আমার চাকরি শুরু হয়েছে ১৫ তম গ্রেডে ৯৭০০ টাকা স্কেলে। পিটিআইতে সি-ইন-এড প্রশিক্ষণের পর এক গ্রেড উন্নীত হয়ে ১৪ তম গ্রেডে এসেছে। বেতন তো বৃদ্ধি পাবার কথা স্বাভাবিকভাবেই। সত্যিই, মূল বেতন বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু মোট বেতন গেছে কমে! কিভাবে?
আগে বাড়ি ভাড়া ছিল ৫০ শতাংশ। মাত্র এক গ্রেড বাড়তে না বাড়তেই এবার তা হয়ে গেছে ৪৫ শতাংশ! মূল বেতন বাড়লেও মোট বেতন কমে গেছে। বেতন বৃদ্ধির কথা বলে বরং বেতন কমিয়ে দেয়া হয়েছে! একে কি তামাশা বলবেন, নাকি প্রহসন বলবেন, নাকি বঞ্চনা বলবেন, নাকি বলবেন ধোঁকা? যা-ই বলবেন, সবই ঠিক।
২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর সরকার অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলের গেজেট প্রকাশ করে। প্রাথমিক অবস্থায় যখন দেখেছি সরকার চাকরিজীবিদের বেতন আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করে দিয়েছে, তখন বেতন স্কেলের অন্য দিকগুলো নিয়ে তেমন ভাববার প্রয়োজন মনে হয়নি। যেমন: আগে আট বছর পর যে টাইম স্কেল দেওয়া হতো, তা বাদ দিয়ে নতুন কাঠামোয় ১০ বছরে একটা গ্রেড বৃদ্ধির নিয়ম করা হয়।আমার চাকরি শুরু মে ২০০৯ সালে। সেই হিসেবে ৮ বছরের জায়গায় ১০ বছরে, মানে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে একটা গ্রেড বৃদ্ধি পাবার কথা ছিল। কিন্তু ১১ বছর পার হয়ে যাবার পরও এখনো তার কোনো নাম-গন্ধও নেই। ‘‘প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়’’ এবং ‘‘প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর’’ এর মতো দুই দুইটি বড় প্র্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও এমন হওয়াটা কোনোভাবেই কাম্য হবার কথা ছিল না।
কথা সেটা নয়। কথা হচ্ছে, ৮ বছরের জায়গায় ১০ বছরের দীর্ঘ অপেক্ষার পর একটা গ্রেড পরিবর্তন হয়ে উন্নীত গ্রেডে যাবার পর আমাদের বেতন কত বৃদ্ধি পেতো?
বর্তমান বেতন কাঠামো বা গ্রেডগুলো সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই, তাদেরকে এ সম্পর্কে অনুমান করতে বললে তাদের অধিকাংশ মানুষের অনুমানের সাথে বাস্তবতার দূরত্ব অনেক অনেক বেশি হবে, সন্দেহ নেই। কারণ তারা সবাই ভাববে, প্রথমতঃ সরকারি চাকরি, দ্বিতীয়তঃ ১০ বছর চাকরি করার পর একটা গ্রেড বৃদ্ধি পাবে, নিশ্চয়ই অনেক টাকা বাড়বে।
কিন্তু বাস্তবতা কী বলে?
সেজন্য দেখতে হবে বর্তমান বেতন কাঠামো, যা প্রণয়ন করেছে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী কিছু প্রবীণ আমলা।

‘‘২০ তম গ্রেডের বেতন ৮২৫০ থেকে ২৫০ টাকা বেড়ে ১৯ তম গ্রেডে বেতন হয় ৮৫০০ টাকা, ১৯ তম গ্রেড থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে ১৮ তম গ্রেডে বেতন হয় ৮৮০০ টাকা, ১৮ তম গ্রেড থেকে ২০০ টাকা বেড়ে ১৭ তম গ্রেডে বেতন হয় ৯০০০ টাকা, ১৭ তম গ্রেড থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে ১৬ তম গ্রেডে বেতন হয় ৯৩০০ টাকা, ১৬ তম গ্রেড থেকে ৪০০ টাকা বেড়ে ১৫ তম গ্রেডে বেতন হয় ৯৭০০ টাকা, ১৫ তম গ্রেড থেকে ৫০০ টাকা বেড়ে ১৪ তম গ্রেডে বেতন হয় ১০২০০ টাকা, ১৪ তম গ্রেড থেকে ৮০০ টাকা বেড়ে ১৩ তম গ্রেডে বেতন হয় ১১০০০ টাকা, ১৩ তম গ্রেড থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে ১২ তম গ্রেডে বেতন হয় ১১৩০০ টাকা, ১২ তম গ্রেড থেকে ১২০০ টাকা বেড়ে ১১ তম গ্রেডে বেতন হয় ১২৫০০ টাকা, ১১ তম গ্রেড থেকে ৩৫০০ টাকা বেড়ে ১০ম গ্রেডে বেতন হয় ১৬০০০ টাকা, ১০ম গ্রেড থেকে ৬০০০ টাকা বেড়ে ৯ম গ্রেডে বেতন হয় ২২০০০ টাকা, ৯ম গ্রেড থেকে ১০০০ টাকা বেড়ে ৮ম গ্রেডে বেতন হয় ২৩০০০ টাকা, ৮ম গ্রেড থেকে ৬০০০ টাকা বেড়ে ৭ম গ্রেডে বেতন হয় ২৯০০০ টাকা, ৭ম গ্রেড থেকে ৬৫০০ টাকা বেড়ে ৬ষ্ঠ গ্রেডে বেতন হয় ৩৫৫০০ টাকা, ৬ষ্ঠ গ্রেড থেকে ৭৫০০ টাকা বেড়ে ৫ম গ্রেডে বেতন হয় ৪৩০০০ টাকা, ৫ম গ্রেড থেকে ৭০০০ টাকা বেড়ে ৪র্থ গ্রেডে বেতন হয় ৫০০০০ টাকা, ৪র্থ গ্রেড থেকে ৬৫০০ টাকা বেড়ে ৩য় গ্রেডে বেতন হয় ৫৬৫০০ টাকা, ৩য় গ্রেড থেকে ৯৫০০ টাকা বেড়ে ২য় গ্রেডে বেতন হয় ৬৬০০০ টাকা, ২য় গ্রেড থেকে ১২০০০ টাকা বেড়ে ১ম গ্রেডে বেতন হয় ৭৮০০০ টাকা।’’
তার মানে ১৪ তম গ্রেডে যারা আছেন, তারা ১০ বছর চাকরি করার পর একটা গ্রেড বৃদ্ধি পাবার ফলে তাদের বেতন বাড়বে ৮০০ টাকা! ১০ বছর পর ‘মাত্র’ ৮০০ টাকা বেতন বৃদ্ধি করাটা কি রীতিমতো তামাশার বিষয় নয়?
পরবর্তী গ্রেড? পরবর্তী গ্রেডে অবশ্য ৮০০ টাকাও নয়, মাত্র ৩০০ টাকা বৃদ্ধির নিয়ম করা হয়েছে। একজন লোক যত অভিজ্ঞ হয়, চাকরি যত গাঢ় হয়, চাকরি করতে করতে একজন লোক যত দক্ষ হয়, তার বেতন বৃদ্ধির হার তত বাড়বে, এটই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের বেতন কাঠামোর চিত্র তার ঠিক উল্টো মেরুতে
১২ তম গ্রেড থেকে ১১তম গ্রেডে গেলে ৩০০ টাকা থেকে লাফ দিয়ে বেতন বাড়ে ১২০০ টাকা (আগের তুলনায় ৪গুণ), আবার ১১তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে বেতন বাড়ে ৩৫০০ টাকা (তিন গুণ প্রায়)! এই ১৪ তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে যাবার পথে বেতন কাঠামো কোনো ফর্মুলা বা ব্যাকরণ-ই অনুসরণ করেনি। কেন? এমন মনগড়া কাঠামো প্রণয়নের কী দরকার ছিল? প্রশ্ন জাগে, এমন ‘মনগড়া ও যাচ্ছেতাই’ বেতন কাঠামো প্রণয়নের জন্য দেশের ‘সর্বোচ্চ মেধাবী কিছু প্রবীণ আমলা’কে নিয়োগ করার কি কোনো আবশ্যকতা ছিল? এজন্য তো এসএসসি পাস কয়েকজনকে নিয়োগ দিলেই কাজটা তারা অল্পসময়ে করে দিতে পারতো! প্রশ্ন জাগে, বেতন কাঠামো কি বৃটিশ বা পাকিস্তানী আমলারা প্রণয়ন করেছে? এখনও কি এদেশে বৃটিশ বা পাকিস্তানী আমল চলছে? মোটেই না।
এই কাঠামো অল্পশিক্ষিত কেউ যেমন প্রণয়ন করেনি, বৃটিশ বা পাকিস্তানী আমলারাও করেনি, করেছে এদশেরই কিছু ‘উচ্চশিক্ষিত স্বার্থপর’ মানুষ, কাজেকর্মে যারা বৃটিশ বা পাকিস্তানী শাসনরীতিই অনুসরণ করে; যারা বৃটিশ বা পাকিস্তানী আমলা না হলেও বৃটিশ বা পাকিস্তানী শাসকদের প্রেতাত্মার মতোই কাজটি করেছে। জমিদারী প্রথা আমরা দেখিনি, কিন্তু চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, এখনো কাজেকর্মে আমাদের অনেকেই আমাদের সাথে জমিদারদের মতোই আচরণ করছে। এরা সেইসব জমিদারদের আক্ষরিক অর্থে উত্তরসূরী না হলেও তাদের প্রেতাত্মা, কোনো সন্দেহ নেই।
বর্তমান বেতন কাঠামোকে ‘মনগড়া ও যাচ্ছেতাই’ বলা এবং এই কাঠামো প্রণেতাদেরকে ‘বৃটিশ-পাকিস্তানী শাসকদের প্রেতাত্মা’ বা ‘জমিদারদের প্রেতাত্মা’ বলার কারণ সম্পর্কে উপরে সামান্যই বলা হয়েছে। আমরা এবার এই কাঠামোর আরো কিছু ‘মনগড়া ও যাচ্ছেতাই’ বিষয় এবং কাঠামো-প্রণেতাদের স্বার্থপরতার আরো কিছু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখবো।
২০ তম গ্রেড থেকে ১২তম গ্রেড পর্যন্ত মোট ৮টা গ্রেড মিলিয়ে যেখানে বেতন বাড়ে মাত্র ৩০৫০ টাকা, সেখানে ৭ম গ্রেড থেকে মাত্র ১টা গ্রেড বেড়ে ৬ষ্ঠ গ্রেডে গেলেই বেতন বাড়ে ৬৫০০ টাকা, দ্বিগুণেরও বেশি! একটা গ্রেড পরিবর্তনে যেখানে সর্বোচ্চ বেতন বাড়ে ১২০০০ টাকা, সেখানে শেষের দশটা গ্রেড মিলিয়ে বেতন বাড়ে মাত্র ৭৭০০ টাকা!
আমরা উপরে বেতন কাঠামোয় গ্রেডে গ্রেডে বেতন বৃদ্ধির ধারা দেখেছি। বেতন বৃদ্ধির এই ধারা (২৫০<৩০০>২০০<৩০০<৪০০<৫০০<৮০০>৩০০<১২০০<৩৫০০<৬০০০>১০০০<৬০০০<৬৫০০<৭৫০০>৭০০০>৬৫০০<৯৫০০<১২০০০) কি বিজ্ঞানের কোনো সূত্র অনুসরণ করেছে, নাকি গণিতের কোনো সূত্র অনুসরণ করেছে, বুঝতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এটাকে লুডু খেলার মইয়ের সাথে তুলনা করারও সুযোগ নেই। কারণ সেখানে যে-কারও ভাগে বড় মইও পড়তে পারে, ছোট মইও পড়তে পারে। কিন্তু এখানে অন্যদের জন্য নির্দিষ্ট (ফিক্স) করে দেয়া হয়েছে শুধু বিভিন্ন আকারের ছোট ছোট মই, আর যারা কাঠামোটি প্রণয়ন করেছে, তাদের নিজেদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে সব বড় বড় মই। এখানে প্রতিপক্ষের জন্য বড় মইয়ে ওঠার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি আর যারা খেলাটা আয়োজন করেছে, তাদের ভাগে ছোট মই পড়ার কোনো সম্ভাবনাই রাখা হয়নি। এটাকে ‘বৃটিশ-পাকিস্তানী শাসকদের প্রেতাত্মা’দের কাজ মনে না করার সুযোগ কোথায়! এটাকে ‘মনগড়া ও যাচ্ছেতাই’ না বলেও কি কোনো উপায় আছে?
বেতন বৃদ্ধির এই ধারায় ২৫০ টাকা থেকে বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে ২০০ টাকায় নেমে গেছে, আবার বাড়তে বাড়তে ৮০০ টাকা পর্যন্ত গিয়ে পা পিছলে হঠাৎ নেমে গেছে ৩০০ টাকায়, আবার বাড়তে বাড়তে ৬০০০ টাকায় গিয়ে শেয়ার বাজারের মতো হঠাৎ নেমে গেছে ১০০০ টাকায়! এভাবে নাটকের পর নাটক হয়েছে মাত্র ২০টা গ্রেডের একটা কাঠামোতে। এটা কি শেয়ার বাজারের দরের উঠানামা? এটা সবার বিশ্বাস হবে, যারা এই কাঠামোটা করেছে, তাদের কাছে এই ‘উঠানামা’র পক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো যুক্তি নেই। এটা সম্পূর্ণ মনগড়া, যাচ্ছেতাই। স্বার্থপরতার সর্বোচ্চ প্রদর্শনী। বিমূর্ত কবিতা সম্পর্কে একটি রম্যরচনা পড়েছিলাম অনেক আগে একটি দৈনিক পত্রিকায়। সেখানে একটি গল্প উল্লেখ করা হয় এরকম, ইংল্যান্ডের একজন প্রসিদ্ধ কবির একটি কবিতার অনুষ্ঠানে এক পাঠক ঐ কবিকে তাঁর একটি কবিতার দু’টি চরণ উল্লেখ করে প্রশ্ন করলো, ‘স্যার, এই দু’টি চরণ দ্বারা আপনি কী বুঝিয়েছেন?’ কবি জবাবে বললেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, কবিতাটি যখন লিখেছিলাম, তখন এই চরণ দু’টির অর্থ শুধু আমি আর ঈশ্বর জানতাম, কিন্তু এখন দেখি শুধু ঈশ্বরই জানেন!’
আমার এক সহকর্মী বললো, ‘১২তম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেডে বেতন পায় কর্মচারী ও কামলারা, তাই তাদের গ্রেডে বাড়ে ২০০/৩০০ টাকা করে আর ১ম গ্রেড থেকে ১১তম গ্রেডে বেতন পায় কর্মকর্তা ও আমলারা, এই জন্য তাদের বেতন বাড়ে ৬০০০/৭০০০ টাকা করে।’
আমলা ছাড়া যারা এই বেতন কাঠামোর সুবিধার আওতার বাইরে, এমন ১ লক্ষ সচেতন মানুষের মতামত নেয়া হলে এমন ১ জনও খুঁজে পেতে কষ্ট হতে পারে, যে এরকম ধাপ নির্ধারণকে নিঃস্বার্থ, পক্ষপাতহীন ও যৌক্তিক বলে মতামত দেবে।
আমার মতো যারা ১৫তম গ্রেডে চাকরি শুরু করেছেন, তাদের (কিছু কিছু ডিপার্টমেন্টে ভিন্ন হতে পারে) চাকরির ১০ম বছরে নতুন গ্রেডে উন্নীত হবার সময় ইনক্রিমেন্ট পেয়ে পেয়ে মূল বেতনের সাথে যোগ হয়েছে ৪৯২০ টাকা। অথচ ১০ বছর পর উন্নীত গ্রেডে যাবার ফলে তার চেয়ে বেশি না বেড়ে যদি মাত্র ৮০০ টাকা বাড়ে, তাহলে বিষয়টা কি পুরোপুরি তামাশা হয়ে যায় না? ১০ বছরে ইনক্রিমেন্ট পেয়ে পেয়ে যা বেড়েছে, উন্নীত গ্রেডে তার চেয়ে বেশি বাড়লেই ১০ বছর অপেক্ষা করাটা সার্থক হতো। সকল শ্রেণির চাকরিজীবির ক্ষেত্রেই কথাটা প্রযোজ্য। এই দৃষ্টিকোণ থেকেও বর্তমান কাঠামোকে ‘যাচ্ছেতাই ও তামাশাপূর্ণ’ বলার সুযোগ থাকে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমান সরকার দেশকে উন্নত দেশের কাতারে শামিল করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আমার মনে হয়, দেশের উন্নত হবার পথে এক বড় বাধার নাম আমলাতন্ত্র। জাপানের একটা বিষয় লক্ষ্য করলে আমার এই মতামতের সত্যতা প্রমাণিত হবে। জাপানে শ্রমের মূল্য অনেক বেশি। সেখানে একজন মুচি বা নাপিতের আয়ও দেশের প্রথম সারির পেশাজীবিদের গড় আয়ের অনেকটা কাছাকাছি। দেশের সব নাগরিকের হাতে যেন পর্যাপ্ত টাকা থাকে, সে জন্য জাপান সরকার বিভিন্ন রকম পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। সেখানে একজন নাপিতের গড় আয় মাসে ২০০০ ডলার। [দেখুন, জাপান কাহিনি ২য় খন্ড, আশির আহমেদ, ঐতিহ্য, পৃষ্ঠা-৬০] জাপানের মতো কোরিয়াতেও মানুষের আয়বৈষম্য নিরসনে সরকার সবসময় সচেষ্ট থাকে। অন্যরা যখন আয়বৈষম্য নিরসনের চেষ্টায় লিপ্ত, আমরা তখন আয়বৈষম্য বৃদ্ধির অপচেষ্টায় লিপ্ত, যার উজ্জ্বল উদাহরণ জাতীয় বেতন কাঠামো।
অস্ট্রেলিয়ায় যান। দেখবেন, সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের বেতন যা, একজন সাধারণ শ্রমজীবি মানুষের বেতনও তার প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু বাংলাদেশে সব শ্রেণির মানুষের হাতে পর্যাপ্ত টাকা থাক, এটা অন্তত এদেশের আমলাশ্রেণির মানুষ চায় না। এরা মারাত্মক স্বার্থপর, সঙ্কীর্ণ মনের অধিকারী। যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ এই চরম বৈষম্যমূলক বেতন কাঠামো, যেখানে নিচের শ্রেণির এক গ্রেড পরিবর্তনে বেতন বাড়ে ৩০০/৮০০ টাকা করে আর উপরের শ্রেণির এক গ্রেড পরিবর্তনে বেতন বাড়ে ৬০০০/৭০০০ টাকা করে। কেন, সব গ্রেডে যদি আনুপাতিকহারে সমানভাবে বেতন বাড়ে, উপরের গ্রেডে চাকরিজীবিদের কি মস্ত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে বা নিচের গ্রেডের চাকরিজীবিদের বেতন কি উপরের গ্রেডে চাকরিজীবিদের চেয়ে বেড়ে যেতে পারে?
উপরের গ্রেডের চাকরিজীবিরা হয়তো বলতে পারেন, নিচের দিকের গ্রেডগুলোতে জনবল বেশি। তাই তাদেরকে বেশি বেতন দিতে গেলে দেশের অর্থনীতির উপর চাপ পড়তে পারে। যদি দেশের প্রতি তাদের এতোই মায়া থাকে, তাহলে নিজেদের গ্রেডগুলোর মধ্যকার ব্যবধান এত বেশি রেখেছেন কেন? এমনিতেই উপরের দিকের গ্রেডে চাকরি করছেন, এরপর বেতন বৃদ্ধিটা যদি নিচের দিকের গ্রেডগুলোর চেয়ে দু’তিন গুণ বেশি হতো, তবু কম হতো না। কিন্তু তাদের বেতন বাড়ে নিচের দিকের গ্রেডগুলোর চেয়ে ২০/২৫ গুণ বেশি করে। তাদেরকে এতো বেতন দিতে গেলে দেশের অর্থনীতির উপর কি চাপ পড়ে না? আসলে এসব হচ্ছে বাহানা। নিজেরা বেতন কম নিয়ে দেশপ্রেমের কথা বললে তা সত্যিকার দেশপ্রেম হতো।
বর্তমান বেতনকাঠামো অনুযায়ী মাস-শেষে সরকারের যে টাকা খরচ হয়, সবার বেতন আনুপাতিক হারে সমানভাবে (পদ্ধতি নিচে উল্লেখ করা হলো) বৃদ্ধি করলেও সরকারের খরচ বেশ একটা বাড়বে না। তাছাড়া দেশের সব নাগরিকের প্রতি সুবিচার করতে গেলে যদি দেশের কিছু টাকা বাড়তি খরচ হয়, তা তো আর উপরের গ্রেডের চাকরিজীবিদের পকেট থেকে যাবে না! এদেশে সরকার যতো রাজস্ব পায়, তার বেশির ভাগ পায় সাধারণ মানুষ থেকে। উপরের গ্রেডের অল্প সংখ্যক চাকরিজীবি মুঠোফোনে কথা বলে প্রতি মাসে সরকারকে যা রাজস্ব দেয়, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি রাজস্ব দেয় নিচের দিকের চাকরিজীবিরা।
দেশের তৃণমূলে সরকারি দায়িত্ব পালন করছে নিচের দিকের চাকরিজীবিরা। উপরের শ্রেণির চাকরিজীবিদের কেউ কেউ শুয়ে-বসেই বেতন নিচ্ছে, পাচ্ছে বাড়তি অনেক সুবিধাও। একজন ইউএনও বা জেলা প্রশাসককে কখনো কি দেখেছেন কোনো উপজেলা বা জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হবার পর এক মাসের মধ্যে পুরো উপজেলা বা জেলা ঘুরে দেখেছে, সেই উপজেলা বা জেলায় কয়টি রাস্তা, কয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুরবস্থায় আছে, কয়টি সংস্কারযোগ্য ক্ষেত্র আছে? কখনো কি দেখা যায়, একজন ইউএনও বা জেলা প্রশাসক কোনো এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হবার পর অল্প সময়ের মধ্যে সেই এলাকার প্রতিটা গ্রাম/ইউনিয়ন ভিত্তিক মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদের সাথে পরিচিত হতে, তাদের সমস্যার কথা একান্তে শুনার ব্যবস্থা করতে? দেখা যায় না। এরা মূলত মিটিংয়ে মিটিংয়েই সময় কাটায়। এদের দৃশ্যমান কাজ খুব অল্প। যেমন: পাবলিক পরীক্ষা পরিদর্শন, বাল্যবিয়ে ভেঙ্গে দেয়া, কারেন্ট জাল নিধন, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা, বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা পরিচালনা ইত্যাদি।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির নাম, কিংবা একজন সংসদ সদস্য বা উপজেলা চেয়ারম্যানের নাম যেভাবে সংশ্লিষ্ট এলাকার সবাই জানে, একজন ইউএনও বা জেলা প্রশাসকের নাম সংশ্লিষ্ট উপজেলা বা জেলার মানুষ সেভাবে জানে না। এরা কোনো উপজেলা বা জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হবার পর কয়েক বছর চাকরি করলেও সংশ্লিষ্ট উপজেলা বা জেলার অধিকাংশ মানুষ এদেরকে চেনা দূরের কথা, এদের নামটা পর্যন্ত জানে না। আক্ষরিক অর্থে এরা মানুষের খুব কম কাজেই লাগে। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণির চাকরিজীবিরা শিক্ষা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের সেবা করে, খুব কমই এরা শুয়ে-বসে থাকতে পারে। কিন্তু বেতনের ক্ষেত্রে সুবিধাগুলো নিয়ে নেয় প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবিরা। এটাই বৃটিশ বা পাকিস্তানী মানসিকতা, এটাই জমিদারসুলভ আচরণের প্রতিফলন।
উপরের গ্রেডে চাকরিজীবিদের স্বার্থপরতার কাছেই জিম্মি হয়ে আছে দেশের সামগ্রিক মানুষের জীবনমানের উন্নতি। একটা বিশেষ শ্রেণির হাতে দেশের টাকা চলে যাচ্ছে বেশি। সরকার বিষয়টা যতদিন বিবেচনায় না নেবে, ততদিন দেশ সত্যিকার উন্নতির পথ খুঁজে পাবে না।
বেতন কাঠামোর বৈষম্য নিরসনের উদ্যোগ যখনই নেয়া হয়, তখন অথবা পরবর্তী পে-স্কেল যখনই দেয়া হয়, তখন কিছু প্রস্তাব বিবেচনায় নেয়ার অনুরোধ থাকবে।
১. প্রতি গ্রেডে ব্যবধান যেন আনুপাতিকহারে সমান করে দেয়া হয়। এতে উপরের দিকের গ্রেডে যারা চাকরি করে, তাদের কোনো ক্ষতি হবার কথা নয়। কারণ তারা তো বড় স্কেলেই চাকরি শুরু করেছে।
‘আনুপাতিকহারে সমান’ করার প্রক্রিয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের মতামত চাইলে অনেক রকম মতামত আসতে পারে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, পক্ষপাতহীন ও নিঃস্বার্থ মতামত হতে পারে প্রতি গ্রেডে শতকরা হারে বেতন বৃদ্ধি করার নিয়ম রাখা হলে। যেমন: প্রতি গ্রেডে ২০ শতাংশ বা ২৫ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি করা হলে গ্রেডে গ্রেডে ‘ব্যবধান’কে কোনোভাবে ‘বৈষম্য’ বলার সুযোগ থাকবে না; কোনো শ্রেণির চাকরিজীবি এতে অসন্তুষ্ট হবে না; সবাই যার যার স্কেল এবং উন্নীত গ্রেড নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে। এটা ঠিক বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের মতো।
সর্বশেষ গ্রেড (২০ তম বা ১৬ তম) নির্ধারণ করে সেখান থেকে শতকরা হারে উপরের সব গ্রেডের বেতন নির্ধারণ করা হোক। সর্বশেষ গ্রেডে ৯০০০ বা ১০,০০০ টাকা হলে সহজে উপরের গ্রেডগুলো ১৫ শতাংশ বা ২০ শতাংশ বা ২৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করে নির্ধারণ করা যাবে।
২. ২০ গ্রেড থেকে কমিয়ে ১৬ গ্রেড করা হলে অনেক দিক থেকে ভালো হতে পারে।
৩. প্রতি ৮ বছর পর পর যেন সকল চাকরিজীবির বেতন গ্রেড পরিবর্তন করা হয়, চাকরিজীবনে ন্যূনতম ৩ বার যেন উন্নীত গ্রেডে যাবার সুযোগ থাকে। এতে যেসব পদে প্রমোশনের সুযোগ নেই, সেসব পদে চাকরিজীবিদের মনে হতাশা কমবে। যেমন: তৃতীয় শ্রেণির চাকরিজীবি যারা, তারা ১২ তম গ্রেডে চাকরি শুরু করবে, এরপর প্রতি ৮ বছর পর পর নতুন গ্রেডে যেতে যেতে শেষে ৯ম গ্রেড পর্যন্ত পৌঁছবে, এভাবে ১ম শ্রেণির চাকরিজীবিরা ৪র্থ গ্রেডে চাকরি শুরু করবে, এরপর প্রতি ৮ বছর পর পর নতুন গ্রেডে যেতে যেতে ১ম গ্রেড পর্যন্ত পৌঁছবে। এতে কোনো শ্রেণির চাকরিজীবি নিজের শ্রেণি অতিক্রম করে উপরের শ্রেণি স্পর্শ করার সম্ভাবনাও থাকবে না, যা বর্তমান কাঠামোয় আছে এবং অযৌক্তিক।
৪. সরকারি চাকরিতে যেহেতু মোট ৪টি শ্রেণি, গ্রেড কমিয়ে ১৬টি করে নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৬টি গ্রেডকে ৪ শ্রেণি দিয়ে ভাগ করে প্রতি শ্রেণির প্রান্তিক গ্রেডকে সেই শ্রেণিতে নিয়োগের প্রারম্ভিক গ্রেড হিসেবে নির্ধারণ করা হোক। যেমন: প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবিদের নিয়োগ হবে ৪র্থ গ্রেডে, দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিজীবিদের নিয়োগ হবে ৮ম গ্রেডে। তাহলে সব শ্রেণির চাকরিজীবিই নিজের পদ, সম্মান ও বেতন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে; বর্তমান কাঠামোর অনেক জটিলতা এবং অসঙ্গতিও দূর হবে।
৫. বেতন কাঠামোয় বর্তমান ২০ গ্রেডের ভেতরে ভেতরে যেসব খুচরা খুচরা ধাপ রাখা হয়েছে, সেগুলো রাখার কোনো যৌক্তিকতা আছে কিনা, সে ব্যাপারে জনমত যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এগুলোর যৌক্তিকতা বা প্রয়োজনীয়তা নেই বলেই অধিকাংশ মানুষ মতামত দিতে পারে। সর্বশেষ গ্রেডের মূল বেতন ৯০০০ বা ১০,০০০ টাকা নির্ধারণ করে ১৫/২০/২৫ শতাংশ হারে প্রতি গ্রেডে বৃদ্ধি করা হলে খুচরা খুচরা ধাপগুলোর প্রয়োজনীয়তা একেবারে দূর হয়ে যাবে।
৬. বর্তমান কাঠামোয় গ্রেড উন্নীতকরণের পাশাপাশি বাড়িভাড়া কমানোর নিয়ম রাখায় উন্নীত গ্রেডে যাওয়াটা অনেকের জন্য বঞ্চনা ও হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাড়িভাড়া তো দিন দিন বাড়েই, কমে না। তাহলে কেন বাড়িভাড়া কমানো হবে? বাড়িভাড়া কমানোর নিয়ম উন্নীত গ্রেডে যাবার সাথে সাংঘর্ষিক। তাই এই নিয়ম বাতিল করা উচিত।
তবে এখনকার মতো ২০টি গ্রেড রাখলেও বড় ধরনের সমস্যা নেই। তখন প্রতিটি শ্রেণির জন্য গ্রেড হবে ৫টি। প্রতি গ্রেডের চাকরিজীবিকে নিয়োগ দেয়া হবে সেই শ্রেণির প্রাথমিক গ্রেডে। যেমন প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবিদের নিয়োগ হবে ৫ম গ্রেডে, তৃতীয় শ্রেণির চাকরিজীবিদের নিয়োগ হবে ১৫তম গ্রেডে। সেক্ষত্রে প্রত্যেক শ্রেণির চাকরিজীবিদেরকে চাকরিজীবনে চারবার উন্নীত গ্রেডে যাবার সুযোগ রাখতে হবে।
এককথায় প্রতি গ্রেডের ব্যবধান আনুপাতিক হারে সমান রাখতে হবে এবং সব শ্রেণির চাকরিজীবির জন্য সমান হারে প্রমোশন/উন্নীত গ্রেডে যাবার সুযোগ রাখতে হবে। তাহলেই বৈষম্য দূর হতে পারে।
নূর আহমদ : সরকারি চাকরিজীবি