ষতির সম্মুখীন হয়, ধূমপান করলে যেসব ক্ষতি হয় বলে প্রচার করা হয়। ধূমপান সম্পর্কীয় আমার ওই অধ্যায়টি পড়লে আশা করি সবাই বিষয়টা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবেন।

যাহোক, হার্ট অ্যাটাকের জন্য মানসিক উত্তেজনা যে সরাসরি দায়ী নয়, অন্তত এ কথাটা বিশ্বাস করতে এ গবেষণা প্রতিবেদনও সবাইকে সহায়তা করবে। আমরা নিজেরাও আমাদের আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলে পরিষ্কার বুঝতে পারবো, সুখী মানুষরাই, বিশেষ করে যেসব সুখী মানুষ সুখে থাকার পাশাপাশি আরামে থাকতেও পছন্দ করে, তারাই বেশি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। আর যাদের জীবনে মানসিক অস্থিরতা বেশি, তাদের মধ্যে যারা শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে, তারাই বেশি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। বিষয়টা হাজার বার যাচাই করা হলেও একই ফল মিলবে। আশা করি হার্ট অ্যাটাকের কারণ সম্পর্কে অনর্থক কোনো কিছুকে দোষারোপ করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা থেকে সবাই সতর্ক হবে।


পুরো বই শুরু থেকে পড়তে হলে: https://waytogainlonglife.blogspot.com/2019/03/blog-post.html

‘শিক্ষক নিবন্ধন’ একটি তামাশার নাম

 ‘শিক্ষক নিবন্ধন’ একটি তামাশার নাম

নূর আহমদ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষক নিয়োগে তো এমন নিয়ম হতে পারতো যে, ছাত্রজীবন শেষে যেসব ছাত্র শিক্ষকতায় আগ্রহী তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ জমা দেবে আর ঐ প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শূন্য পদে বা সৃষ্ট পদে প্রয়োজন এবং সময়মতো পর্যায়ক্রমে তাদেরকে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেবে।

কিন্তু আমাদের দেশে নিয়মটা কেমন? একজন ছাত্র যতোই মেধাবী হোক, মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি যত কৃতিত্বের সঙ্গেই নিক, কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু নয়, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্যও তাকে যোগ্য মনে করা হয় না, তাকে এজন্য পুনরায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায়  অংশ নিতে হয়! এর একটা অর্থ কিন্তু এটা দাঁড়ায় যে, একজন নিয়োগপ্রার্থী তার শিক্ষাজীবনে যদি সবগুলো পাবলিক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতেও উত্তীর্ণ হয়, সেও কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়েও শিক্ষকতার যোগ্য নয়! তার যোগ্যতা যাচাইয়ের আরো বাকি থাকে! আরেকটা অর্থ হতে পারে যে, আমাদের দেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলো শিক্ষার্থীদের মেধা বা যোগ্যতা মূল্যায়নে ব্যর্থ; এসব পরীক্ষার সনদগুলো ভুয়া!

আমি বাংলাদেশের স্বনামধন্য দুটি মাদ্রাসা থেকে কামিল পর্যন্ত সবগুলো পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ/শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হই। ২০০৬ সালে নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রভাষক, আরবি পদের জন্য অংশগ্রহণ করি। ফলাফল হাতে পেয়ে মনে আশা জাগলো এবার তাহলে একটা চাকরি পাওয়া সহজ হবে।  কিন্তু আমি কোথাও যোগদানের সুযোগ পাইনি। তাহলে কি আমার পড়ালেখা সব ভুয়া, নাকি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস ভুয়া?

শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষকে নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরাসরি নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা দিলে সমস্যা কোথায়?

নূর আহমেদ,

দক্ষিণ মাগুরী, দত্তপাড়া, লক্ষ্মীপুর

[লেখাটি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয় ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ইং। লিঙ্ক: https://archive1.ittefaq.com.bd/print-edition/letter/2014/09/23/5339.html ]

যৌতুকের জন্য খুন বন্ধ হবে কবে?

 যৌতুকের জন্য খুন বন্ধ হবে কবে?

আহমেদ নূর
প্রায়ই পত্রিকায় যৌতুকের জন্য স্ত্রী খুনের সংবাদ চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে একই দিন দেশের একাধিক স্থানে যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে খুন করার ঘটনাও ঘটে। বিগত ১৮ সেপ্টেম্বর যুগান্তরে প্রকাশিত এ রকম তিনটি ঘটনার শিরোনাম দেখুন : ‘যৌতুক দাবিতে স্বামী-শাশুড়ি মিলে তাহেরাকে পিটিয়ে হত্যা’ (পৃষ্ঠা-২); ‘যৌতুকের দাবিতে সাভারে স্ত্রী হত্যা : স্বামী আটক’ (পৃষ্ঠা-১৫) এবং ‘ফুলপুরে যৌতুকের জন্য প্রাণ গেল গৃহবধূর’ (পৃষ্ঠা-১৮)। শুধুমাত্র যৌতুকের জন্য এভাবে দেশে কত স্ত্রী নিহত হচ্ছে কেউ নিশ্চয়ই হিসাব রাখে না। কত মানুষ তার জীবনসঙ্গিনীর জীবন কেড়ে নিচ্ছে শুধুমাত্র যৌতুকের জন্য, তা ভাবার মতো কোনো দায়িত্বশীল মানুষ এদেশে  আছে বলে মনে হয় না। যাহোক, এতদিন যৌতুক-লোভী অমানুষদের হাতে যৌতুকের শিকার হতে দেখতাম শুধু তাদের অভাগা স্ত্রীদের। কিন্তু এবার যে সংবাদ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম তা হলো- ‘সখীপুরে যৌতুকের দাবিতে শাশুড়িকে পিটিয়ে হত্যা।’ মেয়ের বিয়ের যৌতুকের জন্য এখন শাশুড়িও খুন হতে শুরু করেছে! কোন সমাজে আমরা বাস করছি! কত নিচে নেমে গেছে আমাদের সমাজ!
যৌতুক আমাদের সমাজে বিয়ের একটি ‘মহাগুরুত্বপূর্ণ’ অংশ বলে যেন মনে করা হয়। তা না হলে যৌতুকের জন্য স্ত্রী বা শাশুড়িকে খুন দূরের কথা, যৌতুকজনিত কোনো অঘটন আমাদের সমাজে ঘটারই কথা নয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, যৌতুকের জন্য যারা তাদের স্ত্রীকে শুলিতে চড়ায়, তাদের বিয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে যৌতুক; জীবনসঙ্গী পাওয়া বা বংশ বৃদ্ধি করা এদের বিয়ের কোনো উদ্দেশ্য নয়। বিয়ে হচ্ছে এদের কাছে অন্য কারো সম্পদে ভাগ বসানোর একটা উপায়। এরা হচ্ছে ডাকাত, যারা কারো কাছে টাকা চেয়ে না পেলে তাকে খুন করতে দ্বিধা করে না। এসব ডাকাত থেকে সমাজকে সুরক্ষার জন্য  আমাদের দেশে কারো মাথাব্যথা নেই। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত সবাই। নিরীহ মানুষরা যে এসব ডাকাতের খপ্পরে পড়ে অহরহ প্রাণ হারায়, কেউ নিজেকে এজন্য দায়ী মনে করছে না।
ঢাকা শহরের যানজট দূর করার জন্য নজরকাড়া সব ফ্লাইওভার নির্মিত হচ্ছে, পদ্মা নদীতে বহু কাক্সিক্ষত দীর্ঘ সেতু তৈরি হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনা রোধের জন্য দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোকে একাধিক লেনে উন্নীত করা হচ্ছে, দেশ দিন দিন ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু যে মানুষদের জন্য এসব করা হচ্ছে তারা যে খুবই নাজুক জীবনযাপন করছে সেদিকে মনোযোগের বিশাল ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশে আইন, আদালত, বিচারব্যবস্থা সবই আছে তবু মানুষ এভাবে মরছে কেন? এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন সেদিন পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের চেয়ারপারসন ও মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল। সম্প্রতি নিজের মেয়েকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে দু’পা হারানো কৃষক শাহানুর বিশ্বাসকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘অপরাধীর শাস্তি দেয়ায় রাষ্ট্র দুর্বল।’
অপরাধীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র যদি কঠোর হতো, দেশে অপরাধের সংখ্যা দিন দিন কমে যেত, সন্দেহ নেই। দেশে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ খুন হচ্ছে কিন্তু মামলার দীর্ঘসূত্রিতা এবং আইনের নানা ফাঁক-ফোকর দিয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। আছে ঘুষ আদান-প্রদানেরও অবারিত সুযোগ। তাই দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি না হওয়ায় দেশের অনেক মানুষ পশুতে পরিণত হচ্ছে। তুচ্ছ ঘটনার জন্যেও, সামান্য টাকার জন্যেও কাউকে খুন করতে মানুষ দ্বিধা করছে না।
আমাদের দেশের প্রকৃতি মানুষ বাসের জন্য বেশ উপযোগী এবং ভারসাম্যপূর্ণ হলেও আমরা অনেকেই জানি এদেশের অনেক মানুষ অন্য দেশে থাকার সুযোগ পেলে অন্য দেশে বাস করাকেই প্রাধান্য দেয় বেশি। অনেকেই এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিবারসহ বসবাস করেন, দেশে আসতে চান না। কেন? এখানকার মানুষ বেশ বর্বর, লোভী এবং অমানুষ বলে। দেশের প্রকৃতি জীবনবান্ধব হলেও মানুষগুলো জীবনবান্ধব নয়। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে, যেখানে প্রকৃতি মানুষের জীবন-বিরুদ্ধ হলেও মানুষগুলো শান্ত বলে সেসব দেশের মানুষ নিজেদের দেশে বাস করাকে মোটেই অপছন্দ করে না। সুমন লাহিড়ী নামক নরওয়ে প্রবাসী একজন লেখক বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় সেদেশ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘নরওয়েতে ঠান্ডার তীব্রতা এত বেশি, অনেক মানুষ পথ চলতে গিয়ে বরফে পিছলে পড়ে পা ভেঙ্গে ফেলে।’ আর ইতালীর অবস্থা এমন, সেখানে শীতকালে কখনো কখনো এত বেশি শীত পড়ে, মানুষ থুতু ফেললে তা মাটিতে পড়তে পড়তেই বরফ হয়ে যায়! তবু এসব দেশের মানুষ সভ্য-শান্ত বলেই সবাই বেশ শান্তিতে বসবাস করছে। কিন্তু এসব দেশের তুলনায় আমাদের দেশের প্রকৃতি খুবই জীবন-ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও মানুষগুলোর আচরণ হিংস্র হবার কারণে এখানে মানুষের জীবনে শান্তি নেই। প্রতিদিনই এখানে একজন আরেকজনের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। এমন একদিন পাওয়া যাবে না, যেদিন পত্রিকায় খুন-খারাবীর সংবাদ নেই। এদেশের মানুষের নিকট মানুষ খুন একেবারেই সাধারণ ব্যাপার। যারা জাপান গিয়েছেন তারা জানেন, না গেলে জাপান-প্রবাসী কারো সাথে আলাপ করে জানতে পারবেন, জাপানীরা মানুষ খুনকে কত মারাত্মকভাবে ঘৃণা করে। সেখানে খুনের ঘটনা একেবারেই বিরল। বিষয়টা যাদের জানার উপায় নেই, তাদের জন্য ‘জাপান কাহিনি’ (দ্বিতীয় খন্ড; লেখক: আশির আহমেদ; প্রকাশনায় : ঐতিহ্য) নামক একটি বই থেকে এ সম্পর্কিত একটা লেখার অংশবিশেষ উল্লেখ করছি: ‘(জাপানে) ফাঁসির রায় হওয়া আর ফাঁসি কার্যকর হবার মাঝখানে বিরাট লম্বা সময় থাকে। কারো ১ বছর কারো ২০-৩০ বছর। ...গড়িমসিটা করেন কারা কর্তৃপক্ষ। কারা প্রধানরা নিজের আমলে এই অপ্রিয় কাজটা করতে চান না। জাপানের মাত্র ৭টি কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ আছে। এই সব কারাগারে আসার পরপরই বদলির জন্য তদবির করতে থাকেন কারা প্রধানরা। ...জাপানে  কেউ জল্লাদ হতে চান না। সুস্থ মস্তিষ্কে আরেকটা মানুষ খুন করার দায়িত্ব এড়াতে চান। সারা জীবন নাকি একটা প্রশ্ন জীবন্ত খোঁচাতে থাকবে “তুই খুনি, তুই মানুষ মেরেছিস, তুই মানুষ মেরেছিস, তুই খুনি”।’ [পৃ-৩৬-৩৮]
বইটি থেকে আরও জানা যায়, জাপানে ক্রাইমের সংখ্যা এমনিতেই কম। মৃত্যুদ- কার্যকরের সংখ্যা এক ডিজিটের কোটায়- ২০১৪ সালে ফাঁসি হয়েছে মাত্র ৩ জনের। একেকজন আসামীকে ফাঁসির জন্য জল্লাদ রাখা হয় ৫ জন। ৫ জন পাঁচটা বাটন টেপার পরই আসামীর ফাঁসি নিশ্চিত হয়। একজন লোকের মৃত্যুদ- কার্যকরের জন্য পাঁচজন লোক কেন? যাতে কেউই নিজেকে এজন্য এককভাবে দায়ী মনে না করে, সর্বোচ্চ ৫ ভাগের ১ ভাগ দায়ী মনে করতে পারে। একেকটি বাটন টেপার জন্য ফি হলো বিশ হাজার ইয়েন। এই অর্থও নাকি তারা নেন না, সরাসরি মন্দিরে দিয়ে দেন। [পৃ-৩৮]
জাপানে যেখানে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে একজন ফাঁসির আসামীর মৃত্যুদ- কার্যকর করার পারিশ্রমিকটাও মানুষ ভোগ করতে দ্বিধা করেন, সেখানে আমাদের দেশে বিয়ের মতো পবিত্র একটি সম্পর্কের পর আমরা শ্বশুরবাড়ির সামান্য সম্পদ লাভে ব্যর্থ হয়ে নিজের স্ত্রীকে বা শাশুড়িকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করি না! মোগল স¤্রাট শাহজাহান নিজের স্ত্রীর নামকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তাজমহল নির্মাণ করেছেন, আর আমরা কাপুরুষরা সামান্য অর্থ-সম্পদের লোভে নিজের স্ত্রীর প্রাণ পর্যন্ত কেড়ে নিই! আমাদের এ ঘৃণ্য প্রবণতার বিরুদ্ধে এ রাষ্ট্র পরিচালকদের তেমন কথা  বলতে শুনি না। দেশে যে প্রতিদিন অসংখ্য নারী যৌতুকের শিকার হচ্ছে, কখনো আমাদের কর্তাব্যক্তিদের এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখি না। শুধু রাস্তাঘাট, পুল-সেতু নির্মাণ করাই কি সরকারের কাজ? দেশকে শুধু ডিজিটাল করলেই হবে? মানুষের জীবনকে নিরাপদ রাখার দায়িত্বও অবশ্যই সরকারকে নিতে হবে। 
আমাদের দেশের নারী নেত্রীরাও দেখি যৌতুকের ব্যাপারে তেমন সরব নয়। সমাজকে ধ্বংস করে ফেলছে যৌতুক, সেজন্য তাদের মাথাব্যথা তেমন দেখা যায় না। যৌতুকের জন্য নারীরা প্রতিনিয়ত খুন হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে, নানারকম হেনস্থার শিকার হচ্ছে। কিন্তু তারা দেখেও না দেখার ভান করছেন। কেন? এর কোনো সদুত্তর নেই। মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর নির্ধারণের জন্য এসব নেত্রীকে দেখি বেশ তৎপর। অথচ এটা একটা অযৌক্তিক বিষয়। ১৮ বছর বয়সের আগেই নারীরা বিয়ের জন্য উপযুক্ত হয়ে যায়। সে জন্য জাপানে নারীর বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় সব রাজ্যেই ১৮ বয়সের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে কোর্ট বা তাদের অভিভাবকের সম্মতিতে হতে পারে। কোনো কোনো রাজ্যে এ বিয়ে সর্বনি¤œ ১২ বছরে হয়ে থাকে। এমনকি একটি রাজ্যে বিয়ের কোনো সর্বনি¤œ বয়সসীমা নেই! নারী বা পুরুষের বিয়ের ক্ষেত্রে এটাই হওয়া উচিত কোনো দেশের স্বাভাবিক নিয়ম। কারণ একজন অভিভাবক তার সন্তানকে কখন বিয়ে দেবে তা সম্পূর্ণ তার এখতিয়ারে থাকাটাই ব্যক্তিস্বাধীনতা। এখানে রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি হবার প্রশ্নও জড়িত নেই। তবু আমাদের নারী নেত্রীরা এ নিয়ে বেশ সোচ্চার। কিন্তু তাদেরই মতো অসংখ্য নারী যে প্রতিদিন যৌতুকের শিকার হচ্ছে তারা মনে হয় তা জানতেই পারেন না!
আমাদের পাঠ্যবইগুলোতেও যৌতুক সম্পর্কে তেমন কোনো গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা নেই। কোনো কোনো পাবলিক পরীক্ষায় মাঝে মাঝে দায়সারাভাবে যৌতুক প্রথা সম্পর্কে রচনা লিখতে বলা হয় শুধু। মানুষ খুনকে নিরুৎসাহিতকরণ সম্পর্কেও আমাদের পাঠ্যবইগুলো নিশ্চুপ। এটা, আমি মনে করি, যারা পাঠ্যবই প্রণয়ন করেন, আমাদের সমাজ সম্পর্কে তাদের অসচেতনতার পরিচায়ক।
লেখক: শিক্ষক

লেখাটি দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত হয় 
১২ জানুয়ারি, ২০১৭। লিঙ্ক: https://m.dailyinqilab.com/article/58118

লোডশেডিং যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম বাধা

 লোডশেডিং যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম বাধা 

নূর আহমদ
বিদ্যুতের ঘাটতি বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাগুলোর অন্যতম। যুগের পর যুগ ধরে বাংলাদেশে লোডশেডিং সগৌরবে বিদ্যমান। যখন ছোট ছিলাম, ১৯৯০ সালের দিকে আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। তখনও লোডশেডিং ছিল, এখনও আছে। অসত্য বলার কী দরকার, তখন লোডশেডিং এখনকার মতো ছিল না, আরও কম ছিল। দিন যতই গেল, লোডশেডিং ততই বাড়ল। সামনের অবস্থা চিন্তা করলে শংকিতই হতে হয়। আমরা যারা গ্রামাঞ্চলে থাকি, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা এ দেশের তৃতীয়, চতুর্থ বা আরও নীচু শ্রেণীর নাগরিক বলে গণ্য। অভিজাত এলাকাসহ দেশের অনেক নির্দিষ্ট এলাকায় লোডশেডিং যখন নেই বললেই চলে, তখন আমাদের সঙ্গে লোডশেডিং সব সময় এক তামাশার খেলা খেলেই চলে! আমরা কি মানুষ, নাকি অপাঙ্ক্তেয় কোনো জীব, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাই মাঝে মাঝে। জেলখানার মানুষের সঙ্গেও এমন আচরণ করা মনে হয় ঠিক নয়। আমাদের জেলাশহরে পর্যন্ত এত লোডশেডিং নেই, যা গ্রামবাসীর ভাগ্যে বরাদ্দ রাখা হয়! গ্রামে বসবাস করা কি অপরাধ?
গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ না থাকা অবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষে কী অসহনীয় কষ্টের মধ্যে সময় কাটায়, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। বিদ্যুতের একটা তামাশাপূর্ণ আচরণ হল, শীতকালে যখন বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবহার নেই, তখন লোডশেডিংয়ের পরিমাণ কম থাকে; আর গরমকালে যখন চব্বিশ ঘণ্টা বৈদ্যুতিক পাখা চালানোর প্রয়োজন হয়, তখন লোডশেডিংয়ের মাত্রা চরমভাবে বেড়ে যায়। বিদ্যুৎ অবশ্য তখন বারবার চলে যায়- এমন নয়, মাঝে মাঝে আসে কেবল! বৈদ্যুতিক পাখা থাকা সত্ত্বেও তা চালাতে না পেরে নিজেদের কত যে অসহায় মনে হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বিদ্যুতের তামাশাপূর্ণ আচরণের আরেকটি দিক হল, দিনের বেলা কলকারখানা, দোকানপাট, অফিস-আদালত সব একসঙ্গে খোলা থাকে বলে চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিতে পারে, কিন্তু রাতে যখন এসব কিছুই খোলা থাকে না, তখন তো অন্তত বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। অথচ তখন ছাত্রছাত্রীরা পড়তে বসে বা মানুষ দিনের পরিশ্রম শেষে একটু ঘুমাতে যায়, বিদ্যুৎ তখনও অপ্রত্যাশিতভাবে দিনের মতোই আসা-যাওয়ার খেলা খেলেই চলে; শান্তিমতো কিছুই করা যায় না।
অনেকেই লোডশেডিংয়ের সময় রিচার্জেবল লাইট বা ফ্যান ব্যবহার করে। বিদ্যুৎ থাকা সত্ত্বেও, যথারীতি বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা সত্ত্বেও এসব বাড়তি খরচ কেন করতে হবে? বিত্তশালী কেউ কেউ আবার আইপিএস ব্যবহার করে। কিন্তু নিয়মিত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করাই যাদের জন্য চ্যালেঞ্জ, তারা কোথায় পাবে আইপিএস! অবশ্য মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ফিরে আসতে এত গড়িমসি করে যে, আইপিএসও নিজের পক্ষ থেকে লোডশেডিং ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। বিষয়টা এমন, কুইনাইন জ্বর সারাবে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে? লোডশেডিংয়ের এই দেশে বিদ্যুতের সঙ্গে যাদের ব্যবসার সরাসরি সম্পর্ক, দিনের বেলা পিক আওয়ারে বসে বসে তাদের আঙুল চোষা ছাড়া করার কিছুই থাকে না। কাস্টমার আছে, মেশিনও সব ঠিকঠাক আছে; শুধু বিদ্যুৎ নেই!
বর্তমান সরকারের একটা বিশেষ প্রতিশ্রুতি ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। এটা অবশ্যই অভাবনীয় এক সৌভাগ্যের বিষয় আমাদের জন্য। সরকার এ প্রতিশ্র“তি পূরণের জন্য যে পুরোপুরি আন্তরিক, তা বোঝা যাচ্ছে সরকারের এ সংক্রান্ত নানা পদক্ষেপ দেখে। ব্যাংক-বীমাসহ প্রায় সব অফিস-আদালত অনলাইন হচ্ছে। গত কয়েক বছরে কয়েক কোটি মানুষ ইন্টারনেটে যুক্ত হয়েছে; রীতিমতো অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সুবিধা ভোগ করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রযুক্তিনির্ভর পাঠদানের জন্য সরকার কোটি কোটি টাকার উপকরণ সরবরাহ করছে। তবে..., তবে ডিজিটালাইজেশনের প্রাণ যেহেতু বিদ্যুৎ, তাই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে দেশকে ডিজিটাল করার প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যেমন- মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে পাঠদান করতে গিয়ে বিদ্যুৎ না থাকলে ল্যাপটপ চলে ঠিকই, কিন্তু প্রজেক্টর অচল হয়ে যায়, লাভ কী! এভাবে অনেক উচ্চবিদ্যালয় এবং কলেজে সরকারের সরবরাহকৃত কম্পিউটারগুলো স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায়। বেসরকারিভাবে ডিজিটাল হওয়ার প্রচেষ্টাও স্বাভাবিক গতিতে এগোচ্ছে না লোডশেডিংয়ের অভিশাপে। বর্তমান সরকার দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তেও বদ্ধপরিকর। দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়া যত কঠিন বা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, লোডশেডিংমুক্ত একটি সত্যিকার ডিজিটাল দেশ গড়া ততটা কঠিন অবশ্যই নয়। দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য দেশের মানুষ নিজেরা কাজ করতে পারে, করেও; কিন্তু লোডশেডিং থেকে মুক্তি পাওয়ার কাজটা শুধুই সরকারের হাতে। চব্বিশ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ যতদিন নিশ্চিত না হবে, ততদিন বাংলাদেশকে ডিজিটাল করার প্রক্রিয়া পঙ্গু হয়েই থাকবে।
শিক্ষক, রোকনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বশিকপুর, লক্ষ্মীপুর

[লেখাটি দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয় ১৫ জুলাই ২০১৫]

প্রেম নয়, বরং জীবন বড়

 প্রেম নয়, বরং জীবন বড়

নূর আহমদ
বিষয়টি নিয়ে লেখার প্রয়োজন পড়ত না, যদি প্রেমের জন্য পৃথিবীতে অনেক বিয়োগান্তক ঘটনা না ঘটত। কয়েকদিন পরপরই পত্রিকার পাতায় সংবাদ দেখে বিমূঢ় হয়ে যাই- প্রেমের জন্য কখনও প্রেমিক, কখনও প্রেমিকা, কখনও প্রেমিক-প্রেমিকা উভয়ের একসঙ্গে আত্মহনন। গত মাসের ২৬ তারিখ যুগান্তরে ‘ঠাকুরগাঁওয়ে প্রেমিকযুগলের আত্মহত্যা : ‘পরজীবনে দু’জনের যেন মিলন হয়’ শিরোনামে সংবাদটিতে তাদের সুইসাইড নোট উদ্ধৃত করা হয়েছে- ‘এ সমাজের মানুষ আমাদের ভালোবাসার স্বীকৃতি দিল না। ইচ্ছা ছিল দু’জনে সুখের ঘর বাঁধব। কিন্তু পরিবারের লোকজন ভালোবাসার মানুষটিকে মেনে নিতে পারল না। তাই আমরা দু’জনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ জীবনে মিলন না হলেও যেন পরজীবনে আমাদের মিলন হয়। তাই আমরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিলাম। আমাদের আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয়। মৃত্যুর পরে আমাদের দু’জনের কবর যেন একসঙ্গেই দেয়া হয়। এটি সবার প্রতি অনুরোধ।’
‘একই রশিতে প্রেমিক-প্রেমিকার আত্মহত্যা’ বা ‘প্রেমিকের আত্মহত্যা’ বা ‘প্রেমিকার আত্মহত্যা’ ইত্যাদি কথা লিখে ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত এরকম অসংখ্য ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায়। কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম, প্রেমের জন্য অনশন করতে করতে প্রেমিকার মারা যাওয়ার সংবাদ। এরকম আত্মবিধ্বংসী ঘটনা সমাজে কেন ঘটে? ঘটে মূলত আমাদের ক্ষণিকের আবেগ বা জীবন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে। ঘটনাগুলো দেখলে মনে হয়, জীবনের চেয়ে প্রেমই বড়। আসলে কি তাই? চলুন, বিষয়টা গভীরভাবে দেখি।
প্রেমের সাধারণ উদ্দেশ্য হল বিয়ে। যদি এমন হতো, প্রেম ছাড়া বিয়েই করা যেত না, তাহলে প্রেম সবাইকে করতেই হতো, শুধু যার কোনো কারণে বিয়ে করার ইচ্ছা নেই, সে ছাড়া। কিন্তু আমাদের সমাজে প্রেম ছাড়া বিয়ে করাই এখনও সামাজিকতা এবং এমন বিয়ের সংখ্যাই বেশি। তাই জীবনে কারও সঙ্গে প্রেম হয়নি বলে আপনার বিয়ে বন্ধ হয়ে থাকবে, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই! আর কারও সঙ্গে প্রেম হয়ে থাকলেও যদি অনিবার্য কোনো কারণে সেই প্রেম বিয়ে পর্যন্ত না গড়ায়, তবে এমন সম্পর্ককে কৌশলে ‘না’ বলে আপনার সুস্থ-সবল-সম্ভাবনাময় জীবনকে আত্মহত্যার হাত থেকে রক্ষা করুন! আপনার জন্য হয়তো আরও বড় কিছু অপেক্ষা করছে!
হয়তো আপনি এমন একজন মানুষ পেলেন, যাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে না পেলে আপনার বেঁচে থাকা মূল্যহীন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু তার সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পর আপনি কি কখনও চিন্তা করে দেখেছেন, ওই মানুষটির সঙ্গে সম্পর্ক না হলেও আপনি সহজেই জীবন কাটাতে পারতেন? তাহলে এখন তার সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পর কেন আপনার মনে হল, তাকে ছাড়া আপনার বেঁচে থাকা অর্থহীন?! এমন অর্থহীন আবেগ থেকে আপনার মূল্যবান জীবন রক্ষার জন্য জীবনকে আরও বেশি ভালোবাসতে হবে। মনে রাখবেন, মানুষকে ভালোবাসার চেয়ে জীবনকে ভালোবাসা অনেক অনেক জরুরি।
ধরুন, আপনি একজন পুরুষ। সৌভাগ্যক্রমে এমন একটি মেয়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক হল, আপনার মনে হতে পারে- তাকে ছাড়া আর কোনো মেয়ে নিয়ে আপনি সুখী হতে পারবেন না। কিন্তু আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন, এরকম অনেক বিয়ে বালির বাঁধের মতো ভেঙে যায়? আপনার বিয়েও এভাবে ভেঙে যাবে না বা আপনাদের দাম্পত্য জীবনে চরম মনোমালিন্য দেখা দেবে না, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? সমাজে অনেক সুখী দম্পতির বিয়ে জীবনের মাঝপথে এসে ভেঙে যায়, এমন নজির রয়েছে। আপনাদের সুগভীর সম্পর্কও ভেঙে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তাই কোনো সম্পর্ককে স্থায়ী করতে না পারার জন্য আত্মাহুতি দেয়ার কোনো মানে হয় না।
প্রেম করলেই আপনি খুব চয়েসফুল একটি মেয়ে পাবেন, না হলে পাবেন না- এ কথা কে বলল আপনাকে? আমার চেনাজানা এমন অনেক মেয়ে আছে, যাদের বিয়ে প্রেম ছাড়াই হয়েছে। যেসব ছেলের সঙ্গে তাদের বিয়ে হয়েছে, প্রেম করেনি বলে কি সেসব ছেলে ঠকেছে? প্রেম ছাড়া আপনি ভালো মেয়ে পাবেন না, এমন চিন্তা আজ থেকে পরিহার করুন। আগে প্রতিষ্ঠিত হোন, ভালো এবং মনের মতো মেয়ে অবশ্যই পাবেন। বেকার বা ছাত্রজীবনে প্রেম করে আপনার পড়াশোনাও নষ্ট হবে না, তাকে না পেয়ে আপনার মূল্যবান জীবনও নষ্ট হবে না।
আপনি মেয়ে হলে আত্মহত্যার আগে ভাবুন, প্রেম করে বিয়ে করতে ব্যর্থ হওয়ায় আপনার বিয়ে বন্ধ হয়ে যায়নি। অতীত ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন। প্রেম করেই বিয়ে করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। মনে রাখা দরকার, জীবনে বিয়ে ছাড়া অনেক কিছুই আছে। পছন্দের মানুষের সঙ্গে পরিণয়ে আবদ্ধ হতে না পারা জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা নয়। জীবন অনেক বড়।
শিক্ষক, রোকনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
বশিকপুর, লক্ষ্মীপুর
nurahmad786@gmail.com

লেখাটি দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয় 
 ০৫ অক্টোবর, ২০১৬ তারিখে। লিঙ্ক: https://www.jugantor.com/news-archive/dristipat/2016/10/05/65723

প্রাথমিক শিক্ষায় পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করা উচিত নয়

প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি। যে শিক্ষার মাধ্যমে সে শিখতে শুরু করে, তাই প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার মানে এ নয় যে, সে শিখে ফেলেছে অনেক-অনেক কিছু। প্রকৃতপক্ষে একজন শিক্ষার্থীর জন্য জ্ঞানের বিশাল রাজ্যে প্রবেশের উপযুক্ত সময় হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন যেদিন শেষ হবে, ঠিক সেদিন থেকে তার অবশিষ্ট জীবন।

আমার এক বিজ্ঞ শিক্ষক বলেছিলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটা হচ্ছে একেবারে সীমিত শিক্ষা। এটা মূলত জ্ঞানার্জনের নিয়মগুলো জানার জন্যই। একজন শিক্ষার্থী তার প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে জ্ঞানার্জনের নিয়মগুলোই শুধু শিখে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ থেকে কঠিন কবিতাগুলোর কিছু ‘নমুনা’ মাত্র একজন শিক্ষার্থীকে প্রথম থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যসব কবিতা সে পড়বে কোন সময়? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন স্তরের কবিতা সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা অর্জিত হওয়ার পরই তার অবশিষ্ট জীবনে।’


অথচ আমাদের দেশে অনেকে বুঝতেই পারে না প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্দেশ্য। এজন্যই একটি শিশু কিছু শিখতে না শিখতেই পাঠ্যবইবহির্ভূত বিষয়ে তার দক্ষতা-যাচাই আরম্ভ হয়ে যায়! মাত্র তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে, এমন শিক্ষার্থীকেও বাংলা পাঠ্যবইবহির্ভূত একটা অনুচ্ছেদ দিয়ে তার পরীক্ষা নেয়া হয়। হায়! এ বয়সে কী শিখেছে সে বাংলা ভাষার! যখন একটা-একটা শব্দ করে, একটা-একটা বাক্য করে সে শিখতে আরম্ভ করে, পাঠ্যবইয়ের যা সে ঘুণাক্ষরেও পড়েনি, সে সম্পর্কে তার জ্ঞান যাচাই করতে যাওয়ার কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে! পাঠ্যবইয়ের শব্দ বা বাক্যগুলো সে বুঝেছে কিনা, তা যাচাই করাই মূলত প্রয়োজন; কিন্তু পাঠ্যবইবহির্ভূত যে পড়াটা সে কখনও পড়েনি, যে শব্দার্থগুলো তাকে কখনও পড়ানো হয়নি, তার ওপর পরীক্ষা নেয়ার প্রয়োজন আছে কি?
অথচ আমাদের তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা এবং ইংরেজি প্রশ্নে এখন যুগপৎভাবে পাঠ্যবইয়ের অন্তর্গত এবং পাঠ্যবইবহির্ভূত দু’রকম দুটি অনুচ্ছেদের ওপর পরীক্ষা নেয়া হয়।
ইংরেজির কথায় আসি। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর ইংরেজি প্রশ্নকাঠামোতে এখন একটি Passage আসে, যা পাঠ্যবইয়ে নেই। ২০১৩ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ইংরেজি প্রশ্নে দেখলাম, বিশাল একটি Unseen Passage এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পেসেজটিকে পঞ্চম শ্রেণীর ইংরেজি পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত পেসেজের সমপর্যায়ের মনে করা হলেও এ পেসেজের Vocabulary গুলো কি শিক্ষার্থীরা পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্যবই থেকে শিখতে পেরেছে? না শিখে থাকলে তারা এ পেসেজের অর্থ উদ্ধার করবে কিভাবে? এ পেসেজের Sentence গুলোর কাঠামো কি তারা এ পর্যন্ত চর্চার সুযোগ পেয়েছে? তাহলে এ পেসেজের ওপর বিভিন্ন প্রশ্নের তারা উত্তর দেবে কিভাবে?
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। শিশুরা শৈশব থেকে বাংলা শুনতে এবং বাংলায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত কোনো শিশু বাংলা ভাষায় রচিত পাঁচ-পাঁচটি বইয়ের বিপরীতে একটিমাত্র ইংরেজি বই অধ্যয়নের সুযোগ পায়। আমাদের শ্রেণীকক্ষের ভাষাও কিন্তু ইংরেজি নয়। তবু বাংলার মতোই ইংরেজিতেও পাঠ্যবইবহির্ভূত বিষয়ের ওপর প্রশ্ন করাটা কতটা যৌক্তিক?
একটা কৌতুক মনে পড়ছে। হাসপাতালের বেডে শায়িত সদ্য জ্ঞান ফিরে পাওয়া একজন ট্রাকচালককে ট্রাকটির মালিক জিজ্ঞেস করলেন-
: দুর্ঘটনাটি কিভাবে হয়েছে?
চালক বললেন-
: ট্রাকটি স্টার্ট দেয়ার কিছুক্ষণ পর দেখি সামনের দিক থেকে একটি বাস আসছে, তাকে সাইড দিলাম; এরপর দেখি একটি ট্রাক আসছে, তাকেও সাইড দিলাম; এরপর দেখি একটি ব্রিজ আসছে, তাকেও সাইড দিলাম; এরপর আর কিছু মনে নেই!
বাংলার মতো ইংরেজিতেও পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করাটা এরকম সবকিছুকে একই মাপকাঠিতে পরিমাপ করার মতোই বিপজ্জনক।
পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করলে করা যেতে পারে গণিতে। পাঠ্যবইয়ের একটা অংকের সংখ্যা পরিবর্তন করে প্রশ্ন করা যেতে পারে। তাহলে বোঝা যাবে, এরকম অন্য একটা সমস্যার সমাধান সে করতে পারে কিনা। কিন্তু এরকম প্রশ্ন না করে বরং ‘যোগ্যতাভিত্তিক’ নাম দিয়ে পাঠ্যবইয়ের একটা সমস্যাকে ভেঙে সমস্যাটির চারটি শাখা বের করা হয়। বড়ই অদ্ভুত ধারণা। মাঝে মাঝে ভাবি, যারা এভাবে একটি অংককে চার বা পাঁচ ভাগে বিভক্ত করে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন তৈরির অভিনব নিয়মটি প্রবর্তন করলেন, শৈশবে তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে কোনো অংকই কি শিখতে পারেননি? অংক নিয়ে এত নাটকের কী প্রয়োজন? ঐকিক নিয়মের একটি অংক পাঠ্যবইয়ে যেভাবে আছে, একইভাবে পরীক্ষায় প্রশ্ন করে কি শিক্ষার্থীদের ঐকিক নিয়মের জ্ঞান যাচাই করা সম্ভব নয়? এত শাখা-প্রশাখা বের করে শিশু-শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করার কী প্রয়োজন? প্রাথমিকের ইংরেজি বা বাংলায় পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করাটা কোনোক্রমেই সঙ্গত নয়। শিক্ষাজীবনের শেষ পর্যায়ে, স্নাতক বা স্নাতকোত্তরে এমন প্রশ্ন করা যেতে পারে। কারণ সে পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ভাষা সম্পর্কে কিছুটা পারদর্শিতা অর্জন করে। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, আমাদের প্রাথমিকের তৃতীয় শ্রেণীর বাংলায় পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করা হলেও স্নাতকের বাংলায় পাঠ্যবইবহির্ভূত কোনো প্রশ্ন করা হয় না, এমনকি পাঠ্যবই থেকেও যোগ্যতাভিত্তিক কোনো প্রশ্ন করা হয় না। সবই সেই প্রাগৈতিহাসিক মুখস্থ বিদ্যা! এর কি অর্থ এটাই যে, আমাদের স্নাতকের শিক্ষার্থীদের চেয়ে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা বাংলায় বেশি দক্ষ!
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় গাইডবই নিষিদ্ধ। কিন্তু ওপেন সিক্রেট হচ্ছে- গাইড ব্যবহার করে না, এমন শিক্ষার্থী আবিষ্কার করা বর্তমান সময়ে বেশ কষ্টকর! কেন? প্রশ্নকাঠামো পাঠ্যবইভিত্তিক নয় বলেই। ২০১৫ সালের সমাপনী পরীক্ষার জন্য ‘জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি’ যে প্রশ্নকাঠামো নির্ধারণ করেছে, তাতে পাঠ্যবই থেকে মাত্র একটি পেসেজ আসার কথা বলা হয়েছে মাত্র, আর কিছু নয়। এ পেসেজ ছাড়া প্রশ্নকাঠামোর অন্য আইটেমগুলো শিক্ষার্থীরা চর্চা করবে কোত্থেকে? এজন্যই গাইডনির্ভরতা।
আমি মনে করি, পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করে গাইড বা মডেল টেস্টের প্রয়োজনীয়তাই প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে প্রকারান্তরে। ২০১৩ সালের ইংরেজি প্রশ্নকাঠামোতে পাঠ্যবইবহির্ভূত অনুচ্ছেদটি ব্যতীত অন্য প্রশ্নগুলো যেভাবে পাঠ্যবইভিত্তিক ছিল, পুরো প্রশ্নকাঠামো এভাবে পাঠ্যবইভিত্তিক করা হলে এসবের প্রয়োজনীয়তা শূন্য হয়ে যাবে। তাই অন্তত ‘প্রাথমিক’ শিক্ষায় পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করা কোনোভাবেই উচিত নয়। বাংলা এবং ইংরেজি ব্যতীত অন্য চারটি বিষয়ে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন যেভাবে শুধু পাঠ্যবই থেকেই করা হয়, বাংলা এবং ইংরেজিতেও এভাবে শুধু পাঠ্যবই থেকেই যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন করা উচিত।
নূর আহমদ
শিক্ষক, রোকনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
বশিকপুর, লক্ষ্মীপুর
nurahmad786@gmail.com

[লেখাটি দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছে ০৪ নভেম্বর ২০১৫