ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার মোট কারণ মাত্র ৩টি!

মহামারীর চেয়েও ভয়ঙ্কর এক রোগ ডায়াবেটিস
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষ্যে প্রথম আলোয় ১৪ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে ‘ডায়াবেটিস: প্রতিটি পরিবারের যুদ্ধ’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রতিদিন সকালটা ফিলিস্তিনের শিশু আহমেদের শুরু হয় একটু পরই গুলির শব্দ হবে, এ শঙ্কা নিয়ে। আর অন্যদিকে ভারতের শিশু মালিনীর সকাল শুরু হয় অন্য রকম ভয় নিয়ে। তাকে ইনসুলিন নিতে হবে, চামড়া ভেদ করে রক্তাক্ত করে ইনসুলিন দেওয়া হবে; এ আতঙ্কে দিন কাটে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এই শিশুর। যুদ্ধ, সহিংসতা আর হানাহানিতে মানুষের মৃত্যু যেমন দিন দিন পৃথিবীকে করে তুলছে ভয়ংকর; তেমনি পৃথিবীতে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী ১০টি রোগ এ মুহূর্তে হয়ে উঠেছে আশঙ্কাজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে সবচেয়ে উদ্বেগজনক ১০টি স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে অন্যতম ডায়াবেটিস। পৃথিবীতে এ মুহূর্তে ৪৫ কোটির অধিক লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রায় ৮০ লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।’
‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে যেসব জানা জরুরি’ শিরোনামে ১৩ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ১৯৮০ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ১১ কোটি। ২০১৪ সালে সেটা বেড়ে হয় ৪২ কোটিরও বেশি। ১৯৮০ সালে ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের ডায়াবেটিস হওয়ার হার ছিল ৫ শতাংশেরও কম কিন্তু ২০১৪ সালের তাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ।’
আরেকটা প্রতিবেদনের একটা অংশ উল্লেখ করা খুব সংগত মনে হচ্ছে। ‘ঘরে ঘরে ডায়াবেটিস’ শিরোনামে যা দৈনিক সমকালে ১৪ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শুধু বয়স্ক বা মধ্যবয়সী নয়, শিশুরাও এখন এই নীরব ঘাতকের শিকার হচ্ছে। শহর থেকে গ্রাম- সর্বত্র প্রায় সমান হারে ছড়িয়ে পড়ছে ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস এখন প্রায় প্রতিটি ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে।’
সেখানে আরও বলা হয়, ‘দ্রুত নগরায়নের ফলে পরিবর্তিত জীবনযাপনের কারণে বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। আইডিএফের (ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশন) ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪৩ কোটি। ১৯৮৫ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র তিন কোটি। গত আড়াই দশকে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৩ গুণ বেড়েছে। সংস্থাটি দুই বছর পরপর আক্রান্ত মানুষের তথ্য প্রকাশ করে। তাদের ধারণা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৪ কোটিতে উন্নীত হবে।’ এ তথ্যগুলো আমাদেরকে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সতর্ক হবার বার্তা দেয় নিঃসন্দেহে।

ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে বিভ্রান্তি

প্রথমে আমাদের জানা দরকার ডায়াবেটিস কেন হয়?
খুবই হতাশ হই, যখন দেখি ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী মানুষকে সঠিক ধারণা দেয়ার পরিবর্তে ভুল ধারণা দেয়া হয় খুব বেশি। ডায়াবেটিস নিয়ে বিশ্বের নামকরা সব প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত যত গবেষণা করেছে, কোনো গবেষণা ডায়াবেটিসের নির্ভেজাল কারণ খুঁজে বের করতে পারেনি।  দু’একটা উদাহরণ দেখা যাক:
১৭ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখের প্রথম আলোয় ‘গ্রামে ডায়াবেটিস সচেতনতা কম’ শিরোনামে গবেষণা-তথ্যভিত্তিক (গবেষণা তথ্যটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট-এর) একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ‘গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রায় তিনজনের একজন ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত অথবা রোগের ঝুঁকিতে আছেন। ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অপ্রতুল কায়িক পরিশ্রম ডায়াবেটিস হওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।’
এই অধ্যায়ের শুরুতে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘ডায়াবেটিস: প্রতিটি পরিবারের যুদ্ধ’ শিরোনামের যে প্রতিবেদনের কথা বলা হয়েছে, সেখানে আরও বলা হয়, ‘ডায়াবেটিস রোগের সবচেয়ে বড় কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। খাদ্যাভ্যাসে অসচেতনতা, কম শারীরিক কর্মকান্ড, পরিবেশগত বিভিন্ন উপাদান এবং বংশগত বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে জিনগত অস্বাভাবিকতা। বিশ্বের মোট ডায়াবেটিসের শতকরা ৯০ ভাগ টাইপ-২ জাতীয় ডায়াবেটিসে এবং বিশ্বে বর্তমানে ৩০ কোটির অধিক লোক এই প্রকার ডায়াবেটিসে ভুগছে।... তাহলে প্রশ্ন হলো ডায়াবেটিসের কি কোনো সমাধান নেই? অবশ্যই আছে। সুস্থ জীবনযাপন। অতিরিক্ত চিনি কিংবা চর্বিজাতীয় খাবার পরিহার করা, হাঁটা কিংবা ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সচল রাখা, অতিরিক্ত ওজন কমানোর চেষ্টা, ফাস্ট ফুড বা জাঙ্কফুড ও অতিরিক্ত মদপান পরিহার করা।’


বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত যে প্রতিবেদনের কথা এ অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে আরও বলা হয়, ‘ডায়াবেটিস যদিও জেনেটিক এবং আপনার জীবন যাপনের স্টাইলের ওপর নির্ভরশীল তারপরেও আপনি চেষ্টা করলে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারেন।
সেজন্যে আপনাকে খাবার গ্রহণের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে এবং আপনাকে হতে হবে অত্যন্ত সক্রিয় একজন মানুষ।
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। মসৃণ শাদা আটার রুটির পরিবর্তে খেতে হবে ভুষিওয়ালা আটার রুটি। এটাই প্রথম ধাপ।
এড়িয়ে চলতে হবে হোয়াইট পাস্তা, প্যাস্ট্রি, ফিজি ড্রিংকস, চিনি জাতীয় পানীয়, মিষ্টি ইত্যাদি।
আর স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে রয়েছে শাক সব্জি, ফল, বিন্স এবং মোটা দানার খাদ্য শস্য।
স্বাস্থ্যকর তেল, বাদাম খাওয়াও ভালো। ওমেগা থ্রি তেল আছে যেসব মাছে সেগুলো বেশি খেতে হবে। যেমন সারডিন, স্যামন এবং ম্যাকেরেল।
এক বেলা পেট ভরে না খেয়ে পরিমানে অল্প অল্প করে বিরতি দিয়ে খাওয়া দরকার।
শরীর চর্চ্চা বা ব্যায়াম করার মাধ্যমে রক্তে চিনির মাত্রা কমিয়ে রাখা সম্ভব।
চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতি সপ্তাহে আড়াই ঘণ্টার মতো ব্যায়াম করা দরকার। তার মধ্যে দ্রুত হাঁটা এবং সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠাও রয়েছে।
শারীরিকভাবে থাকতে হবে সক্রিয়। ওজন কম রাখলেও চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যদি ওজন কমাতে হয় তাহলে সেটা ধীরে ধীরে করতে হবে। সপ্তাহে আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত।
ধূমপান পরিহার করাও জরুরী। নজর রাখতে হবে কোলস্টেরলের মাত্রার ওপর। এর মাত্রা বেশি হলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।’ [https://www.bbc.com/bengali/news-46194839]


ডায়াবেটিসের কারণ এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে আমি আরও অনেকগুলো প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিতে পারি, যেগুলোতে ডায়াবেটিসের আরও ভিন্ন ভিন্ন কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করতে চাই না। শুধু এ তিনটি প্রতিবেদনেই ডায়াবেটিসের অনেকগুলো কারণ বলা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি এতোগুলো কারণেই ডায়াবেটিস হয় এবং মানুষকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার জন্য এতোগুলো উপায় অবলম্বন করতে হয়, তাহলে কয়জনের ধৈর্যে কুলাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার? শুধু এ কারণেই, আমার খুব শক্তভাবে মনে হয়, বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগের প্রকোপ কমছে না, বরং হু হু করে বাড়ছেই। মহামারীর চেয়েও ভয়াবহ মাত্রায় ডায়াবেটিস সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি এখানে ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে শুধু একটি ধারণা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করবো এবং ডায়াবেটিসের মূল কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করবো। ডায়াবেটিসের কারণ বলে প্রচারিত সব কারণগুলোর স্বরূপ উন্মোচনের জন্য এই লেখার বিভিন্ন জায়গায় আরো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

এখানে প্রথম আলোয় প্রকাশিত "গ্রামে ডায়াবেটিস সচেতনতা কম" শিরোনামের প্রতিবেদনে ডায়াবেটিসের তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, যার প্রথমটি হচ্ছে ধূমপান। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, "ধূমপান পরিহার করাও জরুরী।" আমি ডায়াবেটিস সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় আরো অনেক লেখায় পড়েছি, বলা হচ্ছে, ধূমপানও নাকি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার একটি অন্যতম কারণ।

আমার বড় দুভাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বেশ কয়েক বছর ধরে। আমার মেঝো ভাইয়ের স্ত্রীও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আমাদের বিদ্যালয়ের ঝুনু রানী পাল নামক একজন মহিলা শিক্ষক অনেক বছর ধরে ডায়াবেটিসের সাথে যুদ্ধ করছেন। আমার শাশুড়িরও আছে ডায়াবেটিস। মাদ্রাসা শিক্ষিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত আমার পরিচিত অনেক লোক আছেন, যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আমার মেঝো ভাবীর বাবা-মাও অনেক বছর ধরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এভাবে আমার প্রতিবেশী এবং আত্মীয়সহ কাছের এবং দূরের পরিচিত অনেক লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যাদের সাথে ধূমপানের কোনো সম্পর্কই নেই। ধূমপান করা ছাড়াই তাদের তাহলে ডায়াবেটিস হলো কী করে?! বলতে পারেন, যাদের কথা এখানে বলা হয়েছে, তারা প্রত্যক্ষ ধূমপানের সাথে জড়িত না হলেও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। কিন্তু না, এদের কেউ পরোক্ষ ধূমপানের শিকারও নন। বরং একটা তথ্য জেনে সবাই অবাক হতে পারেন, আমার যে সহকর্মীর ডায়াবেটিস, তাঁর স্বামী নিয়মিত ধূমপান করেন, কিন্তু এখনো ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত। যিনি ধূমপান করেন, তিনি যদি ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত থাকেন, তাহলে তাঁর ধূমপানের পরোক্ষ শিকার কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবেন কিভাবে?!

"বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে ডায়াবেটিস কেন বাড়ছে?" শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় বিবিসি বাংলায় ১৪ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে। সেখানে বলা হয়, "বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি বলছে, বর্তমানে ৩৫ লাখের বেশি নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সংস্থাটি বলছে, এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশের নারীরাই সন্তান জন্মদানের জন্য সক্ষম অবস্থায় (অর্থাৎ কম বয়সে) এ রোগে আক্রান্ত হন" প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, "বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসক মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা দেখেছেন প্রতি দশ জন নারীর মধ্যে একজনের ডায়াবেটিস আছে। আর এজন্য এখনকার জীবনযাত্রাকেই সবচেয়ে বড় কারণ বলে তিনি মনে করেন।
"মূল কারণ আমাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন। কায়িক পরিশ্রম নাই, বসে থাকা হয় বেশি। আর নারীদের আক্রান্ত বেশি হবার কারণ, তারা সংসারের অনেক কাজ করেন, সংসার সামলানো, সন্তান প্রতিপালনসহ সব করার পরে নিজের দিকে নজর দেন না তারা। ডায়াবেটিস হলেও সেটার চিকিৎসায় নজর দেন না অনেকেই।"
এখানে বলা হয়েছে, বর্তমানে ৩৫ লাখের বেশি নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে যারা বসবাস করেন এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে যারা একটু ভালোভাবে জানেন, তারা জানেন, বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা নেই বললেই চলে। উপজাতীয়দের মধ্যে কোনো কোনো মহিলা ধূমপান করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ভার্সিটি পড়–য়া কিছু কিছু তরুণীর মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এখানে যে ৩৫ লাখ নারীর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার কথা বলা হয়েছে, আমার মনে হয়, এদের মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যা খুঁজতে গেলে সর্বোচ্চ এক হাজার জনও পাওয়া যাবে না। তাহলে এই লক্ষ লক্ষ নারী ধূমপান ছাড়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেন কী করে?! নাকি সবার স্বামীই ধূমপায়ী বলেই ধূমপানের পরোক্ষ শিকার হয়ে এরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন? এটাও সম্ভব নয়। কারণ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অনেক মহিলার স্বামীও ধূমপান করেন না। বাংলাদেশে যারা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করেছেন বলে ধর্মীয় চেতনা ধারণ করেন, তাঁরা ধূমপানকে রীতিমতো ঘৃণাই করেন, ধূমপান দূরের কথা। এ ধরনের ধর্মীয় ভাবধারার অসংখ্য মানুষও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাহলে ধূমপানের সাথে সম্পর্ক না থাকার পরও এরা কেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন?

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সাথে ধূমপানের সম্পর্কের বিষয়টা নিয়ে যে কেউ একটু নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই দেখবেন, এর কোনো ভিত্তি নেই। ধূমপানের সাথে সত্যিই যদি ডায়াবেটিসের সম্পর্ক থাকতো, তাহলে বিশ্বব্যাপী শুধু ধূমপায়ীরাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতেন, অধূমপায়ী কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত না হতেন। এখন তো দেখা যায় অনেক ১০-১৫ বছর বয়সী শিশু, যাদের সাথে এখনো ধূমপানের কোনো সম্পর্কই নেই, তারাও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। বিশ্বের যে কোনো দেশে নতুন করে বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করলে এটাই শতভাগ সত্য প্রমাণিত হবে, ডায়াবেটিসের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপানের কোনো সম্পর্ক নেই। বিষয়টা শতভাগ অবাস্তব।

ডায়াবেটিসের প্রকৃত কারণ

গত চার বছরের বেশি সময় ধরে ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। কারণ রোগগুলো সারাবিশ্বেই কোটি কোটি মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন করছে। শুধু ডায়াবেটিসের কথাই বলছি। আমার আত্মীয় এবং পরিচিত অনেকেই রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে কঠিন জীবন যাপন করছে, অনেকে ইতোমধ্যে মারাও গেছে। আমাদের বাড়ির আমার এক জেঠাতো ভাই, নাম আবুল বাশার, ২০১৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা বৃদ্ধি পেয়ে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পরই আরেক জেঠাতো ভাইয়ের স্ত্রী আকস্মিক ডায়াবেটিস বেড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আরো অনেক আত্মীয় ডায়াবেটিসে ভুগে কঠিন জীবন পার করছেন, যে কোনো সময় মারা যেতে পারেন।
ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অনেক ডাক্তারের লেখা ও অনেক গবেষণা প্রতিবেদনে এবং মানুষের মুখে অনেক রকম মন্তব্য পাওয়া যায়। মন্তব্যগুলোর সাথে বাস্তবতার মিল খুঁজতে গিয়ে আমি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হতাশ হয়েছি। দেখেছি, যে কারণগুলোকে ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী করা হয়, বাস্তবতার সাথে তার অনেকগুলোরই মিল নেই।
ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে বিশ্বের অনেক বড় বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ফলাফল মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। দুঃখজনক হচ্ছে, কোনো গবেষণা-ফলাফলেই ডায়াবেটিসের মূল কারণ কয়টি, তা চিহ্নিত করতে দেখা যায় না এবং ডায়াবেটিসের মোট কারণ কয়টি, তা-ও সুনির্দিষ্টভাবে খুঁজে বের করতে পারে না কোনো গবেষণা। একেক গবেষণায় একক কারণকে ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়। কিছু কারণ অনেক সময় মিলে যায়, কিছু কারণ আবার মিলে না। সবগুলো কারণ একত্র করলে মানুষ ডায়াবেটিস থেকে বাঁচার আশা বাদ দিয়ে ভাববে, এতোগুলো কারণ পরিহারের চেয়ে ডায়াবেটিসে ধুঁকে ধুঁকে মরাই বরং ভালো!
মাফ করবেন, আমি কোনো ডাক্তার নই, কোনো গবেষকও নই, তবু এমন মন্তব্য করে ফেললাম। কারণ এমন মন্তব্য করার মতো শক্তি আমার আছে। আমি যে মন্তব্য করেছি, তা খুব ভালোভাবে প্রমাণ করে দেখাতে পারবো বলেই মন্তব্য করার সাহস পেয়েছি।
আমি দেখেছি, ডায়াবেটিসের মূল কারণ মাত্র ১টি এবং ডায়াবেটিস সর্বমোট তিন কারণে হয়। ডায়াবেটিস মূলতঃ যে কারণে হয়, মানুষ তা থেকে দূরে থাকতে পারলে মানুষকে ডায়াবেটিস আক্রমণ করতে পারবে খুব কম। আর ডায়াবেটিস মোট যে তিনটি কারণে হয়, সবগুলো এড়িয়ে চললে নিশ্চিতভাবে মানুষ ডায়াবেটিস থেকে রক্ষা করতে পারবে নিজের মূল্যবান জীবনকে।

আমি দীর্ঘদিন ধরে শুধু একটা বিষয় দেখেছি চরম সত্য হিসেবে, ডায়াবেটিস শুধু ঐসব মানুষের হয়, যারা শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকে বা করলেও পরিমাণে কম করে। পাশাপাশি যারা বেশি বেশি খায় বা মনের চাহিদামতো খায় বা ভোজনপ্রিয় এবং যারা মোটা শরীরের, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বেশি বেশি। এককথায় ডায়াবেটিসের মূল কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা এবং অন্য দুকারণ হচ্ছে বেশি খাওয়া বা মনের চাহিদামতো খাওয়া এবং মুটিয়ে যাওয়া। এই তিনটি কারণ যার মধ্যে নেই, সে কখনো কোনোভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। তবে যারা মোটা হওয়া সত্ত্বেও এবং বেশি বেশি খাওয়া সত্ত্বেও শারীরিক পরিশ্রম করে বেশি বেশি, তারাও খুব কমই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। আবার চিকন লোকও যখন শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকে, অনেক সময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই এতে কোনো সন্দেহ নেই, ডায়াবেটিসের মূল কারণ শারীরিক পরিশ্রম না করা বা কম করা। এককথায় পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম যারা করে, তারা কখনো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। আমার এ বক্তব্যে পুরো আস্থা রাখার জন্য চার শ্রেণির লোকের দিকে লক্ষ্য করার অনুরোধ করছি।
১. বাংলাদেশের ঐসব "পায়েচালিত" রিকশাচালক, যারা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে (অনেকে ৩০-৪০ বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে চালায়) রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এমন এক হাজার বা দশ হাজার রিকশাচালকের খোঁজ নিয়ে দেখুন, দেখবেন তারা কেউই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নন। এমনও দেখা যেতে পারে, তাদের অনেকের পিতামাতা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন বা কোনো সন্তান ইতোমধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এমনও দেখা যাবে, তাদের অধিকাংশই ধূমপান করছেন, নয়তো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার জন্য প্রচারিত অন্য কোনো কারণ অনেকের মধ্যে বিরাজমান, তবু তারা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে না।
২. বিশ্বের সব দেশেই শ্রমজীবি মানুষ আছে। যারা মাটি কাটার কাজ করে বা ফসলের জমি কিংবা কারখানায় হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কাজ করে, এককথায় সেসব শ্রমজীবি মানুষ, যারা শারীরিক শ্রমনির্ভর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে, এমন শ্রম, যা এদেরকে মোটা হতে দেয় না। পনেরো-বিশ বছরের বেশি সময় ধরে যেসব শ্রমজীবি মানুষ এভাবে পরিশ্রম করছেন দিনের একটা বড় অংশ, তারা কেউ দেখবেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নন।
৩. যেসব অ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদ পেশাগতভাবে শারীরিক শ্রমনির্ভর বিভিন্ন খেলা (যেমন: ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, সাঁতার, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি) খেলে যাচ্ছেন ১০ বছরের বেশি সময় ধরে, তাদের খোঁজ নিয়ে দেখুন, দেখবেন ডায়াবেটিসে তারা কেউ আক্রান্ত নন। এরা অনেকে হয়তো ধূমপানও করেন, অনেকে হয়তো ফাস্টফুডেও আসক্ত, অনেকের বাবা-মা কারো হয়তো ডায়াবেটিস ছিল, তবু এরা ডায়াবেটিসের ছোবল থেকে মুক্ত।
৪. বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীতে যারা চাকরি করেন এবং বাধ্যগতভাবে রুটিনমাফিক নিয়মিত পর্যাপ্ত ব্যায়াম করেন, অতিরিক্ত ব্যায়ামের কারণে মোটা হতেও পারছেন না, তাদের কাউকেও দেখবেন না ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে।
এ চার শ্রেণির মানুষের ডায়াবেটিস না হওয়াটা প্রমাণ করে, ডায়াবেটিসের মূল কারণ শারীরিক শ্রম থেকে দূরে থাকা, অন্য কিছু নয়।
মানুষ যখন শারীরিক পরিশ্রম কম করে, মনের চাহিদামতো খায়, একসময় এসব কারণে মুটিয়ে যায়। আর মুটিয়ে গেলে শরীরে চর্বি বা কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। কোলেস্টেরলের মধ্যেই জন্ম নেয় ডায়াবেটিস। অনেক মানুষ মোটা না হলেও নিয়মিত শারীরিক শারীরিক পরিশ্রম না করার কারণে শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
তিনটি কারণে মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। প্রথম কারণ পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করা, দ্বিতীয় কারণ বেশি খাওয়া, তৃতীয় কারণ মুটিয়ে যাওয়া। যে তিনটি কারণে মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়, সেই তিনটি কারণেই মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ যে কোনো কারণে কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। তাই যেসব মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে না পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের কারণে, সেসব মানুষ ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকে।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শতভাগ লোকের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে যে, সে পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম করে না। অনেকের মধ্যে এটা পাওয়া যাবে যে, তারা মোটা বা বেশি বেশি খায়। কিন্তু অন্য কোনো কারণ, যেগুলোকে ডায়াবেটিসের কারণ বলে প্রচার করা হয়, শতভাগ লোকের মধ্যে পাওয়া যাবে না। আমি ধূমপান এবং ডায়াবেটিসের সম্পর্ক নিয়ে আগেই বলেছি, ধূমপানকে তখনই ডায়াবেটিসের কারণ বলে বিশ্বাস করা যেতো, যখন দেখা যেতো ধূপায়ীরাই (সবাই না হলেও অনেকেই) শুধু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় এবং অধূমপায়ী কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। কথাটি প্রচারিত অন্য কারণগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন বলা হয়, ডায়াবেটিস নাকি বংশগতভাবেও হয়। ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ তখনই বলা যাবে,  যখন দেখা যাবে: ১. কারো পূর্বপুরুষ শুধু এক সিঁড়ি নয়, একাধিক সিঁড়ি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল, ২. পিতা/মাতা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, শুধু এমন লোকেরাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বেশি বেশি এবং ৩. পূর্বপুরুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নয়, এমন মানুষ খুব কমই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলা সম্পর্কে এ লেখায় আরো অনেক আলোচনা আছে। এখানে আরো দুএকটা কথা না বললেই নয়। এ অধ্যায়ের শুরুতে ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা সম্পর্কে অনেক পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে। একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, "ইডিএফের ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪৩ কোটি। ১৯৮৫ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র তিন কোটি। গত আড়াই দশকে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৩ গুণ বেড়েছে। সংস্থাটি দুই বছর পরপর আক্রান্ত মানুষের তথ্য প্রকাশ করে। তাদের ধারণা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৪ কোটিতে উন্নীত হবে।"

দৈনিক যুগান্তরে ২৮ ফেব্রুয়াারি ২০১৮ তারিখে "ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস" উপলক্ষ্যে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "এক জরীপ মতে বিশ্বে প্রতি সাত সেকেন্ডে একজন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে এই রোগ এখন মহামারী রূপ নিচ্ছে। দেশে বর্তমানে ৮৪ লাখেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
ডায়াবেটিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৪২ দশমিক ৫ কোটি। অথচ ১৯৮৫ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ কোটি। এখনই এই রোগ প্রতিরোধ করা না গেলে ২০৩৫ সালের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৫৯ কোটিতে পৌঁছানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে।"
এই রকম পরিসংখ্যানগুলো কী নির্দেশ করে, তা আমরা সহজে বুঝতে পারি না বলে ডায়াবেটিসকে বংশগত বা জিনগত রোগ বলে নিজেদের সর্বনাশ করছি। এই রকম পরিসংখ্যানগুলো বলে- যত পেছনের সময়ে যাওয়া যায়, দেখা যায় তখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সমাজে তত কম ছিল। এভাবে যেতে যেতে এমন একটা সময় দেখা যাবে, তখন তেমন কারো ডায়াবেটিস ছিল না। যদি এক সময় পৃথিবীতে তেমন কারো ডায়াবেটিস না থাকে, তাহলে কোন্ সব পূর্বপুরুষ থেকে রোগটি আমাদেরকে সংক্রমিত করেছে? পূর্বপুরুষ কারো তো একসময় ডায়াবেটিস ছিলই না পরিসংখ্যান মতে!
ডায়াবেটিসকে জিনগত রোগ বলে আমরা নিজেদেরকে ধোঁকা দিচ্ছি। যখন দেখছি আমাদের বাবা-মা কারো রোগটি ছিল, তখন ভাবছি রোগটি তো আমার হওয়া অবশ্যম্ভাবী, তাহলে কী আর করার আছে! এটা ভেবে রোগটির নিকট আমরা অসহায় আত্মমসমর্পণ করছি। রোগটি সময় মতো আমাদের আক্রমণ করে বসছে। যারা ডায়াবেটিসকে জিনগত রোগ বলছে, তারা মানবজাতির সর্বনাশ করছে।
আমরা যদি দেখতাম, যত পেছনের সময়ে যাওয়া যায়, মানুষের জীবন তত কষ্টসাধ্য ছিল; মানুষ হেঁটে হেঁটেই তখন চলে যেতো অনেক দূরের গন্তব্যে, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অধিকাংশ কাজ করতে হতো শারীরিক শ্রমের বিনিময়ে; আর মানব সমাজে তখন থেকেই ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, যখন থেকে মানুষের শারীরিক পরিশ্রমের কাজ কমে যেতে শুরু করেছে, যখন থেকে মানুষ মেশিন-নির্ভর হয়ে পড়তে শুরু করেছে; যখন থেকে আরামপ্রিয়তা মানুষের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে; যখন থেকে মানুষ দশ মাইল দূরের কথা, এক মাইল দূরে যাবার জন্যেও গাড়ি ব্যবহার করছে বা করতে পারছে; আমরা বুঝতাম, ডায়াবেটিস আগেকার কোনো ডায়াবেটিস রোগী থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত রোগ নয়, বরং ডায়াবেটিস আরামপ্রিয় মানুষের রোগ; আরামপ্রিয় মানুষের সংখ্যা সমাজে যত বাড়ছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও আনুপাতিকহারে তত বাড়ছে; আমরা খুব সহজে বুঝতাম, ডায়াবেটিস শুধু শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা মানুষদেরকেই আক্রমণ করে, পাশাপাশি যারা পরিমিত খায় না এবং মোটা, তাদেরকে।
টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসকে যারা বংশগত মনে করে, তারা ভাবে না, একসময় সমাজে তেমন কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতো না। পরে আরামপ্রিয় হয়ে যাবার পর থেকেই মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত হতে শুরু করছে। এখন থেকে যদি বিশে^র সকল ডায়াবেটিসমুক্ত মানুষ শারীরিক পরিশ্রমে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় ব্যয় করার মাধ্যমে একযোগে রোগটি প্রতিহত করা শুরু করে, এদের সন্তানরা বা সামনের প্রজন্মের কেউ আর টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত হবে না। তাছাড়া পরিসংখ্যান মতে, টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা সমাজের মোট ডায়াবেটিস রোগীর দশ শতাংশ। এ অধ্যায়ের শুরুতেও প্রথম আলোয় প্রকাশিত "ডায়াবেটিস: প্রতিটি পরিবারের যুদ্ধ" শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বের মোট ডায়াবেটিস রোগীর শতকরা ৯০ ভাগ টাইপ-২ জাতীয় ডায়াবেটিসে ভুগছে।
যদি শুধু এই দশ শতাংশ টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীকে বংশগত ডায়াবেটিস রোগী ধরে নেয়া হয়, তবু বাকি নব্বই শতাংশ টাইপ টু ডায়াবেটিস রোগীর বিবেচনায় টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা একেবারে নগণ্য। তাই রোগটিকে জিনগত না বলাই ভালো।রোগটিকে বংশগতভাবেও হয়, এমন রোগের কাতারে ফেললে যাদের বাবা-মা কারো ডায়াবেটিস, তারা আতঙ্কে জীবন কাটাবে এবং যাদের বাবা-মা কারো ডায়াবেটিস হয়নি, তারা নিশ্চিন্তে জীবন কাটাবে। উভয় শ্রেণিই একসময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়বে কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ফলে।

ডায়াবেটিসের মূল কারণ সম্পর্কে কিছু প্রতিবেদনের বক্তব্য

ডায়াবেটিসের মূল কারণ যে শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা, কথাটির সমর্থনে কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করছি।
(১) ৭ এপ্রিল ২০১৬ তারিখের বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত "বিশ্ব ডায়াবেটিসের ''ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের'' ঝুঁকিতে" শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, "বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সারা বিশ্বে এখন প্রতি ১১ জনে একজন ব্যক্তি ডায়াবেটিস আক্রান্ত। ২০১৪ সালে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪২২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়ষ্ক ব্যক্তি, যা ১৯৮০-তে আক্রান্তের তুলনায় ৪ গুণ বেশি। ৭ই এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রাক্কালে প্রকাশিত সংস্থাটির প্রথম গ্লোবাল রিপোর্টে বলা হয়েছে প্রতি বছর রক্তে উচ্চমাত্রার গ্লুকোজ বা ডায়াবেটিসের কারণে বিশ্বে মারা যাচ্ছে ৩৭ লক্ষ মানুষ।
২০১২ সালে ১৫ লাখ লোক প্রত্যক্ষভাবে ডায়াবেটিসের কারণে মারা যান।"
আরো বলা হয়, "বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে এখনই ''দৃঢ় পদক্ষেপ'' না নিলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।"
এই রিপোর্টে টাইপ-১ এবং টাইপ-২ - দুধরনের ডায়াবেটিস আক্রান্তদের কথাই বলা হয়েছে। তবে এটাও বলা হয়েছে যে ধরনের ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে তারা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের শিকার, যার মূল কারণ অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন।"
(২) জার্মানির জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের (বাংলা) ওয়েবসাইটে ২১ এপ্রিল ২০১২ তারিখে প্রকাশিত "ভারতে ডায়বেটিসের প্রকোপ" শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, "বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাব্লিউএইচও"র তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ৩৪৬ মিলিয়ন মানুষ ডায়বেটিসে আক্রান্ত। ২০৩০ সাল নাগাদ গোটা বিশ্বে আনুমানিক ৭.৮ শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বর্তমানে চীন ও ভারতে দেখা যাচ্ছে এর প্রকোপ। নতুন সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে ৫১ মিলিয়ন মানুষ ডায়বেটিসে ভুগছেন। আগামী ২০ বছরে এই সংখ্যা ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দিল্লি, মুম্বই ও কলকাতার মতো বড় বড় শহরে ডায়াবেটিস রোগীরা একই ধরনের সমস্যার কথা বলেন চিকিৎসকের কাছে, যেমন অফিসে চেয়ারে বসেই কাজ করতে হয় অনেকটা সময়, খেলাধুলা ও স্বাস্থ্যকর খাবারের সুযোগ সুবিধাও কম। পুষ্টিকর খাদ্য দ্রব্য ও রান্নাবান্নার সময়ও পান না অনেকে। চারিদিকে, কোকাকোলা, পিৎসা ও বার্গারের মতো ফাস্টফুডের বিজ্ঞাপন। একটু স্বচ্ছল হলেই গাড়ি কেনার প্রবণতা। ঘরকন্নার সাহায্যে থাকে কাজের লোক। শারীরিক পরিশ্রমের পাল্লাটা অনেক কম ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এসবই বহুমূত্র রোগের দিকে ঠেলে দেয় মানুষকে।"
(৩) ডয়চে ভেলের (বাংলা) ওয়েবসাইটে আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৩ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে "ডায়াবেটিস ও ইনসুলিন" শিরোনামে। সেখানে বলা হয়, "সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। এর কারণ হল বেশি খাওয়া ও কম দৌড়ঝাঁপ বা হাঁটাচলা করা। যার ফলে ডায়াবেটিস আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গী হয়ে উঠেছে। সারা বিশ্বে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। তবে খাওয়াদাওয়া ঠিক রাখলে আর নিয়মিত ব্যায়াম করলে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।"
(৪) ভারত থেকে প্রকাশিত xiaomi.dailyhunt.in (শাওমী ডট ডেইলীহান্ট ডট আইএন) নামক অনলাইন পত্রিকায় ‘ইনসুলিনের অভাবে ভুগবে বিশ্ব’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বর্তমান বিশ্বের অন্যতম জীবনঘাতী রোগ বলা হয় ডায়াবেটিসকে। এই রোগের কারণে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪২ কোটি ৫০ লাখ। আর প্রতিবছরই আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বেড়ে ২০৩০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৫১ কোটি ১০ লাখে। তবে সেই হারে বাড়বে না এই রোগে আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় জীবনরক্ষাকারী ওষুধ ইনসুলিনের সরবরাহ। ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের চার কোটির বেশি রোগী ইনসুলিন পাবেন না। এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ওশেনিয়া অঞ্চলে ভয়াবহ প্রভাবের আশঙ্কা করছেন গবেষকরা।
ল্যানসেট ডায়াবেটিস ও এন্ডোক্রায়োনোলজি জার্নালের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।’
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, ‘গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার সঞ্জয় বসু বলেন, ছোঁয়াচে নয় এমন রোগ বিশেষ করে ডায়াবেটিসের বিস্তার রোধে জাতিসংঘের নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও বর্তমানে চাহিদার তুলনায় ইনসুলিনের প্রাপ্যতা অনেক কম। আগামী ১২ বছরে বার্ধক্য, নগরায়ন, খাদ্যাভাস ও শারীরিক কাজকর্মের ধরনে নানা পরিবর্তনের কারণে গোটা বিশ্বেই টাইপ টু ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে।’
(৫) ‘ডায়েবেটিস থেকে সাবধান!’ শিরোনামে ডয়চে ভেলের ওয়েবসাইটে ২৭ মে ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ার মূল কারণ, অতিরিক্ত ওজন।’ [https://www.dw.com/overlay/media/bn/38965147/41071625]
(৬) ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে "নিয়মিত জীবনযাপন দূর করবে ডায়াবেটিস" শিরোনামে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি দিয়েছেন বোলপুরের চিকিৎসক প্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়। সাক্ষাৎকারের একটি অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে।
"প্রশ্ন: ডায়াবেটিস কেন হয়?
উত্তর: হাইপারটেনশন, থাইরয়েড, হার্টের অসুখ, ফ্যাটি লিভার, আর্থারাইটিজের মতোই ডায়াবেটিস মূলত একটি "লাইফস্টাইল ডিজিজ"। জীবনশৈলীর কারণে যে অসুখগুলো হয় তার মধ্যে অন্যতম হল ডায়াবেটিস। এখন মানুষ কায়িক পরিশ্রম কম করে, অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া করে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই এই ধরনের অসুখের মূলে। আগেকার দিনে ফ্রিজ, এসি, গাড়ি, কম্পিউটার, টিভি, মোবাইলের ব্যবহার কম ছিল। এখন মানুষ মাঠে খেলাধুলোর বদলে কম্পিউটারে গেমে মনোনিবেশ করে। সাইকেলের বদলে স্কুটি ব্যবহার করে। আগে সব ক্ষেত্রেই পরিশ্রম অনেক বেশি ছিল। বর্তমানে গাড়ি চড়া, না হাঁটা, রেস্তোরাঁতে খাওয়া সব দিক থেকে মানুষের জীবনশৈলী বদলেছে। মাছ, ভাত, শাক, পোস্তার জায়গায় খাবার হিসেবে এসেছে পাস্তা, পেস্ট্রি, কোল্ড ড্রিংকস, আইসক্রিম, নুডলস যেগুলি মূলত হাই ক্যালোরির খাবার। এই সমস্ত খাবার বেশি করে খাওয়া এবং কম পরিশ্রম করার ফলে চাইল্ডহুড ওবেসিটি হচ্ছে। এই ওবেসিটিই হচ্ছে ভবিষ্যতে সুগার, প্রেসার, হার্টের অসুখের প্রবেশ পথ। আগেকার থেকে এখন মানুষের জীবনযাত্রা অনেক জটিল হয়েছে। বেড়েছে মানসিক চিন্তা। সমাজ, সংসার, কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপও ডায়াবেটিসের মূলে।"

এই ছয়টি নিবন্ধ-প্রতিবেদনের প্রথমটিতে ডায়াবেটিসের মূল কারণ বলা হয় অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনকে, দ্বিতীয়টিতে ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয় আরামপ্রিয় জীবনযাপন এবং শারীরিক পরিশ্রম কম করাকে, তৃতীয়টিতে ডায়াবেটিসের কারণ বলে মনে করা হয় বেশি খাওয়া, দৌড়ঝাঁপ বা হাঁটাচলা কম করা এবং নিয়মিত ব্যায়াম না করাকে, চতুর্থটিতে বার্ধক্য, নগরায়ন, খাদ্যাভাস ও শারীরিক কাজকর্মের ধরনে নানা পরিবর্তনের কারণে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বলে মনে করা হয়, পঞ্চমটিতে ডায়াবেটিসের মূল কারণ বলা হয় অতিরিক্ত ওজনকে, আর ষষ্ঠটিতে ডায়াবেটিসকে "লাইফস্টাইল ডিজিজ" বলেই আখ্যা দেয়া হয়। লাইফস্টাইল হিসেবে বলা হয়, "এখন মানুষ কায়িক পরিশ্রম কম করে, অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া করে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই এই ধরনের অসুখের মূলে। আগেকার দিনে ফ্রিজ, এসি, গাড়ি, কম্পিউটার, টিভি, মোবাইলের ব্যবহার কম ছিল। এখন মানুষ মাঠে খেলাধুলোর বদলে কম্পিউটারে গেমে মনোনিবেশ করে। সাইকেলের বদলে স্কুটি ব্যবহার করে। আগে সব ক্ষেত্রেই পরিশ্রম অনেক বেশি ছিল। বর্তমানে গাড়ি চড়া, না হাঁটা, রেস্তোরাঁতে খাওয়া সব দিক থেকে মানুষের জীবনশৈলী বদলেছে।"
এই প্রতিবেদনগুলোতে কিন্তু ডায়াবেটিসকে বংশগতভাবেও হয়, এমন রোগ বলা হয়নি; ডায়াবেটিসের সাথে ধূমপান, মদপান, চিনি/মিষ্টি/লবণ বেশি খাওয়ার সম্পর্ক আছে বলেও বলা হয়নি। তবে শুধু শেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ডায়াবেটিসের সাথে মানসিক চাপের সম্পর্কের কথা। শুধু একটা কথাই বলবো, এ অধ্যায়ে যে চার শ্রেণির ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত থাকার কথা বলা হয়েছে, শারীরিক পরিশ্রমে যুক্ত থাকা ছাড়া জীবনের অন্য বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে এরা কি আর সব মানুষের মতো নয়? আর সব মানুষের মতো এদের জীবনেও হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের সাথে মানসিক চাপও নিশ্চয়ই আছে। তাহলে মানসিক চাপ এদেরকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত করতে পারছে না কেন? কারণ মানসিক চাপ কাউকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত করতে পারে তখন, যখন মানুষ পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করার ফলে শরীরে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পায়। যেসব মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে না, তারা শুধু ডায়াবেটিস নয়, হার্ট অ্যাটাক এবং উচ্চ রক্তচাপ থেকেও বেঁচে থাকে। তাই মানসিক চাপ ডায়াবেটিসসহ এ তিনটি রোগের প্রত্যক্ষ কারণ নয়। বরং এসব রোগের প্রত্যক্ষ কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা বা আরামপ্রিয় জীবন যাপন করা। আরামে থাকলেই মানুষকে রোগগুলো আক্রমণ করার সুযোগ পায়।

হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপেরও মূল কারণ ১টি, মোট কারণ ৩টি

এর আগের অধ্যায়ের আগের অধ্যায়ে এটা স্পষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ এই রোগ তিনটি একই সূত্রে গাঁথা। রোগ তিনটির কারণ যেহেতু একই, এগুলো থেকে বেঁচে থাকার উপায়ও একই। আর সর্বশেষ অধ্যায় থেকে সবাই আশা করি স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছেন, ডায়াবেটিসের মূল কারণ ১টি, আর মোট কারণ ৩টি।

যেহেতু ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ এই তিনটি রোগ সমগোত্রীয়, সেহেতু ডায়াবেটিসের মূল কারণ যা, বাকি দু’টি রোগের মূল কারণও তা-ই এবং ডায়াবেটিস যেহেতু মোট তিনটি কারণে মানুষের হয়ে থাকে, অন্য রোগ দু’টিও মোট তিনটি কারণেই মানুষের হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে এর আগের অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, তাই বাড়তি কিছু বলার মনে হয় প্রয়োজন নেই।


‘‘দীর্ঘজীবন লাভের উপায়’’ শিরোনামে একটি বইয়ের অংশ বিশেষ এই লেখাটি। পুরো বই অনলাইনে পড়তে হলে যেতে হবে এই লিঙ্কে: দীর্ঘজীবন লাভের উপায় : পর্ব-১

ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক এবং হাই ব্লাড প্রেসার রোগগুলো পরস্পর সম্পর্কিত

ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ এই রোগগুলোর একটার সাথে আরেকটার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। রোগগুলো একই সূত্রে গাঁথা। কাউকে এরকম একটা রোগ আক্রমণ করলে অন্য রোগগুলোও তাকে আক্রমণ করার সম্ভাবনা খুব বেড়ে যায় এবং আক্রমণ করেও প্রায়ই। কারণ একই ধরনের কারণে রোগগুলো মানুষকে আক্রমণ করে। যাদেরকে রোগগুলো আক্রমণ করে, খুঁজলে দেখা যায়, তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং জীবনযাত্রা প্রায় একই। তাই রোগগুলো যে সমগোত্রীয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে যারা এরকম কোনো একটি বা দু’টি রোগে আক্রান্ত হবার পর সেগুলো নিয়ন্ত্রণের যথাসাধ্য চেষ্টা করে, তাদেরকে সমগোত্রীয় অন্য কোনো রোগ সহজে আক্রমণ করতে পারে না। কিন্তু যারা অবহেলা করে, রোগ নিয়ন্ত্রণের তেমন চেষ্টা করে না, তাদেরকে খুব দ্রুত অন্য রোগগুলো আক্রমণ করে বসে। বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে হলে প্রথমে আমরা বাস্তবতার দিকে একটু চোখ বুলাই।

বাস্তবতা কী বলে?

এমন অসংখ্য মানুষ আমি দেখেছি আমার পরিচিতজনদের মধ্যে, যারা একই সাথে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিস এই তিনটি রোগেই আক্রান্ত। উদাহরণ দিতে চাই না। কারণ আমার দেয়া উদাহরণ শুধু আমার পরিচিতজনরাই যাচাই করে দেখার সুযোগ পাবে সহজে, অন্যরা নয়। তাই উদাহরণ খুঁজে নেয়ার দায়িত্ব সকলের উপর ছেড়ে দিচ্ছি। আপনার পরিচিত যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, দেখবেন তাদের অনেকে উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ এই দু’টির একটি বা উভয়টিতেও আক্রান্ত, আবার যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, তাদের অনেকে দেখবেন ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এই দু’টি রোগের একটি বা উভয়টিতেও আক্রান্ত, আবার যারা হৃদরোগে আক্রান্ত, তাদের অনেককে দেখবেন উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস এই দু’টি রোগের একটি বা উভয়টিতেও আক্রান্ত। তবে হৃদরোগে অনেকে আক্রান্ত হবার পর বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে না বলে সমগোত্রীয় অন্য রোগে আক্রান্ত হবার সুযোগই পায় না বলে হৃদরোগে আক্রান্তদের মধ্যে এ জাতীয় অন্য রোগ দেখা যায় কম। আবার অনেক হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বাইপাস সার্জারী করে অনেকটা সুস্থ হয়ে যাবার কারণে বা নিয়মিত কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ঔষধ সেবন করার ফলে তাদেরকে সমজাতীয় অন্য রোগ আক্রমণ করতে সময় লেগে যায়। তবে হৃদরোগে আক্রান্ত অধিকাংশ ব্যক্তিকে দেখবেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত না হলেও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত।

অনেক মানুষ প্রথমে আক্রান্ত হয় উচ্চ রক্তচাপে, তা নিয়ন্ত্রণে ত্রুটি করলে অন্য দু’টি রোগের কোনো একটি বা উভয়টি তাকে একসময় আক্রমণ করে বসে। অনেককে প্রথমে আক্রমণ করে ডায়াবেটিস, তা নিয়ন্ত্রণ না করলে একসময় হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপ তাকে আক্রমণ করে বসে। অনেকে আবার প্রথমে আক্রান্ত হয় হৃদরোগে, তা নিয়ন্ত্রণে ত্রুটি করলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস এই দু’টি রোগের একটি বা উভয়টি একসময় আক্রমণ করে বসে।
তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ প্রথমে আক্রান্ত হয় উচ্চ রক্তচাপে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ না করলে তাদেরকে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এই দু’টি রোগের কোনো একটি বা উভয়টি আক্রমণ করে। খুব কম লোক এমন পাওয়া যায়, যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার পর তা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার পরও ১০-১৫ বছর ধরে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এই দু’টি রোগের কোনো একটি বা উভয়টি থেকে নিরাপদ ছিলেন।

একটু খুঁজলেই আমাদের আশেপাশে এমন অসংখ্য লোক পাওয়া যাবে, যাদের কেউ এরকম দু’টি রোগে, কেউ আবার একই সাথে তিনটি রোগেই আক্রান্ত। এই রোগগুলোর কোনো একটিতে ১০ বছর ধরে আক্রান্ত এক হাজার রোগীর খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের অন্তত ৮০০ জন লোক এজাতীয় একাধিক রোগে আক্রান্ত। কারণ? কারণ হলো, রোগ তিনটির মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব রয়েছে।

রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে কিছু মতামত

বিষয়টা আরো স্পষ্টভাবে বুঝার জন্য রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক। রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে আমি অনেক গবেষণা প্রতিবেদন এবং পত্রপত্রিকায় ডাক্তারের লেখা অনেক নিবন্ধ পড়েছি। অনেক মানুষের মুখেও রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে অনেক কথা শোনা যায়। দুঃখজনক হচ্ছে, রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার তিন-চারটি প্রকৃত কারণ ছাড়াও অনেকগুলো কারণকে গড়পড়তাভাবে রোগগুলোর জন্য দায়ী বলে প্রচার করা হয়। যেমন: পূর্বপুরুষদের কারো রোগগুলো থাকা, বয়স ৪৫ বা তার বেশি হওয়া, টেনশন বা মানসিক অস্থিরতা, ধূমপান, মদপান, চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার বেশি খাওয়া, লবণ খাওয়া, খাদ্যে ফরমালিন বা ভেজাল, অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম ইত্যাদি। দু’একটা নমুনা দেখা যাক:

৮ অক্টোবর ২০১৬ তারিখের দৈনিক আমাদের সময়ে ডা: এম শমশের আলী একটি নিবন্ধ লেখেন ‘হাই প্রেসার ও হৃদরোগ’ শিরোনামে। সেখানে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে বলা হয়, ‘যারা বেশি টেনশনের কাজ করেন, যাদের কাজের চাপ খুব বেশি, যারা কাজের চাপের জন্য শরীরের যত্ন নিতে পারেন না, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম বা ঘুমাতে পারেন না, তাদের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। দুশ্চিন্তা, অবসন্ন, বংশগত প্রবণতা, অতিমাত্রায় ধূমপান ও মদ্যপান উচ্চ রক্তচাপের কারণ হিসেবে বিবেচিত। যারা খুব বেশি প্রতিযোগী মনোভাবাপন্ন, তাদেরও এ রোগে ভোগার আশঙ্কা রয়েছে। কায়িক শ্রমের অভাব বা অলস জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অতিমাত্রায় লবণ খাওয়ার অভ্যাস, শারীরিক ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস ও রক্তে উচ্চ মাত্রায় কোলেস্টেরল উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।... অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ বিভিন্নভাবে হৃদরোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং যাদের অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা শতভাগ।’

১১ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘হৃদরোগের লক্ষণ ও তা থেকে বাঁচার উপায়’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়, যা লিখেছেন ঢাকার ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট, কার্ডিওলজিস্ট ও সিসিইউ ইনচার্জ ডা. মাহবুবর রহমান। সেখানে বলা হয়, ‘গবেষণায় দেখা যায়, পারিবারিক ইতিহাস ও জেনেটিক বৈশিষ্ট্যই হৃদরোগের ক্ষেত্রে প্রধান ও নিয়ন্ত্রণের অযোগ্য কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিয়ন্ত্রণযোগ্য কারণেই মানুষ আজকাল হৃদরোগে আক্রান্ত হন বেশি। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ এবং অতিরিক্ত ওজন।’

১৭ মে ২০১৮ তারিখের দৈনিক সমকালে ‘বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস’ উপলক্ষ্যে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘আজ বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস’ শিরোনামে। সেখানে বলা হয়, ‘এক গবেষণায় দেখা গেছে, ওজন বাড়লে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার হার দুই থেকে ছয়গুণ বেড়ে যায়। এ ছাড়া  অতিরিক্ত লবণ খাওয়া, ধূমপান, মদপানও উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টিতে দায়ী।’

এ লেখার ‘উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে ভুল ধারণা’ শিরোনামের অধ্যায়ে  ‘উচ্চ রক্তচাপে করণীয়’ শিরোনামে ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখের দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি লেখার অংশবিশেষ উল্লেখ করা হয়েছে। লেখাটিতে ‘৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না’ বলা হলেও উচ্চ রক্তচাপের আশংকা বাড়ায়, এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ করা হয়। যথা: বংশানুক্রমিক, ধূমপান, অতিরিক্ত লবণ গ্রহন, অধিক ওজন ও অলস জীবনযাত্রা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত মদপান, ডায়াবেটিস ও অতিরিক্ত উৎকন্ঠা।

‘আপনি কি ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন?’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয় ৮ অক্টোবর ২০১৭ তারিখের প্রথম আলোয়। লিখেছেন ঢাকার বিআইএইচএস জেনারেল হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিশেষজ্ঞ ডা. এ হাসনাত শাহীন। আট ধরনের মানুষকে লেখাটিতে ডায়াবেটিসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়। যথা: ১. বয়স ৪৫ বা তার বেশি ২. স্থূল ব্যক্তি ৩. রক্ত-সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়ের ডায়াবেটিস থাকলে ৪. শারীরিক পরিশ্রমের ঘাটতি ৫. গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা অধিক ওজনের সন্তান প্রসবের পূর্ব ইতিহাস ৬. পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম ৭. উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক বা হৃদরোগ এবং ৮. রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেশি এবং এইচডিএলের মাত্রা কম থাকলে। [https://www.prothomalo.com/life-style/article/1339441]

‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে যেসব জানা জরুরি’ শিরোনামে বিবিসি বাংলায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৩ নভেম্বর ২০১৮। সেখানে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কিছু উপায় উল্লেখ করা হয়। ‘প্রতিরোধের উপায়’ আর ‘কারণ’ প্রকারান্তরে একই কথা। বলা হয়, ‘ডায়াবেটিস যদিও জেনেটিক এবং আপনার জীবন যাপনের স্টাইলের ওপর নির্ভরশীল তারপরেও আপনি চেষ্টা করলে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারেন। সেজন্যে আপনাকে খাবার গ্রহণের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে এবং আপনাকে হতে হবে অত্যন্ত সক্রিয় একজন মানুষ। প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। মসৃন শাদা আটার রুটির পরিবর্তে খেতে হবে ভুষিওয়ালা আটার রুটি। এটাই প্রথম ধাপ। এড়িয়ে চলতে হবে হোয়াইট পাস্তা, প্যাস্ট্রি, ফিজি ড্রিংকস, চিনি জাতীয় পানীয়, মিষ্টি ইত্যাদি।
আর স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে রয়েছে শাক সব্জি, ফল, বিন্স এবং মোটা দানার খাদ্য শস্য। স্বাস্থ্যকর তেল, বাদাম খাওয়াও ভালো। ওমেগা থ্রি তেল আছে যেসব মাছে সেগুলো বেশি খেতে হবে। যেমন সারডিন, স্যামন এবং ম্যাকেরেল।
এক বেলা পেট ভরে না খেয়ে পরিমানে অল্প অল্প করে বিরতি দিয়ে খাওয়া দরকার।
শরীর চর্চা বা ব্যায়াম করার মাধ্যমে রক্তে চিনির মাত্রা কমিয়ে রাখা সম্ভব। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতি সপ্তাহে আড়াই ঘণ্টার মতো ব্যায়াম করা দরকার। তার মধ্যে দ্রুত হাঁটা এবং সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠাও  রয়েছে।
ওজন কম রাখলেও চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যদি ওজন কমাতে হয় তাহলে সেটা ধীরে ধীরে করতে হবে। সপ্তাহে আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত।
ধূমপান পরিহার করাও জরুরী। নজর রাখতে হবে কোলস্টেরলের মাত্রার ওপর। এর মাত্রা বেশি হলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।’ [https://www.bbc.com/bengali/news-46194839]

উপরের প্রতিবেদনগুলোতে হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের অনেকগুলো কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কারণগুলোর মধ্যে কিছু আছে, তিনটি রোগের ক্ষেত্রেই যেগুলো অনিবার্যভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন: কায়িক শ্রমের অভাব বা অলস জীবনযাপন, শারীরিক ওজন বৃদ্ধি, রক্তে উচ্চ মাত্রায় কোলেস্টেরল, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি। যেহেতু রোগগুলো কিছু কমন বা সাধারণ কারণে হয়ে থাকে, তাই রোগগুলো অবশ্যই সমগোত্রীয়।

নির্দিষ্ট এ কারণগুলো ছাড়া অন্য যে কারণগুলোকে রোগগুলোর জন্য দায়ী করা হয়েছে, (যেমন: ধূমপান, মদপান, লবণ খাওয়া, চিনি/মিষ্টি খাওয়া, বয়স বেশি হওয়া, বংশের কারো থাকা ইত্যাদি) সেগুলো যে সত্যিই রোগগুলোর জন্য দায়ী নয়, তা শুধু এদিকে লক্ষ্য করলেই বুঝা যায়, সব নিবন্ধ/প্রতিবেদনে এগুলোকে রোগগুলোর জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়নি। একেকটিকে একেক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। যদি এগুলো সত্যিই রোগগুলোর জন্য দায়ী হতো, তাহলে সব লেখায় এগুলোর প্রত্যেকটিকে অপরিহার্যভাবে উল্লেখ করা হতো।

মতামতগুলোর সাথে বাস্তবতার মিল কতটুকু?

এই নিবন্ধ/প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখিত কারণগুলোর কোনটি সত্যিকারের কারণ, আর কোনটি সত্যিকারের কারণ নয়, তা আমরা বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখলেও বুঝতে পারবো। বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, যেসব লোক দিনের বেশির ভাগ সময় শারীরিক পরিশ্রমেই কাটিয়ে দেয় বা রুটিনমাফিক দৈনিক দুএক ঘন্টা ব্যায়াম করে, তারা ফাস্টফুডে আসক্ত হলেও, বয়স বেশি হলেও, ধূমপান করলেও, মাদকের সাথে সম্পর্ক রাখলেও, চিনি/মিষ্টান্ন/লবণ মনমতো খেলেও, এমনকি তাদের জীবনে অনেক মানসিক চাপ থাকলেও তাদের শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে না বলে তারা রোগগুলো থেকে মুক্ত থাকে।

আর যেসব মানুষ পনেরো-বিশ বছর ধরে এমন পেশায় নিযুক্ত, যেখানে সারাক্ষণ বসে বসেই কাজ করতে হয়, ব্যায়ামে অভ্যস্ত নয়, এককথায় যাদের জীবনে শারীরিক পরিশ্রম তেমন নেই বা থাকলেও খুব কম, তারা ফাস্টফুড বা জাঙ্কফুড খাক বা না খাক, মিষ্টান্ন/চিনি/লবণ বেশি বা কম খাক, ধূমপান করুক বা না করুক, মদপান করুক বা না করুক, তাদের টেনশন কম থাক বা বেশি থাক বা না থাক, তাদের বাবা-মা এরকম রোগে আক্রান্ত হোক বা না হোক, তারা এসব রোগ থেকে রক্ষা পায় না। এমনকি, এমরকম একটা রোগে আক্রান্ত হবার পরও যখন তাদের টনক না নড়ে, তা নিয়ন্ত্রণে একটু গড়িমসি বা অবহেলা করে, তখন এ জাতীয় অন্য রোগও তাকে পেয়ে বসে।

এক কথায় এটাই বাস্তব, শারীরিক পরিশ্রম যে যত বেশি করে, তার নিকট থেকে এসব রোগ তত বেশি দূরে থাকে আর শারীরিক পরিশ্রম থেকে যে যত বেশি দূরে থাকে, সে তত বেশি এসব রোগে আক্রান্ত হয়। রোগগুলোর সম্পর্ক শুধুই পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম করা বা না করার সাথে। মূলত এখানে এসেই রোগগুলো এক সূতোয় গেঁথে যায়।

রোগগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কিছু মতামত

বিষয়টা আরো পরিষ্কারভাবে বুঝার জন্য বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এই রোগ তিনটির মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন ও নিবন্ধে বর্ণিত মতামত উল্লেখ করা হলো। আশা করি এগুলো পড়ার পর এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ থাকবে না, রোগগুলো যে একই সূত্রে গাঁথা।

প্রথমে ডায়াবেটিস থেকে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে:

উচ্চ রক্তচাপের কারণ ও প্রতিকার' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় জার্মানির জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলে বাংলার ওয়েবসাইটে ২৬ জুন ২০১৩ তারিখে, যা লিখেছেন নুরুননাহার সাত্তার। প্রতিবেদনটির উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার কারণ অনেক' শিরোনামের পরিচ্ছেদে বলা হয়, উচ্চ রক্তচাপের ঠিক আসল কারণ কী তা সেভাবে প্রমাণ হয়নি। তবে অতিরিক্ত ওজন, স্ট্রেস, বেশি মাত্রায় মদ্য পান, ধূমপান, ডায়েবেটিস-২ যাঁদের রয়েছে এবং বয়স- এসবই এর প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। তাছাড়া জেনেটিক কারণও রয়েছে। অর্থাৎ মা-বাবার হাই প্রেশার থাকলে সন্তানদেরও হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।''
[https://www.dw.com/bn/g-16909656]

ডায়াবেটিসের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্কের বিষয়ে বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন' অনুষ্ঠানের ২৯২৪ তম পর্বে কথা বলেন ঢাকার ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. এম এ রশীদ। এনটিভির ওয়েবসাইটে ১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে অনুষ্ঠানটির ভিডিওসহ অনুষ্ঠানটির বিষয়বস্তু লিখিত আকারে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের সম্পর্ক কী?' শিরোনামে প্রকাশ করা হয়। আলোচনায় অধ্যাপক ডা. এম এ রশীদ বলেন, ডায়াবেটিসের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে উচ্চ রক্তচাপের। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা বেশি।' [https://www.ntvbd.com/health/169113]

ঢাকার বারডেম হাসপাতালের ল্যাবরেটরী সার্ভিসেসের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরীর একটি লেখা প্রকাশিত হয় দৈনিক ইত্তেফাকে ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ' শিরোনামে। সেখানে তিনি বলেন, যাদের ডায়াবেটিস নেই, তাদের তুলনায় যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ দেখা যায় বেশি। এমন দেখা যায়, পূর্ণবয়স্ক তিন জন ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে দুই জনেরই থাকে উচ্চ রক্তচাপ। ডায়াবেটিস থাকলে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকিও দ্বিগুণ। চিকিৎসা না হলে উচ্চ রক্তচাপ থেকে হতে পারে হার্ট এ্যাটাক ও স্ট্রোক।' [https://archive.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDlfMjFfMTNfNF80N18xXzcyODgy]

দৈনিক যুগান্তরে ২৮ জুলাই ২০১৮ তারিখে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ' শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ও সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ২০০৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরের বেশি বয়সী ডায়াবেটিস রোগীর ৭৩ শতাংশই উচ্চ রক্তচাপেও ভুগছিল।' [https://www.jugantor.com/todays-paper/features/stay-well/74630]

এবার ডায়াবেটিস থেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে:

ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ' শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয় ১৩ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে, যা লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাকা) ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট অধ্যাপক এস এম মুস্তফা জামান। সেখানে তিনি বলেন, গবেষণা বলছে ৭০ শতাংশ ডায়াবেটিসের রোগী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই অকালে মৃত্যুবরণ করে থাকেন। ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ- এ দুটো পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যে বিষয়গুলো ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত, যেমন: অতি ওজন, ধূমপান, মন্দ খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা বা বংশগতি, এগুলো হৃদরোগেরও ঝুঁকি। তাই এ দুটো সমস্যা পরস্পরের হাত ধরেই চলে। একটির ঝুঁকি কমালে অপরটির ঝুঁকিও কমে আসে।'

ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের সম্পর্ক কী?' শিরোনামে এনটিভির ওয়েবসাইটে ০১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত যে ফিচারটির একটি অংশ একটু আগে উল্লেখ করা হয়, সে ফিচারটির আরেকটি অংশ এখানে উল্লেখ করতে হচ্ছে।
"প্রশ্ন : ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ দুটোর মধ্যে সম্পৃক্ততা কোথায়?
উত্তর : বিষয়টি কিন্তু অত্যন্ত মূল্যবান। ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ দুটো রোগই কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য।... ডায়াবেটিসের সঙ্গে হৃদরোগের ব্যাপক সম্পর্ক রয়েছে। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি।"

ফিচারটির দুটো বক্তব্য একত্র করলে যোগফল এই দাঁড়ায়, রোগ তিনটি একে অন্যের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত।

বাংলাদেশ প্রতিদিনে ৬ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে 'হৃদরোগ যখন ডায়াবেটিস রোগীর' শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. এম শমশের আলী। তিনি সেখানে বলেন, 'ডায়াবেটিস রোগীর হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি শতভাগ। আপনি যদি হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে চান তবে প্রথম অবস্থা থেকেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে আপনাকে বেশ তৎপর হতে হবে।'

এবার উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে:

'উচ্চ রক্তচাপে কেন ওষুধ ব্যর্থ হয়' শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় দৈনিক কালের কণ্ঠে ২৮ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে। সেখানে বলা হয়, 'সারা বিশ্বে মানুষের একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় এখন হৃদরোগ। যদি আপনার উচ্চ রক্তচাপ থাকে তবে আপনাকে এই রোগের বিপদ সম্পর্কে নিশ্চয়ই চিকিৎসকরা সতর্ক করেছেন।
উচ্চ রক্তচাপে রক্তনালীর বেষ্টনীর বিরুদ্ধে রক্তের চাপ খুব বেশি হয়। ফলে হৃদযন্ত্র এবং রক্তনালীকে বাড়তি কাজ করতে হয়। এতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।'

বাংলাদেশ প্রতিদিনে ১৯ মে ২০১৮ তারিখে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় 'উচ্চ রক্তচাপ : নীরব ঘাতক' শিরোনামে, যা লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের অধ্যাপক ও ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, 'দিন দিন উচ্চ রক্তচাপ মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ চারটি অঙ্গে মারাত্মক ধরনের জটিলতা হতে পারে। যেমন হৃৎপিন্ড, কিডনি, মস্তিষ্ক ও চোখ। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদযন্ত্রের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ফলে হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করতে পারে না এবং এই অবস্থাকে বলা হয় হার্ট ফেইলিওর।

এবার উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে:

জার্মানীর জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের ওয়েবসাইটে 'হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ চিনুন, জীবন বাঁচান' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৫ আগস্ট ২০১৪ তারিখে, যা তৈরি করেন নুরুননাহার সাত্তার । সেখানে 'হার্ট অ্যাটাকের কারণ বা ঝুঁকিগুলো কী?’ শিরোনামের পরিচ্ছেদে বলা হয়, 'অতিরিক্ত ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, মদ্যপান, স্ট্রেস বা মানসিক চাপ, কম হাঁটা-চলা, ডায়বেটিস ইত্যাদি।' [https://www.dw.com/overlay/media/bn/17856309/40942842]

'হার্টের অসুখ প্রতিরোধ করা যায়' শিরোনামে দৈনিক কালের কন্ঠে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় 'বিশ্ব হার্ট দিবস' উপলক্ষ্যে, যা লিখেছেন এম এইচ শমরিতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের (ঢাকা) হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ। সেখানে বলা হয়, 'বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, জীবনযাত্রা যত আধুনিক হচ্ছে হার্টের অসুখে আক্রান্তের হার তত বাড়ছে। নিবন্ধটির শেষদিকে হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য যে বিষয়গুলো মেনে চলার কথা বলা হয়, সেগুলোর একটি হচ্ছে-
উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস থাকলে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।''
'ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ' শিরোনামে একটি লেখা দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত হয় ৯ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে, যা লিখেন, ডা. হাফিজা লুনা। তাতে বলা হয়, 'ডায়াবেটিস রোগীরা অধিকহারে ও তীব্রতরভাবে হৃদরোগের শিকার হয়।...যাদের ডায়াবেটিস টাইপ-২ হয়েছে, তাদের উচ্চ রক্তচাপে ভোগার সমূহ সম্ভাবনা আছে। একই সাথে রক্তের লিপিডের অস্বাভাবিকতা, দৈহিক স্থূলতা ইত্যাদিও ২ থেকে ৪ গুণ হারে বৃদ্ধি পায়। সর্বোপরি হৃদরোগ সামগ্রিকভাবে কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমাদের দেশের টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের ৭০ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপ, ৯৭ শতাংশ রক্তে লিপিডের অস্বাভাবিকতা ও ৮০ শতাংশ দৈহিক ওজনজনিত সমস্যায় ভোগেন। এসব রোগ একই সূত্রে বাঁধা- এমনো মতামত দেয়া হয়। এরূপ চক্রকে মেটাবলিক সিনড্রোম বলে।

রোগ তিনটি যে পরস্পরের হাত ধরাধরি করে চলে, এ ব্যাপারে আর কারো সংশয়ের অবকাশ থাকার কথা নয়।

‘‘দীর্ঘজীবন লাভের উপায়’’ শিরোনামে একটি বইয়ের অংশ বিশেষ এই লেখাটি। পুরো বই অনলাইনে পড়তে হলে যেতে হবে এই লিঙ্কে: দীর্ঘজীবন লাভের উপায় : পর্ব-১

আরামে থাকা এবং মোটা হবার ক্ষতি

কষ্টের কাজ থেকে গা বাঁচিয়ে আরামে আরামে থেকে আর বসে বসে খেয়ে মোটা হয়ে অনেকে প্রথম প্রথম ভাবে, ‘জীবনের সেরা সময়টা বুঝি কাটছে আমার; বেশ সুখী এবং সুস্থ-সবল দেখাচ্ছে আমায়!’ কিন্তু মোটা হবার সাথে সাথে যখন শরীরের ওজন বেড়ে যেতে শুরু করে, শরীরে মেদ জমতে শুরু করে, ভূঁড়ি বেড়ে যায়, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা তখন নানাভাবে ব্যাহত হয়; পরিশ্রমের সামান্য কাজ করতে গিয়েও মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে।

নতুন নতুন সব বিপদে পড়ে একসময় ভাবে, ‘কেন মোটা হলাম? চিকন থাকাই তো ভালো ছিল!’ মাঝে মাঝে এমন অনেক লোকের কথা জানতে পারি, যারা একসময় চিকন ছিল। অনেক চেষ্টা-সংগ্রামের পর মোটা হয়ে এখন আবার চিকনত্ব ফিরে পাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে, কিন্তু চিকন হতে পারছে না কোনোভাবে!

মোটা হওয়ার পরিণতি অবশ্য এ অস্থিরতা আর অস্বস্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মোটা মানুষদের এ সমস্যাগুলো কেবল মোটা হওয়ার প্রাথমিক পরিণতি মাত্র। মোটা হওয়াটা ইদানিং বিশ^ব্যাপী মানুষের মহাবিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোটা হওয়াটা এখন মানুষের সুস্বাস্থ্য এবং জীবনের জন্যই হুমকি। মোটা হবার কারণে মানুষ ইদানিং এমন অনেক রোগে আক্রান্ত হয়, যে রোগগুলো মানুষের জীবনকে জটিল করে তোলে, মানুষকে দ্রুত মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়। যেসব মানুষের কায়িক শ্রমের কোনো কাজ নেই, ব্যায়ামেরও অভ্যেস বা সুযোগ নেই, মোটা হওয়ার পর ধীরে ধীরে তাদের শরীর ও রক্তে চর্বি-কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। অতিরিক্ত চর্বি এবং কোলেস্টেরলের ফলে তাদের শরীরে দেখা দেয় উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ব্লকেজের মতো রোগ। আমার পরিচিতজনদের মধ্যে অসংখ্য মানুষ এখন এসব রোগে আক্রান্ত, অনেকে ইতোমধ্যে মারাও গেছেন। আমি দেখেছি, এসব লোকের মধ্যে অধিকাংশই মোটা ছিলেন, অন্যদিকে শারীরিক পরিশ্রমের কোনো কাজের সাথেও এদের তেমন সম্পর্ক ছিল না।

ত্রিশের বেশি বয়সী মোটা মানুষরা এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে রোগের জটিলতায় কঠিন জীবনের মুখোমুখি হবার ঘটনা বিশ্বব্যাপী এখন হু হু করে বাড়ছে। ত্রিশের কম বয়সী মোটা মানুষরাও, এমনকি শিশুরাও এখন এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আমি খুব গভীরভাবে দেখেছি, মোটা হওয়া এবং শারীরিক শ্রমশূন্য থাকার সমন্বয় যার মধ্যে ঘটে, এসব রোগ থেকে সে খুব কমই রেহাই পায়। কেউ হয়তো দ্রুত এসব কোনো রোগে আক্রান্ত হয়, কেউ একটু দেরিতে।

আরামে থাকা এবং মোটা হওয়াজনিত এসব রোগের কারণে মানুষ এক কঠিন জীবনের মুখোমুখি হয়; খাওয়া-দাওয়ায় লাগাম টেনে ধরতে হয়; সার্বক্ষণিক ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতে হয়; সব সময় ঔষধ সাথে রাখতে হয়; নিয়মিত ঔষধ গ্রহণ করতে হয়; রুটিনমাফিক হাঁটতে বা ব্যায়াম করতে হয়; রক্তচাপ-ডায়াবেটিস এসব মাপতে হয় নিয়মিত; হার্টের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয় কয় দিন পরপর- জীবনের এক বিভীষিকাময় অধ্যায়ে মানুষ প্রবেশ করে। মানুষের স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া, স্বাভাবিক চলাফেরা, সর্বোপরি স্বাভাবিক জীবন চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। একমাত্র মৃত্যুই মানুষকে রোগগুলোর যন্ত্রণা থেকে পুরোপুরি মুক্তি দেয়।

ডায়াবেটিস দেখা দিলে অনেকের চোখ আর কিডনীও পর্যায়ক্রমে ক্ষতিগ্রস্থ হয়; ডায়াবেটিস বেড়ে গেলেও বিপদ, শূন্য হয়ে গেলেও বিপদ। উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিলে রোগের তীব্রতায় অনেকে আকস্মিক হার্ট অ্যাটাকের কবলে পড়ে মুহূর্তেই মৃত্যুমুখেও পতিত হয়। হার্ট অ্যাটাকের কবলে পড়া অনেক রোগী তাৎক্ষণিক মারা না গেলেও দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারের অ্যাটাকে মারা যায়। মাঝখানের সময়টা তার কাটে অন্তহীন শঙ্কা আর হতাশায়, চোখের সামনে সব সময় মৃত্যুকে দেখে। অনেক হার্ট অ্যাটাকের রোগীকে রিং বসিয়ে বা বাইপাস সার্জারী করে সাময়িকভাবে কোনো রকম সুস্থ করে তোলা গেলেও বাকি জীবন চলতে হয় খুব সতর্কভাবে।
মোটা হওয়ার এসব গুরুতর ক্ষতি সম্পর্কে আমরা সতর্ক না হলে দিন যত যাবে, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের মতো রোগগুলো বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনকে সংক্ষিপ্ত থেকে সংক্ষিপ্ততম করতেই থাকবে।

‘‘দীর্ঘজীবন লাভের উপায়’’ শিরোনামে একটি বইয়ের অংশ বিশেষ এই লেখাটি। পুরো বই অনলাইনে পড়তে হলে যেতে হবে এই লিঙ্কে: https://waytogainlonglife.blogspot.com/2019/03/blog-post.html

ভেজাল খাদ্য কি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার কারণ?

খাদ্যে ভেজাল তথা বাজার থেকে কেনা খাদ্যে বিভিন্ন রকম ক্ষতিকর ক্যামিকেল মেশানো বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে অন্যতম আলোচনা-সমালোচনার বিষয়। সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রচেষ্টার পরও খাদ্যে ভেজাল এখনো পুরোপুরি দূর করা যায়নি।

বাজারে বিক্রিত ফলমূল, মাছ, সবজিসহ প্রায় সব খাবারে নানা রকম ক্ষতিকর ক্যামিকেল মেশানো হয়। যেমন: ফরমালিন, প্যারাথিয়ন, মেলামাইন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথোফ্যান, সোডিয়াম কার্বনেট, ফ্লেভার, কৃত্রিম রং, রাসায়নিক কীটনাশক, ইথাইলিন ইত্যাদি। এসব ক্যামিকেলের মধ্যে কিছু আছে, যেগুলো কাঁচা ফলকে পাকিয়ে দেয় অল্প সময়ে; কিছু আছে, ফলে স্বাদ বৃদ্ধি করে; কিছু ক্যামিকেল আছে, যেগুলো মাছ, সবজি, ফল এসবের দ্রুত পঁচন রোধে ব্যবহার করা হয়; কিছু আছে খাদ্যের রংকে কৃত্রিমভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে; কোনো কোনো ক্যামিকেল ফসল বা সবজিতে কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়; কিছু ক্যামিকেল আছে প্রিজারভেটিভ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

এসব ক্যামিকেল মানবদেহের অনেক রকম ক্ষতি করে বলে পত্রপত্রিকায় অনেক লেখা ছাপা হয়। ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখের দৈনিক ইনকিলাবে ‘খাদ্যে ভেজালের ক্ষতিকারক প্রভাব’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যা লিখেছেন ডা. লোকমান হেকিম। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের ডা. আহমদ সাইফুল জব্বার বলেন, মেটাল বেইজড ভেজাল খাবারে কিডনি স্বল্পমাত্রা থেকে সম্পূর্ণ বিকল হতে পারে। পরিপাকতন্ত্রে ভেজাল খাবারের জন্য হজমের গন্ডগোল, ডায়ারিয়া এবং বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের এনেসথেশিয়া ডা. মোঃ মিল্লাত-ই-ইব্রাহীম বলেন, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনের জন্য কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে এ খাবারগুলোতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিষক্রিয়া কার্যকর থাকে। যা রান্না করার পরও অটুট থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার ও ফলমূল আকর্ষণীয় করা ও দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য ক্ষতিকর কার্বাইড, ইন্ডাসট্রিয়াল রং, ফরমালিন, প্যারাথিয়ন ব্যবহার করা হয়। এগুলো গ্রহণের ফলে কিডনি, লিভার ফাংশন, অ্যাজমাসহ বিভিন্ন প্রকার জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ভেজাল খাবারের কারণে যে রোগগুলো দ্বারা মানুষ বেশি আক্রান্ত হয় তাহলো অ্যালার্জি, অ্যাজমা, চর্মরোগ, বমি, মাথাব্যথা, খাদ্য বিষক্রিয়া, অরুচি, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনি ফেলিউর, হার্ট অ্যাটাক প্রভৃতি।’


আরও উল্লেখ করা হয়‘পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের ‘বিষাক্ত খাদ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি’ শীর্ষক সেমিনারে বলা হয়, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ।’


নিবন্ধটিতে খাদ্যে ক্ষতিকর ক্যামিকেল মেশানোকে অনেক রোগের জন্য দায়ী করা হয়েছে। মনে হচ্ছে, খাদ্যে ভেজাল মেশানো যখন শুরু হয়নি, তখন মানুষ রোগগুলোতে আক্রান্ত হতো না। হ্যাঁ, খাদ্যে এসব বিষাক্ত ক্যামিকেল মানুষের ক্ষতি করতেই পারে। কিন্তু তাই বলে এমন অসংখ্য শারীরিক সমস্যার জন্য আমরা এখন খাদ্যে ভেজালকে দায়ী করি, খাদ্যে ভেজালের কারণে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হবার বাস্তব প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। ক্যামিকেলযুক্ত কোনো খাবার খেয়ে তাৎক্ষণিক উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, ক্যান্সার এবং ডায়াবেটিস এসব রোগে আক্রান্ত হবার উদাহরণ কেউ দিতে পারবে না। ক্যামিকেলযুক্ত খাবার খেয়ে তাৎক্ষণিক বমি, পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, অজ্ঞান হওয়া, এমনকি মারা যাবার ঘটনাও মাঝে মাঝে আমাদের দেশে ঘটে। যেমন: ১০ জুলাই ২০১৪ তারিখের প্রথম আলোয় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় ‘আম খেয়ে চারজন অসুস্থ’ শিরোনামে। সংবাদে বলা হয়, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় গত মঙ্গলবার রাতে আম খেয়ে তিন ভাইসহ চারজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাতে ভাত খাওয়ার পর আম খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সবার পেটে ব্যথা শুরু হয়। এরপর বমি ও কয়েকবার পায়খানা হয়।

২১ আগস্ট ২০১৩ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘আম খেয়ে একই পরিবারের ৯ জন হাসপাতালে’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ক্যামিকেল মেশানো আম খেয়ে অসুস্থ হয়ে একই পরিবারের শিশু ও মহিলাসহ নয় জন গুরুতর অসুস্থ হয়েছে। পরে তাদেরকে কলাপাড়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদের অধিকাংশই অর্ধচেতন অবস্থায় রয়েছে। ওই পরিবারের সদস্য শিমুল জানান, কলাপাড়া পৌর শহরের সদর রোড এলাকার এক বিক্রেতার কাছ থেকে তার শ্বশুর গত সোমবার আম ক্রয় করেন। রাতে সবাই ওই আম খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। দফায় দফায় বমি ও পায়খানা করতে থাকে সবাই।

১৪ জুলাই ২০১৬ তারিখের দৈনিক যুগান্তরে ‘লাখাইয়ে আম খেতে গিয়ে শিশুর মৃত্যু’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার শিবপুর গ্রামে আম খেতে গিয়ে শারমিন নামে সাড়ে ৩ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সে ওই গ্রামের কৃষক রবিউল ইসলামের মেয়ে। সোমবার বেলা আড়াইটায় এ ঘটনা ঘটে।
তার পরিবার ও এলাকাবাসী থেকে জানা যায়, কৃষক রবিউল ইসলাম রোববার বিকালে কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলার আদমপুর বাজার থেকে এক কেজি ফজলি আম কিনে আনেন। সোমবার দুপুরে তার মেয়ে শারমিন একটি আম খাওয়া শুরু করে। খাওয়ার প্রায় শেষ পর্যায়ে সে ছটফট করতে থাকে। এভাবে প্রায় ২০ মিনিট ছটফট করতে করতেই সে মারা যায়।

এরকম ঘটনা অবশ্যই গুরুতর। অন্তত এরকম ঘটনাগুলো প্রতিহতের জন্য খাদ্যে ভেজাল রোধ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু যেহেতু এরকম ঘটনা ছাড়া খাদ্যে ভেজালের অন্য কোনো ক্ষতির বাস্তব উদাহরণ নেই, তাই সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
কোনো একটা নির্দিষ্ট অপরাধে একজন লোক দোষী প্রমাণিত হলো। সমাজে সংঘটিত অন্য অপরাধগুলোর হোতা খুঁজে না পেয়ে সেগুলোর জন্যও ঐ লোককে কোনো প্রমাণ ছাড়া দায়ী করাটা কি ঠিক হবে? খাদ্যে ক্যামিকেলের জন্য বমি, পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, অজ্ঞান হওয়া, এমনকি ক্যামিকেলের বিষক্রিয়ায় তাৎক্ষণিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটারও প্রমাণ আছে। কিন্তু ক্যামিকেলযুক্ত খাবার খাওয়ার কারণে ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ফাংশন, অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনি ফেইলিউর, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হবার বাস্তব উদাহরণ যখন খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন এসব রোগের জন্যও খাদ্যে ভেজালকে দায়ী করা কখনোই উচিত নয়।

অনেকে বলে থাকেন, বমি, পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, অজ্ঞান হওয়া এসব হচ্ছে ক্যামিকেলযুক্ত খাবার খাওয়ার তাৎক্ষণিক ক্ষতি। আর ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ফাংশন, অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনি ফেইলিউর, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি রোগ হচ্ছে খাদ্যে ভেজালের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি। কিন্তু যারা এসব কথা বলেন, তারা তাদের কথার পক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারবেন? তারা কি বলতে পারবেন, যেসব দেশে আমাদের দেশের মতো খাদ্যে বিষাক্ত ক্যামিকেল মেশানো হয় না, সেসব দেশে কি ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ফাংশন, অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনি ফেইলিউর, হার্ট অ্যাটাক এসব রোগে কেউ আক্রান্ত হয় না? বাংলাদেশে খাদ্যে ক্যামিকেল মেশানো যদি পুরোপুরি রোধ করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ কি ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ফাংশন, অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনি ফেইলিউর, হার্ট অ্যাটাক এসব রোগ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ হয়ে যাবে?
অনেক সাধারণ মানুষকেও প্রায়ই বলতে শুনি, খাদ্যে ভেজালের কারণে আমরা ডায়াবেটিসসহ বিপজ্জনক সব রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। অনুরোধ, মনগড়া মন্তব্য করে কাউকে বিভ্রান্ত করবেন না।

‘‘দীর্ঘজীবন লাভের উপায়’’ শিরোনামে একটি বইয়ের অংশ বিশেষ এই লেখাটি। পুরো বই অনলাইনে পড়তে হলে যেতে হবে এই লিঙ্কে: https://waytogainlonglife.blogspot.com/2019/03/blog-post.html

ধর্ষণ বৃদ্ধির একটি অন্তর্নিহিত কারণ

পত্রপত্রিকায় অহরহ ধর্ষণের সংবাদ আসে। বিচিত্র ধরণের- বিয়ের আগের রাতে কনেকে ধর্ষণ, পাঁচ বছরের শিশু ধর্ষণ, কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণ, কোচিং সেন্টারে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণ, ফেসবুকে প্রেম, অতঃপর ধর্ষণ ইত্যাদি।

তবু আমার মনে হয় আমাদের সমাজে সংঘটিত ধর্ষণের নব্বই ভাগ খবরই প্রকাশিত হয় না, পত্রিকায় আসা দূরে থাক। এর প্রধান কারণ-  ধর্ষিতা বা তার পরিবার মনে করে, বিষয়টা জানাজানি হলে সমাজে মেয়েটি চরমভাবে হেয় হবে এবং তাকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না।

কেন, একটা মেয়ে ধর্ষিত হলে তাকে বিয়ে করতে অসুবিধা কোথায়? তার তো এখানে বিন্দুমাত্র দোষ নেই। তাছাড়া বিয়ের পর স্বামীর সাথে মাত্র একটি রাত কাটানোর পর একটি মেয়ের যে অবস্থা, ধর্ষিতা মেয়েটিরও একই অবস্থা। স্বামীর সাথে একশত রাত কাটানোর পরও একটি মেয়ে যদি 'পুরনো' না হয়, মাত্র একবার অল্প সময়ের জন্য একটি মেয়ে সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় একজনের সাথে থাকার কারণে পুরনো বা পরিত্যক্ত হবে কেন?

ধর্ষিত হওয়া যদি আমাদের সমাজে নিন্দনীয় (সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে) না হতো, তাহলে নরপশুদের হাতে ধর্ষিত হওয়া থেকে এদেশের হাজার হাজার বালিকা-কিশোরী-তরুণী রেহাই পেতো, যারা আমার বা আপনার স্নেহের বোন বা কন্যা।

গোপনে কারো একটি হাত ভেঙ্গে দেয়ার সাহস যেমন কারো হয় না, তেমনি গোপনে কারো চরিত্রে হস্তক্ষেপ করার সাহসও কেউ করতো না যদি হাত ভেঙ্গে দেয়ার মতো ধর্ষণের বিষয়টিও সবাইকে বলে দেয়া যেতো স্বাভাবিকভাবে।

যতদিন ধর্ষিত মেয়েদের প্রতি আমাদের এ ভ্রান্ত ধারণা দূর না হবে, ততদিন সমাজে আমাদের অজান্তে হাজার হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটতেই থাকবে, কিন্তু কেউ মুখ খুলবে না। এমনকি নরপশুরা মেয়েদের এ দুর্বলতা ও অসহায়ত্বেরই সুযোগ গ্রহণ করতেই থাকবে।

এমনও হতে পারে, আপনার আদরের কন্যাও একদিন কোনো নরাধম কর্তৃক ধর্ষিত হতে পারে, কিন্তু আপনার কন্যা আপনার কাছ থেকেও তা লুকিয়ে রাখবে। কারণ এতে আপনার কাছেই সে ছোট হয়ে যাবে!

তাই ধর্ষিত হবার পর ধর্ষিতা নারী যদি তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট জানিয়ে দেয়, তাহলে সমাজে ধর্ষণ দিন দিন কমে যেতে পারে।

পোস্টটি সম্পর্কে আপনার সুচিন্তিত মতামত জানাতে পারেন কমেন্টে।

খুন ও ধর্ষণ বন্ধের একটি কার্যকর উপায়

পৃথিবীতে মানুষের হাতে মানুষ খুনের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। পৃথিবীর শুরু থেকেই মানব সমাজে খুন-হত্যার মতো চূড়ান্ত অনাকাঙ্খিত ঘটনা চলে আসছে। মানুষের কাছে মানুষের পরাজয়ের অন্যতম দিক খুন। আর ধর্ষণের শুরু কখন থেকে, তা সঠিকভাবে বলা না গেলেও মানুষের হাতে মানুষের ইজ্জত লুট হওয়াটা মনুষত্ববোধের চরম পরাজয় ছাড়া কিছু নয়। পৃথিবীর অনেক অনেক দেশে খুন এবং ধর্ষণের সংখ্যা কম হলেও অনেক দেশে খুন এবং ধর্ষণ চলছে ব্যাপকহারে।

পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র যদি খুন ও ধর্ষণ পুরোপুরি বন্ধ করতে আন্তরিকভাবে বদ্ধপরিকর হয়, তাহলে সে রাষ্ট্রের উচিত এরকম একটি আইন করা- ‘‘খুন করলে খুনীকে গ্রেফতারের পর একমাসের মধ্যে যেভাবে সে খুন করেছে, যথাসম্ভব একইভাবে খোলা প্রান্তরে তাকে খুন করা হবে আর ধর্ষককেও গ্রেফতারের পর এক মাসের মধ্যে গ্রেফতার করে খোলা প্রান্তরে পুড়িয়ে মারা হবে’’ এবং আইন কার্যকর করা শুরু করা।

যদি এই আইন প্রবর্তন করে অনতিবিলম্বে কার্যকর করা শুরু করা হয়, আমার বিশ্বাস, পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে সেই রাষ্ট্রে খুন ও ধর্ষণ আগের চেয়ে ৯০ শতাংশ কমে যাবে। এভাবে শুধু ১০ জনকে শাস্তি দেয়া হলে শত শত মানুষ খুন হওয়া থেকে রক্ষা পাবে, হাজারো নারী ধর্ষণ থেকে রক্ষা পাবে, মানুষের জীবন আগের চেয়ে আরো নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ হবে। আমার এটাও মনে হয়, যদি শুধু কোনো এক রাষ্ট্র এরকম আইন করে, অন্য অনেক রাষ্ট্রও এমন আইন করতে পারে।

 জানি না, খুন ও ধর্ষণ বন্ধে পৃথিবীর কোনো দেশে এখনো এরকম কোনো আইন প্রণীত হয়নি কেন বা আদৌ কখনো প্রণীত হবে কিনা!

স্র্রষ্টা বলতে কি সত্যিই কিছু আছে?

আমি যেহেতু ইসলাম ধর্মে জন্মলাভ করেছি, সে সূত্রে ইসলাম-সম্পর্কিত দু’একটা কাহিনী জানি। ইসলামের একজন পন্ডিতের নাম ছিল আবু হানিফা রহ.। তাঁর জীবদ্দশায় একজন নাস্তিক প্রকাশ্যে যেখানে সেখানে প্রচার করতে লাগল, সৃষ্টিকর্তা নামক কিছু নেই। পৃথিবী, মহাবিশ্ব এমনি এমনি (Automatically) সৃষ্ট। এক পর্যায়ে সে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল, যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে, সৃষ্টিকর্তা আছে, তাহলে সে তৎক্ষণাৎ তার অবিশ্বাস ত্যাগ করবে। তার সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন ইমাম আবু হানিফা রহ.। একটি বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল। তারিখ, সময় নির্ধারণ করা হল। লোকজনকে জানানো হল। নির্ধারিত সময়ের আগে কৌতুহলী জনগণ এসে উপস্থিত হল। নাস্তিকও। কিন্তু আবু হানিফার নাম-গন্ধও নেই। অনেকে ভাবতে আরম্ভ করল আবু হানিফা হয়তো রণেভঙ্গ দিয়ে পিছু হটে গেছেন। নাস্তিকও খালি মাঠে গোল দেয়ার আনন্দ অনুভব করতে আরম্ভ করল। অবশেষে দেখা গেল আবু হানিফা আসছেন।

   আসা’র পর নাস্তিক তামাশাচ্ছলে বললেন “আপনি একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি, আপনার কথার ঠিক থাকে না, সময় নির্ধারণ করে সময়মত হাজির হওয়ার চেষ্টা করেন না।” ইমাম সাহেব বললেন, “আগে জিজ্ঞেস করতে পারতেন, পথে কোনো সমস্যা হয়েছিল কিনা, তা জিজ্ঞেস না করেই আমাকে দোষারোপ করছেন কেন?” নাস্তিক একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “পথে কি সত্যি কোনো সমস্যা হয়েছিল?” ইমাম বললেন, “হ্যাঁ, একটা সমস্যা হয়েছিল। আর সেজন্য সময়মত পৌঁছতে পারিনি এখানে। জানতে চাইলে বলতে পারি সমস্যাটা।” নাস্তিক বলল, “বলুন না শুনি।” ইমাম সাহেব বললেন, “আমি রওনা হয়ে কিছুদূর আসার পর দেখি সামনে একটা নদী। কিংকর্তব্যবিমূঢ়তায় আমি অস্থির হয়ে যাই। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি নৌকা পাবার আশায়। কিন্তু কোনো নৌকা সেদিকে আসছিল না।

   অবশেষে দেখি আমার সামনেই নদীর তীরে একটি গাছের চারা উঠল। চারাটি দেখতে না দেখতে বড় হয়ে পূর্ণাঙ্গ গাছে পরিণত হল। এরপর দেখে অবাক হই যে, গাছটি নিজে নিজেই ভেঙ্গে পড়ল। এমনকি ভেঙ্গে এমন মাপের টুকরো টুকরো কাঠে পরিণত হল যেগুলো দিয়ে নৌকা তৈরি হয়। এরপর কাঠগুলো আপনা-আপনি জোড়া লেগে একটি সুন্দর নৌকায় রূপান্তরিত হল। আমি তখন আমার জন্য আশির্বাদ মনে করে নৌকাটি দিয়ে নদী পার হয়ে এখানে আসতে সক্ষম হলাম। নয়তো কী অবস্থা হতো জানি না।”

   নাস্তিক লোকটি ইমাম সাহেবের কাহিনী শুনে বলল, “কী যা-তা বলছেন এসব? আপনি একজন ইমাম হয়ে এমন বানোয়াট গল্প বলতে পারেন?” ইমাম বললেন “বানোয়াট কেন বললেন?” নাস্তিক বলল, “আপনি যে কাহিনী বললেন, এ ধরনের নৌকা তৈরি আপনা আপনি কখনো সম্ভব নয়।” ইমাম সাহেব বললেন, “এ ধরনের কাহিনী আপনা-আপনি কখনো সম্ভব না হলে এ পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, মানুষ, গাছপালা, ফুল-ফল নিয়ে যে সুশৃঙ্খল সুন্দর বিশ্ব-ব্যবস্থাপনা, এ কাহিনী তাহলে আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়েছে বলে আপনার বিশ্বাস হয় কিভাবে?” নাস্তিক হতভম্ব হয়ে গেল ইমাম সাহেবের বাস্তবধর্মী প্রশ্ন শুনে।

   যাহোক যখন ধরেই নিয়েছি মহাবিস্ফোরণ ঘটেছিল, তখন এ ব্যাপারে আপাততঃ কথা আর না বাড়িয়ে চলে যাই মানব জাতির প্রাথমিক দু’সদস্যের আবির্ভাবের আলোচনায়।

    এককোষী প্রাণী, কোটিকোষী প্রাণীর পথ পাড়ি দিয়ে যখন মানবজাতির শুভসূচনা ঘটেছিল, তখন তাদের দু’সদস্য দু’লিঙ্গের হল কেন? উভয় সদস্য একই লিঙ্গের হওয়া স্বাভাবিক ছিল। মানুষের বৈশিষ্ট্য যেমনঃ পঞ্চ-ইন্দ্রীয়, যৌন চাহিদা, বিবেক-বুদ্ধি ইত্যাদি কোত্থেকে সে অর্জন করল? এসবও না হয় সৌভাগ্যবশতঃ তার সঙ্গী হল, কিন্তু মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে পানাহার দরকার, সে পানাহারের ব্যবস্থা তার জন্য কোত্থেকে হল? মহাবিস্ফোরণের ফলে যে পৃথিবীর অভ্যুদয় হল, সে পৃথিবী বসবাস-উপযুক্ত মাটির তৈরি হল কেন? লোহা বা ইস্পাতের তৈরিও হতে পারত পৃথিবী-পৃষ্ঠ। তাছাড়া মাটিতে উৎপন্ন গাছের ফল মাটির মত না হয়ে মিষ্টি, সুস্বাদু খাদ্যে পরিণত হয় কোন্ যুক্তিতে?

    নাক দিয়ে মানুষ ঘ্রাণ নেয় এবং শ্বাসকার্য চালায়। নাকের সাথে সম্পর্ক রেখে ফুলে-ফলে ঘ্রাণ এল কিভাবে? আবার মানুষের ফুসফুস এবং নাকের সাথে সঙ্গতি রেখে অদৃশ্য বায়ুমন্ডল সৃষ্টি হল কোন্ সূত্রে? প্রারম্ভিক মানুষদ্বয় কি নিজের প্রয়োজনেই এসব গড়ে নিল? সম্ভব? শুধু পানি-জাতীয় কোনো কিছু মহাবিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ পৃথিবীতে অস্তিত্বশীল না হলেও মানবজাতির প্রারম্ভিক দু’সদস্যের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে যেত। এ পানি তৈরি হল কিভাবে? মানুষ কি এসব নিজে সৃষ্টি করতে পারে? নাকি অপরিকল্পিত একটি ‘এ্যাটম-বিস্ফোরণ’ থেকে এগুলো তৈরি হওয়া বিশ্বাস করা যায়?

সূর্যটি লাভহীন কেন ঘুরে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত?

  প্রসঙ্গ এলে একটা প্রশ্ন আমি মাঝে মাঝে করে থাকি ছাত্রদেরকে। প্রশ্নটি হল, আমরা যখন কোনো বীজ রোপন করি, তখন তা কখনো কখনো মাটির নিচে চলে যায়। এরপরও তা থেকে চারা উঠে। মাটির নিচে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া বীজটি থেকে চারাগাছটি নিচে, ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পিছনে না গিয়ে উপরের দিকে ঢুঁ মারে কোন্ বুদ্ধিতে? এ প্রশ্নের উত্তর কোনো  ছাত্র কখনো দিতে পারেনি। আমরা অনেকে হয়তো পারি। কিন্তু অনেকের কাছে বিষয়টি বেশ রহস্যময় মনে হবে। মনে হতে পারে বীজের এ ধরনের কোনো জ্ঞান আছে যে, কোন্ দিক উপর। না, বীজের বাস্তবিকপক্ষে এ ধরনের কোনো জ্ঞান নেই। তাহলে সে ঠিকঠাকভাবে উপরে উঠে আসে কিভাবে? এর উত্তর হচ্ছে বীজ যে দিক থেকে তাপ অনুভব করে সেদিকে উঠে আসে, এটা বীজের ধর্ম। এজন্য বেশি নিচে পুঁতে যাওয়া বীজ গজায় না, কারণ সে তাপ অনুভব করতে পারে না।

আরো পড়তে পারেন: ডিম আগে, না মুরগী আগে?- এর উত্তরেই আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়

   এ তাপ কোত্থেকে আসে? সূর্য থেকে। এ সূর্য, তাপের উৎস, নিছক একটি তারকা। রাতের আকাশে আমরা দেখি অসংখ্য-অগণিত তারকা জ্বলজ্বল করছে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে (আকাশে মেঘ না থাকলে) মনে হয় প্রতি রাতেই আকাশে কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে, আর নিয়নসাইনের মত হয়ে তারকাগুলো সে অনুষ্ঠানের শোভা বৃদ্ধি করছে। তারকার এ মিটিমিটি আলো আমাদের মনে যেমন আনন্দ সঞ্চার করে, তেমনি রাতে চলাচল করার ক্ষেত্রেও কাজে আসে অল্প হলেও।

   সূর্য এ তারকাগুলোরই একটি সদস্য। মহাবিস্ফোরণের সময় বাকি সব তারকা রাতে পৃথিবীকে সৌন্দর্যমন্ডিত করার মত দূরত্বে অবস্থান করলো, আর সূর্য তারকাটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবীর নিকটে চলে এল পৃথিবীকে আলো-তাপ দেয়ার জন্য, উদ্ভিদ জন্মানোর জন্য, ফল পাকানোর জন্য, দিন-রাত সৃষ্টি করার জন্য, কোন্ যুক্তিতে? যারা নিজেদের ‘যুক্তিবাদী-যুক্তিবাদী’ দাবি করতে করতে গলা ফাটিয়ে ফেলে, খুবই পুলক অনুভব করে, তাদের কাছে এ প্রশ্নের কী জবাব আছে?

   মানুষের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনে সূর্য, পৃথিবী এগুলো নির্দিষ্ট কক্ষপথে নিয়মিত সুদূর অতীতকাল ধরে আবর্তন করে যাচ্ছে কোন্ লাভে, কোন উদ্দেশ্যে? কখনো এমন ঘটেনি যে, সূর্য তার কক্ষপথ থেকে হারিয়ে গেছে আর পৃথিবীর মানুষ অন্তহীন রাতে হাবুডুবু খেয়ে কান্নাকাটি করছে। কী করার থাকবে তখন বিজ্ঞানী-যুক্তিবাদীদের, সূর্যকে কক্ষপথে ফিরিয়ে আনার জন্য?

   অবাক হই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষের স্রষ্টার নুন খেয়ে গুণ গাওয়া দূরে থাক, স্রষ্টাকে স্বীকার না করার মতো স্পর্ধা দেখে; যেখানে মানুষের চেয়ে নয়, পৃথিবীর চেয়ে লক্ষ লক্ষ গুণ বড় সৃষ্টিগুলো ঐকান্তিকভাবে স্রষ্টার নির্দেশ পালন করে।

মহাবিস্ফোরণের পরিণতি মাটি, বাতাস, পানি....!

   পৃথিবী বড়ই অভাবিত, উপভোগ্য স্থান। রঙ্গিন এক জগত। এতো সুন্দর, মনোরম, কাঙ্খিত একটা কিছু নিছক একটা বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্টি হওয়াটা কল্পনা করা যায়! পৃথিবীর উপরিভাগ তৈরি মাটি দিয়ে। মহাবিস্ফোরণ থেকে অপরিকল্পিতভাবে একটা পৃথিবী ভূমিষ্ট হল, সেটা মাটির না হলেও তো হত। সেটা হতে পারত তামার তৈরি; পাথর, লোহা বা দস্তার তৈরী। কোন্ যুক্তিতে তা এমন পদার্থের তৈরি হল, যা থেকে উদ্ভিদ জন্মে, গাছপালা, ফুল-ফল, শাকসব্জি জন্মে? পৃথিবী মাটির তৈরি না হলে স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা দুরে থাক, নিজের অস্তিত্বের খবরও আমাদের থাকত না।

   ধরে নিলাম, বিগ ব্যাং থেকে পৃথিবী মাটির তৈরি হল অপরিকল্পিতভাবে, কিন্তু সূর্য নামের যে তারকা তাপ দেয়ার ফলে মাটিতে উদ্ভিদ জন্মে, সে তারকাটি যদি অন্য তারকাদের ভীড়েই রয়ে যেত, তাহলে পৃথিবী মাটির তৈরি হয়েও কী লাভ হত? এখন কি ধরে নিতে হবে যে, সূর্যও অপরিকল্পিতভাবে তারকাজগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবীতে তাপ, আলো সরবরাহের জন্য ছুটে এসেছে মহাবিস্ফোরণের পর? ঠিক আছে, ধরে নিলাম। 

   ২২ আগস্ট ২০১০, রাত ১০.০০টা। আজ রাত ইশার নামাযের জন্য মসজিদে গিয়েছি চাঁদের আলোয়, ফিরেও এসেছি চাঁদের আলোয়। আস্তিকতা-নাস্তিকতার জ্ঞানহীন একজন নিরপেক্ষ মানুষ যদি একটু চিন্তা করে যে, যে নির্দিষ্ট নিয়মে চাঁদ আবর্তন করে, আলো দেয়, এ নিয়মে চাঁদ কোন্ বুদ্ধিবলে এল? চাঁদের কি বুদ্ধি বলতে কিছু আছে? চাঁদ কি জড়বস্তু নয়? চাঁদের হ্রাস-বৃদ্ধি, পূর্ণিমা-অমাবস্যা কিন্তু একটি নির্দিষ্ট পঞ্জিকারও কাজ করে। এ চাঁদ কি কোনো অপরিকল্পিত বিস্ফোরণের ফল হতে পারে? ঐ ব্যক্তিকে যদি কেউ বলে, একটি অজ্ঞাত বিস্ফোরণ থেকে এ চাঁদ সৃষ্টি হয়েছে এবং এভাবে নির্ধারিত কক্ষপথে স্থাপিত হয়েছে, তবে সে কি বিষয়টি সমর্থন করতে পারে? মেনে নিলাম চাঁদও অপরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট এবং স্থাপিত।

   এবার পানির কথায় আসা যাক। ভুপৃষ্ঠের চার ভাগের প্রায় তিন ভাগই পানি। পানি ছাড়া জীবন অচল। সে জীবন উদ্ভিদের হোক আর প্রাণীর হোক। ধরে নিলাম বিগ ব্যাং থেকে চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, উদ্ভিদ, পশু, পাখি, মানুষ প্রভৃতি সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ পানি নামক কোনো কিছু সৃষ্টি হয়নি, তাহলে অবস্থা কেমন হত? মানুষের কি উদ্ভব হত পানি ছাড়া? মানুষ সৃষ্টি হলেও কি সে বেঁচে থাকতে পারত? প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উভয় ভাবে মানুষের পানির প্রয়োজন।

   একটি নিছক বিস্ফোরণ থেকে পানির সৃষ্টি, তা-ও পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগই পানি, এমন উদ্ভট গল্প যারা সাজায়, তাদের ‘যুক্তিবাদী’ বলার কোনো সুযোগ থাকে?

   এবার বাতাস নিয়ে একটু আলোচনা করি। বাতাস দেখেছে, এমন গানগল্প কোনো পাগলকেও করতে শোনা যায় না। মাঝে মাঝে চিন্তা করি, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে জীবনধারণ করে যে প্রাণীগুলো, সে প্রাণীগুলোর মধ্যে নাক এবং ফুসফুস কোত্থেকে স্থাপিত হল? আবার শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার জন্য বাতাসের ব্যবস্থা হল কোত্থেকে? ঈশ্বর নামক কোনো কিছুর চিন্তা বাদ দিয়ে যখন বিষয়টি নিয়ে ভাবি, তখন মাথা যেন শুধু ঘোরে, চোখে সব অন্ধকার দেখা যায়। কে দেবে এ প্রশ্নের উত্তর?

   দেখা যায় না যে বাতাস, সে বাতাস যদি মহাবিস্ফোরণের পর সৃষ্টি না হত, তাহলে কেউ কি বলতে পারত, পৃথিবীর উপরিভাগের শূণ্যস্থানে কী একটা যেন নেই, সেটা হল না কেন? নাক আর ফুস্ফুস থাকা সত্ত্বেও মানুষ তার সৃষ্টি হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়ত। অন্যান্য প্রাণীর কথা উল্লেখই বাহুল্য। স্বয়ংক্রিয় এক বিস্ফোরণ থেকে বাতাস নামক এ অদৃশ্য জিনিসটা ঘটনাক্রমে সৃষ্টি না হলে সুন্দর, পরিপাটি এ বিশ্বজগত সৃষ্টি কি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হত না?


লেখাটি ‘‘আল্লাহকে বিশ্বাস করি কেন?’’ নামক একটি বইয়ের অংশবিশেষ। বইটি পুরোপুরি অনলাইনে পড়া যাবে। এই লিঙ্কে যেতে হবে:আল্লাহকে বিশ্বাস করি কেন? (পর্ব-১)