লোডশেডিং যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম বাধা

 লোডশেডিং যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম বাধা 

নূর আহমদ
বিদ্যুতের ঘাটতি বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাগুলোর অন্যতম। যুগের পর যুগ ধরে বাংলাদেশে লোডশেডিং সগৌরবে বিদ্যমান। যখন ছোট ছিলাম, ১৯৯০ সালের দিকে আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। তখনও লোডশেডিং ছিল, এখনও আছে। অসত্য বলার কী দরকার, তখন লোডশেডিং এখনকার মতো ছিল না, আরও কম ছিল। দিন যতই গেল, লোডশেডিং ততই বাড়ল। সামনের অবস্থা চিন্তা করলে শংকিতই হতে হয়। আমরা যারা গ্রামাঞ্চলে থাকি, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা এ দেশের তৃতীয়, চতুর্থ বা আরও নীচু শ্রেণীর নাগরিক বলে গণ্য। অভিজাত এলাকাসহ দেশের অনেক নির্দিষ্ট এলাকায় লোডশেডিং যখন নেই বললেই চলে, তখন আমাদের সঙ্গে লোডশেডিং সব সময় এক তামাশার খেলা খেলেই চলে! আমরা কি মানুষ, নাকি অপাঙ্ক্তেয় কোনো জীব, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাই মাঝে মাঝে। জেলখানার মানুষের সঙ্গেও এমন আচরণ করা মনে হয় ঠিক নয়। আমাদের জেলাশহরে পর্যন্ত এত লোডশেডিং নেই, যা গ্রামবাসীর ভাগ্যে বরাদ্দ রাখা হয়! গ্রামে বসবাস করা কি অপরাধ?
গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ না থাকা অবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষে কী অসহনীয় কষ্টের মধ্যে সময় কাটায়, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। বিদ্যুতের একটা তামাশাপূর্ণ আচরণ হল, শীতকালে যখন বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবহার নেই, তখন লোডশেডিংয়ের পরিমাণ কম থাকে; আর গরমকালে যখন চব্বিশ ঘণ্টা বৈদ্যুতিক পাখা চালানোর প্রয়োজন হয়, তখন লোডশেডিংয়ের মাত্রা চরমভাবে বেড়ে যায়। বিদ্যুৎ অবশ্য তখন বারবার চলে যায়- এমন নয়, মাঝে মাঝে আসে কেবল! বৈদ্যুতিক পাখা থাকা সত্ত্বেও তা চালাতে না পেরে নিজেদের কত যে অসহায় মনে হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বিদ্যুতের তামাশাপূর্ণ আচরণের আরেকটি দিক হল, দিনের বেলা কলকারখানা, দোকানপাট, অফিস-আদালত সব একসঙ্গে খোলা থাকে বলে চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিতে পারে, কিন্তু রাতে যখন এসব কিছুই খোলা থাকে না, তখন তো অন্তত বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। অথচ তখন ছাত্রছাত্রীরা পড়তে বসে বা মানুষ দিনের পরিশ্রম শেষে একটু ঘুমাতে যায়, বিদ্যুৎ তখনও অপ্রত্যাশিতভাবে দিনের মতোই আসা-যাওয়ার খেলা খেলেই চলে; শান্তিমতো কিছুই করা যায় না।
অনেকেই লোডশেডিংয়ের সময় রিচার্জেবল লাইট বা ফ্যান ব্যবহার করে। বিদ্যুৎ থাকা সত্ত্বেও, যথারীতি বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা সত্ত্বেও এসব বাড়তি খরচ কেন করতে হবে? বিত্তশালী কেউ কেউ আবার আইপিএস ব্যবহার করে। কিন্তু নিয়মিত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করাই যাদের জন্য চ্যালেঞ্জ, তারা কোথায় পাবে আইপিএস! অবশ্য মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ফিরে আসতে এত গড়িমসি করে যে, আইপিএসও নিজের পক্ষ থেকে লোডশেডিং ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। বিষয়টা এমন, কুইনাইন জ্বর সারাবে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে? লোডশেডিংয়ের এই দেশে বিদ্যুতের সঙ্গে যাদের ব্যবসার সরাসরি সম্পর্ক, দিনের বেলা পিক আওয়ারে বসে বসে তাদের আঙুল চোষা ছাড়া করার কিছুই থাকে না। কাস্টমার আছে, মেশিনও সব ঠিকঠাক আছে; শুধু বিদ্যুৎ নেই!
বর্তমান সরকারের একটা বিশেষ প্রতিশ্রুতি ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। এটা অবশ্যই অভাবনীয় এক সৌভাগ্যের বিষয় আমাদের জন্য। সরকার এ প্রতিশ্র“তি পূরণের জন্য যে পুরোপুরি আন্তরিক, তা বোঝা যাচ্ছে সরকারের এ সংক্রান্ত নানা পদক্ষেপ দেখে। ব্যাংক-বীমাসহ প্রায় সব অফিস-আদালত অনলাইন হচ্ছে। গত কয়েক বছরে কয়েক কোটি মানুষ ইন্টারনেটে যুক্ত হয়েছে; রীতিমতো অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সুবিধা ভোগ করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রযুক্তিনির্ভর পাঠদানের জন্য সরকার কোটি কোটি টাকার উপকরণ সরবরাহ করছে। তবে..., তবে ডিজিটালাইজেশনের প্রাণ যেহেতু বিদ্যুৎ, তাই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে দেশকে ডিজিটাল করার প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যেমন- মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে পাঠদান করতে গিয়ে বিদ্যুৎ না থাকলে ল্যাপটপ চলে ঠিকই, কিন্তু প্রজেক্টর অচল হয়ে যায়, লাভ কী! এভাবে অনেক উচ্চবিদ্যালয় এবং কলেজে সরকারের সরবরাহকৃত কম্পিউটারগুলো স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায়। বেসরকারিভাবে ডিজিটাল হওয়ার প্রচেষ্টাও স্বাভাবিক গতিতে এগোচ্ছে না লোডশেডিংয়ের অভিশাপে। বর্তমান সরকার দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তেও বদ্ধপরিকর। দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়া যত কঠিন বা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, লোডশেডিংমুক্ত একটি সত্যিকার ডিজিটাল দেশ গড়া ততটা কঠিন অবশ্যই নয়। দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য দেশের মানুষ নিজেরা কাজ করতে পারে, করেও; কিন্তু লোডশেডিং থেকে মুক্তি পাওয়ার কাজটা শুধুই সরকারের হাতে। চব্বিশ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ যতদিন নিশ্চিত না হবে, ততদিন বাংলাদেশকে ডিজিটাল করার প্রক্রিয়া পঙ্গু হয়েই থাকবে।
শিক্ষক, রোকনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বশিকপুর, লক্ষ্মীপুর

[লেখাটি দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয় ১৫ জুলাই ২০১৫]

প্রেম নয়, বরং জীবন বড়

 প্রেম নয়, বরং জীবন বড়

নূর আহমদ
বিষয়টি নিয়ে লেখার প্রয়োজন পড়ত না, যদি প্রেমের জন্য পৃথিবীতে অনেক বিয়োগান্তক ঘটনা না ঘটত। কয়েকদিন পরপরই পত্রিকার পাতায় সংবাদ দেখে বিমূঢ় হয়ে যাই- প্রেমের জন্য কখনও প্রেমিক, কখনও প্রেমিকা, কখনও প্রেমিক-প্রেমিকা উভয়ের একসঙ্গে আত্মহনন। গত মাসের ২৬ তারিখ যুগান্তরে ‘ঠাকুরগাঁওয়ে প্রেমিকযুগলের আত্মহত্যা : ‘পরজীবনে দু’জনের যেন মিলন হয়’ শিরোনামে সংবাদটিতে তাদের সুইসাইড নোট উদ্ধৃত করা হয়েছে- ‘এ সমাজের মানুষ আমাদের ভালোবাসার স্বীকৃতি দিল না। ইচ্ছা ছিল দু’জনে সুখের ঘর বাঁধব। কিন্তু পরিবারের লোকজন ভালোবাসার মানুষটিকে মেনে নিতে পারল না। তাই আমরা দু’জনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ জীবনে মিলন না হলেও যেন পরজীবনে আমাদের মিলন হয়। তাই আমরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিলাম। আমাদের আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয়। মৃত্যুর পরে আমাদের দু’জনের কবর যেন একসঙ্গেই দেয়া হয়। এটি সবার প্রতি অনুরোধ।’
‘একই রশিতে প্রেমিক-প্রেমিকার আত্মহত্যা’ বা ‘প্রেমিকের আত্মহত্যা’ বা ‘প্রেমিকার আত্মহত্যা’ ইত্যাদি কথা লিখে ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত এরকম অসংখ্য ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায়। কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম, প্রেমের জন্য অনশন করতে করতে প্রেমিকার মারা যাওয়ার সংবাদ। এরকম আত্মবিধ্বংসী ঘটনা সমাজে কেন ঘটে? ঘটে মূলত আমাদের ক্ষণিকের আবেগ বা জীবন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে। ঘটনাগুলো দেখলে মনে হয়, জীবনের চেয়ে প্রেমই বড়। আসলে কি তাই? চলুন, বিষয়টা গভীরভাবে দেখি।
প্রেমের সাধারণ উদ্দেশ্য হল বিয়ে। যদি এমন হতো, প্রেম ছাড়া বিয়েই করা যেত না, তাহলে প্রেম সবাইকে করতেই হতো, শুধু যার কোনো কারণে বিয়ে করার ইচ্ছা নেই, সে ছাড়া। কিন্তু আমাদের সমাজে প্রেম ছাড়া বিয়ে করাই এখনও সামাজিকতা এবং এমন বিয়ের সংখ্যাই বেশি। তাই জীবনে কারও সঙ্গে প্রেম হয়নি বলে আপনার বিয়ে বন্ধ হয়ে থাকবে, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই! আর কারও সঙ্গে প্রেম হয়ে থাকলেও যদি অনিবার্য কোনো কারণে সেই প্রেম বিয়ে পর্যন্ত না গড়ায়, তবে এমন সম্পর্ককে কৌশলে ‘না’ বলে আপনার সুস্থ-সবল-সম্ভাবনাময় জীবনকে আত্মহত্যার হাত থেকে রক্ষা করুন! আপনার জন্য হয়তো আরও বড় কিছু অপেক্ষা করছে!
হয়তো আপনি এমন একজন মানুষ পেলেন, যাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে না পেলে আপনার বেঁচে থাকা মূল্যহীন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু তার সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পর আপনি কি কখনও চিন্তা করে দেখেছেন, ওই মানুষটির সঙ্গে সম্পর্ক না হলেও আপনি সহজেই জীবন কাটাতে পারতেন? তাহলে এখন তার সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পর কেন আপনার মনে হল, তাকে ছাড়া আপনার বেঁচে থাকা অর্থহীন?! এমন অর্থহীন আবেগ থেকে আপনার মূল্যবান জীবন রক্ষার জন্য জীবনকে আরও বেশি ভালোবাসতে হবে। মনে রাখবেন, মানুষকে ভালোবাসার চেয়ে জীবনকে ভালোবাসা অনেক অনেক জরুরি।
ধরুন, আপনি একজন পুরুষ। সৌভাগ্যক্রমে এমন একটি মেয়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক হল, আপনার মনে হতে পারে- তাকে ছাড়া আর কোনো মেয়ে নিয়ে আপনি সুখী হতে পারবেন না। কিন্তু আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন, এরকম অনেক বিয়ে বালির বাঁধের মতো ভেঙে যায়? আপনার বিয়েও এভাবে ভেঙে যাবে না বা আপনাদের দাম্পত্য জীবনে চরম মনোমালিন্য দেখা দেবে না, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? সমাজে অনেক সুখী দম্পতির বিয়ে জীবনের মাঝপথে এসে ভেঙে যায়, এমন নজির রয়েছে। আপনাদের সুগভীর সম্পর্কও ভেঙে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তাই কোনো সম্পর্ককে স্থায়ী করতে না পারার জন্য আত্মাহুতি দেয়ার কোনো মানে হয় না।
প্রেম করলেই আপনি খুব চয়েসফুল একটি মেয়ে পাবেন, না হলে পাবেন না- এ কথা কে বলল আপনাকে? আমার চেনাজানা এমন অনেক মেয়ে আছে, যাদের বিয়ে প্রেম ছাড়াই হয়েছে। যেসব ছেলের সঙ্গে তাদের বিয়ে হয়েছে, প্রেম করেনি বলে কি সেসব ছেলে ঠকেছে? প্রেম ছাড়া আপনি ভালো মেয়ে পাবেন না, এমন চিন্তা আজ থেকে পরিহার করুন। আগে প্রতিষ্ঠিত হোন, ভালো এবং মনের মতো মেয়ে অবশ্যই পাবেন। বেকার বা ছাত্রজীবনে প্রেম করে আপনার পড়াশোনাও নষ্ট হবে না, তাকে না পেয়ে আপনার মূল্যবান জীবনও নষ্ট হবে না।
আপনি মেয়ে হলে আত্মহত্যার আগে ভাবুন, প্রেম করে বিয়ে করতে ব্যর্থ হওয়ায় আপনার বিয়ে বন্ধ হয়ে যায়নি। অতীত ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন। প্রেম করেই বিয়ে করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। মনে রাখা দরকার, জীবনে বিয়ে ছাড়া অনেক কিছুই আছে। পছন্দের মানুষের সঙ্গে পরিণয়ে আবদ্ধ হতে না পারা জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা নয়। জীবন অনেক বড়।
শিক্ষক, রোকনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
বশিকপুর, লক্ষ্মীপুর
nurahmad786@gmail.com

লেখাটি দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয় 
 ০৫ অক্টোবর, ২০১৬ তারিখে। লিঙ্ক: https://www.jugantor.com/news-archive/dristipat/2016/10/05/65723

প্রাথমিক শিক্ষায় পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করা উচিত নয়

প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি। যে শিক্ষার মাধ্যমে সে শিখতে শুরু করে, তাই প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার মানে এ নয় যে, সে শিখে ফেলেছে অনেক-অনেক কিছু। প্রকৃতপক্ষে একজন শিক্ষার্থীর জন্য জ্ঞানের বিশাল রাজ্যে প্রবেশের উপযুক্ত সময় হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন যেদিন শেষ হবে, ঠিক সেদিন থেকে তার অবশিষ্ট জীবন।

আমার এক বিজ্ঞ শিক্ষক বলেছিলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটা হচ্ছে একেবারে সীমিত শিক্ষা। এটা মূলত জ্ঞানার্জনের নিয়মগুলো জানার জন্যই। একজন শিক্ষার্থী তার প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে জ্ঞানার্জনের নিয়মগুলোই শুধু শিখে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ থেকে কঠিন কবিতাগুলোর কিছু ‘নমুনা’ মাত্র একজন শিক্ষার্থীকে প্রথম থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যসব কবিতা সে পড়বে কোন সময়? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন স্তরের কবিতা সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা অর্জিত হওয়ার পরই তার অবশিষ্ট জীবনে।’


অথচ আমাদের দেশে অনেকে বুঝতেই পারে না প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্দেশ্য। এজন্যই একটি শিশু কিছু শিখতে না শিখতেই পাঠ্যবইবহির্ভূত বিষয়ে তার দক্ষতা-যাচাই আরম্ভ হয়ে যায়! মাত্র তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে, এমন শিক্ষার্থীকেও বাংলা পাঠ্যবইবহির্ভূত একটা অনুচ্ছেদ দিয়ে তার পরীক্ষা নেয়া হয়। হায়! এ বয়সে কী শিখেছে সে বাংলা ভাষার! যখন একটা-একটা শব্দ করে, একটা-একটা বাক্য করে সে শিখতে আরম্ভ করে, পাঠ্যবইয়ের যা সে ঘুণাক্ষরেও পড়েনি, সে সম্পর্কে তার জ্ঞান যাচাই করতে যাওয়ার কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে! পাঠ্যবইয়ের শব্দ বা বাক্যগুলো সে বুঝেছে কিনা, তা যাচাই করাই মূলত প্রয়োজন; কিন্তু পাঠ্যবইবহির্ভূত যে পড়াটা সে কখনও পড়েনি, যে শব্দার্থগুলো তাকে কখনও পড়ানো হয়নি, তার ওপর পরীক্ষা নেয়ার প্রয়োজন আছে কি?
অথচ আমাদের তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা এবং ইংরেজি প্রশ্নে এখন যুগপৎভাবে পাঠ্যবইয়ের অন্তর্গত এবং পাঠ্যবইবহির্ভূত দু’রকম দুটি অনুচ্ছেদের ওপর পরীক্ষা নেয়া হয়।
ইংরেজির কথায় আসি। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর ইংরেজি প্রশ্নকাঠামোতে এখন একটি Passage আসে, যা পাঠ্যবইয়ে নেই। ২০১৩ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ইংরেজি প্রশ্নে দেখলাম, বিশাল একটি Unseen Passage এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পেসেজটিকে পঞ্চম শ্রেণীর ইংরেজি পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত পেসেজের সমপর্যায়ের মনে করা হলেও এ পেসেজের Vocabulary গুলো কি শিক্ষার্থীরা পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্যবই থেকে শিখতে পেরেছে? না শিখে থাকলে তারা এ পেসেজের অর্থ উদ্ধার করবে কিভাবে? এ পেসেজের Sentence গুলোর কাঠামো কি তারা এ পর্যন্ত চর্চার সুযোগ পেয়েছে? তাহলে এ পেসেজের ওপর বিভিন্ন প্রশ্নের তারা উত্তর দেবে কিভাবে?
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। শিশুরা শৈশব থেকে বাংলা শুনতে এবং বাংলায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত কোনো শিশু বাংলা ভাষায় রচিত পাঁচ-পাঁচটি বইয়ের বিপরীতে একটিমাত্র ইংরেজি বই অধ্যয়নের সুযোগ পায়। আমাদের শ্রেণীকক্ষের ভাষাও কিন্তু ইংরেজি নয়। তবু বাংলার মতোই ইংরেজিতেও পাঠ্যবইবহির্ভূত বিষয়ের ওপর প্রশ্ন করাটা কতটা যৌক্তিক?
একটা কৌতুক মনে পড়ছে। হাসপাতালের বেডে শায়িত সদ্য জ্ঞান ফিরে পাওয়া একজন ট্রাকচালককে ট্রাকটির মালিক জিজ্ঞেস করলেন-
: দুর্ঘটনাটি কিভাবে হয়েছে?
চালক বললেন-
: ট্রাকটি স্টার্ট দেয়ার কিছুক্ষণ পর দেখি সামনের দিক থেকে একটি বাস আসছে, তাকে সাইড দিলাম; এরপর দেখি একটি ট্রাক আসছে, তাকেও সাইড দিলাম; এরপর দেখি একটি ব্রিজ আসছে, তাকেও সাইড দিলাম; এরপর আর কিছু মনে নেই!
বাংলার মতো ইংরেজিতেও পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করাটা এরকম সবকিছুকে একই মাপকাঠিতে পরিমাপ করার মতোই বিপজ্জনক।
পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করলে করা যেতে পারে গণিতে। পাঠ্যবইয়ের একটা অংকের সংখ্যা পরিবর্তন করে প্রশ্ন করা যেতে পারে। তাহলে বোঝা যাবে, এরকম অন্য একটা সমস্যার সমাধান সে করতে পারে কিনা। কিন্তু এরকম প্রশ্ন না করে বরং ‘যোগ্যতাভিত্তিক’ নাম দিয়ে পাঠ্যবইয়ের একটা সমস্যাকে ভেঙে সমস্যাটির চারটি শাখা বের করা হয়। বড়ই অদ্ভুত ধারণা। মাঝে মাঝে ভাবি, যারা এভাবে একটি অংককে চার বা পাঁচ ভাগে বিভক্ত করে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন তৈরির অভিনব নিয়মটি প্রবর্তন করলেন, শৈশবে তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে কোনো অংকই কি শিখতে পারেননি? অংক নিয়ে এত নাটকের কী প্রয়োজন? ঐকিক নিয়মের একটি অংক পাঠ্যবইয়ে যেভাবে আছে, একইভাবে পরীক্ষায় প্রশ্ন করে কি শিক্ষার্থীদের ঐকিক নিয়মের জ্ঞান যাচাই করা সম্ভব নয়? এত শাখা-প্রশাখা বের করে শিশু-শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করার কী প্রয়োজন? প্রাথমিকের ইংরেজি বা বাংলায় পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করাটা কোনোক্রমেই সঙ্গত নয়। শিক্ষাজীবনের শেষ পর্যায়ে, স্নাতক বা স্নাতকোত্তরে এমন প্রশ্ন করা যেতে পারে। কারণ সে পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ভাষা সম্পর্কে কিছুটা পারদর্শিতা অর্জন করে। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, আমাদের প্রাথমিকের তৃতীয় শ্রেণীর বাংলায় পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করা হলেও স্নাতকের বাংলায় পাঠ্যবইবহির্ভূত কোনো প্রশ্ন করা হয় না, এমনকি পাঠ্যবই থেকেও যোগ্যতাভিত্তিক কোনো প্রশ্ন করা হয় না। সবই সেই প্রাগৈতিহাসিক মুখস্থ বিদ্যা! এর কি অর্থ এটাই যে, আমাদের স্নাতকের শিক্ষার্থীদের চেয়ে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা বাংলায় বেশি দক্ষ!
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় গাইডবই নিষিদ্ধ। কিন্তু ওপেন সিক্রেট হচ্ছে- গাইড ব্যবহার করে না, এমন শিক্ষার্থী আবিষ্কার করা বর্তমান সময়ে বেশ কষ্টকর! কেন? প্রশ্নকাঠামো পাঠ্যবইভিত্তিক নয় বলেই। ২০১৫ সালের সমাপনী পরীক্ষার জন্য ‘জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি’ যে প্রশ্নকাঠামো নির্ধারণ করেছে, তাতে পাঠ্যবই থেকে মাত্র একটি পেসেজ আসার কথা বলা হয়েছে মাত্র, আর কিছু নয়। এ পেসেজ ছাড়া প্রশ্নকাঠামোর অন্য আইটেমগুলো শিক্ষার্থীরা চর্চা করবে কোত্থেকে? এজন্যই গাইডনির্ভরতা।
আমি মনে করি, পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করে গাইড বা মডেল টেস্টের প্রয়োজনীয়তাই প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে প্রকারান্তরে। ২০১৩ সালের ইংরেজি প্রশ্নকাঠামোতে পাঠ্যবইবহির্ভূত অনুচ্ছেদটি ব্যতীত অন্য প্রশ্নগুলো যেভাবে পাঠ্যবইভিত্তিক ছিল, পুরো প্রশ্নকাঠামো এভাবে পাঠ্যবইভিত্তিক করা হলে এসবের প্রয়োজনীয়তা শূন্য হয়ে যাবে। তাই অন্তত ‘প্রাথমিক’ শিক্ষায় পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্ন করা কোনোভাবেই উচিত নয়। বাংলা এবং ইংরেজি ব্যতীত অন্য চারটি বিষয়ে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন যেভাবে শুধু পাঠ্যবই থেকেই করা হয়, বাংলা এবং ইংরেজিতেও এভাবে শুধু পাঠ্যবই থেকেই যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন করা উচিত।
নূর আহমদ
শিক্ষক, রোকনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
বশিকপুর, লক্ষ্মীপুর
nurahmad786@gmail.com

[লেখাটি দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছে ০৪ নভেম্বর ২০১৫

প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য বন্ধ করুন!

 প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য বন্ধ করুন!

নূর আহমদ
বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো কেজি স্কুল, ক্যাডেট স্কুল, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলসহ নানারকম বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে। ‘বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ না বলে এগুলোকে ‘ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান’ বলাই সঠিক। কারণ এগুলো সমাজে শিক্ষার প্রসারের জন্য গড়ে ওঠেনি। গড়ে উঠেছে লাভজনক ব্যবসায় বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে। এর প্রমাণ, যেসব এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, সেসব এলাকায়ও এরকম অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে! প্রায় প্রতিদিনই শহরের নতুন কোনো গলিতে অথবা গ্রামের কোনো পাড়ায় এরকম নতুন নতুন ‘দোকানের’ জন্ম হচ্ছে। জানি না কে বা কারা এসব খোলার অনুমতি দেয় অথবা এসব প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য আদৌ কারও অনুমতির প্রয়োজন হয় কিনা।
এসব প্রতিষ্ঠানের ভিন্নতা বা বৈশিষ্ট্য হল এখানে যে কেউ নিজ থেকেই শিক্ষক বনে যেতে পারে, শিক্ষক নিবন্ধন বা সরকারিভাবে কোনো নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য যে শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রয়োজন তা ছাড়াই! শুধু তা-ই নয়, পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত এসব কেজি স্কুলপ্রধানরা নিজেদের অধ্যক্ষ (চৎরহপরঢ়ধষ) বলেই সচরাচর পরিচয় দেন!
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেখানে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ প্রার্থীরা সরকারিভাবে নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষকতা করার অনুমতি পান, সেখানে এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করার জন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের একটু সুনজর পেলেই হয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা যা-ই থাকুক না কেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেখানে ১৮ মাসব্যাপী ‘ডিপিএড প্রশিক্ষণ’ ছাড়াও বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন, সেখানে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোনো প্রশিক্ষণেরই প্রয়োজন হয় না! তবু এরা শিক্ষক! জানি না, এরকম প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের অনুমোদন পায় কী করে।
কিছু মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে পড়ালেখা করানোটাকে আজকাল ফ্যাশন মনে করে। টাকা-পয়সা একটু বেশি থাকলেই হল। কাছের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যত যোগ্যই হোন না কেন, এরা টাকার গরমে সন্তানকে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেন কেজি স্কুলে। এতে পাড়া-পড়শীরা ভাবে লোকটি সন্তানের পড়ালেখায় অনেক টাকা খরচ করছে। কেজি স্কুলগুলো প্রতিষ্ঠার পর থেকে মানুষের এ হুজুগেপনার কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে এখন অনেকে ‘গরিবের বিদ্যালয়’ বলেই মনে করে। তাছাড়া কেজি স্কুলগুলোতে প্রতি শ্রেণীতে আট থেকে দশটি করে বই থাকায় অভিভাবকরা মনে করে কেজি স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করালে সন্তান অল্প দিনে অনেক কিছু শিখে বিশাল কিছু হয়ে যাবে; কিন্তু এটা ভাবে না, যাদের কাছে তার সন্তানকে পড়তে দিয়েছে, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কী, তাদের মধ্যে সততা কতটুকু রয়েছে, তাদের মধ্যে আদর্শ রয়েছে কিনা, সর্বোপরি প্রতিষ্ঠানটি তারা কী উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ে শিশুরা কি কিছুই শিখতে পারছে না? এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ে অনেক শিশু ভালো ফলাফলও তো করে? অনেকে বিষয়টা গভীরভাবে দেখেন না। গভীরে তাকালে দেখা যাবে, এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বিত্তশালী পরিবারের, যাদের বাবা-মাও শিক্ষিত হওয়ার কারণে বাবা-মায়ের কাছেও এরা বাসায় অনেক কিছু শিখে থাকে এবং এদের দু-তিনজন টিউটরের কাছে প্রাইভেট পড়ানো হয়, যার ফলে বিদ্যালয় থেকে তেমন কিছু শেখার প্রয়োজন হয় না। শেষে ফলাফল ভালো করলে অনেকেই মনে করেন এটা প্রতিষ্ঠানের কৃতিত্ব। আসলে কিন্তু তা নয়। কেজি স্কুলগুলোতে যদি দরিদ্র ও নিন্মশ্রেণীর পরিবারের সন্তানরাও পড়ালেখা করার সুযোগ পেত, তাহলে প্রকাশ পেত এসব প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার প্রকৃত চেহারা।
কেজি স্কুলগুলো নিয়ে সরকারের নতুন করে ভেবে দেখার আরেকটি কারণ আছে। সরকার দেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ঘোষণা করেছে। অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাকে সরকার আইনেও পরিণত করেছে। দেশের সব শিশুর বিনা বেতনে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাওয়া একটা সাংবিধানিক অধিকার। এ আইন ও অধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কেজি স্কুল এবং প্রাথমিক স্তরের বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাথমিক শিক্ষাকে চড়া মূল্যে বিক্রি করছে জাতির কাছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই এনে সেগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ মোটা অংকের টাকায় বিক্রি করছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে এসব প্রতিষ্ঠান রীতিমতো ব্যবসায় পরিণত করছে। প্রাথমিক শিক্ষা তাহলে অবৈতনিক রইল কই?
আশার কথা, এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে অবশেষে সরকারের টনক নড়েছে। সরকার দেশের গ্রাম-গঞ্জ ও শহরের অলিগলিতে গড়ে ওঠা অবৈধ ইংলিশ মিডিয়াম, কিন্ডারগার্টেন ও বাংলা মাধ্যমের স্কুল বন্ধে ৫ মাস আগে উদ্যোগ নেয়। এ লক্ষ্যে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ৫৫৯টি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, ৫ মাস গত হওয়ার পরও মাঠ প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে কাজটি মোটেও এগোয়নি। এ সম্পর্কিত বড় একটি প্রতিবেদন গত ২৫ জানুয়ারি যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে এসব অবৈধ স্কুল সম্বন্ধে বলা হয়েছে, ‘কেজি স্কুলগুলো লাগামহীনভাবে চলছে। কোনো কোনো বেসরকারি প্রকাশকের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে অনেক শিক্ষক আছেন যাদের শিক্ষক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা নেই। অনেক স্কুলের মালিক তার স্ত্রী ও সন্তানরা মিলে চালাচ্ছেন। আদায় করা হচ্ছে ইচ্ছেমতো ফি। যদিও শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষকদের বেতন-ভাতাও দেয়া হয় নামমাত্র। এককথায় রমরমা শিক্ষা বাণিজ্য চালাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান।’
অন্তত প্রাথমিক শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ থেকে রক্ষার জন্য এবং মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আশা করি সরকার এসব স্কুলকে শক্ত নিয়মের আওতায় আনার ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেবে। বিশেষত যেসব এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, সেসব এলাকা থেকে প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিতে এবং নতুন করে কোথাও কেজি স্কুল স্থাপনে অনুমোদন নেয়ার ব্যাপারে সরকার আইন প্রণয়ন করবে।
আহমেদ নূর : শিক্ষক
nurahmad786@gmail.com

[লেখাটি দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয় ৩১ জানুয়ারি ২০১৭]

গ্রেডিং পদ্ধতি কেন মেধাবীদের পক্ষে নয়?

 গ্রেডিং পদ্ধতি কেন মেধাবীদের পক্ষে নয়?

নূর আহমদ
বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফলাফল গ্রেডিং পদ্ধতিতে প্রকাশ করা হচ্ছে, যা আগে প্রকাশ করা হতো বিভাগ বা শ্রেণিভেদে। উচ্চ মাধ্যমিকের পরের স্তরগুলোতে গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফলাফল প্রকাশ না করে এখনো ‘শ্রেণী’ ভেদে প্রকাশ করা হয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ফলাফল প্রকাশের আগের প্রথাটা কেন এখনো রয়ে গেল, জানি না। সনাতন পদ্ধতির তুলনায় গ্রেডিং পদ্ধতির অনেক না হলেও কিছু ইতিবাচক দিক আছে। যেমনÑ সনাতন পদ্ধতিতে প্রতি বোর্ডে সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত মাত্র ২০ জনকে সর্বোচ্চ মেধাবী বলে স্বীকৃতি দেয়া হতো। আর এখন ৮০ বা তদূর্ধ্ব নম্বরপ্রাপ্ত সবাইকে সর্বোচ্চ মেধাবী বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এটা অবশ্যই মেধাবীদের মূল্যায়নের এক উৎকৃষ্ট পন্থা। কিন্তু গ্রেডিং পদ্ধতির বড় একটি খারাপ দিক হচ্ছে, এ পদ্ধতিতে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী তাদের চেয়ে দুর্বল অনেক শিক্ষার্থীর তুলনায় খারাপ ফলাফল করে, হতাশ হয়। তাদের অভিভাবকেরাও ব্যথিত ও হতাশ হন। আর তাদের শিক্ষক, যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নিজেদের সুনামের জন্য শিক্ষার্থীদের পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন, তাদের কথা না-ই বা বললাম।
প্রথমে পঞ্চম শ্রেণীর ফলাফলের ক্ষেত্রে আসি। পঞ্চম শ্রেণীতে মোট বিষয় ছয়টি। এই ছয় বিষয়ের সব ক’টিতে যে শিক্ষার্থী ৮০ বা তার বেশি নম্বর পাবে, তার গ্রেড হবে ‘এ প্লাস’। আর যদি কোনো শিক্ষার্থী ছয় বিষয়ের কোনো একটিতে ৮০ নম্বরের কম (৭০-এর বেশি) পায়, তার গ্রেড হবে ‘এ’।
এই হিসাবে অনেক সময় এমনো হতে পারে, একজন শিক্ষার্থী পাঁচ বিষয়ে ১০০ করে আর মাত্র একটি বিষয়ে ৭৯সহ মোট ৫৭৯ নম্বর পাওয়ার কারণে পায় ‘এ’ গ্রেড। আরেকজন শিক্ষার্থী সব বিষয়ে ৮০ করে পেয়ে ছয় বিষয়ে মোট ৪৮০ নম্বর পাওয়ার ফলে পায় যায় ‘এ প্লাস’!
কত সহজ ‘এ প্লাস’ পাওয়া! ৯৯ নম্বর বেশি(!) পেয়ে একজন যেখানে পায় ‘এ’ গ্রেড, সেখানে আরেকজন তার চেয়ে ৯৯ নম্বর কম পেয়েও পেয়ে যায় ‘এ প্লাস’! কী উদ্ভট নিয়ম!
এভাবে কত মেধাবী শিক্ষার্থী গ্রেডিং পদ্ধতি প্রবর্তনের পর থেকে তাদের মেধা ও পরিশ্রমের পরিবর্তে হতাশার আগুনে দগ্ধ হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। আমাদের বিদ্যালয় থেকে ২০১৫ সালে এমন চার-পাঁচজন বেশ মেধাবী শিক্ষার্থী মাত্র একটি বিষয়ে ৮০ না পাওয়ার কারণে ‘এ প্লাস’ পায়নি, যাদের চেয়ে অনেক দুর্বল শিক্ষার্থী ওই বছর ‘এ প্লাস’ পেয়েছে বলে আমার প্রবল বিশ্বাস। এর কৈফিয়ত কে দেবে?
এবার পঞ্চম শ্রেণী ছাড়া অন্য পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফলাফলে আসি। যেগুলোতে ‘এ প্লাসের’ ওপরেও আরেকটা গ্রেড রয়েছেÑ ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ নামে। এসব পরীক্ষায় যে শিক্ষার্থী সব বিষয়ে পৃথক পৃথকভাবে ৮০ বা তার চেয়ে বেশি নম্বর পাবে, তার ফলাফল হবে ‘গোল্ডেন এ প্লাস’, আর যে শিক্ষার্থী সব বিষয়ে গড়ে ৮০ নম্বর পাবে, তার ফলাফল হবে ‘এ প্লাস’। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। হিসাবটা সহজ করার জন্য ধরা যাক তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছেÑ গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন। একজন শিক্ষার্থী গণিত ও পদার্থে পেয়েছে ১০০ করে; কিন্তু রসায়নে পেয়েছে ৭৯, তার ফলাফল হবে ‘এ প্লাস’। যদিও তার মোট নম্বর ২৭৯। আরেকজন শিক্ষার্থী তিনটি বিষয়েই পেয়েছে ৮০ করে, তার ফলাফল কিন্তু ‘গোল্ডেন এ প্লাস’! অথচ তার মোট নম্বর মাত্র ২৪০।
মাত্র তিনটি বিষয়ে ৩৯ নম্বর কম পেয়েও একজন শিক্ষার্থী প্রচলিত গ্রেডিং পদ্ধতিতে পেয়ে যায় ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ আর ৩৯ নম্বর বেশি পাওয়া সত্ত্বেও আরেকজন পায় শুধু ‘এ প্লাস’। সব বিষয়ের ক্ষেত্রে মোট নম্বরে অনেক বড় পার্থক্যের সম্ভাবনাও থেকে যায়। এ রকম সব বিষয়ে কাঁটায় কাঁটায় ৮০ নম্বর পেয়ে ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ পাওয়া একজন শিক্ষার্থীর চেয়ে ১৪০-১৫০’র মতো নম্বর বেশি পেয়েও অনেক শিক্ষার্থী ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ পায় না, পায় মাত্র ‘এ প্লাস’। দেশের সেরা মেধাবীদের প্রতি এটা কি তামাশা নয়? এটা কি প্রকৃত মেধাবীদের মূল্যায়ন, নাকি অবমূল্যায়ন? বছরের পর বছর দেশের সেরা অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী এভাবে অবমূল্যায়নের শিকার হয়ে আসছে। বিষয়টি গভীরভাবে যাচাই করে দেখার মনে হয় কেউ নেই!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একবার এ বিষয়ে একটি লেখা লিখেছি। প্রায় সবাই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু একজন পাঠক মন্তব্য করে বসলেন, ‘ছেলে নাইনটি নাইন পার্সেন্ট ভালো। শুধু মাঝে মাঝে নাইট ক্লাবে যায়। নিশ্চয় এই ছেলেকে আপনি ভালো বলবেন না।’ আমি তাকে উত্তরে লিখলাম, ‘৭৯ বা ৮০ পাওয়া-না-পাওয়ার সাথে নাইট ক্লাবে যাওয়া-না-যাওয়ার তুলনা করা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম এক নির্বুদ্ধিতা।’ ওই পাঠক এর পরও প্রচলিত গ্রেডিং পদ্ধতির ভ্রান্তি সুস্পষ্টভাবে বুঝতে না পেরে পুনরায় মন্তব্য করলেন, ‘একজন ওভার-অল ভালো। আরেকজন শারীরিক শিক্ষা, কৃষি আর বাংলায় ভালো। গণিত আর ইংরেজিতে খারাপ। অথচ আপনি আন্দোলনে নামলেন শেষের বলদকে ডগায় তুলার জন্য। হা হা হা। ভালোই...।’ তার কথার জবাবে এবার বললাম, ‘০১. খারাপ বলতে কি এমন খারাপ যে, সে গণিত বা ইংরেজিতে ফেল করেছে বা ৭০ থেকেও কম পেয়েছে? ০২. এবার বলুন, একজন গণিত ও ইংরেজিতে ১০০ করে পেয়ে শারীরিক শিক্ষায় পেয়েছে ৭৯, সে কি ওই শিক্ষার্থীর চেয়ে খারাপ, যে সব বিষয়ে পেয়েছে ৮০ করে?... ০৩. আপনার কথা শুনে মনে হলো, যারা গ্রেডিং সিস্টেমটা এভাবে সাজিয়েছে, তারাও আপনার মতোই অতি উর্বর মস্তিষ্কের অধিকারী। না হয়, সিস্টেমটা সবার জন্যই কল্যাণকর হতো।’ আমার এ রিপ্লাইয়ের পর ওই পাঠক অকপটে নিজের ভুল স্বীকার করে লিখলেন, ‘আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। ধন্যবাদ...।’
প্রচলিত গ্রেডিং পদ্ধতির আরেকটা ত্রুটি আমার কাছে মনে হয় ৮০ থেকে ১০০ পর্যন্ত মাত্র একটি গ্রেড রাখা। ৮০ থেকে নিচের দিকে প্রায় প্রতি ১০ নম্বরের ব্যবধানে একটা গ্রেড পরিবর্তন হয়। কিন্তু ৮০ থেকে এর পরে মোট ২১ নম্বরে একটাই গ্রেড। একজন শিক্ষার্থী সব বিষয়ে ৮০ থেকে সামান্য বেশি করে নম্বর পেয়ে যে গ্রেড পায়, আরেকজন শিক্ষার্থী সব বিষয়ে ৯০-৯৫ বা এর চেয়ে বেশি নম্বর পেয়েও সেই একই গ্রেড পায়। এটা কি সুবিচার? এ জন্য আমার মনে হয় সবরকম পাবলিক পরীক্ষায় যে শিক্ষার্থী সব বিষয়ে গড়ে ৮০ থেকে ৮৯ নম্বর পাবে, তাকে দেয়া উচিত ‘এ প্লাস’ আর যে শিক্ষার্থী সব বিষয়ে গড়ে ৯০ থেকে ১০০ নম্বর পাবে, তাকে দেয়া উচিত ‘গোল্ডেন এ প্লাস’। তাহলে মেধাবীদের প্রতি কোনো রকম অবিচার হবে না এবং উপরে উল্লিখিত উভয় সমস্যারই যুক্তিযুক্ত সমাধান হবে।
ইংরেজি GPA কথাটি মূলত Grading Point Average-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। মানে গড় পয়েন্টের ওপর ভিত্তি করে গ্রেড দেয়া। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এখন ‘গোল্ডেন এ প্লাসের’ ক্ষেত্রে কোনো গড় করাই হয় না। সব বিষয়ে ৮০ বা তার চেয়ে বেশি নম্বর পেতে হবে। তাহলে এটা Average বা গড় হলো কেমন করে? অনেক বিষয়ে ৯০ বা তার চেয়ে বেশি পাওয়া একজন শিক্ষার্থী কোনো এক বিষয়ে ৮০ থেকে একটু কম নম্বর পেতেই পারে। সে কি ওই শিক্ষার্থী থেকে খারাপ হয়ে গেল, যে সব বিষয়ে ৮০ থেকে বেশি পেয়েছে বটে, তবে কোনো বিষয়েই ৯০ বা তার চেয়ে বেশি পায়নি? এ জন্য মোট নম্বরে গড় বিবেচনা করে গ্রেডিং করা হলে কোনো মেধাবী শিক্ষার্থীই তার পরিশ্রমের বিনিময়ে হতাশ হবে না। বিষয়টির প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক : শিক্ষক
nurahmad786@gmail.com
..............................................................................
[লেখাটি দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত হয়েছে ১০ জুলাই ২০১৮। লিঙ্ক: https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/331634
দৈনিক যুগান্তরের উপসম্পাদকীয় পাতায়ও লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ তারিখে।]

জাতীয় বেতন কাঠামো : বৈষম্য দূর করার উপায়

জাতীয় বেতন কাঠামো নিয়ে সরকারি চাকরিজীবিদের মধ্যে অনেক অসন্তোষ আছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণির চাকরিজীবিদের মধ্যে। অসন্তোষের নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। প্রধান কারণ গ্রেডে গ্রেডে আকাশ-পাতাল বৈষম্য।

আমার চাকরি শুরু হয়েছে ১৫ তম গ্রেডে ৯৭০০ টাকা স্কেলে। পিটিআইতে সি-ইন-এড প্রশিক্ষণের পর এক গ্রেড উন্নীত হয়ে ১৪ তম গ্রেডে এসেছে। বেতন তো বৃদ্ধি পাবার কথা স্বাভাবিকভাবেই। সত্যিই, মূল বেতন বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু মোট বেতন গেছে কমে! কিভাবে?

আগে বাড়ি ভাড়া ছিল ৫০ শতাংশ। মাত্র এক গ্রেড বাড়তে না বাড়তেই এবার তা হয়ে গেছে ৪৫ শতাংশ! মূল বেতন বাড়লেও মোট বেতন কমে গেছে। বেতন বৃদ্ধির কথা বলে বরং বেতন কমিয়ে দেয়া হয়েছে! একে কি তামাশা বলবেন, নাকি প্রহসন বলবেন, নাকি বঞ্চনা বলবেন, নাকি বলবেন ধোঁকা? যা-ই বলবেন, সবই ঠিক।

২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর সরকার অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলের গেজেট প্রকাশ করে। প্রাথমিক অবস্থায় যখন দেখেছি সরকার চাকরিজীবিদের বেতন আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করে দিয়েছে, তখন বেতন স্কেলের অন্য দিকগুলো নিয়ে তেমন ভাববার প্রয়োজন মনে হয়নি। যেমন: আগে আট বছর পর যে টাইম স্কেল দেওয়া হতো, তা বাদ দিয়ে নতুন কাঠামোয় ১০ বছরে একটা গ্রেড বৃদ্ধির নিয়ম করা হয়।

আমার চাকরি শুরু মে ২০০৯ সালে। সেই হিসেবে ৮ বছরের জায়গায় ১০ বছরে, মানে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে একটা গ্রেড বৃদ্ধি পাবার কথা ছিল। কিন্তু ১১ বছর পার হয়ে যাবার পরও এখনো তার কোনো নাম-গন্ধও নেই। ‘‘প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়’’ এবং ‘‘প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর’’ এর মতো দুই দুইটি বড় প্র্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও এমন হওয়াটা কোনোভাবেই কাম্য হবার কথা ছিল না।
কথা সেটা নয়। কথা হচ্ছে, ৮ বছরের জায়গায় ১০ বছরের দীর্ঘ অপেক্ষার পর একটা গ্রেড পরিবর্তন হয়ে উন্নীত গ্রেডে যাবার পর আমাদের বেতন কত বৃদ্ধি পেতো?
বর্তমান বেতন কাঠামো বা গ্রেডগুলো সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই, তাদেরকে এ সম্পর্কে অনুমান করতে বললে তাদের অধিকাংশ মানুষের অনুমানের সাথে বাস্তবতার দূরত্ব অনেক অনেক বেশি হবে, সন্দেহ নেই। কারণ তারা সবাই ভাববে, প্রথমতঃ সরকারি চাকরি, দ্বিতীয়তঃ ১০ বছর চাকরি করার পর একটা গ্রেড বৃদ্ধি পাবে, নিশ্চয়ই অনেক টাকা বাড়বে।

কিন্তু বাস্তবতা কী বলে?
সেজন্য দেখতে হবে বর্তমান বেতন কাঠামো, যা প্রণয়ন করেছে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী কিছু প্রবীণ আমলা।
‘‘২০ তম গ্রেডের বেতন ৮২৫০ থেকে ২৫০ টাকা বেড়ে ১৯ তম গ্রেডে বেতন হয় ৮৫০০ টাকা, ১৯ তম গ্রেড থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে ১৮ তম গ্রেডে বেতন হয় ৮৮০০ টাকা, ১৮ তম গ্রেড থেকে ২০০ টাকা বেড়ে ১৭ তম গ্রেডে বেতন হয় ৯০০০ টাকা, ১৭ তম গ্রেড থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে ১৬ তম গ্রেডে বেতন হয় ৯৩০০ টাকা, ১৬ তম গ্রেড থেকে ৪০০ টাকা বেড়ে ১৫ তম গ্রেডে বেতন হয় ৯৭০০ টাকা, ১৫ তম গ্রেড থেকে ৫০০ টাকা বেড়ে ১৪ তম গ্রেডে বেতন হয় ১০২০০ টাকা, ১৪ তম গ্রেড থেকে ৮০০ টাকা বেড়ে ১৩ তম গ্রেডে বেতন হয় ১১০০০ টাকা, ১৩ তম গ্রেড থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে ১২ তম গ্রেডে বেতন হয় ১১৩০০ টাকা, ১২ তম গ্রেড থেকে ১২০০ টাকা বেড়ে ১১ তম গ্রেডে বেতন হয় ১২৫০০ টাকা, ১১ তম গ্রেড থেকে ৩৫০০ টাকা বেড়ে ১০ম গ্রেডে বেতন হয় ১৬০০০ টাকা, ১০ম গ্রেড থেকে ৬০০০ টাকা বেড়ে ৯ম গ্রেডে বেতন হয় ২২০০০ টাকা, ৯ম গ্রেড থেকে ১০০০ টাকা বেড়ে ৮ম গ্রেডে বেতন হয় ২৩০০০ টাকা, ৮ম গ্রেড থেকে ৬০০০ টাকা বেড়ে ৭ম গ্রেডে বেতন হয় ২৯০০০ টাকা, ৭ম গ্রেড থেকে ৬৫০০ টাকা বেড়ে ৬ষ্ঠ গ্রেডে বেতন হয় ৩৫৫০০ টাকা, ৬ষ্ঠ গ্রেড থেকে ৭৫০০ টাকা বেড়ে ৫ম গ্রেডে বেতন হয় ৪৩০০০ টাকা, ৫ম গ্রেড থেকে ৭০০০ টাকা বেড়ে ৪র্থ গ্রেডে বেতন হয় ৫০০০০ টাকা, ৪র্থ গ্রেড থেকে ৬৫০০ টাকা বেড়ে ৩য় গ্রেডে বেতন হয় ৫৬৫০০ টাকা, ৩য় গ্রেড থেকে ৯৫০০ টাকা বেড়ে ২য় গ্রেডে বেতন হয় ৬৬০০০ টাকা, ২য় গ্রেড থেকে ১২০০০ টাকা বেড়ে ১ম গ্রেডে বেতন হয় ৭৮০০০ টাকা।’’

তার মানে ১৪ তম গ্রেডে যারা আছেন, তারা ১০ বছর চাকরি করার পর একটা গ্রেড বৃদ্ধি পাবার ফলে তাদের বেতন বাড়বে ৮০০ টাকা! ১০ বছর পর ‘মাত্র’ ৮০০ টাকা বেতন বৃদ্ধি করাটা কি রীতিমতো তামাশার বিষয় নয়?
পরবর্তী গ্রেড? পরবর্তী গ্রেডে অবশ্য ৮০০ টাকাও নয়, মাত্র ৩০০ টাকা বৃদ্ধির নিয়ম করা হয়েছে। একজন লোক যত অভিজ্ঞ হয়, চাকরি যত গাঢ় হয়, চাকরি করতে করতে একজন লোক যত দক্ষ হয়, তার বেতন বৃদ্ধির হার তত বাড়বে, এটই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের বেতন কাঠামোর চিত্র তার ঠিক উল্টো মেরুতে।

১২ তম গ্রেড থেকে ১১তম গ্রেডে গেলে ৩০০ টাকা থেকে লাফ দিয়ে বেতন বাড়ে ১২০০ টাকা (আগের তুলনায় ৪গুণ), আবার ১১তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে বেতন বাড়ে ৩৫০০ টাকা (তিন গুণ প্রায়)! এই ১৪ তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে যাবার পথে বেতন কাঠামো কোনো ফর্মুলা বা ব্যাকরণ-ই অনুসরণ করেনি। কেন? এমন মনগড়া কাঠামো প্রণয়নের কী দরকার ছিল? প্রশ্ন জাগে, এমন ‘মনগড়া ও যাচ্ছেতাই’ বেতন কাঠামো প্রণয়নের জন্য দেশের ‘সর্বোচ্চ মেধাবী কিছু প্রবীণ আমলা’কে নিয়োগ করার কি কোনো আবশ্যকতা ছিল? এজন্য তো এসএসসি পাস কয়েকজনকে নিয়োগ দিলেই কাজটা তারা অল্পসময়ে করে দিতে পারতো! প্রশ্ন জাগে, বেতন কাঠামো কি বৃটিশ বা পাকিস্তানী আমলারা প্রণয়ন করেছে? এখনও কি এদেশে বৃটিশ বা পাকিস্তানী আমল চলছে? মোটেই না।

এই কাঠামো অল্পশিক্ষিত কেউ যেমন প্রণয়ন করেনি, বৃটিশ বা পাকিস্তানী আমলারাও করেনি, করেছে এদশেরই কিছু ‘উচ্চশিক্ষিত স্বার্থপর’ মানুষ, কাজেকর্মে যারা বৃটিশ বা পাকিস্তানী শাসনরীতিই অনুসরণ করে; যারা বৃটিশ বা পাকিস্তানী আমলা না হলেও বৃটিশ বা পাকিস্তানী শাসকদের প্রেতাত্মার মতোই কাজটি করেছে। জমিদারী প্রথা আমরা দেখিনি, কিন্তু চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, এখনো কাজেকর্মে আমাদের অনেকেই আমাদের সাথে জমিদারদের মতোই আচরণ করছে। এরা সেইসব জমিদারদের আক্ষরিক অর্থে উত্তরসূরী না হলেও তাদের প্রেতাত্মা, কোনো সন্দেহ নেই।

বর্তমান বেতন কাঠামোকে ‘মনগড়া ও যাচ্ছেতাই’ বলা এবং এই কাঠামো প্রণেতাদেরকে ‘বৃটিশ-পাকিস্তানী শাসকদের প্রেতাত্মা’ বা ‘জমিদারদের প্রেতাত্মা’ বলার কারণ সম্পর্কে উপরে সামান্যই বলা হয়েছে। আমরা এবার এই কাঠামোর আরো কিছু ‘মনগড়া ও যাচ্ছেতাই’ বিষয় এবং কাঠামো-প্রণেতাদের স্বার্থপরতার আরো কিছু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখবো।

২০ তম গ্রেড থেকে ১২তম গ্রেড পর্যন্ত মোট ৮টা গ্রেড মিলিয়ে যেখানে বেতন বাড়ে মাত্র ৩০৫০ টাকা, সেখানে ৭ম গ্রেড থেকে মাত্র ১টা গ্রেড বেড়ে ৬ষ্ঠ গ্রেডে গেলেই বেতন বাড়ে ৬৫০০ টাকা, দ্বিগুণেরও বেশি! একটা গ্রেড পরিবর্তনে যেখানে সর্বোচ্চ বেতন বাড়ে ১২০০০ টাকা, সেখানে শেষের দশটা গ্রেড মিলিয়ে বেতন বাড়ে মাত্র ৭৭০০ টাকা!

আমরা উপরে বেতন কাঠামোয় গ্রেডে গ্রেডে বেতন বৃদ্ধির ধারা দেখেছি। বেতন বৃদ্ধির এই ধারা (২৫০<৩০০>২০০<৩০০<৪০০<৫০০<৮০০>৩০০<১২০০<৩৫০০<৬০০০>১০০০<৬০০০<৬৫০০<৭৫০০>৭০০০>৬৫০০<৯৫০০<১২০০০) কি বিজ্ঞানের কোনো সূত্র অনুসরণ করেছে, নাকি গণিতের কোনো সূত্র অনুসরণ করেছে, বুঝতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এটাকে লুডু খেলার মইয়ের সাথে তুলনা করারও সুযোগ নেই। কারণ সেখানে যে-কারও ভাগে বড় মইও পড়তে পারে, ছোট মইও পড়তে পারে। কিন্তু এখানে অন্যদের জন্য নির্দিষ্ট (ফিক্স) করে দেয়া হয়েছে শুধু বিভিন্ন আকারের ছোট ছোট মই, আর যারা কাঠামোটি প্রণয়ন করেছে, তাদের নিজেদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে সব বড় বড় মই। এখানে প্রতিপক্ষের জন্য বড় মইয়ে ওঠার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি আর যারা খেলাটা আয়োজন করেছে, তাদের ভাগে ছোট মই পড়ার কোনো সম্ভাবনাই রাখা হয়নি। এটাকে ‘বৃটিশ-পাকিস্তানী শাসকদের প্রেতাত্মা’দের কাজ মনে না করার সুযোগ কোথায়! এটাকে ‘মনগড়া ও যাচ্ছেতাই’ না বলেও কি কোনো উপায় আছে?

বেতন বৃদ্ধির এই ধারায় ২৫০ টাকা থেকে বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে ২০০ টাকায় নেমে গেছে, আবার বাড়তে বাড়তে ৮০০ টাকা পর্যন্ত গিয়ে পা পিছলে হঠাৎ নেমে গেছে ৩০০ টাকায়, আবার বাড়তে বাড়তে ৬০০০ টাকায় গিয়ে শেয়ার বাজারের মতো হঠাৎ নেমে গেছে ১০০০ টাকায়! এভাবে নাটকের পর নাটক হয়েছে মাত্র ২০টা গ্রেডের একটা কাঠামোতে। এটা কি শেয়ার বাজারের দরের উঠানামা? এটা সবার বিশ্বাস হবে, যারা এই কাঠামোটা করেছে, তাদের কাছে এই ‘উঠানামা’র পক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো যুক্তি নেই। এটা সম্পূর্ণ মনগড়া, যাচ্ছেতাই। স্বার্থপরতার সর্বোচ্চ প্রদর্শনী। বিমূর্ত কবিতা সম্পর্কে একটি রম্যরচনা পড়েছিলাম অনেক আগে একটি দৈনিক পত্রিকায়। সেখানে একটি গল্প উল্লেখ করা হয় এরকম, ইংল্যান্ডের একজন প্রসিদ্ধ কবির একটি কবিতার অনুষ্ঠানে এক পাঠক ঐ কবিকে তাঁর একটি কবিতার দু’টি চরণ উল্লেখ করে প্রশ্ন করলো, ‘স্যার, এই দু’টি চরণ দ্বারা আপনি কী বুঝিয়েছেন?’ কবি জবাবে বললেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, কবিতাটি যখন লিখেছিলাম, তখন এই চরণ দু’টির অর্থ শুধু আমি আর ঈশ্বর জানতাম, কিন্তু এখন দেখি শুধু ঈশ্বরই জানেন!’

আমার এক সহকর্মী বললো, ‘১২তম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেডে বেতন পায় কর্মচারী ও কামলারা, তাই তাদের গ্রেডে বাড়ে ২০০/৩০০ টাকা করে আর ১ম গ্রেড থেকে ১১তম গ্রেডে বেতন পায় কর্মকর্তা ও আমলারা, এই জন্য তাদের বেতন বাড়ে ৬০০০/৭০০০ টাকা করে।’

আমলা ছাড়া যারা এই বেতন কাঠামোর সুবিধার আওতার বাইরে, এমন ১ লক্ষ সচেতন মানুষের মতামত নেয়া হলে এমন ১ জনও খুঁজে পেতে কষ্ট হতে পারে, যে এরকম ধাপ নির্ধারণকে নিঃস্বার্থ, পক্ষপাতহীন ও যৌক্তিক বলে মতামত দেবে।

আমার মতো যারা ১৫তম গ্রেডে চাকরি শুরু করেছেন, তাদের (কিছু কিছু ডিপার্টমেন্টে ভিন্ন হতে পারে) চাকরির ১০ম বছরে নতুন গ্রেডে উন্নীত হবার সময় ইনক্রিমেন্ট পেয়ে পেয়ে মূল বেতনের সাথে যোগ হয়েছে ৪৯২০ টাকা। অথচ ১০ বছর পর উন্নীত গ্রেডে যাবার ফলে তার চেয়ে বেশি না বেড়ে যদি মাত্র ৮০০ টাকা বাড়ে, তাহলে বিষয়টা কি পুরোপুরি তামাশা হয়ে যায় না? ১০ বছরে ইনক্রিমেন্ট পেয়ে পেয়ে যা বেড়েছে, উন্নীত গ্রেডে তার চেয়ে বেশি বাড়লেই ১০ বছর অপেক্ষা করাটা সার্থক হতো। সকল শ্রেণির চাকরিজীবির ক্ষেত্রেই কথাটা প্রযোজ্য। এই দৃষ্টিকোণ থেকেও বর্তমান কাঠামোকে ‘যাচ্ছেতাই ও তামাশাপূর্ণ’ বলার সুযোগ থাকে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমান সরকার দেশকে উন্নত দেশের কাতারে শামিল করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আমার মনে হয়, দেশের উন্নত হবার পথে এক বড় বাধার নাম আমলাতন্ত্র। জাপানের একটা বিষয় লক্ষ্য করলে আমার এই মতামতের সত্যতা প্রমাণিত হবে। জাপানে শ্রমের মূল্য অনেক বেশি। সেখানে একজন মুচি বা নাপিতের আয়ও দেশের প্রথম সারির পেশাজীবিদের গড় আয়ের অনেকটা কাছাকাছি। দেশের সব নাগরিকের হাতে যেন পর্যাপ্ত টাকা থাকে, সে জন্য জাপান সরকার বিভিন্ন রকম পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। সেখানে একজন নাপিতের গড় আয় মাসে ২০০০ ডলার। [দেখুন, জাপান কাহিনি ২য় খন্ড, আশির আহমেদ, ঐতিহ্য, পৃষ্ঠা-৬০] জাপানের মতো কোরিয়াতেও মানুষের আয়বৈষম্য নিরসনে সরকার সবসময় সচেষ্ট থাকে। অন্যরা যখন আয়বৈষম্য নিরসনের চেষ্টায় লিপ্ত, আমরা তখন আয়বৈষম্য বৃদ্ধির অপচেষ্টায় লিপ্ত, যার উজ্জ্বল উদাহরণ জাতীয় বেতন কাঠামো।
অস্ট্রেলিয়ায় যান। দেখবেন, সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের বেতন যা, একজন সাধারণ শ্রমজীবি মানুষের বেতনও তার প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু বাংলাদেশে সব শ্রেণির মানুষের হাতে পর্যাপ্ত টাকা থাক, এটা অন্তত এদেশের আমলাশ্রেণির মানুষ চায় না। এরা মারাত্মক স্বার্থপর, সঙ্কীর্ণ মনের অধিকারী। যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ এই চরম বৈষম্যমূলক বেতন কাঠামো, যেখানে নিচের শ্রেণির এক গ্রেড পরিবর্তনে বেতন বাড়ে ৩০০/৮০০ টাকা করে আর উপরের শ্রেণির এক গ্রেড পরিবর্তনে বেতন বাড়ে ৬০০০/৭০০০ টাকা করে। কেন, সব গ্রেডে যদি আনুপাতিকহারে সমানভাবে বেতন বাড়ে, উপরের গ্রেডে চাকরিজীবিদের কি মস্ত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে বা নিচের গ্রেডের চাকরিজীবিদের বেতন কি উপরের গ্রেডে চাকরিজীবিদের চেয়ে বেড়ে যেতে পারে?
উপরের গ্রেডের চাকরিজীবিরা হয়তো বলতে পারেন, নিচের দিকের গ্রেডগুলোতে জনবল বেশি। তাই তাদেরকে বেশি বেতন দিতে গেলে দেশের অর্থনীতির উপর চাপ পড়তে পারে। যদি দেশের প্রতি তাদের এতোই মায়া থাকে, তাহলে নিজেদের গ্রেডগুলোর মধ্যকার ব্যবধান এত বেশি রেখেছেন কেন? এমনিতেই উপরের দিকের গ্রেডে চাকরি করছেন, এরপর বেতন বৃদ্ধিটা যদি নিচের দিকের গ্রেডগুলোর চেয়ে দু’তিন গুণ বেশি হতো, তবু কম হতো না। কিন্তু তাদের বেতন বাড়ে নিচের দিকের গ্রেডগুলোর চেয়ে ২০/২৫ গুণ বেশি করে। তাদেরকে এতো বেতন দিতে গেলে দেশের অর্থনীতির উপর কি চাপ পড়ে না? আসলে এসব হচ্ছে বাহানা। নিজেরা বেতন কম নিয়ে দেশপ্রেমের কথা বললে তা সত্যিকার দেশপ্রেম হতো।

বর্তমান বেতনকাঠামো অনুযায়ী মাস-শেষে সরকারের যে টাকা খরচ হয়, সবার বেতন আনুপাতিক হারে সমানভাবে (পদ্ধতি নিচে উল্লেখ করা হলো) বৃদ্ধি করলেও সরকারের খরচ বেশ একটা বাড়বে না। তাছাড়া দেশের সব নাগরিকের প্রতি সুবিচার করতে গেলে যদি দেশের কিছু টাকা বাড়তি খরচ হয়, তা তো আর উপরের গ্রেডের চাকরিজীবিদের পকেট থেকে যাবে না! এদেশে সরকার যতো রাজস্ব পায়, তার বেশির ভাগ পায় সাধারণ মানুষ থেকে। উপরের গ্রেডের অল্প সংখ্যক চাকরিজীবি মুঠোফোনে কথা বলে প্রতি মাসে সরকারকে যা রাজস্ব দেয়, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি রাজস্ব দেয় নিচের দিকের চাকরিজীবিরা।

দেশের তৃণমূলে সরকারি দায়িত্ব পালন করছে নিচের দিকের চাকরিজীবিরা। উপরের শ্রেণির চাকরিজীবিদের কেউ কেউ শুয়ে-বসেই বেতন নিচ্ছে, পাচ্ছে বাড়তি অনেক সুবিধাও। একজন ইউএনও বা জেলা প্রশাসককে কখনো কি দেখেছেন কোনো উপজেলা বা জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হবার পর এক মাসের মধ্যে পুরো উপজেলা বা জেলা ঘুরে দেখেছে, সেই উপজেলা বা জেলায় কয়টি রাস্তা, কয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুরবস্থায় আছে, কয়টি সংস্কারযোগ্য ক্ষেত্র আছে? কখনো কি দেখা যায়, একজন ইউএনও বা জেলা প্রশাসক কোনো এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হবার পর অল্প সময়ের মধ্যে সেই এলাকার প্রতিটা গ্রাম/ইউনিয়ন ভিত্তিক মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদের সাথে পরিচিত হতে, তাদের সমস্যার কথা একান্তে শুনার ব্যবস্থা করতে? দেখা যায় না। এরা মূলত মিটিংয়ে মিটিংয়েই সময় কাটায়। এদের দৃশ্যমান কাজ খুব অল্প। যেমন: পাবলিক পরীক্ষা পরিদর্শন, বাল্যবিয়ে ভেঙ্গে দেয়া, কারেন্ট জাল নিধন, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা ইত্যাদি।

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির নাম, কিংবা একজন সংসদ সদস্য বা উপজেলা চেয়ারম্যানের নাম যেভাবে সংশ্লিষ্ট এলাকার সবাই জানে, একজন ইউএনও বা জেলা প্রশাসকের নাম সংশ্লিষ্ট উপজেলা বা জেলার মানুষ সেভাবে জানে না। এরা কোনো উপজেলা বা জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হবার পর কয়েক বছর চাকরি করলেও সংশ্লিষ্ট উপজেলা বা জেলার অধিকাংশ মানুষ এদেরকে চেনা দূরের কথা, এদের নামটা পর্যন্ত জানে না। আক্ষরিক অর্থে এরা মানুষের খুব কম কাজেই লাগে। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণির চাকরিজীবিরা শিক্ষা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের সেবা করে, খুব কমই এরা শুয়ে-বসে থাকতে পারে। কিন্তু বেতনের ক্ষেত্রে সুবিধাগুলো নিয়ে নেয় প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবিরা। এটাই বৃটিশ বা পাকিস্তানী মানসিকতা, এটাই জমিদারসুলভ আচরণের প্রতিফলন।

উপরের গ্রেডে চাকরিজীবিদের স্বার্থপরতার কাছেই জিম্মি হয়ে আছে দেশের সামগ্রিক মানুষের জীবনমানের উন্নতি। একটা বিশেষ শ্রেণির হাতে দেশের টাকা চলে যাচ্ছে বেশি। সরকার বিষয়টা যতদিন বিবেচনায় না নেবে, ততদিন দেশ সত্যিকার উন্নতির পথ খুঁজে পাবে না।

বেতন কাঠামোর বৈষম্য নিরসনের উদ্যোগ যখনই নেয়া হয়, তখন অথবা পরবর্তী পে-স্কেল যখনই দেয়া হয়, তখন কিছু প্রস্তাব বিবেচনায় নেয়ার অনুরোধ থাকবে।

১. প্রতি গ্রেডে ব্যবধান যেন আনুপাতিকহারে সমান করে দেয়া হয়। এতে উপরের দিকের গ্রেডে যারা চাকরি করে, তাদের কোনো ক্ষতি হবার কথা নয়। কারণ তারা তো বড় স্কেলেই চাকরি শুরু করেছে।
‘আনুপাতিকহারে সমান’ করার প্রক্রিয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের মতামত চাইলে অনেক রকম মতামত আসতে পারে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, পক্ষপাতহীন ও নিঃস্বার্থ মতামত হতে পারে প্রতি গ্রেডে শতকরা হারে বেতন বৃদ্ধি করার নিয়ম রাখা হলে। যেমন: প্রতি গ্রেডে ২০ শতাংশ বা ২৫ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি করা হলে গ্রেডে গ্রেডে ‘ব্যবধান’কে কোনোভাবে ‘বৈষম্য’ বলার সুযোগ থাকবে না; কোনো শ্রেণির চাকরিজীবি এতে অসন্তুষ্ট হবে না; সবাই যার যার স্কেল এবং উন্নীত গ্রেড নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে। এটা ঠিক বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের মতো।
২. ২০ গ্রেড থেকে কমিয়ে ১৬ গ্রেড করা হলে অনেক দিক থেকে ভালো হতে পারে।
. প্রতি ৮ বছর পর পর যেন সকল চাকরিজীবির বেতন গ্রেড পরিবর্তন করা হয়, চাকরিজীবনে ন্যূনতম ৩ বার যেন উন্নীত গ্রেডে যাবার সুযোগ থাকে। এতে যেসব পদে প্রমোশনের সুযোগ নেই, সেসব পদে চাকরিজীবিদের মনে হতাশা কমবে। যেমন: তৃতীয় শ্রেণির চাকরিজীবি যারা, তারা ১২ তম গ্রেডে চাকরি শুরু করবে, এরপর প্রতি ৮ বছর পর পর নতুন গ্রেডে যেতে যেতে শেষে ৯ম গ্রেড পর্যন্ত পৌঁছবে, এভাবে ১ম শ্রেণির চাকরিজীবিরা ৪র্থ গ্রেডে চাকরি শুরু করবে, এরপর প্রতি ৮ বছর পর পর নতুন গ্রেডে যেতে যেতে ১ম গ্রেড পর্যন্ত পৌঁছবে। এতে কোনো শ্রেণির চাকরিজীবি নিজের শ্রেণি অতিক্রম করে উপরের শ্রেণি স্পর্শ করার সম্ভাবনাও থাকবে না, যা বর্তমান কাঠামোয় আছে এবং অযৌক্তিক।
৪. সরকারি চাকরিতে যেহেতু মোট ৪টি শ্রেণি, গ্রেড কমিয়ে ১৬টি করে নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৬টি গ্রেডকে ৪ শ্রেণি দিয়ে ভাগ করে প্রতি শ্রেণির প্রান্তিক গ্রেডকে সেই শ্রেণিতে নিয়োগের প্রারম্ভিক গ্রেড হিসেবে নির্ধারণ করা হোক। যেমন: প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবিদের নিয়োগ হবে ৪র্থ গ্রেডে, দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিজীবিদের নিয়োগ হবে ৮ম গ্রেডে। তাহলে সব শ্রেণির চাকরিজীবিই নিজের পদ, সম্মান ও বেতন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে; বর্তমান কাঠামোর অনেক জটিলতা এবং অসঙ্গতিও দূর হবে।

৫. বেতন কাঠামোয় বর্তমান ২০ গ্রেডের ভেতরে ভেতরে যেসব খুচরা খুচরা ধাপ রাখা হয়েছে, সেগুলো রাখার কোনো যৌক্তিকতা আছে কিনা, সে ব্যাপারে জনমত যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এগুলোর যৌক্তিকতা বা প্রয়োজনীয়তা নেই বলেই অধিকাংশ মানুষ মতামত দিতে পারে।
৬. বর্তমান কাঠামোয় গ্রেড উন্নীতকরণের পাশাপাশি বাড়িভাড়া কমানোর নিয়ম রাখায় উন্নীত গ্রেডে যাওয়াটা অনেকের জন্য বঞ্চনা ও হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাড়িভাড়া তো দিন দিন বাড়েই, কমে না। তাহলে কেন বাড়িভাড়া কমানো হবে? বাড়িভাড়া কমানোর নিয়ম উন্নীত গ্রেডে যাবার সাথে সাংঘর্ষিক। তাই এই নিয়ম বাতিল করা উচিত।

এই আর্টিকেল সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত জানাতে পারেন এই পেইজে: https://www.facebook.com/nurahmad.bangladeshi/posts/104529757819418

হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক কি বংশগতভাবে বা জিনগতভাবে হয়?

শুধু উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস নয়, হৃদরোগও যে বংশগত কারণে হতে পারে বলে কেউ মনে করে, তা রীতিমতো আমার ধারণার বাইরে ছিল। অবাক হয়ে গেলাম সেদিন একটি দৈনিক পত্রিকায় খোদ এক ডাক্তারের লেখায় এমন কথা পড়ে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ দৈনিক যুগান্তরের ‘সুস্থ থাকুন’ পাতায় ‘হার্ট ভালো রাখার টিপস’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়, যা লিখেছেন ঢাকার উত্তরার শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের ডাক্তার সামিয়া তাসনীম। তিনি লিখেছেন, ‘উত্তরাধিকার সূত্রেও কেউ হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারেন।’

একসময় অধিকাংশ মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হতো ষাট-সত্তর বছর বয়সের পর। একজন লোক যদি ষাট বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয় বা মারা যায় এবং তার কোনো সন্তান পরে কখনো হৃদরোগে আক্রান্ত হয়, ধরে নেয়া হয়, লোকটির হৃদরোগ থাকাতেই তার সন্তানও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু এটা কি সম্ভব? সম্ভব নয়। কারণ-

১. লোকটি যখন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়, তার অনেক আগেই, যখন সে হৃদরোগমুক্ত ছিল, তখনই তার সন্তানটি তার স্ত্রীর গর্ভে আসে। তাহলে সন্তানের শরীরে তার শরীর থেকে এ রোগ কিভাবে সংক্রমিত হবে?

২. লোকটি ষাট বছর বয়সে পৌঁছার পরই তো তার শরীরে হৃদরোগ দেখা দেয়। ষাট বছরের আগে যদি সে হৃদরোগ ব্যতীত কোনো দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো কারণে মারা যেতো, তখন কি তার সন্তান হৃদরোগ থেকে নিষ্কৃতি পেতো?

৩. সন্তানটি জন্মের পর থেকে চল্লিশ বছর যখন হৃদরোগমুক্ত ছিল, তখন বংশগত কারণটি কোথায় ছিল? বংশগত কারণে যেসব রোগ হয়, সেসব সাধারণতঃ জন্মের সময়েই সন্তান শরীরে করে পৃথিবীতে নিয়ে আসে। চল্লিশ বছর যখন সে সুস্থ ছিল, তখন এটা বলার কোনো সুযোগই থাকে না, রোগটি তার বংশগত কারণে হয়েছে।

৪. বিগত চার-পাঁচ দশক ধরে যারা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন, হৃদরোগে মারা গেছেন, তাদের মধ্যে এমন মানুষ খুঁজে বের করা কষ্টকর হবে, যার পূর্বপুরুষ কারো হৃদরোগ ছিল। এর প্রধান কারণ, চার-পাঁচ দশক বা তারও আগে মানুষের জীবন শ্রমসাধ্য সব কাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল বলে হৃদরোগ মানুষকে তেমন স্পর্শ করার সুযোগ পেত না। হৃদরোগের উপদ্রব শুরু হয় মানুষের জীবন থেকে কায়িক শ্রম দূরে সরে যেতে থাকার পর থেকে; মানুষ ব্যবসা আর চাকরিমুখী হয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা অফিসে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে অভ্যস্ত হওয়ার পর থেকে; গাড়ি, লিফট, মেশিন এসব আরামের উপকরণ ব্যবহারে মানুষ অভ্যস্ত হবার পর থেকে; সর্বোপরি মানুষের শরীরে চর্বি-কোলেস্টেরল বৃদ্ধির সুযোগ পাবার পর থেকে।

তাই হৃদরোগকে বংশগত বলে আমরা প্রকারান্তরে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া-না হওয়ার বিষয়টাকে নিয়তির উপরই ছেড়ে দিচ্ছি এবং হৃদরোগ থেকে আত্মরক্ষার উপায় খোঁজার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছি। বিশ্বব্যাপী মানুষ ব্যাপকহারে হৃদরোগে আক্রান্ত হবার এটা একটা প্রধান কারণ।

 এই নিবন্ধটি ‘‘দীর্ঘজীবন লাভের উপায়’’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি বই থেকে নেয়া হয়েছে। পুরো বই অনলাইনে পড়তে হলে এই পেইজে যেতে হবে: https://www.facebook.com/waytogainlonglife/posts/786418842097294